Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পুরোনো কলকাতার গান

পুরোনো কলকাতার গান -- সুধীর চক্রবর্তী

সুধীর চক্রবর্তী

 

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি জগতের এক অভিভাবক সুধীর চক্রবর্তী চলে গেলেন৷ তাঁর বৈদগ্ধ ও কাজের ক্ষেত্র অনেকান্ত। আজ তাঁর প্রয়াণক্ষণে গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার মতোই চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর স্টিম ইঞ্জিন বিভাগের জন্য বেছে নেওয়া হল তাঁরই একটি পুরনো প্রবন্ধের অংশবিশেষ। 'পুরোনো কলকাতার গান' এই গভীর ও ব্যতিক্রমী প্রবন্ধটি সঙ্কলিত হয়েছিল তাঁর লেখা 'বাংলা গানের সন্ধানে' বইটিতে৷ বইখানির প্রথম প্রকাশ ২৫শে বৈশাখ ১৩৯৭। প্রকাশক অরুণা প্রকাশনী। প্রবন্ধটির একটি নির্বাচিত অংশ পুনঃপ্রকাশের মাধ্যমে সুধীর চক্রবর্তীর উজ্জ্বল স্মৃতিকে স্মরণ করলাম আমরা।

পুরনো কলকাতার গানের কথা লিখতে গেলে প্রথমেই বলা দরকার যে তার গঠনে আর তার আয়োজনে গ্রামিক ও নাগরিক এই দু’রকম উপাদানই কার্যকর ছিল। গ্রামিক, কেন না কলকাতা পত্তনের অব্যবহিত আগে এবং সমকালে বাংলার গ্রামজীবন আর গ্রাম্যসংস্কৃতি সমানভাবে বহমান ছিল। হয়তো তাতে একটু ছোঁয়া লেগেছিল ক্ষয়ের বা রূপান্তরের। কেন না চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগে ও পরে ইংরাজ প্রশাসন এমন সব রাজস্বনীতি আর দমননীতি চালু করেছিল যে প্রবহমান রাজন্যতন্ত্র ও জমিদারতন্ত্রে ভাঙন ধরেছিল। ইংরাজদের  অনুগ্রহে গজিয়ে উঠেছিল এক হঠাৎ-জমিদার শ্রেণি। তাদের ঘিরে, তাদের বিত্তের আকর্ষণে দলে দলে গ্রামত্যাগী মানুষ কলকাতায় স্থায়ী আস্তানা পাতে৷ অবশ্য ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের করুণ ও মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষে গ্রামিক জনসংঘ আগে থেকে অনেকটাই বিপন্ন ও বিপর্যস্ত ছিল। এর ফলে বাংলা ও বিহারে এক কোটি মানুষ মারা যায়। ইংরাজ শোষণে বাঙালীর রেশমশিল্পে ও বস্ত্রশিল্পে মন্দা আসে। অন্যদিকে নবগঠিত স্বচ্ছল বাবুসমাজ আর তাদের স্বেচ্ছাচারী বিনোদনের কাজে গ্রাম্য-মানুষ নিযুক্ত হতে থাকে। শহর কলকাতা সেসময় ছিল ব্যবসায়ী, বেনিয়ান, ষ্টিভেডোর, মুৎসুদ্দি আর নানারকম জোগানদারদের নির্বাধ স্বর্গ। তাছাড়া নতুন নগর পত্তনের  কারণে বহুতর প্রয়োজনে নানাবর্গের শ্রমজীবী ক্রমে ক্রমে কলকাতায় স্থায়ী আস্তানা গড়ে নেয়৷ মনে রাখতে হবে এরা সবাই সঙ্গে করে এনেছিল তাদের গ্রামিক সংস্কার ও মূল্যবোধ। এনেছিল শান্ত নিস্তরঙ্গ ভক্তি-নম্র ফেলে আসা দিনযাপনের স্মৃতি। এনেছিল কীর্তন-পাঁচালি-যাত্রা-কথকতার অন্তর্গত দেবতার মানবায়নের সহজ উত্তরাধিকার। বাউল মুর্শিদা গানের অনুষঙ্গে মজ্জাগত গুরুবাদের প্রতি আস্থা ছিল তাদের। আগমনী বিজয়ার গানের উমা ছিল তাদের বিশ্বাস্য জগতের জীবন্ত কন্যার মতো। রাধা কৃষ্ণ আয়ান ও জটিলা-কুটিলার গল্পে ছিল সাংসারিকতার করুণ-মধুর তাপ। নগর কলকাতার গানের সংগঠনে তাই গ্রামীন সংস্কার ও সঙ্গীতধারার সংযোগ ঘটেছিল স্বাভাবিকভাবে। তবে সেইসঙ্গে একথাও স্মরণীয় যে, কলকাতার গানের অগ্রসৃতি সেই অন্তঃশীল গ্রাম্যতা থেকে ক্রমমুক্তির সংকেত। তারই ফলে ক্রমে সেখানকার বিনোদমের সামূহিক গান শেষপর্যন্ত হয়ে ওঠে ব্যক্তিক  উচ্চারণের ও নিবেদনের গান। নবীন কলকাতায় নবোদ্ভূত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ যেমন সাহিত্য আর সমাজমানসে আধুনিকতাকে প্রত্যাসন্ন করে তোলে, তেমনই বাংলার সঙ্গীতের চারিত্র‍্যে এনে দেয় এক আমূল দ্বান্দ্বিকতা। খেউড় কবিগান থেকে নিধুবাবু-শ্রীধর কথকের প্রেমগীতি যেন এক অসামান্য অভিযাত্রা, নিগূঢ় উত্তরণ।

অবশ্য এর আরেকটা দিকও ভেবে দেখবার মতো। কলকাতার প্রথম যুগের দুজন কৃতী কলাবৎ গোপাল উড়ে এবং রূপচাঁদ পক্ষী মূলে ছিলেন উড়িষ্যাবাসী। ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় এসে তাঁদের জীবন অন্য তাৎপর্যে ফলবান হয়ে গেল এবং তাঁরা স্থান পেলেন আবহমান বাংলা গানের বৃত্তে। আবার অন্যদিকে দেখি ১৭৪১ সালে হুগলী-ত্রিবেণীর চাঁপড়া গ্রামে বৈদ্যবংশে যে শিশুটি জন্মায় ১৭৫০ সাল বরাবর গুপ্তিপাড়ার চাটুজ্জ্যে পরিবারে জন্মায় যে শিশু, তারাই কালান্তরে হয়ে ওঠেন নিধুবাবু (রামনিধি গুপ্ত) এবং কালী মির্জা (কালিদাস চট্টোপাধ্যায়), বাংলা গানের প্রথম লিরিক-সম্ভাবনা তো এই যুগল-কিন্নরেরই অতুলনীয় দান। অবশ্য এঁদের দুজনের জীবন গোপাল উড়ে-রূপচাঁদ পক্ষীর একেবারে বিপরীত৷ উড়িষ্যা থেকে জীবিকার টানে বাংলায় এসে প্রথম দুজন বাংলাগানের বৈচিত্র‍্য আর নিধুবাবু  ও কালী মির্জা গেলেন পশ্চিমে এবং আনলেন সেখানকার গানের রূপরীতির অভিনবত্ব। নিধুবাবু পাঞ্জাবী ধাঁচের দ্রুতচালের টপ্পাকে অত্বর ভঙ্গীতে ভেঙে নতুন এক ভঙ্গীর গীতরীতির প্রবর্তন করলেন আর কালী মির্জা লক্ষ্ণৌ ও দিল্লি ঘরানার খেয়াল ও টপখেয়াল আত্মস্থ করে বাংলা গানকে নতুন সৃষ্টিশীলতার দিকে সম্প্রসারিত করলেন। এমনতর নানা দেওয়া-নেওয়ার ইতিহাস লুকিয়ে আছে আঠারো-উনিশ কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা গানের ভাঁজে ভাঁজে।

কলকাতাকেন্দ্রিক কথাটা বিশেষভাবে উঠলো এইজন্য যে এই বিশিষ্ট নগরটির পত্তনের সমসময়ে বৃহত্তর বাংলা ও বাঙালীর বিনোদনের মূল অংশ অর্থাৎ কৃষ্ণযাত্রা, পাঁচালি, কবিগান, ঢপকীর্তন প্রভৃতির এক পা ছিল গ্রামে আরেক পা ছিল কলকাতায়। অনেক ক্ষেত্রে তাই দেখি কৃষ্ণনগর শান্তিপুর কিংবা চুঁচুড়া চন্দননগরে যেসব গানের উদ্ভব হয়েছে, তার বিকাশ এমনকি বিবর্ধন হয়েছে কলকাতার বাবুসমাজের পোষকতায়। আবার আশ্চর্য যে, বেশ পরবর্তীকালের শিক্ষিত রুচিমান শ্রোতাদের প্রয়াসে সেই বিবর্ধমান গীতরীতিও এমনকি একেবারেই পরিত্যক্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে নাগরিক শিষ্ট বোধের চাপ পড়েছে স্থূল গ্রাম্যতার মূলে। এর একটা জলজ্যান্ত নমুনা হলো খেউড় (<খেড়ু) গান। ভারতচন্দ্রের কাব্যে আমরা সর্বপ্রথম শুনতে পাই- ‘নদে শান্তিপুর হৈতে’ খেড়ু আনাবার প্রস্তাবনা। পরবর্তী পর্যায়ে খবর মিলেছে যে, নবমীপূজার দিন মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আর তাঁর সন্তানরা ‘সকার-বকার’ সহযোগে পরস্পরকে খেউড় শোনাতেন। সেটাই ছিল ধর্মকৃত্যের অঙ্গ। এরই ধরনের কলকাতার মহারাজ নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর (১৮৩৩-১৭৫৭) আরও অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তিকে নিয়ে কবিওয়ালাদের গাওয়া খেউড় ও লহর শুনতেন। ‘লহর’ হলো খেউড়ের এক শহুরে সম্প্রসারণ। তার কাজ ছিল ব্যক্তির কুৎসা।

অথচ কালক্রমে এমনতর জনপ্রিয় খেউড় কলকাতার শিষ্ট ও ইংরেজীশিক্ষিত বাঙালীদের অনুমোদন না পেয়ে অবলুপ্ত হয়ে যায়। এতটাই অবলুপ্ত যে তার সুর তাল ও গায়ন পদ্ধতির কোনো দিশাই আজ আর মেলে না। সংগীতের ইতিহাসে সেটা এক গুরুতর ক্ষতি। কেননা খেউড়ের বিষয়বস্তু অশালীন ও ভাষা অশ্লীল হলে তা বর্জিত হয়েছে, কিন্তু তার গায়কী ও স্বর-স্বাতন্ত্র‍্য আমাদের বস্তুগত চর্চা ও সাংগীতিক জিজ্ঞাসার পক্ষে খুব প্রাসঙ্গিক।

আদি কলকাতার গানের আলোচনায় এ আমাদের খুব পরিতাপের বিষয় যে তখন টেপরেকর্ডার তো ছিলই না, এমনকি স্বরলিপি ছিল না। তার ফলে আঠারো-উনিশ শতকের গান আমাদের কাছে আজ শুধুই বানীসর্বস্ব, থিমেটিক। তার বিষয়বস্তু ও শব্দ খতিয়ে দেখে, রুচি আর নীতির পরকলা পরে আজ তার বিচার ও ফাঁসি হচ্ছে। কিন্তু বিচারকবৃন্দ ভুলে যাচ্ছেন যে সে সব গানের একটা স্পন্দমান ও উচ্চকিত জনাদর ছিল। সেই জনাদরের সবচেয়ে বড় কারণ শিল্পীদের পারফরমেন্স। অসামান্য শ্রুতিধর সেইসব কণ্ঠবাদক, অসাধারণ পুরাণজ্ঞ এবং উপস্থিতবুদ্ধিসম্পন্ন তেমন শিল্পী আজ কই?


*বানান অপরিবর্তিত