Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গান্ধিসাগরের গল্প

গান্ধিসাগরের গল্প -- অভি বিশ্বাস

অভি বিশ্বাস

 

ঘরে ফিরে হাত মুখ ধুয়ে সোজা ডাইনিং হলের দিকে হাঁটা দিল অলোক।

নতুন জায়গায় এলে খিদেটা নাকি নিজে থেকেই বেড়ে যায়। সেটা ইতিমধ্যেই বেশ টের পাচ্ছে।

 

আজ অষ্টমী। এই সময় কলকাতায় লক্ষ লক্ষ লোক রাস্তায় নেমে, হোল নাইট কিভাবে ছেলেমানুষি আর খামখেয়ালিপনা করে কাটানো যায় সেইসব প্ল্যান কষছে। অবশ্য বাড়িতে থেকেও লাভ নেই। তার চেয়ে হয়ত রাস্তায় থাকাই ভালো।

সাধারণ শহুরে বাঙালি যেসব জিনিস নিয়ে মেতে থাকে তার কোনওটাই বিশেষ পোষায় না অলোকের। পলিটিক্স, শেয়ার মার্কেট, খেলা, গানবাজনা, নাটক, সিনেমা, পালাপার্বণ, উৎসব— সব বিষয়েই তার নিরাসক্তি। অনেকগুলো মানুষ এক জায়গায় জমায়েত হয়ে হই-হট্টগোল-আলো-আওয়াজ জুড়ে যে জিনিসটা সৃষ্টি করে, সেটা মোটেই উপাদেয় নয় ওর কাছে।

বড্ড বেশি কথা বলে সবাই। জানা কথা রিপিট করে।

তাই অন্য অনেক কিছুই দেখতে বা শুনতে পায় না।

জীবনে অনেক প্রশ্ন আছে, অনেক অজানা আছে। সেগুলোর সন্ধান করা অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং।

যেমন, কাগজের ‘সন্ধান চাই’ কলাম।

অলোকের বরাবরের প্রশ্ন— যে লোকগুলো হারিয়ে গেছে বলে অ্যাড বেরিয়েছে, সেই লোকগুলোকে ফাইনালি পাওয়া গেল কিনা সেটা কি কোনওদিন জানা যায়? কেউ কি জানার কথা ভেবেছে?

এইভাবে কি বহু লোক হঠাৎ করে একদিন হারিয়ে যায়… চিরদিনের মত?

অথবা, কালো রং।

কালো মানে ঠিক কী? কোন রং নেই। মানে কোনও আলো নেই, রাইট?

কিন্তু ঘরে ঢুকে আলোর সুইচটা যদি নিভিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে যেটা তৈরি হয়, সেটা কি কালো? কারণ তার ভেতরেও তো কিছু আলো রয়ে গেছে, কিছুটা দেখা যায়। তাহলে সেটা কালো নয়।

ওর আগের অফিসের সহকর্মী সুদীপ্ত একবার ওকে বলেছিল, কোনও এক ভারতীয় শিল্পী তার কাজে একটা কার্বন-ভিত্তিক পদার্থ ব্যবহার করে যেটা ৯৯.৯% আলো শুষে নেয়। সেই পদার্থ দিয়ে রং করা কিছু কিছু জিনিসের ছবিও দেখিয়েছিল ইন্টারনেটে।

সে এক অদ্ভুত জিনিস। এরকম কোনও কিছু কোনওদিনও দেখেনি অলোক।

ব্যস্ত শিকাগো শহরের মাঝখানে এক অতল গহ্বর। ওই জায়গা থেকে কেউ যেন এক খাবলা অস্তিত্ব সরিয়ে নিয়েছে। জমাট, অনন্ত অন্ধকার। বেশি ঝুঁকলে যেন মনে হয় পড়ে যাবে ওর মধ্যে।

মায়াবী…

অস্বস্তিকর।

 

অলোক বিবাহিত। বউ-মেয়ে-মা কে নিয়ে তার ভরাট সংসার। বাবা মারা গেছেন বছর তিনেক হল। বড় ছেলে, সংসারের প্রধান দায়িত্ব ওরই। অলোকের মা চমৎকার রাঁধেন, রান্নার সুখ্যাতি চেনা পরিচিত সবাই করে। ওর বউও এখন আস্তে আস্তে মা-র কাছে রান্নাটা শিখে নিচ্ছে।

সব মিলিয়ে কলকাতা শহরের পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের মধ্যে একটি পরিচিত, নিটোল মধ্যবিত্ত পরিবার।

কিন্তু ওর চাকরির কপালটা ভালো নয়। কলকাতায় বেশিদিন থাকা হয় না একটানা। মেয়ে উঁচু ক্লাসে পড়ে, তাই বারবার পরিবার নিয়ে স্থান পরিবর্তন করাটা অসুবিধে। মায়েরও বয়েস হচ্ছে।

তাই পরিবার থাকে কলকাতায়, আর অলোক থাকে রাজস্থানের ঝালাওয়ার জেলার ছোট্ট মফস্বল শহর ভাওয়ানি মাণ্ডিতে। ওখানকার সবচেয়ে বড় প্রাইভেট হসপিটালের চিফ অপারেটিং অফিসার।

ভয়ঙ্কর কাজের চাপ। একে ছোট শহরের বড় হাসপাতাল, তার ওপর ওখানে বিনামূল্যে চিকিৎসা সহ অনেক সেবামূলক কাজকর্মও চলে। সব কিছুরই আদ্যন্ত দায়িত্ব অলোকের।

ভাওয়ানি মাণ্ডি জায়গাটা রাজস্থান আর মধ্যপ্রদেশের সীমান্ত অঞ্চলে। ভারতবর্ষের এই জায়গাটায় এখনও জাতপাতের প্রভাব বেশ প্রকট। অলোক যে উচ্চবংশীয় সাবর্ণ, এই ব্যাপারটা ওখানকার মানুষ খুব মেনে চলে। ফলে দায়িত্বও যেমন, সম্মান আর সমাদরও তেমনি।

অলোক থাকে হাসপাতালের কাছের স্টাফ কোয়ার্টারে। বেশ বড় ফ্ল্যাট। কাজের লোকও আছে। ঘর পরিষ্কার, দোকান বাজার, রান্নাবান্না, কাপড় ধোলাই— এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না ওকে।

আর একজন ড্রাইভার আছে, জিতেন। তার কাজ রোজ সকালে ওকে অফিস নিয়ে যাওয়া, আর রাতে নিয়ে আসা। মাঝেমধ্যে টুকটাক বাজার বা ওষুধের দোকানে যাওয়া, ক্বচিৎ কদাচিৎ কোনও সহকর্মীর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করা— এর বাইরে বিশেষ ডিউটি থাকে না তার।

বিবাহিত হয়েও একা থাকতে কোনওদিনই খুব একটা অসুবিধে হয়নি অলোকের। শুরুর দিকে কাজের চাপ এতই বেশি ছিল যে একা থাকার বিষয়টা নিয়ে ভাবারও সময় পায়নি।

আস্তে আস্তে নতুন সময়সূচিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ার পর দিব্যি লাগতে শুরু করেছে জায়গাটা। লোকজনের মধ্যে সারাক্ষণ ব্যস্ততার ভাব নেই, বাতাসে কেমন একটা সোঁদা গন্ধ  গরমকালেও একটা অদ্ভুত ধরনের ছোট কমলালেবু পাওয়া যায়, গুড়ের মত মিষ্টি।

সব মিলিয়ে অফিস ডিউটিটা বাদ দিলে দিব্যি মনোরম পরিবেশ।

বড় শহরের ক্যাকোফোনির থেকে হান্ড্রেড টাইমস বেটার।

“সাহাব, লে যায়েঁ?”

কেয়ারটেকার এসে দাঁড়িয়েছে। খাওয়া শেষের পর বাসনগুলো নিয়ে যাবে কিনা জিজ্ঞাসা করছে।

এমনিতেও রান্না বিশেষ ভালো হয়নি। ছোট্ট করে মাথা নেড়ে উঠে পড়ল। কোণার বেসিনটায় মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। পকেট হাতড়ে লাইটার বের করে একটা গোল্ড ফ্লেক কিংস ধরাল।

জিতেনই প্রথম বলেছিল জায়গাটার কথা।

দশেরার সময়টা এমনিতেই একটু রিল্যাক্সড থাকে। দশেরায় তো ছুটি। আর নবমীটা ও ছুটি নিয়েছে। অষ্টমীর দিন অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের ড্রাইভে চলে এসেছে এই অদ্ভুত জায়গাটায়, জিতেনকে সঙ্গে নিয়ে।

এটা সরকারি জায়গা, যে কেউ বুকিং পায় না। অলোকের যোগাযোগ আছে, জায়গা পেতে অসুবিধা হয়নি।

গান্ধিসাগর।

জায়গাটার নাম।

চমৎকার অক্টাগন প্যাটার্নের মজবুত কাঠের বাংলো। সামনের অফিসঘর বাদ দিলে ছ দিকে ছটা ঘর, আর বাঁদিকে ডাইনিং হল। এই মুহূর্তে ও ছাড়া একজন অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার আর তাঁর স্ত্রী আছেন, ডাইনিং হলের উল্টোদিকের একটা ঘরে। বাকি পাঁচটা ঘর খালি।

আসার সময় টিলার নীচে একটা ছোট জনবসতি পড়ে, সেখানে দুর্গাপুজো হচ্ছিল। কেয়ারটেকার জিজ্ঞেস করেছিল দেখতে যাবে কিনা। আজ আর জাস্ট ইচ্ছে করল না। কাল ভেবে দেখা যাবে।

বাংলোর সামনে একটা পোর্টিকো, যেখান অবধি গাড়ি আসে। আর পেছনদিকে একটা ছোট বাগান মত। বাগানের সীমা শেষ হলেই খাদ। পেছনটা ঘন জঙ্গল, মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে চম্বল নদী। জঙ্গলের ভেতর চিতাবাঘ, বুনো কুকুর, হরিণ… আরও অনেক বন্য প্রাণী আছে।

এসে অবধি পেছনটাই ঘুরে দেখছিল অলোক।

জিতেন বলছিল আশেপাশে অনেক পরিত্যক্ত কেল্লা আছে। সে সব নিয়ে অনেক গল্পও প্রচলিত। এদের এক একটা নশো কি হাজার বছরেরও বেশি পুরনো। তার একটায় সূরযকুণ্ড নামে একটা বিশাল জলের ট্যাঙ্ক আছে। কেল্লার ভেতরে অনেকগুলো সিঁড়ি নীচে নামলে জল পাওয়া যায়। স্থানীয় ভীল আদিবাসীদের কাছে যেটা আজও পবিত্র স্থান।

কাছেই চতুর্ভুজ নামে একটা পাহাড়ি নালা আছে, যার দেওয়ালে নাকি স্টোন এজের পেন্টিং দেখা যায়। আরও একটু দূরে একটা মন্দির আছে, যেটা পঞ্চাশ মিটার লম্বা, কুড়ি মিটার চওড়া আর দশ মিটার উঁচু একটাই পাথর কেটে বানানো। আবার একটা একান্ন বৌদ্ধস্তূপ-ওয়ালা গুহাও আছে।

এই সমস্ত কিছু কাল আর পরশু মিলে দেখতে যাওয়ার প্ল্যান। জিতেনকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে সেইজন্যেই। জিতেন অবশ্য বাংলোতে থাকবে না, বাংলোয় শুধু উচ্চপদস্থ অফিসারদেরই থাকার নিয়ম।

রাত নটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে, সব তুলে তালাবন্ধ করে কেয়ারটেকার নীচের গ্রামে চলে গেল, জিতেনকে সঙ্গে করে।

 

খাওয়ার সময় অন্য অতিথিদের দেখেনি অলোক।

“উও লোগ আজ খানা নেহি লিয়ে?”

“উও আপনে কামরে মে হি লিয়ে থে, সাহাব”, বলেছিল কেয়ারটেকার।

মানে, এখন একটা আধা মফস্বল শহর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে জঙ্গলে ঘেরা একটা টিলার ওপরে ইংরেজ আমলের এই বাংলো বাড়িটায় মাত্র তিনজন লোক।

কেয়ারটেকারের নামটাও জিজ্ঞেস করা হয়নি…  কাল জেনে নেবে।

কাঠের বারান্দায় হালকা চাঁদের আলো এসে পড়েছে। আর কোনও আলো নেই। ডাইনিং হলের আলোও নেভানো। শুধু ওর ঘরেই একটা এলইডি বাল্ব জ্বলছে। সিগারেট শেষ করেও তক্ষুনি ঘরে যেতে ইচ্ছে করছিল না অলোকের।

একটু পেছনের বাগানটা থেকে ঘুরে আসবে? চাঁদের আলোয় নদীটাকে কেমন লাগে…

অবশ্য পোকামাকড়, সাপখোপ থাকতেই পারে। টর্চও নেই।

সঙ্গে করে নিয়ে আসা গল্পের বইটাই পড়বে বলে ঘুরে দাঁড়াতেই চোখ পড়ল ডাইনিং হলের ভেতর। ডাইনিং টেবিলের পাশে একটা আলো জ্বলছে। ভালো করে দেখার জন্যে একটু এগিয়ে এল অলোক। যা দেখল, তাতে অবাক হওয়ার সঙ্গে একটু বিরক্তিও লাগল।

টেবিলের পাশে, একটু দূরে, সোফায় বসে কে একটা মোবাইল ফোন দেখছে। ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে একটা হুড দেওয়া জ্যাকেট গোছের কিছু পরে আছে। চেহারাটা ছোটখাটো, আর কেন জানি মনে হয় ছেলে নয়, মেয়ে।

এটা ওই কর্নেল হতেই পারে না। ওনার স্ত্রী হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। এই অঞ্চলের মহিলারা এই ধরনের শহুরে পোশাক পরে খুব একটা ঘুরে বেড়ায় না।

তাহলে একটাই পড়ে থাকে। নির্ঘাত ব্যাটা কেয়ারটেকার ওর কোনও চেনা লোককে একটা ঘরে থাকতে দিয়েছে, ওপরওয়ালাদের না জানিয়ে।

কাল সকালেই ব্যাপারটার নিষ্পত্তি করতে হবে, এই ভেবে অলোক নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল।

জামা খুলে টাঙিয়ে রেখে আরেকটা গোল্ড ফ্লেক ধরিয়ে বইটা নিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু মনটা খালি চলে যাচ্ছে ডাইনিং হলের দিকে। কী একটা বিষয় নিয়ে মনটা খচ-খচ করছে…

হঠাৎ মনে পড়ল! ডাইনিং হলের ভেতরটা অন্ধকার হওয়া সত্ত্বেও চাঁদের আলো যেটুকু ঢুকছিল, তাতে খুব সামান্য হলেও ভেতরটা দেখা যায়। অথচ, ওই জ্যাকেট পরা ব্যক্তি যে বসেছিল, তাকে ঠিক করে দেখা যাচ্ছিল না। যাচ্ছিল না মানে, অন্ধকারের মধ্যেও যেন দুটো আস্তরণ। একটা আবছা, একটা নিরেট।

ভ্যান্টাব্ল্যাক!

বিদ্দ্যুচ্চমকের মতো নামটা মনে পড়ে গেল। সুদীপ্ত বলেছিল।

ওই ভারতীয় শিল্পীর ব্যবহার করা কালো রংটার নাম।

ডাইনিং হলে বসে থাকা কেয়ারটেকারের দেশওয়ালি ভাই না বোন, সে ওই ৯৯.৯ পারসেন্ট কালো রঙের একটা জ্যাকেট পড়ে আছে।

কিন্তু তাই বা কী করে সম্ভব?

ওই রং ব্যবহারের স্বত্ব কেনা আছে সেই শিল্পীর। ওই রঙের জ্যাকেট বাজারে পাওয়া গেলেও তার যা দাম হবে, তা ওই দেশওয়ালি কেন অলোকের নিজেরও কেনার ক্ষমতা আছে কিনা সন্দেহ।

আর দেশে ওইরকম জামাকাপড় আদৌ পাওয়া যায় কিনা সেটাই তো নিশ্চিত নয়।

এইসব আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে কখন যে ওর চোখের পাতা জড়িয়ে এসেছে, আর কখন ডাইনিং টেবিলটা হাসপাতালের অপারেশান টেবিল হয়ে তার ওপর দাঁড়ানো মহিষাসুর খড়্গ ঘুড়িয়ে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেছে, আর তাই দেখে ওর বউ দামিনী মা দুর্গা হয়ে অস্ত্রোপচারের ছুরি হাতে অসুরটাকে আক্রমণ করেছে, সেই জট ছাড়াতে ছাড়াতে হঠাৎ শোনে কারা যেন দুম দুম করে কিসব পিটিয়ে আওয়াজ করছে, আর চোখ খুলে দেখে সকাল হয়ে গেছে, কেয়ারটেকার বাইরে থেকে ডাকছে, “সাহাব, নাশ্‌তা তইয়ার হ্যায়”…

 

মুখ ধুয়ে বারান্দায় এসে বসল অলোক। মোবাইলের ঘড়িতে সাতটা পনেরো।

“চায়ে য়াহাঁ দে সাকতে হ্যাঁয়?”

কেয়ারটেকার চায়ের সঙ্গে ডাইনিং হলের সোফার সামনে রাখা অ্যাশট্রেটাও নিয়ে এসেছে। অ্যাশট্রে দেখেই মনে পড়ল।

–য়াহাঁ কেয়া অউর কোই হ্যায়?
–অউর কোই বোলে তো? আপ কো ছোড়কে উও সাহাব অউর উনকে বিবি জো হ্যাঁয়…”
–উনকে ইলাওয়া?
–অউর কোই তো নেহি হ্যায় সাহাব… কিউঁ, কেয়া হুয়া?

ডাহা মিথ্যে কথা। পরিষ্কার বুঝতে পারল অলোক। এর সঙ্গে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ওই কর্নেলকেই জিজ্ঞেস করবে বলে মনে মনে ঠিক করল।

–মেরা ড্রাইভার আয়া হ্যায়?
–জী সাহাব, উও ভি নাশ্‌তা কর রাহা হ্যায়…

খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। চা শেষ করে ডাইনিং হলে ঢুকতেই দেখে একজন রাজস্থানি ভদ্রমহিলা ঘোমটা টেনে বেরোচ্ছেন। তার পেছনেই মোটা গোঁফওয়ালা লম্বা এক ভদ্রলোক।

–নমস্তে…
–নমস্তে…
–ম্যায় কাল শাম কো আয়া। আপ লোগ য়াহাঁ কিতনে দিনো কে লিয়ে?
–হাম দো রোজ পেহলে আয়ে থে। কাল দোপাহার তক নিকাল জায়েঙ্গে। নমস্তে।

বয়স্ক দম্পতিটি চলে যাচ্ছিলেন। ঘুরে দাঁড়িয়ে আরেকটা প্রশ্ন করল অলোক।

–এক্সকিউজ মি, অউর এক বাত পুছুঁ?
–কহিয়ে…
–আপ নে য়াহাঁ হাম তিনোঁ কো ছোড়কে কিসি অউর কো দেখা হ্যায়?
–মাত্‌লব্‌ আহৎরাম কো ছোড় কর?

কেয়ারটেকারের নাম তাহলে আহৎরাম।

“জী!”

কর্নেল খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে ভাবতে লাগলেন । ওঁর স্ত্রী অস্ফুট স্বরে কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কর্নেল তাকে একটা দাবড়ানি দিয়ে বললেন, “নেহি, অউর কিসি কো নেহি দেখা।”

বলেই গটগট করে বুটের আওয়াজ তুলে নিজেদের ঘরের দিকে চলে গেলেন।

বোঝা গেল এনারা বিশেষ আলাপী নন।

গায়ে পড়ে আলাপ করতে আসা লোক এমনিতেও অপছন্দ অলোকের। খিদেও পেয়েছে জাঁকিয়ে। আপাতত পরোটা, আচার আর আলুর সব্জির দিকে মনোযোগ দেওয়া যাক।

স্নান সেরে সাড়ে আটটা নাগাদ বেরিয়ে পড়া গেল।

প্রথমেই সূরযকুণ্ড। কেল্লার ওপর চড়ে, তারপর আবার পঞ্চাশ-ষাট ধাপ সিঁড়ি ভেঙে নীচে নেমে কুণ্ডের সবুজ, শেওলা-ধরা জল দেখে বিশেষ ভক্তি টক্তি এল না। দুপুরে খাওয়ার পর চতুর্ভুজ খালের দেওয়ালে ছ হাজার বছর আগেকার প্রস্তরযুগে আঁকা ছবি দেখে মনটা ভরে গেল।

দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে এসেছে। আজ আর মন্দির আর বৌদ্ধ গুহা দেখতে যাওয়া যাবে না। ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। তাই রওনা দিল অলোকরা।

সারাদিনে মাথায় আসেনি, হঠাৎই কাল রাতের ঘটনাটা মনে হওয়াতে নতুন করে একচোট বিরক্তি লাগল।

–জিতেন…
–সার…
–উও আহৎরাম কা জান পেহচান কা কোই বাংলো মে ঠেহরা হ্যায় কেয়া, জানতে হো?
–সার, ম্যায় তো রাত কো নীচে চলা গায়া থা। সুবাহ যাব আয়া, তাব আপ অউর উও মিলিটারিওয়ালে সার কো ছোড়কে অউর কিসি কো তো নেহি দেখা। কুছ প্রবলেম হ্যায় কেয়া সার?
–নেহি, কুছ নেহি…

এই নিয়ে আর বেশি খুঁচিয়ে লাভ নেই। দু দিনের জন্য আসা… একটু ঘুরে বেড়িয়ে, বুক ভরে তাজা হাওয়া নিয়ে, ভালো খাওয়া দাওয়া করে ফেরত চলে যাবে। এইসব ফালতু ঝামেলায় না জড়ানোই ভালো।

কিন্তু মন থেকে খচখচানিটা যাচ্ছে না কিছুতেই।

ফিরে এসে এত ক্লান্ত লাগছিল যে আর খেতে যেতে ইচ্ছে করল না। আহৎরামকে বলে ঘরেই ডিনার আনিয়ে নিল। আর ওকে বলে দিল সব ভালো করে বন্ধ করে তালা লাগিয়ে যেতে।

“হাম তো হর রোজ আচ্ছে সে তালা মার কর হি জাতে হ্যাঁয়…”

খাওয়া হয়ে গেলে এঁটো প্লেটগুলো কোথায় রাখবে জিজ্ঞেস করাতে আহৎরাম বলল দরজার বাইরে রেখে দিতে, ও সকালে এসে নিয়ে নেবে।

–জান্‌ওয়ার তো নেহি আয়েগা, না?
–সাহাব, জান্‌ওয়ার টিলে কে উপার কভি নেহি আতা। উনকো মালুম হ্যায় য়াহাঁ ইন্‌সান ছোড়কে কোই নেহি রেহতা”, বলে মুচকি হেসে চলে গেল।

 

প্লেট নামানোর সময় খুব ইচ্ছে হল উঁকি মেরে দেখার, আজও ডাইনিং হলে বসে সেই দেশওয়ালি লোকটা খাচ্ছে না মোবাইল দেখছে… কিন্তু একরকম জোর করেই ওদিকে না গিয়ে ঘরে ফিরে এল অলোক।

ঝুম্পা লাহিড়ির লেখা বইটার প্রথম গল্পটা কালই শেষ হয়ে গেছিল, আজ দ্বিতীয়টা শুরু করল।

পরকীয়া প্রেমের গল্প। কি আশ্চর্য! একটা বাঙালি লোকের, তাও আবার বিদেশে। গল্পের হিরোইন ঘরের ক্যালেন্ডারে মা কালীর ছবি দেখে ইম্প্রেসড হয়ে লোকটার প্রেমে পড়েছিল।

কালী…

কালো…

অস্বস্তিটা ফিরে এল। মনের মধ্যে একটা অদম্য ইচ্ছা উথলে উঠছে, কিন্তু ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কিছুতেই আজ যাবে না।

সারাদিনের ধকলের পর ভেবেছিল শুয়েই ঘুমিয়ে পড়বে, কিন্তু ঘুম আসছে না…

জোলফ্রেশ টেন-এর পাতাটা হাতে নিয়ে দু-একবার নাড়াচাড়া করে টপ করে খেয়েই নিল একটা।

ও যেটা দেখেছে, ওই কালো ব্যাপারটা, সেটা কি ঠিক? নাকি মনের ভুল? ও কি কালো নিয়ে একটু বেশিই অবসেসড হয়ে পড়ছে না?

পর পর তিনটে সিগারেট খেয়ে ফেলল অলোক। ঘুম আসছে না। আরেকবার বইটা খুলে পড়ার চেষ্টা করল… ধুর, কিছুই ভালো লাগছে না। বেড়াতে এসে একটা ফালতু বিষয় নিয়ে কেন যে ওর মন এমন আনচান করছে, কিছুতেই বুঝতে পারছে না।

আসলে পারছে, কিন্তু মনকে শান্ত করতে পারছে না।

কালোর প্রতি যে ওর দুর্নিবার আকর্ষণ। কালোর যে আলাদা আলাদা মাত্রা হয়। তার প্রত্যেকটার মধ্যে বাস্তবের আলাদা আলাদা অংশ খুঁজে পায় ও। আর সেই পাওয়া, বা না পাওয়ার মধ্যে যে অনির্বচনীয় আনন্দ লুকিয়ে রয়েছে, সেটা কি আর কাউকে বোঝানো সম্ভব?

বুঝতে চাওয়ার মত কি কেউ আছে এই পৃথিবীতে?

রাত সাড়ে তিনটে। কাল আবার সকাল সকাল বেরোনোর কথা। কিন্তু ঘুম যে আসে না…

উঠে জল খেল, খানিকক্ষণ পায়চারি করল, করে আবার শুয়ে পড়ল।

হঠাৎ মনে পড়ল, আরে! আজ তো বিজয়া দশমী। মা-র হাতের নারকেল নাড়ুর কথা ভেবে জিভে জল চলে এল।

মিষ্টির কথাটা মনে আসতেই মনটা হাল্কা হয়ে গেল। কাল সকালে ব্রেকফাস্টের সঙ্গে কি মিষ্টি দেবে ভাবতে ভাবতেই চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে এল…

 

“সার… সার… ঘোষ সার…”

জিতেন। ডাকছে।

চোখ কুঁচকে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে আটটা বেজে গেছে।

“সার… ব্রেক্‌ফাস্ট কর লিজিয়ে… নিকালনা হ্যায়”

খুট করে ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে এল অলোক। মাথাটা প্রচন্ড ধরে আছে।

–সার, উও কেয়ারটেকার ভি তিন-চার দাফা বুলাকে গায়া… আপ নেহি উঠে…
–সুনো, মেরা তবিয়ত আজ কুছ ঠিক নেহি… লাঞ্চ কে বাদ নিকলেঙ্গে। আহৎরাম কো বোলো নাশ্‌তা কামরে মে দে যায়েঁ।
–ওকে সার।

ঘরে এসে দরজা না আটকে আবার বিছানায় এলিয়ে পড়ল। আর শুয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘুম ভাঙল সাড়ে এগারোটায়। উঠতে গিয়ে বুঝতে পারল, জ্বর জ্বর লাগছে। গতকাল ফেরার সময় বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিল, ভারী কিছু সঙ্গে না আনায় আফসোস হচ্ছিল। পাতলা একটা টি–শার্টে আর কতটা আটকায়।

খাবার পড়ে আছে টেবিলে। ইচ্ছেই নেই।

ঢাকা উলটে দেখল, ব্রেড-অমলেট। আবার ঢাকা দিয়ে রেখে দিল।

থার্মোমিটার–ফিটার তো এখানে পাওয়ার কোনও চান্স-ই নেই। প্যারাসিটামল আছে। একটা খেয়ে বাইরে এসে আহৎরামকে হাঁক দিল।

–কফি মিলেগা?
–বানা দেতা হুঁ সাহাব!

চেয়ারটা টেনে এনে বারান্দায় বসে একটা গোল্ড ফ্লেক ধরাল।

পোর্টিকোর নীচে একটা বোলেরো দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে কর্নেলদের গাড়ি। সামনের খয়ের গাছটায় একটা ময়ূর এসে বসেছে। তন্ময় হয়ে সেদিকেই তাকিয়ে ছিল, পেছনে একটা আওয়াজ শুনে ঘুরে দেখে কর্নেলের স্ত্রী একটা চাকাওয়ালা সুটকেস টেনে টেনে নিয়ে আসছেন। সাহায্যের জন্য এগিয়ে যেতেই ভদ্রমহিলা ঘোমটা টেনে বললেন, “ঠিক হ্যায় জী।”

“… আপ সে এক সাওয়াল থা…”

দাঁড়িয়ে পড়লেন মহিলা। ঘোমটাটা একটু সরিয়ে অবাক হয়ে তাকালেন।

“আপ কেয়া য়াহাঁ হাম তিনোঁ কো ছোড়কে কিসি অউর কো দেখেঁ হ্যাঁয়?”

কিছুক্ষন চুপ থেকে খুব নীচু স্বরে বললেন, “পেহলি দিন রাত কো খানে কে বাদ প্লেট ছোড়নে কে লিয়ে ম্যায় ইস তরফ আ রাহি থি। উস সামায় মুঝে লাগা কে মেরে পিছে কোই হ্যায়… ম্যায় জল্‌দি সে ঘুমি, লেকিন ওয়াহাঁ কোই নেহি থা…”

কথাটা শেষ হতে না হতেই সেখানে কর্নেল এসে পড়লেন। ফলে কথা আর এগোল না। তল্পিতল্পা সমেত ওদের নিয়ে গাড়িটা কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের আড়ালে চলে গেল।

কফি শেষ করে সিগারেটটা ক্যারামের স্ট্রাইকারের মত দু-আঙুলের মাঝে রেখে টকাৎ করে ছুড়ে ফেলে ঘরে ঢুকে এল অলোক। এসেই মনে হল জ্বরটা বোধহয় একটু বেড়েছে। শুয়ে থাকবে কিনা একবার ভেবে নিয়েও ডাইনিং হলের দিকে গুটি গুটি পা বাড়াল।

আহৎরামকে বলে দেবে দুপুরে ডাল, আলুসেদ্ধ আর ভাত করতে। আর জিতেনকে বলবে আজ আর বেরোবে না, বিকেলে একবার নীচের গ্রামের পুজোটায় যাবে। বিজয়ার মিষ্টি পাওয়া যেতে পারে।

একটা বাজে।

মনে মনে স্নান কাটিয়ে দিয়ে মোবাইলটা খুলে দেখল। তেইশখানা মেসেজ। দশেরা আর শুভ বিজয়ার। মনে পড়ল, গতকাল বাড়িতে ফোন করা হয়নি। তাড়াতাড়ি ডায়াল করল।

কখন যে আবার ঘুমিয়ে পড়েছে, জানেই না অলোক। উঠে দেখে বাইরে মেঘলা আকাশ, ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। ঘাড় উঁচু করে দেখল, টেবিলে খাবার চাপা দেওয়া আছে… আহৎরাম রেখে গেছে নিশ্চয়ই।

মুখটা তেতো হয়ে আছে, কাল রাতের পর এক কাপ কফি ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয়নি।

ঘড়িতে পৌনে চারটে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও চাট্টি খেতে হবে।

খেতে বসে অলোক টের পেল, তার বেশ খানিকটা খিদে পেয়েছে। ডাল, আলুসেদ্ধ সব ঠান্ডা হয়ে গেছে… তবুও, দিব্যি লাগছে খেতে। দেখতে দেখতে পুরো ভাতটাই খেয়ে ফেলল। জ্বরটাও যেন কমের দিকে।

খেয়ে দেয়ে বেরোবে কিনা ভাবছে, এমন সময় ঝম্‌ ঝম্‌ করে বৃষ্টি নামল।

ধ্যাত্‌!

বেড়াতে এসে একে শরীর খারাপ, তার ওপর বৃষ্টি। এর চেয়ে বাজে আর কিছু হতে পারে?

জিতেনকে কল করল।

–হ্যালো সার, ক্যায়সি তবিয়ত হ্যায় আপ কি?
–ঠিক হুঁ। সুনো, নীচে গাওঁ মে যানে কা মান থা, লেকিন য়ে বারিশ কম হোনে তক রুক্‌না পড়েগা… তুম য়াঁহি রেহনা…
–সার ম্যায় কহিঁ নেহি জা রাহা হুঁ, বারিশ কাম হোতে হি নিকাল পড়েঙ্গে…

অগতির গতি ঝুম্পা লাহিড়ি। পরের গল্পটা শুরু করে বেশ ঢুকে গেল সেটার মধ্যে।

চমৎকার লেখা। পর পর দুটো গল্প পড়ে ফেলার পর খেয়াল হল অন্ধকার হয়ে আসছে। বাইরে বৃষ্টি থামার কোনও লক্ষণই নেই। মেজাজটা একেবারে খিঁচড়ে গেল। মিষ্টিটাও মিস।

আহৎরামকে ডেকে এক কাপ চা করে দিতে বলে প্রশ্ন করল, “রাত কো কেয়া বানায়েঙ্গে?”

–সাহাব আজ রোটি, অড়হর কা দাল অউর ভিন্ডি মাসালা বানা রাহা হুঁ…
–আজ তো দাসেরা হ্যায়… শুভ্‌ কাম্‌নায়েঁ!
–আপ কো ভি সাহাব, বহোত বহোত শুভ্‌ কাম্‌নায়েঁ!

আহৎরাম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নীচু করে।

–অউর কুছ কেহনা হ্যায়?
–উও সাহাব… আজ দশেরা হ্যায় না… ইস লিয়ে…

তাড়াতাড়ি ছুটি চায়।

–ঠিক হ্যায়। খানা ডাইনিং টেবিল পার রাখ কে সব আচ্ছে সে বন্ধ্‌ করকে চলে জানা। অউর মেরা ড্রাইভার কো ভী লে জানা। বিচারা আজ পুরা দিন য়াহাঁ ব্যায়ঠা হ্যায়।
–বহোত আচ্ছা সাহাব!
–ইয়ে, সুনো…
–জী সাহাব…
–তুমহারে পাস কোই টর্চ হ্যায়?

কেয়ারটেকার একটু পরেই টর্চের সঙ্গে এক পিস মোটা মোমবাতিও দিয়ে গেল। এখানে পাওয়ার কাট খুব একটা হয় না, তবু সাবধানের মার নেই।

তাছাড়া, জন্তু-জানোয়ারের প্রতি আহৎরামের যতটা বিশ্বাস, অলোকের ঠিক ততটা নয়।

 

সন্ধে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অলোকের মনে হল জ্বরটা ফিরে এসেছে।

ভাত খাওয়ার পর আরেকটা প্যারাসিটামল খাওয়া উচিত ছিল, এই ভেবে মনে মনে নিজেকে গালি দিয়ে ব্যাগ থেকে বের করে একটা খেয়ে নিল।

আজ বৃষ্টি হলেও ঠান্ডাটা কালকের থেকে কম। বেশ গুমোট হয়ে রয়েছে।

আহৎরাম আর জিতেন চলে গেছে আধ ঘন্টা হল। মোবাইল নিয়ে বেশিক্ষণ সময় কাটানো কোনওদিনই ওর ধাতে নেই, তাও অনেকটা সময় য়ুটিউব ভিডিও দেখে কাটিয়ে ফেলার পর আর কী করবে ভেবে উঠতে পারছিল না।

একবার মনে হল, বাংলোটা পুরো ঘুরে দেখাই তো হয়নি!

যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। টি–শার্টের ওপর আরেকটা জামা চড়িয়ে টর্চ হাতে বেরিয়ে এল বারান্দায়। ডানদিকের বারান্দা ধরে এগোলেই নদীটা দেখা যায়।

ওর ঘরের পর দুটো ঘর তালাবন্ধ, পর্দা টানা। তারপর কর্নেলদের ঘরটা। এটাও তালাবন্ধ, কিন্তু পর্দাটা অর্ধেক টানা, অর্ধেক খোলা। এই ঘরের সামনে থেকেই চম্বল নদী দেখা যায়।

বৃষ্টি থেমে গেছে। জ্যোৎস্নার আলোয় অদ্ভুত সুন্দর লাগছে নদীটাকে।

জঙ্গল অন্ধকার। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যেও কত কিছু দেখা যাচ্ছে। নীচে, একটু দূরে, একটা গাছের ডাল কেঁপে উঠল… একটা পাখি উড়ে গিয়ে পাশের গাছটায় বসল। প্যাঁচা-ট্যাঁচা হবে হয়ত।

তার ঠিক নীচে একঝাঁক জোনাকি জ্বলজ্বল করছে… হঠাৎ মনে হওয়ায় ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখে আকাশ পরিষ্কার, হাজার হাজার জোনাকি তাতে মিট মিট করে জ্বলে আছে।

আরও নীচে, অনেকটা দূরে, একদল শেয়াল নয়তো বুনো কুকুর ডেকে উঠল।

আধুনিক শহুরে সভ্যতার দাপাদাপি থেকে হাজার মাইল দূরে নদী-পাহাড়-জঙ্গল মেশানো ফেলে আসা যুগের একটা জায়গার এই তমসাবৃত সৌন্দর্য ভাষায় বোঝানোর ক্ষমতা নেই ওর। কবি হলে হয়ত লিখে ফেলত দু-একটা কবিতা।

হঠাৎ খেয়াল হল গরম লাগছে। ওপরের জামাটা খুলে ফেলল। গেঞ্জিটা হাল্কা ভিজে গেছে। প্যারাসিটামল কাজ দিচ্ছে।

বাংলোর বাকি অংশটা ঘুরে দেখার জন্য হাঁটা দিল অলোক।

গোটা বারান্দায় কোথাও কোনও আলো নেই। চাঁদের আলোতেই যা আলো হচ্ছে। কর্নেলদের ঘরের পর আবার দুটো ঘর তালাবন্ধ, তারপরেই ডাইনিং হল। তাড়াতাড়ি খেয়ে নেবে, এখানে অসুখ করে পড়ে থাকার জো নেই, কাল সকালেই বেরিয়ে গিয়ে অফিস জয়েন করতে হবে।

কথাটা ভেবেই মুখটা আবার তেতো হয়ে এল।

ডাইনিং হলের কাছাকাছি এসে টের পেল যে ঘরটা অন্ধকার।

কী ইরেস্পন্সিবল রে বাবা কেয়ারটেকারটা! খাবার রেখে গেছিস, আলোটা জ্বালিয়ে রাখবি তো!

ঢুকে আলো জ্বালাবার সুইচ খুঁজতে গিয়েই চোখে পড়ল।

সেই লোকটা। আজও একই জায়গায় বসে আছে। মোবাইলে কিসব দেখছে।

ওর থেকে হাত দশেক দূরেই সোফার ওপর বসে। চাঁদের আলো যেটুকু ঘরে আসছে, তাতে আশ-পাশের জিনিস দিব্যি দেখা যাচ্ছে… অথচ লোকটাকে ঠিক ভালো করে দেখা যাচ্ছে না।

একটা প্রচণ্ড অস্বস্তি হতে শুরু করেছে অলোকের।

হাত বাড়িয়ে হাতড়ে সুইচবোর্ডটা পেয়ে চার বারের চেষ্টায় আলোর সুইচ জ্বালিয়ে দিল। ঘুরে দাঁড়াতেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল।

ঘরে ও একা!

এই তো বসে ছিল লোকটা, স্পষ্ট দেখেছে ও, এরই মধ্যে কোথায় গেল?

ডাইনিং হলে ঢোকা-বেরোনোর একটাই দরজা, আর তার ঠিক সামনেই ও দাঁড়িয়ে। ওকে পেরিয়ে বেরোতে গেলে ও ঠিক টের পেত।

কুল কুল করে ঘাম দিতে শুরু করেছে। গেঞ্জিটা একদম ভিজে গেছে। এটা প্যারাসিটামল নয়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তিন-চার মিনিট কেটে গেছে হয়ত, অলোকের যেন হুঁশই নেই।

একটা অসম্ভব, যুক্তিহীন চিন্তা গ্রাস করছে।

আলোটা একবার নিভিয়ে দেখবে?

অলোকের হাত-পা ঠিক করে কাজ করছে না। কেমন যেন অবশ হয়ে ভেঙে আসছে শরীর।

ডানহাতটা হঠাৎ সম্পূর্ণ অবাধ্যতায় শরীর থেকে আস্তে আস্তে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। সুইচবোর্ডের দিকে।

ওর মন চিৎকার করে বলছে, “না, না, আলোটা নেভাব না!!”…

কিন্তু হাত কথা শুনছে না।

ঠুক।

ঘর আবার অন্ধকার।

আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াল। সমস্ত ইচ্ছাশক্তি যেন অন্য কেউ চালনা করছে।

কালো মূর্তি সোফায় বসে মোবাইল দেখছে।

এইবার ভালো করে দেখল অলোক। নাঃ, কোনও ভুল নেই! শুধু জামা-ই নয়, ভেতরের মানুষটাও ওই নিকষ কালো রং দিয়ে আঁকা। মোবাইল ধরে আছে, সেই আলোরও কোনও প্রতিফলন নেই।

পা দুটো টলে উঠল। খুব বেশি নেশাগ্রস্ত লাগছে নিজেকে।

ওই অদ্ভুত, অসামান্য কালোর ডাক সে যেন নিজের ভেতরে শুনতে পাচ্ছে।

এক পা, এক পা করে এগোতে শুরু করল অলোক।

কালো তাকে টানছে, নিজের দিকে।

শরীরের সমস্ত লোম খাড়া হয়ে আছে, চোখ-মুখ দিয়ে অবিরাম ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে… কিন্তু পা থামছে না।

নীচের জঙ্গলে একপাল শেয়াল ডেকে উঠল।

কালোর মুখোমুখি অলোক। হৃদপিণ্ড প্রায় গলার কাছে উঠে এসেছে।

মোবাইলটা এবার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। শূন্যে ভেসে আছে। একটা গান চলছে, অথচ কোনও শব্দ আসছে না।

নেশায় যেন চুর অলোক। ডান হাতটা আবার অবাধ্যতা শুরু করেছে। ওটা আর ওর নিজের নেই। আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে ওই অমোঘ অন্ধকারের দিকে। ওকে ছুঁয়ে দেখতেই হবে!

হঠাৎ ঘাড়ের কাছে মেরুদণ্ডে একটা প্রচণ্ড ঝটকা… প্রথমে হাতটা, তারপর অবিশ্বাস্য গতি অর্জন করে গোটা শরীরটাই ঢুকে গেল ওই অসীম কালোর মধ্যে।

চু-উ-উ-উ-প।