Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মুখ বন্ধ করো, বাধ্য হও, হাঁটু মুড়ে বসো, তুমি দেশপ্রেমী

শৈলেন সরকার  

 



প্রাবন্ধিক, গল্পকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

৯ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাওসাহেব দানবে মহারাষ্ট্রে বলে দিলেন, দিল্লির কৃষক আন্দোলনের পেছনে চিন ও পাকিস্তানের হাত আছে। এরপর খাদ্য ও রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল বললেন, কৃষক আন্দোলন মাওবাদীরা হাইজ্যাক করে নিয়েছে। কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর বললেন, সমাজবিরোধীরা কৃষকদের সঙ্গে মিশে গিয়ে দিল্লিতে অরাজকতা সৃষ্টি করছে। এরপর কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতিন গড়কড়ি, একই অভিযোগ। কৃষক আন্দোলনে সমাজবিরোধী ও নকশাল। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বেনুগোপাল সুপ্রিম কোর্টকে জানালেন উগ্রপন্থী খালিস্তানিরা কৃষক আন্দোলনে ঢুকে গেছে। এবার আসরে নামল এনআইএ। একেবারে ন্যাশানাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি। সমন পাঠানো হল, জশবীর সিং রোডে, বলবিন্দার পাল সিং, যশবীর সিং, তাজিন্দর সিং, যশবীর সিং, মনু সিং, গুরুচরণ সিং প্রমুখকে। এসএফজি অর্থাৎ শিখ ফর জাস্টিসের বিরুদ্ধে চলতে থাকা এক তদন্তে এদেরকেও সন্দেহভাজনদের তালিকায় আনা হল। মূল অভিযোগটি ছিল পাঞ্জাব ও হরিয়ানার অনেক কৃষক, ব্যবসায়ী, গৃহস্থ মানুষ নাকি বিভিন্ন এনজিও-র মাধ্যমে খালিস্তানপন্থী আন্দোলনে টাকা জোগাচ্ছেন। এবার এই অভিযোগে অভিযুক্তদের মধ্যে এদেরকেও ঢোকানো হল। এবার অভিযুক্তদের মধ্যে আছেন, লেখক, কবি ও পাঞ্জাব ও হরিয়ানার স্থানীয় প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা। আর এরপর চলে এল সেই ঐতিহাসিক ২৬ জানুয়ারির ট্রাক্টর মিছিল ও লালকেল্লায় কৃষকদের পতাকা উত্তোলন ও বিজেপির নেতাদের ছত্রছায়ায় থাকা দীপ সিধু ও লাখা সিধানার কাণ্ড। তারপর শেষমেশ গতকাল গ্রেপ্তার করা হল মনদীপ পুনিয়াকে। মনদীপ একজন স্বাধীন সাংবাদিক, যে পরিচয়টা সরকারের এই মুহূর্তে বেশি শিরঃপীড়ার কারণ। কারণ, মূল ধারার প্রাতিষ্ঠানিক মিডিয়াদের কলাটা মুলোটার লোভ দেখিয়ে বা ভয় দেখিয়ে কাবু করার কৌশল এই সরকারের আয়ত্ত সে আমরা সবাই জানি। এদের মধ্যে এক আধজন সাংবাদিক যদি বেয়াদপি করে, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানকে দিইয়েই তাকে সিধে করার কাজটা প্রাথমিকভাবে সেরে ফেলা যায়। কিন্তু এদের থামানো যাবে কী করে? পুলিশ লেলিয়ে! অগত্যা!

হিটলার মুসোলিনির আদর্শে আরএসএস-এর শিক্ষায় গড়ে ওঠা অমিত শাহ বা মোদি জানেন কীভাবে মিথ্যা বারবার বারবার প্রচারে সত্যে রূপান্তরিত করতে হয়। ঘটনাপরম্পরাগুলি লক্ষ করলে দেখা যাবে কৃষক আন্দোলনকে ভাঙার জন্য কী নিপুণ পরিকল্পনা, কীভাবে ধীরে ধীরে মানুষের মনে কৃষকদের একেবারে দেশবিরোধী বলে দাগিয়ে দেশভক্তের দেশপ্রেমের বন্যা বইয়ে দেওয়া। আর এরা এবার দেশদ্রোহী রবীশকুমারদের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। না, বালাকোট হামলার খবর তিন দিন আগে জেনে ঘুষখোর এক অফিসারের সঙ্গে পাকিস্তানে ভারতের সার্জিকাল স্ট্রাইকের খবর নিয়ে নিভৃত ফোনালাপ করা অর্ণব গোস্বামী নয়, সাংবাদিক রাজদীপ সরদেশাই।

উত্তরপ্রদেশের নয়ডার গৌতম বুদ্ধ নগরের পুলিশ এবার কংগ্রেস নেতা শশী থারুরের সঙ্গে অভিযুক্ত করেছে সাংবাদিক রাজদীপ সরদেশাই, মৃণাল পাণ্ডে, জাফর আগা, অনন্ত নাথ, পরেশ নাথ এবং বিনোদ যোশকে। অভিযোগ সেই ২৬ ডিসেম্বর লালকেল্লা কাণ্ডে কৃষক র‍্যালির রীতিমতো এঁরা তাঁদের সামাজিক মাধ্যমে তাঁদের বিভিন্ন পোস্টের মাধ্যকে হিংসাকে উৎসাহিত করেছেন। অভিযোগকারী জনৈক অর্পিত মিশ্র বলেছেন, এই লোকগুলি তাদের কুৎসা ও ঘৃণ্য প্রচারের সঙ্গে প্রচুর পুলিশের আহত হওয়া, এক প্রতিবাদকারীর মৃত্যু ও লালকেল্লায় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কেউ বলছেন, এ কিছু না, জাস্ট এদেরকে হ্যারাস করার জন্য। এই সব হিটলারের ভাবশিষ্যদের এত সহজে নিলে যে কতটা ভুল হয়, তার প্রমান ভারভারা রাও বা ফাদার স্ট্যান স্বামী। কেউ কি ভেবেছিলেন ৮০ বা ৮৩ বছরের লোকদুটির চশমার ফ্রেম বা গ্লাস থেকে জল টেনে খাওয়ার স্ট্র-ও ১৩০ কোটি মানুষের পৃথিবীর দ্বিতীয় না তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক শক্তি ভারতরাষ্ট্রের পুলিশ জোগাড় করতে পারবে না।

এবার আবার ২৯ ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় দিল্লি ইজরায়েলি দূতাবাসে বোমা বিস্ফোরণ। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা একেবারে দিল্লিতেই ভয়ঙ্করভাবে বিপন্ন। এটাতে দুটো কাজ হল, প্রথমত সেই কবে থেকে যে কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে বিদেশি সম্পর্ক বা মাওবাদী ও খালিস্তানি সম্পর্কের কথা বলা হচ্ছে তা যেন এই ঘটনায় চূড়ান্ত সমর্থন পেল। মানুষকে এবার বলা গেল, দেখলেন তো যা বলছিলাম এত দিন ধরে? হ্যাঁ, আর একটা কাজও হল, অন্তত সাময়িকভাবে হলেও মানুষ ও মিডিয়ার চোখ কৃষক আন্দোলন থেকে সন্ত্রাসীদের দিকে সরে গেল। হ্যাঁ, সেই ২০১৯ ভোটের আগে আগে পুলওয়ামা বা বালাকোট ঘটনার পর এই সরকার যে নিজেদের স্বার্থে এমনকী রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিয়েও খেলতে পারে এই বিশ্বাস মানুষ এতদিনে অর্জন করে ফেলেছে। (সামনেই পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন জেতার জন্য এরা যে চিন-পাকিস্তানের বহিরাক্রমণ বা বাংলাদেশ কি আমাদের এই বাংলাতেই বিভিন্ন এজেন্সিগুলির মাধ্যমে কোথায় কোথায় দাঙ্গার আয়োজন করে রেখেছে কে জানে?) অর্থাৎ এনআইএ-র দ্বারা অভিযুক্তরা আরও কঠিন প্যাঁচে পড়তে যাচ্ছে। সন্ত্রাসীদের দ্বারা দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া বলে কথা। আর কে না জানে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী দলগুলির মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা থাকেই। এই মুহূর্তে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় সন্দেহভাজনদের তালিকায় থাকা ইরানি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে খালিস্তানি যোগ বের করাটা খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়, আর তারপরেই ইতিমধ্যে সমন পাঠানো জশবীর সিং রোডে, বলবিন্দার পাল সিং, তাজিন্দর সিং, মনু সিং, গুরুচরণ সিং প্রমুখের কী অবস্থা হবে তা তো মোদিহত্যার চক্রান্তে অভিযুক্ত ৮০ বছর বয়স্ক তেলেগু কবি ভারভারা রাও বা ভীমা কোরেগাঁও কাণ্ডে মাওবাদী অভিযোগে অভিযুক্ত ৮৩ বছর বয়স্ক ফাদার স্ট্যান স্বামীকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। হ্যাঁ, এই সাংবাদিক রাজদীপ সরদেশাই, মৃণাল পাণ্ডে, জাফর আগা, অনন্ত নাথ, পরেশ নাথ এবং বিনোদ যোশরা সহজে ছাড়া পাবেন ভাবছেন? এরা কেউ সেই হিন্দু মহাসভার (বিপ্লবী?) বীর সাভারকারের গোপনে ব্রিটিশ রাজের কাছে একের পর এক চিঠি লিখে হাতে-পায়ে ধরে ক্ষমা চাওয়ার মতো যদি কিছু না করে, তবে জানবেন এদের একেবারে সাড়ে সর্বনাশ। আর এখনকার কিছু বাঙালি কাঙাল-হ্যাংলাদের মতো দিল্লি ছুট্টে গিয়ে আমিত শাহ কিংবা মোদির পায়ে ধরে শুয়ে পড়তে পারলে রাজ্যসভার মেম্বারশিপ থেকে পদ্মশ্রী পদ্মভূষণ কি না মিলতে পারে। বাকিদের সবক শেখাতে হবে না?

সেই কাশ্মিরে ৩৭০ ধারা রদ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে এই কৃষক আন্দোলন, যখন তখন নীল শার্টের পেছনে বড় বড় করে ইংরেজিতে এনআইএ লেখা গম্ভীর মুখের কেউ দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ছে। নিজেকে হিটলারের আমলের ইহুদি মনে হচ্ছে না? না মনে হয়ে থাকলে কান পাতুন, ভালো করে শুনুন, দরজায় কিন্তু সত্যিই শব্দ হচ্ছে।