উধম সিং ও পাঞ্জাবের হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো

শর্মিষ্ঠা দত্তগুপ্ত

 

 

গবেষক, নারী আন্দোলনের কর্মী, ‘এবং আলাপ’ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক

 

 

 

 

 

একটু আগে দেখলাম আমার এক তরুণ পাঞ্জাবী বন্ধু তাঁর ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করেছেন দিল্লি-হরিয়ানা বর্ডারে কৃষক আন্দোলনের সেদিনকার অর্থাৎ ২৬শে ডিসেম্বরের টাটকা ছবি। কিসান-কিসানিরা সকলে বসে আছেন উধম সিং-এর ছবি দেওয়া পোস্টার হাতে নিয়ে। উধম সিং-কে মনে আছে তো? সেই যিনি ১৯৪০ সালে লন্ডনে গিয়ে স্যার মাইকেল ও’ডায়ারকে গুলি করে জালিয়ানওয়ালা বাগ গণহত্যার প্রতিশোধ নেন এবং সেই অপরাধে যাঁর বিলেতেই ফাঁসি হয় কয়েক মাসের মধ্যে। আজ উধম সিং-এর ১২১তম জন্মদিবস। তাই পাঞ্জাবের কিসান-কিসানিরা স্মরণ করছেন তাঁদের ঘরের ছেলেকে, যেভাবে কলকাতার ছাত্র আন্দোলনে আমরা আজও দেখি ছাত্রছাত্রীদের হাতে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের পোস্টার।

১৯১৯-এর পাঞ্জাবের কুখ্যাত দণ্ডমুণ্ডের কর্তাকে হত্যা করে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ শাসকের চরম অবিচার ও শোষণের বিরদ্ধে উধম সিং প্রতিবাদ করেন। তাঁর প্রতিবাদী সত্তা কৃষকদের মনোবল জোগাচ্ছে, দেখলাম তাঁরা উধম সিং-এর ছবি হাতে স্লোগান দিচ্ছেন, ‘নয়া সাম্রাজ্যবাদীরা দূর হটো, দূর হটো’। উধম সিং-এর প্রতিবাদের অন্য অভিমুখও ছিল। ভগত সিং-এর এই শিষ্যটি জন্মেছিলেন এক দলিত পরিবারে আর পরবর্তীকালে তাঁর নাম পালটে ফেলে হয়েছিলেন রাম মহম্মদ সিং আজাদ। নামের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমান-শিখ পরিচয়ের। কৃষক আন্দোলনের জন্য সেই পরিচয়ও আজ কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আমরা, মানে পাঞ্জাবের বাইরে ভারতবাসীরা, উধম সিং-কে নিয়ে মাথা ঘামাইনি কখনও। অত অতীত-ফতিত নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কোথায়? বর্তমানেই এত সমস্যা, জেরবার হয়ে যাওয়ার জোগাড়। তাছাড়া এই যে একমাস ধরে কৃষকরা টিকরি সীমান্তে প্রতিদিন আন্দোলনে নতুন নতুন মাত্রা যোগ করছেন, তা নিয়ে কলকাতায় বসে আমরা কতটুকু খবর পাচ্ছি এখানকার বাংলা-ইংরেজি দৈনিকে বা টিভিতে? আমাদের জানানো হচ্ছে কতটুকু? কেন্দ্রীয় সরকার, মন্ত্রী-নেতারা কৃষকদের সঙ্গে কতবার বৈঠক করলেন আর কৃষকনেতারা তাঁদের মূল দাবি থেকে সরলেন কি সরলেন না, সেই খবরগুলো অবশ্য আমরা পাচ্ছি রোজ সকালে কাগজ খুলে। কিন্তু সম্পূর্ণ চাপা পড়ে যাচ্ছে কৃষি আইনগুলি প্রত্যাহারের দাবি করতে গিয়ে কীভাবে প্রতিবাদী কিসান-কিসানিরা শান্তিপূর্ণভাবে তুলে ধরছেন এমন কিছু ইস্যু যেগুলো বড় মিডিয়ায় প্রায় অদৃশ্য থেকে যায়।

তা নইলে বলুন কেন আমরা এখানকার কোনও কাগজে দেখলাম না ১৬ই ডিসেম্বর টিকরি সীমান্তের সেই ছবি যেখানে প্রায় ৬০০-৭০০ কৃষক-নারী একটা গোটা দিন পোস্টার হাতে প্রতিবাদে বসলেন খুব দ্রুত বেড়ে-চলা কৃষক আত্মহত্যার প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে? তাঁদের হাতের পোস্টারগুলোয় কী ছবি ছিল জানেন? তাঁদের ছেলে-স্বামী-ভাইদের ছবি যাঁরা গত কয়েক বছরে কৃষি ঋণ না মেটাতে পেরে আত্মহত্যা করেছেন। এক মহিলার হাতে তাঁর স্বামীর ছবি। ২০০৭ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁদের দুটি ছেলের একটিকেও নিজের কাছে রাখতে পারেননি তিনি। একজনকে পুরোপুরি তুলে দিয়েছেন বোনের হাতে আর একজন বড় হচ্ছে তাঁর বাপের বাড়িতে। সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দিনমজুরের কাজ করে এখন পেট চলে তাঁর। কৃষকের স্ত্রী ও সন্তানদের ওপর এই মৃত্যু ও বিচ্ছিন্নতার পরিমাপ নিয়ে আমাদের দেশে কোনও কাজ হচ্ছে কিনা জানা নেই। আর একজন বয়স্কা মহিলা এসেছেন তাঁর নাতির ছবি নিয়ে। পাঁচ বছর আগে তাঁর ১৯ বছরের কলেজপড়ুয়া নাতিটি আত্মহত্যা করে কারণ কৃষিঋণের ভারে ছেলেটিকে আর পড়ানো অসম্ভব হয়ে পড়ে পরিবারের পক্ষে। এ বছর লকডাউনের সময় ঋণের বোঝা বাড়তে থাকার চাপ নিতে না পেরে মৃত্যুকে বেছে নিয়েছেন যে সব চাষী, তাঁদের স্ত্রী/মায়েরাও ছিলেন প্রিয়জনদের ছবি হাতে।

তাঁদের সকলের জোরালো বক্তব্য— একটা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস চালু থাকাও সত্ত্বেও যদি চাষিদের মধ্যে আত্মহত্যা এতখানি বেড়ে গিয়ে থাকে গত কয়েক বছরে, তাহলে নতুন কৃষি আইন বলবৎ হলে এই আত্মহত্যার হার বহুগুণ বেড়ে যাবে। তাঁরা জানতে চান কীভাবে চাষিরা এই ঋণের বোঝা টানবেন যদি সরকার সম্পূর্ণভাবে বাজার খুলে দেন মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের জন্য।

কৃষকদের মঞ্চে প্রিয়জনদের ছবি হাতে কয়েকশো নারীর এই প্রতিবাদী সমাবেশ দেখে আমার চোখের ওপর হঠাৎ ভেসে উঠল ২০১৬ সালে শ্রীনগরের এপিডিপি সংস্থা (Association of Parents of Disappeared Persons) প্রকাশিত একটি ক্যালেন্ডারের ছবি। সেই ক্যালেন্ডারে বারোমাসের বারোটি পাতায় ছবি ও নাম ছিল নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া বারোজন কাশ্মিরি যুবকের। অনেক চেষ্টা করেও পুলিশ ও প্রশাসনের কাছ থেকে যাঁদের খোঁজ পাননি তাঁদের পরিবার। রাষ্ট্র যাঁদের হারিয়ে যেতে দিয়েছে, সেরকম বহু মানুষ অদৃশ্য হয়ে গেছেন কাশ্মির নিয়ে সর্বভারতীয় আলোচনায়, বেশিরভাগ গণমাধ্যম ও প্রচারমাধ্যমে। তাঁদের হারিয়ে যেতে দেননি মূলত তাঁদের মায়েরা। এপিডিপি-র প্রতিষ্ঠাত্রী তেমনই একজন মা পারভিনা আহানগার, যাঁর ১৭ বছরের ছেলে জাভেদ ১৯৯০ সাল থেকে নিখোঁজ। প্রতি মাসের দশ তারিখে এপিডিপি-র সদস্যরা তাঁদের প্রিয়জনদের ছবি হাতে মিলিত হন শ্রীনগরের রাস্তায়— রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দিতে যে আজও তাঁরা জবাব চাইছেন। সেসব খবর আমরা অবশ্য খুব কম পাই। দেশের এক প্রান্তের খবর এই তথ্য বিস্ফোরণের যুগেও অনেকাংশে ব্লক করে রাখা হয় অন্য প্রান্ত থেকে।

এই হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর পরিবারের দুর্ভোগ ও যন্ত্রণা, এবং গত তিন দশকে কাশ্মিরের মানুষের হতাশা-বেদনা-অবসাদ চাপা পড়ে যায় ক্যালেন্ডার ও পোস্টারে আপেল-কুড়োনো কাশ্মিরি মেয়েদের বা মনোরম ডাল লেকে ট্যুরিস্টদের শিকারা-বিহারের ছবির তলায়। মেয়েদের উদ্যোগে এপিডিপি-র ক্যালেন্ডার বা রোলি মুখার্জির মতো বরোদাবাসী শিল্পীর আঁকা কাশ্মির সিরিজের অনেকগুলো কাজ়ে ধরা দেয় কাশ্মিরি মানুষের যন্ত্রণা ও বিষাদ। এভাবে আমরা অশ্রুত কন্ঠস্বরগুলো শুনে একই সময়ের নানা ইতিহাসকে বুঝতে চেষ্টা করতে পারি।

দিল্লি-হরিয়ানা বর্ডারে আত্মহননকারী পুরুষদের ছবি হাতে কৃষক নারীদের দেখেও বারবার মনে হয় সবুজ বিপ্লবের গরিমায় উজ্জ্বল পাঞ্জাবি কৃষকের যে শক্তসমর্থ, আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর, হাস্যোজ্বল ছবিটা আমাদের দেখানো হয়েছে অনেকদিন অবধি, তার মধ্যে কতটা ফাঁকি। ইদানিংকালে ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’র বিজ্ঞাপন সুকৌশলে আড়াল করেছে পাঞ্জাবের বহু কৃষিজীবী পরিবারের বুকের গভীর ক্ষত। যে ব্যথা-যন্ত্রণার আখ্যান ফ্রেমের বাইরে থেকে গেছে অনেকাংশে, তিনটি নতুন কৃষি আইনের মতো কালা কানুন বাতিলের দাবিতে আজকের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন আমাদের সামনে সুযোগ এনে দিয়েছে সেই আখ্যানগুলো মন দিয়ে শোনার। রাষ্ট্র যেই কিসানদের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে নির্বিকার, কিসানিদের আখ্যানগুলো ফ্রেমবন্দি করে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে দিয়ে হয়তো আমরা প্রতিরোধ করতে পারি তাঁদের অদৃশ্যায়ন।


*লেখার ভেতরের ছবি: গুরপাল সিং গুরি

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...