Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিয়ের রং রামধনু

বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়

 


এলজিবিটিকিউ আন্দোলনের কর্মী, সমাজকর্মী

 

 

 

দিল্লি হাইকোর্টের ক্রমাগত তাগাদায় তড়িঘড়ি কেন্দ্রীয় সরকার এমন একটা হলফনামা জমা করেছে যে তা নিয়ে রাগ করবে না হেসে কুটোপুটি যাবে তাই ঠিক করে উঠতে পারছেন না এলজিবিটি আন্দোলন কর্মীরা!

বর্তমান সরকারের কাছাকাছি থাকা এলজিবিটি নেতৃত্বের একাংশ অস্বস্তিতে পুরো চব্বিশ ঘন্টা নিশ্চুপ থেকে পরে বলেছেন, ‘এটা আদালতের রায় নয়। কাজেই আরও দেখে পরে মন্তব্য করব।’ বলেছেন, বা বলতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছেন, ‘এই হলফনামা পিতৃতন্ত্রের বস্তাপচা মালমশলায় ভর্তি। ধোপে টিকবে না। এটি নিয়ে কথা বলা নিরর্থক।’ আসলে শ্যাম রাখি না কুল রাখি দশা!

দিল্লি হাইকোর্টে, বেশ কিছু মাস ধরে কয়েকজন সমলিঙ্গের দম্পতি তাঁদের বিবাহের আইনি স্বীকৃতি চেয়ে আবেদন করে অপেক্ষায় রয়েছেন।

তাঁদের বক্তব্য ৩৭৭ ধারা রদ করে যে রায় সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দিয়েছেন সেখানে বিগত বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রায়ের উল্লেখ আছে। তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতির রায়, ব্যক্তিগত গোপনীয়তাকে সংবিধানের মৌলিক অধিকার হিসাবে মেনে নেওয়ার রায়, এইগুলির উপরে ভর করে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ সর্বসম্মতিক্রমে জানিয়ে দেন ভারতের এলজিবিটি জনগোষ্ঠীকে তাঁদের লিঙ্গপরিচয় বা যৌনতার ভিত্তিতে শতকের পর শতক ধরে যে অপরাধীর তকমা বহন করতে হয়েছে, তার জন্য এই সাংবিধানিক বেঞ্চ ক্ষমাপ্রার্থী!

তো এহেন শক্তিশালী রায়ের পর স্বাভাবিকভাবেই বহু নাগরিক সমাজের একঘরে করার খোপ থেকে বেরিয়ে মানুষের মতো, নাগরিকদের মতো জীবন যাপন করতে শুরু করেছেন। পারিবারিক, সামাজিক আড়ষ্টতা ভেঙে মাথা উঁচিয়ে যুগলে ঘর করতেও শুরু করেছেন।

কিন্তু মুশকিল হয়েছে যে, ৩৭৭ ধারার বিলুপ্তি এলজিবিটি নাগরিকদের অস্তিত্বের কেবল স্বীকৃতি দিয়েছে। আসল অধিকারের লড়াইয়ের এ শুরু মাত্র।

এই মুহূর্তে, দেশে বিয়ের যে আইনকানুনগুলি আছে, তা সে ধর্ম মতে হোক বা স্পেশাল ম্যারেজ আইন মতেই হোক, সবেতেই নারী-পুরুষের বিয়ের কথা বলা আছে।

এবার তাহলে নাগরিক অস্তিত্বের স্বীকৃতি কোর্ট দিলেও বর্তমান আইনে একই লিঙ্গের দুইজন নাগরিকের বিবাহ কীভাবে হবে? আর যদি না হয় তাহলে ভারতের সংবিধান যে বলেছে আইনের চোখে ভারতের সব নাগরিক সমান, তার কী হবে?

বিষমলিঙ্গের দম্পতিদের মতো সমলিঙ্গের দম্পতিদের বিবাহের অধিকার, সন্তানপালনের অধিকার, একের সম্পত্তিতে জীবনসঙ্গী/সঙ্গিনীর অধিকার— এইসবের কী হবে? একই দেশের নাগরিক হয়ে, একই ভোটাধিকার নিয়ে, একইভাবে করদাতা হয়ে, একই যাত্রায় পৃথক ফল কীভাবে হয়? এতে কি সংবিধানের মৌলিক অধিকারকেই অমান্য করা হল না?

এই নিয়েই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন সমলিঙ্গের দম্পতিরা।

তো এই পিটিশন পেয়ে আগে হাইকোর্ট সরকারের কাছেই জানতে চেয়েছে, নোটিস দিয়ে যে তাঁদের কী মত?

সরকারের এবার সেই শ্যাম রাখি না কুল রাখি দশা!

কারণ বর্তমান সরকারে যে রাজনৈতিক গোষ্ঠী রয়েছেন জীবনের অনেক বিষয়েই তাঁদের ধারণা বেশ একটু পুরনোপন্থী। এবং সেটার জন্য তাঁরা বেশ গর্বিতও।

তাঁদের প্রকাশিত ২০২১ সালে ‘ভারতের রোড ম্যাপ’ নামে বই-এ তাঁরা গুছিয়ে বলেছেন সমলিঙ্গের বিবাহ ভারতের সনাতনী যে পরিবারপ্রথা আছে তাকে নষ্ট করে দেশকে উচ্ছন্নে পাঠাবে। কাজেই কোনও মতেই তাঁরা এইসব ম্লেচ্ছ ব্যপারস্যাপার মানবেন না।

এখন মুশকিল হল রাজনৈতিক বা সামাজিক গোষ্ঠী অনেক কিছুই বলে পার পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু সরকারের কোর্টে দেওয়া হলফনামা তো আর আজগুবি গপ্পের উপর দাঁড়াতে পারে না! তাকে তো আইনকানুন, সংবিধান, গণমাধ্যম এবং সর্বোপরি জনগণের সকল অংশের কথা মাথায় রেখেই কাজ করতে হবে। এ তো আর ‘মোটা লোকের সরকার রোগা লোকের কথা বলবে না’ এমন হতে পারে না। অন্তত যদ্দিন গণতন্ত্র নামে ব্যাপারটা রয়েছে!

এহেন চাপে, সরকার যে হলফনামা দাখিল করেছে তাতে একেবারে শিব ঠাকুরের আপন দেশের কায়দাকানুনকে মান্যতা দিতে গিয়ে একেবারে নাকের জলে চোখের জলে অবস্থা।

হলফনামার বক্তব্যকে বিন্দুতে ভাঙলে তলার কয়েকটি বিষয় বেরিয়ে আসে:

১) ভারতীয় বিয়ের আদর্শ হচ্ছে একজন জন্মগত নারী এবং একজন জন্মগত পুরুষের মধ্যে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় মিলন যার মধ্য দিয়ে সন্তান উৎপাদন হয়।
২) একসঙ্গে দীর্ঘদিন থাকা বা লিভইন ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে খাপ খায় না। তাই তাকে বিয়ের মর্যাদা দেওয়া যায় না।
৩) ভারতের বিয়ের আইনগুলি ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের দীর্ঘকালের আচারবিচারের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তাতে কোনও পরিবর্তন করলে সমাজে হুলুস্থুল পড়ে যাবে।
৪) আইন তৈরি সংসদ বা আইনসভার কাজ। কাজেই এতে যেন কোনওভাবে বিচারবিভাগ নাক না গলায়।
৫) বিয়ের অধিকার কোনওমতেই মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না।

একেই বলে, কেঁচো খুঁড়তে কেউটে!

ছিল সমলিঙ্গের দম্পতিদের নাগরিক অধিকারের লড়াই। এহেন হলফনামা ব্যাপারটাকে এবার প্রায় সকল ভারতবাসীর লড়াই বানিয়ে ফেলল!

এই হলফনামা মানলে,

১) লিভইন বিয়ের মর্যাদা পায় না। অথচ আগেই গুরুত্বপূর্ণ সব রায়ে সুপ্রিম কোর্টই লিভইন-কে বিয়ের মর্যাদা দিয়ে রেখেছেন।
২) যে দম্পতিরা বাচ্চা উৎপাদন না করে দত্তক নেন, তাঁরা ভারতীয় মানদণ্ডে বিয়ের মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী নন। কিন্তু আইনে এমন কোনও বাধাই নেই।
৩) অনেক রূপান্তরকামী দম্পতিরা ইতোমধ্যেই ছেলে বা মেয়ে হিসেবে, পরিচয়পত্রে পরিবর্তনের নিরিখে আইনি বিবাহ করে নিয়েছেন। সেগুলিও নাকচ হয়ে যায়!
৪) গার্হস্থ্য হিংসার ক্ষেত্রে সরকারের তৈরি আইনেই নারীদের কোনও পুরুষের সঙ্গে দীর্ঘদিন বাস করলে (লিভইন) সেই নারীর উপর যে কোনও প্রকার হিংসাকেই গার্হস্থ্য হিংসা হিসেবে ধরতে হবে বলে সরকারের আইনেই বলা আছে। সেটিও ভেস্তে যায়।

ফলে ছিল সমস্যা এক প্রান্তের। হলফনামা তাকে নিয়ে একেবারে কেন্দ্রে এনে দিল!

দিল্লি হাইকোর্টের পিটিশনরদের মধ্যে আছেন এক আইনজীবী মহিলা দম্পতি। অনুরাধা কাটজু আর মানেকা  গুরুস্বামী। সুপ্রিম কোর্টের দুঁদে আইনজীবী। এঁরাই ২০১৮ সালে ৩৭৭ বিরোধী পিটিশনেও ছিলেন। এমনকি নিজেরাই কোর্টের সামনে নিজেদের দাম্পত্য জীবনের কথা মেলে ধরে এই ঔপনিবেশিক আইনের বিলুপ্তি চান।

ওঁদের সাহসিকতার জন্য টাইমস পত্রিকার প্রচ্ছদেও ওঁরা স্থান করে নেন।

এঁরা এহেন হলফনামা পেয়েই দ্রুত পরের তারিখের জন্য চেপে ধরেন কোর্টকে। এবারই তো শুরু হবে আবেদনকারীদের বক্তব্য শোনা!

ওঁদেরকে নিরস্ত করতে সরকারপক্ষ বলেও বসেন ‘আহা! এত তাড়া কিসের। এ আর কী এত জরুরি বিষয়?’ প্রায় যেন অনুরোধের সুর, ‘একটু ধীরে গেলে হয় না?’

আজ্ঞে না!

‘মিঞা-বিবি রাজী, তো ক্যায়া করেগা নাজি!’

আগামী শুনানি এপ্রিলের ২০ তারিখে!

বিয়ের রং কি আর একরঙা তুলিতে বুলিয়ে দিলেই হবে?

কাজেই প্রতিবাদ তো হবেই। কোর্টের ভেতরে, বাইরে, রাজনীতির মাঠে, সর্বত্রই হবে।

একরঙা বিয়ের রংকে রামধনুমাখা করতেই হবে তো!