Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দিশা রবিদের তারুণ্যকে ভয় পাচ্ছে রাষ্ট্র

পাঞ্চালী কর

 


নাট্য ও রাজনৈতিক কর্মী

 

 

 

হয়তো গলদটা গোড়াতেই থেকে গিয়েছে বা গোলমালটা হয়েই আসছে, তাই বারবার একইরকম সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে মানুষকে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের শিখিয়েছে যে দেশ, এবং দেশের সঙ্গে যুক্ত যাবতীয় চিহ্নকে সর্বোচ্চ স্তরে বসানো আমাদের আশু কর্তব্য। এই ব্যবস্থায় যা বাদের খাতায় চলে যায় তা হল এই দেশের মানুষ, আমাদের সহনাগরিকরা। তাই দেশের মানুষের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য গ্রেফতার হতে হয় সাফুরা জরগার, নোদীপ কৌর এবং দিশা রবি-র মত মানুষদের। তাই ভারাভারা রাও, স্ট্যান স্বামী, সোমা সেনের মত মানবাধিকার কর্মীদের ইউএপিএ দিয়ে বছরের পর বছর জেলবন্দি করে রাখা হয়, তাই মরতে হয় দাভোলকর, গৌরী লঙ্কেশদের। তাই দিল্লি গণহত্যার সময় মানুষকে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলতে ফেলতে তাকে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করা হয়, তার দেশভক্তির প্রমাণস্বরূপ। তাই কাশ্মির ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ, কিন্তু কাশ্মিরি মানুষ, যাঁরা স্বাধীনতার পর থেকে ভারত রাষ্ট্রের কাছে বৈষম্য ছাড়া কিছুই পাননি, তাঁরা নিজেদের অধিকারের কথা বললে তারা পাকিস্তানি। এই বিভেদের রাজনীতি আমাদের মজ্জাগত, এবং গত কিছু বছর ধরে হিন্দুত্ববাদী ফ্যাসিবাদ কায়েম হওয়ার ফলে বিভেদের রাজনীতিই দেশজুড়ে মূল রাজনীতিতে উত্তীর্ণ হয়েছে। তাই মানুষ নিজেদের সাংবিধানিক অধিকার চাইলেও তাকে দেশদ্রোহী বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

গত নভেম্বর মাস থেকে পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও দিল্লির সীমান্ত বরাবর কৃষক আন্দোলন চলছে। উত্তর ভারতের লাখো কৃষক এবং সাধারণ মানুষ কৃষি আইনের বিরোধিতায় রাস্তা অবরোধ করে অবস্থান বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন অনির্দিষ্টকালের জন্য। তাঁদের দাবি কৃষি আইন সম্পূর্ণ মুকুব না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা এই আন্দোলন চালিয়ে যাবেন কারণ কৃষি আইন কার্যকর হলে সম্পূর্ণ কৃষিব্যবস্থা চলে যাবে পুঁজিপতি কর্পোরেটের হাতে। এর ফলে কৃষকরা ভয়াবহ ক্ষতির মুখোমুখি হবেন কারণ তাঁরা এমএসপি বা ন্যূনতম বিক্রয় মূল্যের অধিকার হারাবেন। এর সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যশস্যের দাম চলে যাবে সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

এই আন্দোলন ইতিহাসে বেশ কিছু মাইলফলক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে এই আন্দোলনের খবর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যায় যখন প্রখ্যাত আর্টিস্ট রিহানা এবং প্রখ্যাত পরিবেশবিদ গ্রেটা থুনবার্গ এই খবর টুইটের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দেন। সারা পৃথিবী যখন ভারত সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে মুখর তখন সরকারের পেটোয়া সেলিব্রিটিরা সোশ্যল মিডিয়ায় এই খবরকে অপপ্রচার বলে দাবি করেন এবং লেখেন যে এই সমস্যা ভারতের অভ্যন্তরীণ এবং বিদেশিদের হস্তক্ষেপে ভারতের সার্বভৌমতা নষ্ট হচ্ছে।

দিশা রবি একজন ২২ বছর বয়সী পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী যাকে গ্রেটা থুনবার্গের কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে প্রস্তাবিত টুলকিটের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য গ্রেফতার করা হয়, এবং ১২৪এ, ১৫৩এ এবং ১২০বি ধারায়, যথাক্রমে দেশদ্রোহিতা, দেশের মধ্যে অস্থির, অনিয়ন্ত্রিত বাতাবরণ সৃষ্টি করা, এবং বেআইনি কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে মামলা রুজু করা হয়। দাবি করা হয় যে দিশা পৃথিবীর সামনে ভারতের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করছেন। এই টুলকিট পোয়েটিক জাস্টিস ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থা তৈরি করেছে। ২৬ জানুয়ারির ট্র্যাক্টর র‍্যালির সময় মিছিলের একাংশ লালকেল্লায় নিশান সাহিব পতাকা ওড়ান এবং এই ঘটনায় কিছু বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, সেই ঘটনা ওই উক্ত টুলকিটের সাহায্যেই করা হয়েছে বলে দাবি করা হয়, এবং দিশা সেই টুলকিটে কিছু পরিবর্তন করার দায়ে ২৬ তারিখের ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করা হয়। যদিও সেইদিনের আন্দোলনরত কৃষকদের সঙ্গে দিশার কোনও ধরনের আলাপ, আলোচনার প্রমাণ পাওয়া যায় না। অভিযোগে আরও বলা হয় যে দিশা বিদেশি মানুষের থেকে আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন চেয়েছেন, কিন্তু দিশা তা চাইলেও সেটা কি কোনওভাবেই অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে? যে দেশদ্রোহী ও খালিস্তানি তকমা দিশার ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন। দিশা রবি-র বিরুদ্ধে আনা একগাদা হঠকারী অভিযোগের ভিত্তিতে যথেষ্ট প্রমাণ না থাকার ফলে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে দিশা তিহার জেল থেকে জামিনে মুক্ত হন। তার বিরুদ্ধে কোনও চক্রান্তের বা নিষিদ্ধ সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

দিশা ছাড়া পেয়ে যান, কিন্তু এই ঘটনা কিছু দীর্ঘমেয়াদি প্রশ্নের মুখে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। সেই প্রশ্নের মধ্যে মূল হল দেশদ্রোহিতা অপরাধকে ১২৪-এ ধারায় যেভাবে দেখা হয় তার সাংবিধানিক বৈধতা। যেখানে সংবিধান আমাদের ভিন্নমত পোষণ করার অধিকার দেয়, সেখানে সরকারের নীতির বিরোধিতা কী করে রাষ্ট্রদ্রোহর পরিচয় হতে পারে? এর আগেও আমরা দেখেছি যে সরকারের জনবিরোধী অবস্থানের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে কানহাইয়া কুমার, উমর খালিদ, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, শার্জিল ইমাম, অসীম ত্রিবেদী, বিনায়ক সেনের মত মানুষদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা করা হয়। ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা এই আইন দেশ এবং সরকারের মধ্যে ফারাক করতে বরাবর অসফল থেকেছে।

দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে বড় প্রশ্ন মহিলাদের অধিকার এবং এজেন্সি বা কর্তৃত্বের সাপেক্ষে, এবং আমাদের সমাজ ও সরকারের নিরিখে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে? বিজেপি সরকারের আইটি সেলে নিযুক্ত মানুষের মূল কাজের মধ্যে রয়েছে ভিন্নমত পোষণ করা মানুষের ওপর নজরদারি এবং মহিলাদের চরিত্রহনন। দিল্লি গণহত্যা হোক বা পুলওয়ামার বিস্ফোরণ, সরকারের সমালোচনা করলেই এক দল মানুষ ধেয়ে আসে কুৎসিত এবং ভিত্তিহীন ব্যক্তিআক্রমণ নিয়ে। দিশার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা ঘটেনি। কোনও একটি সংবাদমাধ্যম ভুল তথ্য দেয় যে দিশা একজন সিঙ্গল মাদার এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ। বিজেপির আইটি সেল তৎক্ষণাৎ লেগে পরে দিশার চরিত্র নিয়ে কাটাছেঁড়া করতে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে এটা বিজেপির আইটি সেলের চরিত্র, কিন্তু একটু ভেবে দেখলে বোঝা যাবে এই নিকৃষ্ট মানসিকতার মানুষজন আমাদের মধ্যেই বিরাজমান। তারা অন্য দুনিয়া থেকে আসেনি। তাদের মধ্যে অনেকে বিশ্বাস করে নারীর অধিকার নেই তার নিজের শরীর, যৌনতার, জীবনের ওপর। এদের অনেকেই সুবিধাপ্রাপ্ত, প্রিভিলেজড, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ, এবং তথাকথিত শিক্ষিত।

আসলে সমস্যা আমাদের গোড়ায়, আমাদের শিক্ষায়। তাই আমরা গুলিয়ে ফেলি দেশ কী― মানুষ না চিহ্ন,  অগ্রাধিকার কার প্রাপ্য― রক্তমাংসের মানুষের বা কিছু চিহ্নের ধারণার? তাই গুলিয়ে ফেলি নারীর শরীরের অধিকার কার― সমাজের না যার শরীর তার? তাই দেশের সর্বোচ্চ আদালত রায় দিতে পারে যে মেয়েদেরকে বাড়িতে রেখে আন্দোলন করতে আসুন। ও হ্যাঁ, দিন কয়েক আগে বোম্বে হাইকোর্ট এক নাবালিকার ধর্ষণের মামলায় অভিযুক্তর কাছে জানতে চেয়েছেন― বিয়ে করার সদিচ্ছা যখন ছিল না, তাহলে ধর্ষণ করলেন কেন?

এই গোষ্টী যতদিন দেশের শাসক হিসেবে থাকবেন, ততদিন প্রগতিশীলতার ধারণা, মানবাধিকার, লিঙ্গসাম্য ইত্যাদি আদর্শগুলিকে নাগরিকেরা আলমারিতে তালাবন্ধ করে রেখে দিলে সরকারের পক্ষে খুব ভালো হয়।

কিন্তু… আমরা কি তা মেনে নেব?