Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অসমে তরুণদের রাজনীতিতে প্রবেশ আশার আলো দেখাচ্ছে

তানিয়া লস্কর

 


প্রাবন্ধিক, গদ্যকার

 

 

 

ভারতীয় উপমহাদেশ বিশ্বের সর্ববৃহত্তম গণতন্ত্র হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর যুবতম দেশগুলোর মধ্যেও একটি। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৫ শতাংশ পঁয়ত্রিশ বছরের নীচে। অথচ ২০১৯ সনের পরিসংখ্যান মতে আমাদের জনপ্রতিনিধিদের মাত্র ৬ শতাংশের বয়স পঁয়ত্রিশের নীচে। এই পরিসংখ্যান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগদানে  নতুন প্রজন্মের অনিচ্ছার কথা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

তবে এবারের অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনে চিত্রটা কিছুটা হলেও পাল্টেছে বলে মনে হচ্ছে। সমসাময়িক পরিস্থিতির চাপেই হোক কিংবা রাজনৈতিক সদিচ্ছা বশেই হোক দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যুবকদেরকে প্রার্থিত্ব দিতে কার্পণ্য করেনি। অসমের ক্ষেত্রে বিশেষ দিক হল তাদের মধ্যে কয়েকজন আবার বিভিন্ন সমাজিক আন্দোলন থেকে উঠে আসা মুখ। প্রায় সকলেই একদম বুনিয়াদি স্তর বা grassroots থেকে উঠে এসেছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন:

প্রণব দলে (৩৫): প্রণব দলে বোকাখাট সমষ্টির নির্দল প্রার্থী। তিনি কাজিরাঙা এলাকায় জীপাল কৃষক মজদুর সংঘ নামে একটি সংস্থায় কাজ করেন। সামাজিক আন্দোলনে জড়িত হয়ে সরকার বিরোধিতার জন্য তাকে এপর্যন্ত দুবার জেলে যেতে হয়েছে। কোভিড প্যানডেমিকের সময় চাউল কেলেঙ্কারি নিয়ে স্থানীয় নেতার বিরুদ্ধে সরব হওয়ার জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এমনকি তিনি যখন নির্বাচনে যোগদান করার কথা বলেন তখনও কোনও প্রকার সার্চ ওয়ারেন্ট ছাড়া তাঁর বাড়িতে হঠাৎ করে পুলিশ হানা দেয়। পরে অবশ্য স্থানীয় লোকেরা প্রতিবাদ করলে অবস্থা বেগতিক দেখে তাদের ফিরে যেতে হয়। দলের নির্বাচনী চিহ্ন টর্চ। তিনি নিজের বক্তৃতায় বলছেন অন্ধকারে পরিপূর্ণ সময়ে আলোর দিকে যাত্রা করতে চান তিনি।

আশরাফুল হুসেইন (২৭): বরপেটা জেলার চেংঙা সমষ্টির এইউডিএফ প্রার্থী আশরাফুল হুসেইন। তিনি একাধারে কবি, সাংবাদিক এবং সমাজকর্মী। অসমে সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বঙ্গ-মূলীয় মুসলমানদের মধ্যে থেকে উঠে আসা যুবক। নাগরিকত্ব বিতর্ক চলাকালীন সময়ে তিনি পুনের নিজের ইঞ্জিনিয়ারিং চাকরি ছেড়ে অসমে চলে আসেন। তখন থেকে সেই ইস্যুতে কাজ করছেন। এনারসি চলাকালীন সময়ে মানুষের সঙ্গে হওয়া নানারকম বঞ্চনা এবং নিপীড়নকে উপজীব্য করে ২০১৫ থেকে যখন মিঞা কবিতা আন্দোলন শুরু হয় আশরাফুলের কবিতাও খুব জনপ্রিয় হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে সেইসব কবিতা লেখার জন্য অন্যান্য মিঞা কবিদের সঙ্গে তার বিরুদ্ধেও মোকাদ্দমা দায়ের করা হয়। পরে তারা হাইকোর্ট থেকে জামিন পান। তিনি এনারসির নামে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে রাজনীতিতে আসতে চান।

আশরাফুল আলম (৩৫): কৃষক নেতা অখিল গগৈর রাজনৈতিক সহকর্মী। কৃষক আন্দোলন, নদী বাঁধ-বিরোধী আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী। তিনি বরপেটার যনিয়া সমষ্টি থেকে লড়ছেন।

স্বরূপ সাহু (৩১): পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। চাকরিতে মনে বসেনি। ২০১৭ থেকে রাজনীতিতে যোগ দেন। বরাক উপত্যকায় যে অল্পসংখ্যক ওড়িয়া আদিবাসী আছেন তাদের একজন। পাথারকান্দী বিধানসভা চক্র থেকে লড়ছেন।

অঙ্কিতা দত্ত (২৮): নাওবৈচা সমষ্টির জাতীয় কংগ্রেসের পার্থী অঙ্কিতা দত্ত।

তমাল কান্তি বণিক (৪৭): “নান্দীকার” সাংস্কৃতিক সংস্থার সদস্য তমাল কান্তি বণিক। যদিও পারিবারে কোনও রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউণ্ড নেই, তিনি কলেজে পড়ার সময় থেকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ২০১৯ সনে শিলচরের পৌর কমিশনার ছিলেন। তিনি নাগরিকত্ব ইস্যুর সমাধান চান। তার সমর্থনে শহরে সাংস্কৃতিক কর্মীরা প্রচারে নেমেছেন।

এরা কয়েকজন হলেন এমন প্রার্থী যাদের সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদান অসমের নির্বাচনকে ভীষণ আকর্ষক করে তুলেছে। এদের প্রত্যেকের প্রচারে নতুন প্রজন্মের উপস্থিতি এবং যোগদান চোখে পড়ার মতো। যেহেতু তারা সকলেই নিজেদের এলাকায় সামাজিক আন্দোলনগুলোর সঙ্গে জড়িত ফলে স্বাভাবিকভাবেই তদের নির্বাচনী ইস্তেহারে নিজেদের স্থানীয় ইস্যুগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে।

বর্তমানে যখন সারাদেশে সামাজিক আন্দোলনকর্মীদের বিরুদ্ধে ‘আরবান নকশাল’, ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’-এর মতো নানা ন্যারেটিভের জন্ম দেওয়া হচ্ছে তখন শিক্ষিত সামাজকর্মীদের সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদান অনেকের মনে আশার আলো ফুটিয়ে তুলছে। এ কয়েকবছরে দেশে বুদ্ধিজীবী তথা সামাজিক কর্মকর্তা বিরোধী একটি আবহাওয়া তৈরি করা প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। উচ্চশিক্ষাকে ধ্বংস করার চেষ্টা হয়েছে। দেশের একটি বিখ্যাত উচশিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিল্লির জেএনইউ বিশ্ববিদ্যালয়কে বন্ধ করে দেওয়ার দাবি তুলা হয়েছে। দিল্লি দাঙ্গা এবং কৃষক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতেও আমরা দেখলাম অনেক যুবাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে গণ আন্দোলনগুলোকে বদনাম করার জন্য দিশা রবিদের মতো তরুণদের টার্গেট করা হয়েছে। এই অবস্থায় সক্রিয় রাজনীতিতে তারুণ্যের উপস্থিতিতি ঘুরে দাঁড়ানোর একটি মরিয়া প্রচেষ্টা হিসেবেও দেখা যাচ্ছে। তাছাড়া তরুণদের সামনে আদর্শের অভাব নেই। কানহাইয়া কুমার, জিগনেশ মেভানিদের ইউটিউব ভিডিওগুলোতে লাইক এবং ভিউসংখ্যা দেখলেই সহজেই অনুমান করা যায়। কৃষক আন্দোলন এবং সিএএ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে মূলত তরুণরাই ছিলেন। সেটার প্রভাবও কিছুটা থেকেই যায়। এসব নানা কারণেই দেশের রাজনৈতিক চিত্র কিছুটা পাল্টাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

তবে এদেশে রাজনীতিতে সামাজকর্মীদের যোগদানের ইতিহাস কিন্তু তেমন আশাব্যাঞ্জক নয়। আমরা ২০১৪-তে মণিপুরে ইরম শর্মিলার ক্ষেত্রে সেটা দেখেছি। ছত্তিশগড়ে সোনি সোরির ক্ষেত্রে দেখেছি। এমনকি গত নির্বাচনে কানহাইয়া কুমারের অবস্থাও একই হয়। সামাজিক মাধ্যম এবং প্রচার অভিযানে তার সপক্ষে প্রবল জন-জোয়ার দেখা গেলেও ব্যালট বাক্সে কিন্তু উল্টো চিত্র দেখা যায়। আসলে সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলো রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে তারুণ্যের উপস্থিতিকে ভয় পায়। সুতরাং তাদেরকে পিছনে ফেলতে একাট্টা হয়ে যায়। নানা ষড়যন্ত্র রচিত হয়। অসমের তরুণ ব্রিগেডকেও নিশ্চিতভাবে সেসবের সামনা করতে হবে।

তবে প্রতিটি প্রজন্মের সামনেই  এমন এক একটি সন্ধিক্ষণ আসে যখন তাদের ব্যক্তিস্বার্থকে ছাপিয়ে সামাজের ডাকে পথে নামতে হয়। বর্তমান সময়ে হয়ত ভারতের নবপ্রজন্মের সামনে সেই সময়টা এসেছে। অন্তত সামাজিক আন্দোলনগুলোকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে সে কথা স্পষ্ট হয়। দেশের যুবারা সামাজিক সাংস্কৃতিক তথা রাজনৈতিক ইস্যুগুলোতে লক্ষণীয়ভাবে পথে নামছে। তবে যুবারাও কোন সমসত্ব বা homogenous গ্রুপ নয়। তাদের মধ্যে নানা ফ্র্যাকশন আছে। দুঃখের বিষয় হল দেশের যুবাদের একটি বড় অংশ আজও উচ্চশিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে তারাই শেষ কথা বলেন। তরুণ রাজনীতিবিদদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল তাদের মন জয় করা। তাদের কাছে নিজেদের বার্তা পৌঁছে দেওয়া। সেইসঙ্গে সমাজের বাকি অংশদেকেও সঙ্গে নিয়ে চলতে হবে। মহিলাদের সঙ্গে আনতে হবে। সেটা করতে তারা কতটা সক্ষম হন সেকথা সময় জানাবে। তবে আপাতত বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সেইসব যুবারা যারা “যেখানে জীবন আছে, যেখানে কবিতা আছে” সেখানে চলে গেছিল তাদের একটি অংশ রাজনৈতিক অঙ্গনে আবার ফিরে এসেছেন বলে মনে হচ্ছে।