Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অভিষেক নন্দী

গুচ্ছ কবিতা -- অভিষেক নন্দী

গুচ্ছ কবিতা

 

চিঠি

সকলেই বৃত্ত আঁকতে পারে না…
আঁকতে চেয়েও, হাতে বসা মাছিকে
তাড়িয়ে ফেলতে যায় আগে
ভেস্তে যায় সভ্যতা!
যে ঘেরাটোপে বাঘের সঙ্গে খেলা করে যাচ্ছে
তোমার প্রাচীনতম চুম্বন,
সেখানে স্থির হয়ে বসে—
লিখে চলি কবিতা।
ভুলে যাই তোমার জংলি শরীরের গন্ধ,
মৃদু হেসে পালিয়ে যাওয়া একটা উন্মাদ মাত্র
কারগারের সেলাই ভেঙে যে ফুল এসেছে পালিয়ে,
তাকে, তোমার ঠিকানায় পাঠাব?

 

সাইড অ্যাক্টর

নায়কের বন্ধুটি নায়কের চে সুন্দর
তবু, তাকে দেখবার লোক নেই।

অনেকটা কাদাজীবন কাটিয়ে কাটিয়ে
প্রায় চল্লিশটা সিনেমায় নায়ককে বাঁচাতে
স্রেফ তেত্রিশবার মৃত্যু ছ-সাতবার জখম।

শূন্যতা ঠেলতে-ঠেলতে বিরামচিহ্ন চোয়াল—
গর্তে হাত-পা পুঁতে-পুঁতে, দূরসম্পর্কের
এক বিজ্ঞানী-কাকার ছেঁড়া মশারির মধ্যে
দু-জন মিলে পাখি ওড়ায় আর ঘুড়ি কাটে

নায়কের বন্ধুটির ক্ষয়ভরা জানু-দুটোর ওপরে, ঐ
ঐশ্বরিক পালকমুখের দিক তাকালেই
বিজ্ঞানী ও তার দলবল ফের প্রমাণ করতে চায়—
সূর্য, পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে…

 

ধ্বনি

তার ক্ষমা পাওয়া উচিত
নাভিকমলে আটকে গ্যাছে যে স্ল্যাং

একজন মিথ্যাবাদীর
প্রিয় পোশাকে
তোমাকে দারুণ মানাচ্ছে, প্রতিবাদ!

জোরে-জোরে বারিষ ঠিকরে এলে পিঠের কাগজে
তাকে অ্যালার্মে বেঁধে রেখেছে স্ল্যাং এবং
মীরজাফরের ইতিহাস

মিছিল থেকে খুলে-পড়া ঘুঙুর—
একটা ফাঁকা মাঠে গড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে এই মানচিত্র,
ঠিক যেন, খালি মদের বোতল!

 

আত্মপরিচয়

আমাদের মধ্যে কেউই কিন্তু বড় হচ্ছে না
যা হচ্ছি–কেবল ধারালো কাচি দিয়ে
আলোছায়া কেটে কেটে
অন্ধকারে হাত-পা ধোয়ার শুচিবায়ুতা!

পুরনো বাতের-ব্যথা নিয়ে একগাল হাসির বদলে
পেন্ডুলামের মতো সবুজ ঘাসে দুলতে থাকা বন্ধুটা,
আমাকে ওদের দেশের রোদ্দুর পাঠায়…
তবু ভালো, শুয়ে থাকারা ছায়াহীন;
এই অজস্র অসুখে যুদ্ধবিরোধী হয়ে
তবু ভালো— আমি আর পোষ্য নেই আগের মতন

পৃথিবীর সবচে বড় এবং ছোট স্বপ্ন দেখা
মানুষগুলোর মাঝে দাঁড়ালে,
আমি ভুলে যাচ্ছি— ‘বেঁচে থাকা’— তুমি একটি মারণরোগ!

 

অস্কারে মনোনীত সিনেমা

তোমার প্রিয় মাছের কাঁটার ভেতর, আশ্রয় পাচ্ছে সন্তান হারানো একটা নদীর আঁচল। এমন সব মূকাভিনয়ের ঝঙ্কারে বেজে ওঠা হারমোনিকা— বিসর্জনের এই মাঠে জাগিয়ে তুলুক আমাদের ভালোবাসা ও একটি সদ্য জন্মানো পাহাড়ের প্রথম চুম্বনের দৃশ্যকে!

 

জাদুগ্লাস

মাঝেমধ্যেই খেয়াল করি
বাবা বক্ষপঞ্জর থেকে লাল আপেল খুলে
এঁটো বাসনের গর্তে ছুঁড়ে মারছে…

আমরা একজন অন্ধ কাজের-মাসি ঠিক করেছি
ম্যাজিশিয়ান আকৃতির বডি-স্প্রে গায়ে মেখে
স্টিলের-গ্লাসের বদলে চকমকে করে তুলছেন
বাবার সেই আপেলপিণ্ড, সেই জাদুগ্লাস-টা!

ওতে করে আমি জল খাই
ওটাতে করে জল নিয়ে মা ক্যাপসুল পোষে পেটে

সেইদিন মা আর ছেলের খিদে পায় না সারাসময়,
বাবা পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়
এক-একটা মদের দোকানের মালিকের হাত থেকে

 

অভিনেতারা মুখোশে থাকে

দাঁড়িপাল্লা থেকে রান্নাঘরের দূরত্ব
ছিনিয়ে নিয়ে যাবে পিঁপড়ের লাশ;
বরফ-জগতের অপরপ্রান্তে
কয়েকটা ডাইনোসর ঝুলছে যে-পাল্লাতে
তারা অবশ্য ভুলে খেয়েছে এইসব সংলাপ

মঞ্চ সাজানো হল…

কালো টিকা ভেঙে
যে যুদ্ধের বাণী ঢুকে পড়েছিল নষ্ট ঘড়ির ভেতর,
সাবান জলের ফেনায়
দাঁড়িপাল্লা তাকে ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি’ ভেবে ওজন করলে,
তুমি শনিবারের বদলে, আমাকে বৃহস্পতিবারের জ্যোৎস্না পাঠালে
লেনিন!

 

দাগ

‘হে অযত্ন,
তোমাকে রাখব যত্ন করে।’

দ্যাখো, এই একটাই তো রাস্তা!
এই রাজনীতি ধরেই এতকাছে এসেছিলে—
এখন যদি তোমার পায়ের ছাপ মারিয়ে
ফিরে যেতে হয় একা আমায়,
কীভাবে অক্ষত থাকবে সেসব দাগ?
কীভাবে বড় হবে সেইসব অতল স্মৃতি!

 

পোস্টাল অ্যাড্রেস

একটাই গর্তবাড়ি, কুয়ো এবং কবর—
সুতোয় পুষে রাখে হেরে যাওয়া খবর
আলোরথ নিভে এলে ভগবানও কীট
ঋতু-প্যাঁচানো কাপড়— ফুলের মার্কশিট
যে বুক শীত পায়নি, তাকে দিও ফুঁ
তোমার খোলস মাখে— পরাগরেণু?
রাত বাড়ে চাঁদ বাড়ে, জমিন গ্যাছে ক্ষয়ে
বাপের অভাবে জাগা নদীর পরিচয়ে
এভাবে রংবদল-এ, কানুন পাল্টায়
ছেলেটির তুমুল দোষ— সে মা হতে চায়!

 

শববাহী গাড়ি

পুরনো হাওয়াই চটির উল্টোপাশের ন্যায়
হাসপাতালের মসৃণ বিছানা, ও
যোনিবৃক্ষের সামনের টেবিলে
এক্ষুনি ফুটে উঠবে যে সদ্যজাত আলো—

গিরগিটি-প্রজাতির একটি শববাহী গাড়ি
তোমাকে নিয়ে দাঁড় করাবে
যাপনের প্রতিটা স্টপেজে

অবাক বালকের মতো তুমি দেখবে
গিরগিটির কেমন রঙ পাল্টাচ্ছে!—
রিকশা > অটো > বাস > ট্রেন > এরোপ্লেন

 

পরকীয়া

তোমার বুকে উঁচু উঁচু স্তন চাই না আর
একটা দেড় কামরার ঘর চাই
যেখানে মুখভার করে বসে থাকতে আসবে
একজন সমকামী কবি

তাকে বুকপকেটে মুড়ে ছুট্টে যাব নদীতে
খাওয়া-দাওয়া হবে, যাঁরা
রামধনু কেনাবেচা করে তাদের সঙ্গে!
অথচ বৃষ্টি মাখব না, সুপুরি পাতায় বেঁধে
গায়ে ঘষব থকথকে বজ্রবিদ্যুৎ

পেপসি-কারখানার ধোঁয়ার ওপর
আমি আর সেই মানুষটা গল্প করতে করতে
কান্নায় ভেঙে পড়লে,
অনেক রাত্তিরে হুইলচেয়ার চেপে
তুমি ধাক্কা মেরে চুম্বন ভেঙে দিও আমাদের…