আলফোনসিনা স্তোর্নি-র কবিতা

আলফোনসিনা স্তোর্নি-র কবিতা : মহুয়া দত্ত

মহুয়া দত্ত

 

আলফোনসিনা স্তোর্নি (Alfonsina Storni) ১৮৯২ সালে সুইজারল্যান্ডে জন্ম নিলেও ৪ বছর বয়সে তিনি বাবা মায়ের সঙ্গে আর্জেনটিনা চলে আসেন। প্রায় একশো বছর আগে জন্মেও তিনি ছিলেন সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা মানুষ। সেসময়ে সমাজে নারী ও পুরুষের পৃথক অবস্থানের বিরুদ্ধে বার বার তিনি কলম ধরেছেন। তাঁর বিভিন্ন কবিতার বিষয় হয়েছে নারীপুরুষের সমানাধিকার। এখানে যে তিনটি কবিতার অনুবাদ করা হয়েছে তার প্রথম দুটিতেও সেই ভাবনা সুস্পষ্ট। তবে শেষ কবিতাটি তাঁর জীবনেরও শেষ কবিতা। ১৯৩৫ সালে ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। ১৯৩৮ সালের অক্টোবরে ক্যান্সার প্রায় গলা পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে বুঝতে পেরে তিনি একা মার দে প্লাতায় আসেন এবং এই কবিতাটি ‘লা নাসিওন’ পত্রিকার ঠিকানায় পাঠিয়ে তিনি সমুদ্রের দিকে চলে যান। সেই পত্রিকায় যখন লেখাটি প্রকাশিত হয়, তখন তিনি হারিয়ে গেছেন সমুদ্রের ঠিকানায়।

 

আলফোনসিনা স্তোর্নি-র কবিতা

 

অজ্ঞ পুরুষ

হা রে পুরুষ! তুচ্ছ পুরুষ!
তোমার পোষা বদ্রি পাখি উড়তে চায়,
মুক্ত করো তাকে।
আমি তোমার খাঁচায় পোষা বন্দি পাখি
খাঁচা খোলো, মুক্তি দাও আমায় তুমি।

আমি তোমার খাঁচায় ছিলাম, অজ্ঞ পুরুষ,
খাঁচা তুমিই দিয়েছিলে আমায়, পুরুষ।
আমি তোমায় অজ্ঞ বলি, কারণ আমায়
বুঝতে তুমি পারোনি যে এক মুহূর্ত,
বুঝবেও না আর কখনও, আমি জানি।

আমিও তোমায় বুঝি না ঠিক, কিন্তু তুমি
খাঁচা থেকে আমায় এবার মুক্তি দিও।
আমায় তুমি এবার যেন উড়তে দিও।
হা রে পুরুষ, ভালোবেসেছিলাম তোমায় কিছুসময়,
এরচেয়ে বেশি ভালোবাসায় জোর কোরো না।

মূল কবিতা: Hombre Pequeñito

 

তুমি চাও আমি শুভ্র হব

তুমি চাও আমি ভোরের মত স্নিগ্ধ হব,
কিম্বা সফেদ সমুদ্দুরের ফেনার মত,
শুক্তি যেমন সাদা, তেমন আমাকে চাও।
সাদা লিলির পবিত্রতা আমার হবে,
এককথাতে, আমি হব লক্ষ্মী সতী, তোমার চাওয়ায়।
মৃদু সুবাস, আগলবন্ধ না-মেলা পাঁপড়ি, ফুলের যেমন।

না আমায় কোনও চাঁদের রশ্মি শুদ্ধ করে,
না কোনও ফুল আমায় বলে সহোদরা,
তুমি চাও আমি হব সাদা বরফকুঁচি,
চাইছ তুমি হব আমি শুভ্র শুচি,
তুমি চাও আমি ভোরের মত স্নিগ্ধ হব।

তোমার কিন্তু হাতের মুঠোয় রসভাণ্ড
ফলের, ফুলমধুতে ওষ্ঠ রঙিন
আঙুরলতায় ঢাকা কোনও ভোজসভাতে
তোমার শরীর ব্যস্ত থাকে
আসবদেবের উদযাপনে।
প্রবঞ্চনার মিথ্যে বাগান
অন্ধকারের, সেখানে তুমি—
রক্তিম সাজ তোমার, তুমি
ছুটেছিলে কোন ধ্বংস-টানে।

জানি না কোন যাদুবলে
এখনও তুমি, একইরকম রয়ে গেছ।
আমায় তুমি দেখতে চাও শুভ্রসফেদ,
ঈশ্বর যেন হয় ক্ষমাশীল তোমার প্রতি,
আমি হব লক্ষ্মীসতী তোমার চাওয়ায়,
ঈশ্বর যেন হয় ক্ষমাশীল তোমার প্রতি,
তুমি চাও আমি ভোরের মত স্নিগ্ধ হব!

পালিয়ে যাও অরণ্যেতে,
হারিয়ে যাও পাহাড়ে,
সুধারসের মুখ ধুয়ে নাও
থাকো কোন কুটিরছায়ায়,
নিজের হাতে ছুঁয়ে দেখো ভেজা মাটি,
খাও কিছুদিন গাছগাছালির তেতো শিকড়
পাথর থেকে ছেনে নিও পানীয় জল।
ঘুমিয়ে থেকো বিছিয়ে নিয়ে তুষারচাদর।
পোশাক তুমি ধুয়ে নিও জল আর ক্ষারে,
ভোরবেলাতে উঠে তুমি পাখির সাথে কথা বোলো।
যখন তোমার শরীর আবার ফিরে আসবে তোমার কাছে,
যখন তুমি রাখবে তোমার হৃদয়খানি সেই শরীরে,
হারিয়েছিল যে মন তোমার শয্যাকক্ষে মিথ্যা ভিড়ে,
তারপরে, হে শুদ্ধ পুরুষ,
বোলো আমায় শুভ্র হতে
হতে বোলো তুষার-সাদা,
হতে বোলো লক্ষ্মী সতী।

মূল কবিতা: Tú Me Quieres Blanca

 

ঘুমোতে দাও

ফুলের পাঁপড়ি, শিশিরবিন্দু
ঔষধি আর তোমার মত আদর্শ নার্স,
এবার আমায় মাটির চাদর বিছিয়ে দিও,
দিও আমায় বুনো শ্যাওলার লেপের আদর।

সেবিকা আমার, ঘুমোতে দাও, এবার ঘুমোই।
মাথার কাছে একটা আলো জ্বালিয়ে রেখো,
ঋক্ষরাজি, কিম্বা তোমার পছন্দসই
যা হোক কিছু, শুধু আলো একটু যেন নিভু থাকে।

একলা আমায় থাকতে দাও, ফুলের কুঁড়ি ভেঙে যাওয়ার শব্দ শোনো
আকাশ থেকে অপার্থিব দৈব পা দোলায় তোমায়,
একটা পাখি উড়ে যাওয়ার ছন্দ আঁকে, তোমার জন্য।

যেহেতু তুমি ভুলে যাবে, ধন্যবাদ জানিয়ে রাখি।
আর অনুরোধ,
যদি সে আবার দূরভাষে কথা বলে,
তাকে বোলো এমন চেষ্টা করতে না আর,
কারণ আমি চলে গেছি…

মূল কবিতা: Voy a dormir

 

 

 

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...