ফয়েজ় আহমদ ফয়েজ়
অনুবাদ: নীলাঞ্জন হাজরা
একটি কবিতা কখন কী কারণে যে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে, তা কেউ আগাম লিখে দিতে পারেন না। কবি ফয়েজ় আহমদ ফয়েজ়-এর ‘হম দেখেঙ্গে’ কবিতাটি, ক’দিন আগে আমাদের চোখের সামনে আচমকাই একটা বোমার মতো ফেটে পড়ল যেন। দেশের প্রথমসারির এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পঞ্চায়ত বসানোর কথা ভাবা শুরু হল – অভিযোগ, কবিতাটি নাকি হিন্দু-বিরোধী। আর, একইসঙ্গে আমরা শুনলাম, দিল্লির শাহিনবাগ থেকে শুরু করে জামিয়া মিলিয়া ক্যাম্পাসে, মুম্বাইয়ের আজাদ ময়দানে, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে সকলে একসঙ্গে গাইতে শুরু করেছেন ‘লাজ়িম হ্যায়কে হামভি দেখেঙ্গে – হম দেখেঙ্গে…’ গত দু’তিনদিনে কবিতাটির একাধিক ইংরেজি ও বাংলা ভাষান্তর সোশ্যাল মিডিয়াবাহিত হয়ে আরও অনেকের মতোই আমাদের হাতেও এসে পৌঁছেছে। প্রায় সবক’টি ভাষান্তরই মোটের ওপর একই কথা বললেও, উর্দু ভাষার সঙ্গে স্বল্পপরিচিত আমাদের মনে হচ্ছিল, অনূদিত পাঠগুলির মধ্যে দিয়ে কবিতার প্রাণটিকে যেন বা ঠিক ধরতে পারছি না আমরা। ইতোমধ্যে খবর পেলাম কবি নীলাঞ্জন হাজরা (পেশায় সাংবাদিক ও প্রবন্ধকার হলেও, আমরা জানি, নীলাঞ্জন আসলে একজন কবিই) কবিতাটির অনুবাদ করেছেন। আগ্রহী পাঠকরা জানেন, উর্দু-ফারসিতে বহুল ব্যুৎপত্তি-সম্পন্ন নীলাঞ্জনের ফয়েজ়-এর কবিতা নিয়ে কাজ করার সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই, সংবাদ পাওয়ামাত্র আমরা তাঁকে অনুরোধ করি, অনূদিত কবিতাটি চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-কে দেওয়ার জন্য। বন্ধুবৎসল নীলাঞ্জন আমাদের অনুরোধ রেখেছেন। অধিকন্তু, অনুবাদের শেষে একটি মহামূল্যবান টীকাও যোগ করে দিয়েছেন, যা কবিতার কেন্দ্রীয় বার্তাটি বোঝার পক্ষে অত্যন্ত জরুরি… -- স্টেশন মাস্টার, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম
লাজ়িম হ্যায়কে হামভি দেখেঙ্গে
ওহ্ দিন জিনকা ওয়াদা হ্যায়
যো লওহ-এ-অজ়লমে লিখা হ্যায়
যব জ়ুল্ম-ও-সিতমকে কোহ্-এ-গিরাঁ
রুই কি তরহ্ উড় যায়েঙ্গে
হম মহকুমোঁ কে পাওঁ তলে
যব ধরতি ধড়-ধড় ধড়কেগি
অওর অ্যাহল-এ-হুকমকে সর-উপর
যব বিজলি কড়-কড় কড়কেগি
যব অর্জ়-এ-খুদাকে কাবেসে
সব বুত উছালে যায়েঙ্গে
হম অ্যাহল-এ-সফা মরদুদ-এ-হরম
মসনদপে বিঠায়ে যায়েঙ্গে
সব তাজ উছালে যায়েঙ্গে
সব তখ্ত গিরায়ে যায়েঙ্গে
বস্ নাম রহেগা আল্লাহ্ কা
যো গ়ায়ব ভি হ্যায় হাজ়ির ভি
যো ম্যায় ভি হুঁ অওর তুম ভি হো
যো মনজ়র ভি হ্যায় নাজ়ির ভি
উঠেগা অন’ল হক* কা নারা
অওর রাজ করেগি খল্ক্-এ-খুদা
যো ম্যায় ভি হুঁ অওর তুম ভি হো
***
দেখব আমরা
আমরাও নিশ্চিত দেখব সেই দিন
সেই যে প্রতিশ্রুত দিন
লিখিত রয়েছে যা অসীমের পাতায় পাতায়
যে দিন অত্যাচারের অচলায়তন
উড়ে চলে যাবে স্রেফ তুলোর মতন
আমরা শাসিত যারা, আমাদের পায়ের তলায়
ধরিত্রী কেঁপে কেঁপে উঠবে যখন
এবং শাসকদের সবার মাথায়
থেকে থেকে বজ্রপাত ঘটবে যখন
ঈশ্বরের এ মাটির দেবালয় থেকে
মূর্তি সব ছুড়ে ফেলা হবে যেই দিন
আমরা নিরপরাধ তবু সব পবিত্রআশ্রয়হীন
সেই দিন আমাদেরই করা হবে ক্ষমতা-আসীন
কেড়ে নেওয়া হবে সব মুকুট যখন
ভেঙেচুরে ফেলা হবে সব সিংহাসন
ঈশ্বরের নামটুকু শুধু রয়ে যাবে
একাধারে অদৃশ্য ও উপস্থিত যে
নিজেই দৃশ্য হয়ে দ্যাখে যে নিজেই
উঠবে ধ্বনি — সৃষ্টিশীল সত্য আমিই
যা আসলে আমি-তুমি আমরা সকলেই
রাজত্ব করবে শুধু ঈশ্বরসৃষ্ট মানুষেই
যা আসলে আমি-তুমি আমরা সকলেই
*মূল কবিতার একেবারে শেষের দিকে ‘অন’ল হক’ কথাটির বাংলা করা আমার সাধ্যের বাইরে। এন হানিফ Biographical Encyclopaedia of Sufis: Central Asia and Middle East নামের বইয়ে তার অনুবাদ করেছেন I am the Creative Truth। আমি তাঁরই অনুসারী হলাম। মনে রাখা প্রয়োজন এই উচ্চারণের জন্য, হানিফ জানাচ্ছেন, “প্রথমে খলিফার নির্দেশে সম্মিলিত ভিড় হল্লাজের দিকে পাথর ছুড়ে মারতে থাকল। তারপর কেটে নেওয়া হল তাঁর হাত দুটো। তারপর জল্লাদ কেটে নিল তাঁর দুটো পা। একে একে উপড়ে ফেলা হল চোখ দুটো। কেটে ফেলা হল জিভ। তাঁর মৃতদেহ কুচিকুচি করে কেটে, টুকরোগুলো পুড়িয়ে সেই ছাই বাতাসে উড়িয়ে দেওয়া হল।”
ফয়েজ়-এর এই কবিতায় ‘অন’ল হক’ স্লোগান (কবি নারা শব্দটি ব্যবহার করেছেন) কবিতাটির আলম্ব বলে আমার মনে হয়েছে। ইকবাল বানোর গানটি মন দিয়ে শুনলেও দেখা যাবে, তিনিও এই অংশটিকে প্রায় ক্লাইম্যাক্সে পরিণত করেছেন। স্পষ্টতই আবু’ মুঘিত অল-হুসেন বিন মনসুর অল-হল্লাজের এই পরিণতির কথা মাথায় রেখেও তিনি সকলকে এই স্লোগান তুলতে উৎসাহ দিচ্ছেন। মুশকিল হল, ‘অন’ল হক’ বললেই হল্লাজের ইতিহাস সঙ্গে সঙ্গে মাথায় আসে। কিন্তু বাংলায় সেই দ্যোতনা কী ভাবে আনা সম্ভব?
অনবদ্য! কুর্ণিশ টীকা ও অনুবাদকে।
অনবদ্য! কুর্ণিশ অনুবাদ ও টীকাকে।