Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এক অবর্ণনীয় অবস্থায় পড়েছেন রোহিঙ্গারা

স্বর্ণালী দত্ত

 




মানবাধিকার কর্মী

 

 

মার্চ ২২, ২০২১

দুপুর আর বিকেলের মাঝামাঝি সময়। ক্যাম্প থেকে খবর এল আগুন লেগেছে। একটি নয়, দু-দুটোতে। মন খানিকটা উচকিত হলেও তেমন গুরুতর ব্যাপার বলে ধারণা করা যায়নি। বাংলাদেশে গ্রীষ্মের আঁচ পেতে পেতে মার্চ শেষে এপ্রিলে গড়ালেও এবছর যেন বেশ আগেই শুরু হয়ে গেছে। এমনিতেই কক্সবাজার এবং এর অন্তর্ভুক্ত উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার তাপমাত্রা গড়পড়তায় ৩৮-৪২-এর মধ্যে ওঠানামা করে। মায়ানমার থেকে আগত বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে তাদের জন্য বরাদ্দ খুপরি ঘরে বাস করে। ঘরগুলো উন্নতমানের তারপুলিন (তেরপল) আর বাঁশের তৈরি। মেঝে সিমেন্ট লেপা। পাকা কিংবা আধাপাকা কোনওটিই বলা চলে না। বনভূমি উজার করে রোহিঙ্গাদের ঠাই দেওয়া হয়েছিল। প্রকৃতিও নারাজ। ঘরগুলো পরস্পর লাগোয়া এবং ক্যাম্পে হাজারো মানুষের বসবাসের কারণে খোলা জানালা তেমন নেই। কাঠফাটা চৈত্র বা বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে ভেতরে প্রায় নরকতুল্য অবস্থা বিরাজ করে। প্রতিটি ঘরে শিশুসহ বাস করে সাত-আটজনের পরিবার বা তারচেয়েও বড়। এর বাইরে আছে মায়ানমার থেকে আগত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পরিবার, সন্তান, বৃদ্ধ-নারী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষ। ফিরে যাই অগ্নিকাণ্ডের দিনে।

বিকেল পাঁচটা নাগাদ জানা হয়ে গেল দুটো কিংবা তিনটে নয়, উখিয়া উপজেলার বালুখালি সংলগ্ন চারটি ক্যাম্পেই আগুনের লেলিহান শিখায় দাউ দাউ করে জ্বলছে। এদের মধ্যে সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাম্প-৯। দশ হাজারের বেশি শেল্টার, বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার অফিস এবং অন্যান্য স্থাপনা, রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য ইউনিসেফ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত শিক্ষাকেন্দ্র, হাসপাতাল, দোকানপাট পুড়ে ছাই। আরও দুঃখজনক যে শেল্টারের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানির নলকূপ এবং টয়লেটগুলোও পুড়ে নষ্ট হয়েছে। দুর্ঘটনায় আক্রান্ত রোহিঙ্গারা যে যেদিকে পারে দৌড়ে, দূরে অন্য ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়ে প্রাণে বেঁচেছে। যে শেল্টারগুলো আগুন থেকে সৌভাগ্যক্রমে রক্ষা পেয়েছে সেগুলোতে বসবাসরত রোহিঙ্গারা ভিন্নরকম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে। যে কোনও দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে দুটো ঘটনা বেশ কমন। এক, নারী-শিশু-বৃদ্ধদের অপেক্ষাকৃত বেশি ভুক্তভোগী হতে হয়। দুই, কিছু স্বার্থন্বেষী মানুষ এই সুযোগে লুটপাটে লিপ্ত হয়। এখানেও ব্যতিক্রম হয়নি। ঘরপোড়া, পুনরায় সর্বহারা হওয়া রোহিঙ্গাদের অনেকেই লুটপাটের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশে উদ্বাস্তু জীবনে প্রাপ্ত সাহায্য থেকে তিলে তিলে গড়া সংসারের খুটিনাটি জিনিসসহ প্রয়োজনের প্রায় সবই হারিয়েছে তারা। বেড়েছে কিশোরী মেয়েদের নিরাপত্তা ঝুঁকি। ফলে রোহিঙ্গা বাবা-মায়েরা এই মেয়েদেরকে অন্যান্য ক্যাম্পে পরিচিত ও আত্মীয় রোহিঙ্গাদের কাছে রেখে এসে পুড়ে যাওয়া বাসস্থানে পরিবারের অপেক্ষাকৃত বয়স্ক সদস্যদের নিয়ে সাহায্যপ্রাপ্তির তদারকি করছেন।

অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপকতা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। কক্সবাজার এজুকেশন সেক্টরের ২৫ মার্চ ২০২১-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ১৩৫টির ওপরে শিক্ষাকেন্দ্র, ২৬টির বেশি কম্যুনিটি বেসড লার্নিং সেন্টার এবং এদের আন্ডারে প্রায় ১৪ হাজারের কাছাকাছি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১১ জনের মৃত্যু, কিছু শিশুর হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প হলেও ভেতরে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থাকায় সেগুলো পুড়ে গিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। বৈষয়িক ক্ষতির পাশাপাশি সবচেয়ে বড় ক্ষতির সম্মুখীন তারা হয়েছে মানসিকভাবে। রোহিঙ্গাদের ভাষ্যমতে, ২০১৭ সাথে মায়ানমার থেকে যে বীভৎস স্মৃতি নিয়ে তারা নাফ নদীর এপারে এসেছিল, সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তাদেরকে পুনরায় সেই অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে।

মার্চ ২৩, ২০২১

বালুখালির পানবাজার সংলগ্ন ৯ নম্বর ক্যাম্পের ভেতরে প্রবেশের পর যে অভিজ্ঞতা হল তার জন্য কেউই প্রস্তত ছিল না। দিগন্তবিস্তৃত খোলা প্রান্তরে তখনও থেকে থেকে বিভিন্ন জায়গায় আগুন জ্বলছে, কোথাও ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। কোথাও কোনও স্থাপনার চিহ্নমাত্র নেই। ক্যাম্পের গুটিকতক গাছ কালো পোড়া শরীরে ন্যাড়া ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে হাহাকার এবং কান্না। আগুন ছড়িয়ে যাবার পর প্রাণ বাঁচাতে বিভিন্ন দিকে চলে যাওয়া রোহিঙ্গারা ফিরে আসছে, পরিবারের হারিয়ে যাওয়া সদস্যকে খুঁজছে। কেউ পিপাসায় অস্থির, কেউ বা ক্ষুধায়। মাথার ওপরে সূর্য একটু বেলা হতেই প্রায় ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা উদগীরণ শুরু করল। পরনের একমাত্র কাপড়খানি সম্বল করে পোড়া টিন হাতড়ে টুকিটাকি সাংসারিক জিনিস খুঁজে হয়রান নারীদের কেউ কেউ ক্লান্ত হয়ে ছাইয়ের ওপর বসে পড়েছে। মাথার ওপর কেবল খোলা আকাশ। ক্যাম্প ম্যানেজমেন্ট, উন্নয়ন সংস্থার লোকজন, স্থানীয় লোকজনও ভীড় বাড়িয়ে ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপের উদ্দেশ্যে ততক্ষণে ক্যাম্পে স্ব স্ব তৎপরতা শুরু করে দিয়েছে। বেশ বড় আকারের দূর্যোগে ভয়াবহ ক্ষতির প্রভাব কাটিয়ে ওঠা কতটা কঠিন ও ধৈর্য্যের বিষয় তা বোধ এভাবে অনেকেই অনুধাবন করতে পারেনি। মানুষের ভেতর হতবিহ্বলতা ছিল চোখে পড়ার মতন। মুখ চেনা রোহিঙ্গারা দেখা হলেই কেঁদে ফেলছিল।একই সঙ্গে ‘মানুষ মানুষের জন্য’— এই বোধও ভেতরটা আর্দ্র করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

আগুনের সূত্রপাত আগের দিন গ্যাস সিলিন্ডার থেকে থেকে ঘটেছে শোনা গেলেও এত ব্যাপকহারে ছড়িয়ে যাওয়ার নেপথ্যে বেশ কিছু কারণ অনুমান করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে কোন্দল ও বিভাজন আছে। আছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। কেউ কেউ ভাসান চরে পুনর্বাসনের বিপক্ষে, কেউ সন্ত্রাসীদের পক্ষে। বালুখালির আগুন নিভে গেছে। তবে ‘আগুন’ এখনও নেভেনি। ২২ তারিখের পর থেকে দফায় দফায় বেশ কয়েকটি ক্যাম্পে আগুন লাগানো, মারামারির ঘটনা ঘটে, এখনও ঘটছে। রোহিঙ্গা, ক্যাম্প ম্যানেজমেন্ট অর্থাৎ বাংলাদেশ সরকার সতর্ক থাকায় সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে বড়সড় ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। রোহিঙ্গাদেরকে রান্নার জন্য প্রতিটি শেল্টারে গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহ করা হয়েছিল যা অগ্নিকাণ্ডের সময় আরও বেশি বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। ২২ মার্চ তারিখ আনুমানিক সাড়ে তিনটা থেকে চারটার মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হলেও কক্সবাজারের সবগুলো ফায়ার সার্ভিস ইউনিট একযোগে কাজ করেও রাত একটার আগে আগুন নিয়ন্ত্রণে নিতে হিমশিম খেয়ে গেছে। পাহাড়ি ও শুষ্ক এলাকা হওয়ায় নির্বাপণে ব্যবহারযোগ্য সহজ পানির সহজলভ্য উৎস না থাকা, শেল্টারগুলো অত্যন্ত দাহ্য হওয়ায় এবং সঙ্কীর্ণ অলিগলি ভর্তি ঘিঞ্জি ক্যাম্পের সকল স্থানে দ্রুত ফায়ার সার্ভিসের যন্ত্রপাতিসহ প্রবেশে বাধা পাওয়ার ফলে ধ্বংসের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেছে।

অগ্নিকাণ্ডের শিকার রোহিঙ্গাদের জীবনে নেতিবাচক মাত্রা যোগ করেছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। গড়ে প্রায় পঁচিশ থেকে ত্রিশটির মতো পরিবারের ব্যবহারের জন্য এক বা দুটি টয়লেটও অবশিষ্ট না থাকায় হাজার হাজার পরিবার খোলা স্থানেই মলত্যাগসহ অন্যান্য দৈনন্দিন কর্মে বাধ্য হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম (ডব্লিউএফপি) প্রতিদিন রান্না করা খাবার সরবরাহ করলেও গরমে উচ্চ তাপমাত্রার কারণে মান শেষপর্যন্ত ঠিক রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবারভর্তি ওয়ান টাইম প্যাকেটগুলো ড্রেনেজ সিস্টেমের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। টিউবওয়েলগুলো লোহার হওয়ায় এর ভেতরের রাবার পুড়ে গেলেও সেগুলো বদলে অধিকাংশ কল থেকে খাবার এবং ব্যবহারের পানি পাওয়া যাচ্ছে, যদিও তা চাহিদার তুলনায় একেবারেই পর্যাপ্ত নয়। পরনের কাপড় না থাকায় ময়লা পোশাকে অনেকেই অস্বাস্থ্যকরভাবে দিন কাটাচ্ছেন। ঘনবসতিপূর্ণ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আগ্নিকাণ্ড্বের পর জনসমাগম বৃদ্ধি পাওয়ায় কোভিড-১৯ আউটব্রেকের আশঙ্কাও রয়েছে। তবে আশার কথা হলো জাতিসঙ্ঘ, সরকার, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সাহায্য আসা শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ঠাই গ্রহণের জন্য অস্থায়ী শেল্টারের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। বিছানা ও দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী যাতে সুশৃঙ্খলভাবে সকল ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গা পেতে পারে এর জন্য পরিকল্পনামাফিক এগোনোর চেষ্টা সংশ্লিষ্ট সকল তরফেই বিদ্যমান। পাশাপাশি কোভিড-১৯ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ সকলকে দেওয়া হয়েছে।

জন স্টেনটনের জেনোসাইডের ধাপগুলো শুরু হয়েছে শ্রেণিবিভাজন দিয়ে আর শেষ হয়েছে ডিনায়াল অর্থাৎ অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে যার প্রতিটিই মিলে যায় ১৯৭১-এ বাংলাদেশে সংঘটিত বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ গণহত্যার ধাপগুলোর সঙ্গে এবং একইভাবে মায়ানমার কর্তৃক রোহিঙ্গাদেরকে সমূলে বিনাশের প্রক্রিয়ার সঙ্গে। মায়ানমার থেকে আগত হত্যা ও নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেওয়ার নেপথ্যেও রয়েছে একাত্তরে আমাদের শরণার্থী পূর্বপুরুষদের নস্টালজিয়া আর মানবিক বিপর্যয়ে পাশে দাঁড়ানোর মানসিকতা। অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতার পরেও পূর্বেকার ন্যায় সহমর্মিতা এবং পাশে থেকে মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলার শক্তি ও সাহস জোগানো। রোহিঙ্গাদের একদিন নিজস্ব পরিচয় হবে, নিজভূমে ফিরে যাবে এমন প্রত্যাশা বরাবরের। যেমনটি আমরা পেরেছিলাম। তবে রোহিঙ্গাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানানরকম প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থন্বেষী গোষ্ঠী যাতে রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তাদেরকে ভুলপথে চালিত করতে না পারে সেদিকে সার্বক্ষণিক নজরদারির বিকল্প নেই।