Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অঞ্জন মণ্ডলের লেখা

অঞ্জন মণ্ডল

 

আমাদের বাড়িতে এক কাজের মাসী ছিল। অনেক বাড়িতেই থাকে। তাদের প্রকারভেদ থাকে। বনেদী কাজের মাসি, ঠিকে কাজের মাসি, সদ্য বিয়ে হওয়া কাজের মাসি। কেউ পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে সুখী সংসারের ছবি নিয়ে গল্পগাছা করেন, তাদের হাতে থাকে পূজোপার্বণের তাগাতাবিজ, একটা ইমিটেশান কি সোনার বালা। এরা ঠাকুমার আমল থেকে কাজ করছেন। সরকারি আমলা প্রায়। এদের চটালে চাপ আছে। বাড়ির নতুন বৌ-ঝিদের এনারা শেখান পড়ান। সংসারের হায়ারার্কিতে এরা অনেক জ্যাঠাইমাদের ঠিক নিচেই। ঠিকে মাসিরা ঠিক আই টি প্রফেশনাল। তরতর করে কাজ করে, ফুরফুর করে হাসে। ছুটিছাটা লেগেই আছে। লয়্যালিটি বড্ড কম। উচ্চাকাঙ্ক্ষী।

আমাদের মফস্বলের নোনা ধরা ঘরের মাসি অন্যরকম ছিল। অন্ত্যজ। খড়ি ওঠা খয়েরি চামড়া। মাথার ছোট খুলিতে কিছু তেল ছাড়া বাদামী চুল হাওয়ায় উঁচু হয়ে থাকে। চোখ দুটো কোটরগত। ছেলেমেয়েদের অপুষ্টিতে পেট ফোলা। দু’বছরের ছেলের নাম হেমন্ত। কোলে কাঁদে সবসময়। মেয়ে পাঁচ বছরের। নাম সাবিত্রী। দিনে দু’বেলা খায়। হ্যাঁ, ঠিক দু’বেলা খেতে পেত। সকালে এসে চা দিয়ে আগের দিনের বাসি রুটি তিনজনে খেত। আর দুপুরবেলার ভাত ভাগাভাগি করে রাত্রে আর দিনে খেত।

তো সেই সাবিত্রীর মা একদিন পুকুরধারে বাসন মাজতে গিয়ে কুড়িয়ে পেল সোনার আংটি। বিশাল কিছু না হলেও, পঁচানব্বই সালে তার দাম ন’হাজার টাকা তো বটেই। ও হ্যাঁ, সাবিত্রীর মায়ের মাস মাইনে ছিল পঁচাত্তর টাকা। মফস্বলের ক্যাশিয়ারবাবুর বাড়িতে ঝিয়ের পেছনে পঁচাত্তর টাকাটাও একটা বড় বিলাসিতা। সাবিত্রীর মা আংটিটা তো পেল, পেয়ে পড়ল মহা ফাঁপড়ে। সে প্রসেনজিত, রঞ্জিত মল্লিক, ভিক্টর সবার সিনেমাই দেখে থাকে। গ্রামের ভিডিও হলে (প্রবেশ মূল্য: চার আনা) সন্ধেবেলা সে নিয়মিত দর্শক। সবই প্রায় কাঠুরের কুড়ুল হারানোর গল্প। সিনেমায় ছোট ছেলে অভিষেক বাবা-মাকে দেখে না, বড় ছেলে প্রসেনজিত/চিরঞ্জিত বাবা-মাকে মাথায় তুলে রাখে। শেষে বড় ছেলেরই উন্নতি ও জয়। ধর্মের জয়ে সাবিত্রীর মা থুতু লাগা কষ ফাটা ঠোঁটে হাসে। মাঝে মাঝে টিভিতে আসে বাবা লোকনাথ, তারা মা। দেবদেবীরা ছলনা করেন, পরীক্ষা নেন জীবনের। যে দুঃখ কষ্ট সয়ে সেই লোভ জয় করে; তার জন্য ষষ্ঠী ঠাকরুন সাজিয়ে রাখেন সোনার পালঙ্ক, রুপোর পানের বাটা, বানর ছেলে সোনার চাঁদ হয়, দুয়োরাণীর মাথায় মুকুট ওঠে। সতীন অন্ধ হয়… কী জানি সাবিত্রীর মায়ের মাথায় কী চিন্তা ভর করে?

সেদিন দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে উঠে একগাল হেসে সে আমার মাকে এসে বলে, “আপনি আমার পরীখ্যা (পরীক্ষা) লিছিলেন। লয়?” আমার মা আকাশ থেকে পড়ে। সাবিত্রীর মা আংটিখানা বের করে দেয়। মা তাকে যত বোঝাবার চেষ্টা করে তার সততার কোনও পরীক্ষাই মা নিচ্ছিল না, আর এভাবে সোনার আংটি সামনে ফেলে রেখে পরীক্ষা নেওয়াটা বেশ রিস্কি… সে ততই মিটমিট করে হাসে। যেন সে ঠিক জানে এবার মালকিন রহস্যটা প্রকাশ করে বলবে তোমার সততায় আমি মুগ্ধ.. এই নাও তোমার রাজ্যপাট, তোমার সুখ, তোমার প্রাপ্য, তোমার কষ্টের দাম, নিয়ে যাও এই আংটি। এই তোমার পুরস্কার।

সেসব কিছুই হল না। মা খুশি হয়ে তাকে ত্রিশ টাকা বের করে দিল। পঁচাত্তর টাকার ঠিকে ঝিকে এর থেকে বেশি দেওয়ার বাজেট আমাদের ছিল না। কিন্তু এই আংটি আদতে তার প্রাপ্য ছিল। অন্যমনস্ক মধ্যবিত্ত গৃহিণীর এই আংটির প্রয়োজনের তুলনায় তার প্রয়োজন অনেক বেশি ছিল। তবু সে মহৎ কোনও সকালের আশায় আংটি ফেরত দিল এবং ফেরত দিয়েই বুঝল সে বোকামি করেছে। তার মহত্ব, তার বিবেক, তার প্রসেনজিত, তার রঞ্জিত মল্লিক সবাই তাকে বঞ্চিত করেছে আসলে।

আহত হয়ে সে ত্রিশ টাকাটাই নিয়েছিল। যেন আরও পুরস্কার চাইতে গেলে তার সততার গর্বও ছোট হয়ে যাবে। যেন সে পুরস্কারের আশায় তো ফেরত দেয়নি। মনিবরা দেখুক ট্রান্সলেশানের সেই আপ্তবাক্য: সাবিত্রীর মা গরীব অথচ সৎ।

এসব কিছুই মনে থাকার কথা ছিল না আমার। সাবিত্রীর মায়ের আংটি ফেরত দিয়ে গর্বিত মুখ, তিরিশ টাকা হাতে পেয়ে ভেবলে যাওয়া, হতাশায় চিবিয়ে যাওয়া রুটি। বিশ্বাস করুন কিছুই মনে ছিল না। তার অলীক বিশ্বাস, সাবিত্রীর মায়ের টিবিতে মরে যাওয়া। কিছুই মনে থাকার কথা ছিল না। আজ এটিএম-এ লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। হাতে আমারই গোলাপী রঙের চারটে আচ্ছে দিন। আর সেসময় দেখলাম কোথাকার কোন বোকা সৈনিক রুটির ছবি টবি দিয়ে কীসব ভিডিও পোস্ট করেছে। যাদের কেউ নেই তাদের রঞ্জিত মল্লিক আছে।