Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

হাজার বছর পরে

অদ্বয় চৌধুরী

—এই হল সেই বস্তু। এর নাম ছিল ‘চশমা’।

বক্তা ঘোষণা করেন। তাঁর ডান হাত শূন্যে ভাসমান একটি ‘চশমার’ দিকে ইশারা করে। অশ্রাব্য শব্দতরঙ্গের উপরে ভাসমান ‘চশমাটি’ ধীরে ধীরে ঘুরতে থাকে। বিরাট হলঘরে কানায় কানায় ভর্তি মানুষ নির্বাক হয়ে দেখতে থাকে ‘চশমাটিকে’। একটি রিমলেস ফাইবারের চশমা, ছোটো চৌকো ফ্রেমের। সরু স্টিল কালারের হ্যান্ডল, মাথার দিকটায় খয়েরি রঙের কভার। আলো পড়লে চশমার কাচের রং বদল হয়। বক্তা বেশ খানিকক্ষণ সময় দেন ‘চশমাটি’ দেখার জন্যে। তারপর আবার কথা বলতে শুরু করেন।

—আমাদের দেশের উত্তর-পশ্চিম ভাগে যে সুবিশাল অনুর্বর ভূমি রয়েছে সেই ভূমি খননের মাধ্যমে এই বস্তুটি আবিষ্কৃত হয়। আমাদের যাবতীয় তথ্যভাণ্ডার ঘেঁটে বিভিন্ন সূত্র কাজে লাগিয়ে আমরা এর সঠিক নাম সম্বন্ধে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। ‘চশমা’।

বস্তুটির নাম আরও একবার উচ্চারণ করে বক্তা আবার তাঁর ডান হাত ওই ভাসমান বস্তুটির দিকে ইঙ্গিত করেন। গোটা হলঘর নিস্তব্ধ। বক্তা নিজের নীরবতার মাধ্যমে তাঁর সামনে উপস্থিত বিশাল জমায়েতের স্তম্ভিত নীরবতা মাপতে থাকেন। তারপর আবার বলতে শুরু করেন।

বিশেষ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি এই বস্তুটি আজ থেকে আনুমানিক হাজার বছর আগে ব্যবহৃত হত। আমাদের ধারণা, কোনও ভূমির শীর্ষব্যক্তি থেকে শুরু করে একেবারে নিম্নবিত্ত মানুষ সকলেই এই ‘চশমা’ ব্যবহার করতেন। তবে ‘চশমার’ অন্তর্বর্তী ক্ষমতার তারতম্য থাকত। সবাই সমান অন্তর্বর্তী ক্ষমতাসম্পন্ন ‘চশমা’ ব্যবহার করতেন না। এবং এই অন্তর্বর্তী ক্ষমতার উপরেই নির্ভর করত ‘চশমার’ ব্যবহারিক প্রয়োগ। হ্যাঁ, ‘চশমার’ একটি বিশেষ ব্যবহারিক প্রয়োগ ছিল। বলা যায়, ওই ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্যেই ‘চশমার’ প্রচলন হয় আজ থেকে আনুমানিক হাজার বছর পিছিয়ে থাকা মানুষের মধ্যে। এবং ‘চশমার’ সেই বিশেষ ব্যবহারিক প্রয়োগই আজ আমাদের সকলকে এই বিশেষ সভায় হাজির করেছে। সেই বিশেষ ব্যবহারিক প্রয়োগই এক কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে আমাদের। এবং সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হবে আপনারা সহমত হলে তবেই। এই সভার মূল উদ্দেশ্য আপনাদের মতামত গ্রহণ।

বিরাট হলঘরে সামান্য গুঞ্জন ওঠে। বক্তা আবার মেপে নেন জনতার প্রতিক্রিয়া।

—না হ’লে আমাদের সামনে ঘোর বিপদ হাজির হতে পারে। আমরা একেবারে ধ্বংস হয়ে যেতে পারি। ঠিক যেমন আনুমানিক হাজার বছর আগে এই এলাকার মানুষ আত্মধ্বংসের মাধ্যমে নিজেদের প্রায় নিঃশেষ করে ফেলেছিল। যে কতিপয় মানুষ তারপরেও বেঁচে ছিল তাদেরই ঔরসজাত সন্তান আমরা। কিন্তু আমরা বুদ্ধি, মেধা, অনুভূতি, আত্মচেতনায় অনেক অনেক উন্নত। সেই কারণেই আমরা ঘৃণা করি ‘চশমার’ বিশেষ ব্যবহারিক প্রয়োগ যা সেই সময়ের মানুষের কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং তাদের এই ‘চশমা-প্রীতি’ আমাদের আজ তাদের প্রতি, নিজেদের পূর্ব-পুরুষদের প্রতিই ঘৃণার উদ্রেক ঘটাচ্ছে।

বিপুল জনরাশির বাঁধভাঙা কৌতূহল ধীরে ধীরে আকার পেতে শুরু করে। শব্দ ওঠে। বক্তা হাত তুলে থামতে বলেন সবাইকে। তারপর আবার কথা শুরু করেন।

—আনুমানিক হাজার বছর আগে আমদের পূর্বপুরুষেরা এই ‘চশমা’ ব্যবহার করতেন মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন করতে, ধর্মের রঙিন কাঁচে নিজেদের দৃষ্টি ঝাপসা করে তুলতে। যখনই ভূমিনেতৃত্বের সঠিক অর্থে উপযুক্ত রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা, বক্তব্য ও আদর্শের অভাব হত, তাঁরা এই ‘চশমা’ ব্যবহার করে ধর্মের ভিত্তিতে একদল মানুষকে অন্য একদল মানুষের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতেন। তঁদের দেখাদেখি একেবারে প্রান্তিক মানুষরাও এই ‘চশমা’ ব্যবহার করতে শুরু করত তখন। এইভাবেই রাজনৈতিক অদক্ষতা ঢাকতে, রাজনৈতিক অবক্ষয়ের কারণে আত্মধ্বংসের মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রায় অবলুপ্ত করে তুলেছিল।

এতটা বলে বক্তা এবার থামেন। লক্ষ করেন তার সামনে উপস্থিত জনগণের হতভম্ব প্রতিক্রিয়া। বক্তা এবার গম্ভীর হয়ে ওঠেন।

—আমাদের সৌভাগ্য যে আজ আর আমাদের এই ‘চশমার’ কোনও ব্যবহারিক প্রয়োজন নেই। আমরা নিজেদের অনেক অনেক উন্নত রাজনৈতিক চেতনার স্তরে নিয়ে যেতে পেরেছি। কিন্তু তারপরেও আমাদের ভয় হয়, এই আবিষ্কৃত ‘চশমাটি’ যদি আমাদের মধ্যে বিরাজ করে, হয়তো আমাদের মধ্যে থেকে কোনও একজন, কোনও একদিন, এটি ব্যবহার করতে শুরু করবে, এবং আমরাও আবার আত্মধ্বংসের পথে এগিয়ে যাব। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই ‘চশমাটি’ ধ্বংস করে ফেলব। হ্যাঁ, অত্যন্ত দুর্লভ কোনও আবিষ্কার ধ্বংস করা আমাদের নীতিবিরুদ্ধ, কিন্তু নিজেদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সুরক্ষার কারণেই এই ‘চশমাটি’ ধ্বংস করা আশু প্রয়োজন। এবার আপনারা নিজেদের মতামত জানান, যার ভিত্তিতে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত উঠে আসবে। আমার যাবতীয় বক্তব্য এখানেই শেষ। এবার জনগণ, আপনারা বলুন।

বক্তার বক্তব্য শেষ হয় একটি শব্দবিস্ফোরণের মাধ্যমে। তারপর যে অদৃশ্য শব্দতরঙ্গের উপর ‘চশমাটি’ ভাসমান ছিল, সেই তরঙ্গ স্তব্ধ হয়ে যায়, এবং ‘চশমাটির’ পতন ঘটে মাটির উপরে। জনতার উল্লাসধ্বনির আড়ালে আর কোনও শব্দ শোনা যায় না।