Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আমাদের কবিতাপড়া

আমাদের কবিতাপড়া -- শঙ্খ ঘোষ

শঙ্খ ঘোষ

 

চলে গেলেন শঙ্খ ঘোষ। অথবা তিনি গেলেন না। কবিরা কোথাও যান না, মৃত্যু হয় না তাঁদের। তাঁদের ছায়া দীর্ঘতর হয় শুধু। শঙ্খ ঘোষের যে বিপুল ও সংবেদনময় সৃষ্টি আমাদের সঙ্গে রয়ে গেল, তার মধ্যে আরও বেশি করে রয়ে গেলেন তিনি। সেই অনিঃশেষ সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা আরেকবার আবিষ্কার করব তাঁকে। তাই গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজার ছলে, এই সংখ্যার স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে আমরা ফিরে পড়লাম শঙ্খ ঘোষের একটি পুরনো প্রবন্ধ, ‘কবিতা পড়া’, ১৯৮৬ সালে লিখিত। প্রবন্ধটি সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে পুনঃপ্রকাশিত 'কবিতালেখা কবিতাপড়া' (২০১৭) গ্রন্থ থেকে গৃহীত।

প্রায় পঁচিশ বছর আগে, একালের এক বড়ো আমেরিকান কবি অ্যালেন গিনসবার্গ এসেছিলেন কলকাতায়। তখনকার দিনের কয়েকজন তরুণ কবির সঙ্গে অল্প সময়ের বৈঠকে প্রথমেই প্রশ্ন করেছিলেন তিনি: ‘কাল রাত্রে ঘুমোবার আগে কার কবিতা পড়েছ তোমরা?’

এ প্রশ্নের কী উওর হয়েছিল, সেটা এখানে তত জরুরি বিষয় নয়। এখানে লক্ষ করবার বিষয় হলো প্রশ্নের অন্তর্গত এই প্রত্যাশা যে, কাব্য-প্রেমিকরা প্রতিদিনই কোনও না কোনও কবিতা পড়বেন। এ প্রত্যাশায় নিশ্চয়ই আতিশয্য আছে। নিয়মিত দৈনন্দিন মন্ত্রপাঠের মতোই নিয়মিত কাব্যপাঠ করবেন কেউ, এ রকম দাবি করবার কোনও মানে নেই। কিন্তু এই জিজ্ঞাসার সূত্র ধরে আমরা অনেকেই নিজেদের কাছে ভিন্ন একটা প্রশ্ন তুলতে পারি: ‘গত একমাসে কি কারো কবিতা পড়েছি আমি? কার কবিতা? কোন কবিতা? যদি এক মাসে না পড়ে থাকি, তিন মাসে? গত পাঁচ মাসে? এক বছরে?” প্রশ্নটাকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে প্রায় এইখানে নিয়ে যাওয়া যায়: ‘কখনওই কি কবিতা পড়তে চেয়েছি আমি? পড়তে চাই?’

প্রথমে সকলেই ভাববেন যে, এর উত্তর এতই স্বতঃসিদ্ধ যে বলবারও দরকার পড়ে না। কবিতা পড়তে কে না চায়! কে না পড়ে কবিতা! এইরকমই প্রথমে মনে হবে আমাদের। কিন্তু একটু আত্মবিশ্লেষণের দিকে এগোলে হয়তো দেখা যাবে যে কথাটা ততটা স্বচ্ছ নয়। নিজেদের যারা আমরা সাধারণ পাঠক বলে ভাবি, তাদের অধিকাংশের অভিজ্ঞতাকে যদি বিচার করে দেখি, তাহলে ভিন্নতর সত্যের মুখোমুখি হওয়া সম্ভব।

গল্প উপন্যাস পড়েন, তথ্যাশ্রয়ী বা তত্ত্বাশ্রয়ী গদ্যরচনাও পড়েন, এমন পাঠক বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতে পারেন কোনও কবিতার বই না ছুঁয়ে। কবিতা যে তিনি কখনও পড়েননি, তা নিশ্চয়ই নয়। স্কুল-কলেজের পাঠক্রমে বাধ্য হয়েই কিছু কবিতা তাঁকে পড়তে হয়েছে। কবিতা কখনও যে তিনি শোনেননি তা নয়, নানা সভায় অনুষ্ঠানে জলদগম্ভীর আবৃত্তি থেকে অনেক কবিতা তাঁর শোনা হয়ে গেছে। কিন্তু এই বাধ্যতা বা আকস্মিকতার বাইরে, কেবলই নিজের আগ্রহে নিজের আনন্দে নিরিবিলি কবিতা পড়তে বসেছি, কোনও বই খুলে, এমন অভিজ্ঞতা আমাদের কতজনের আছে?

আমাদের ঠাকুমা-দিদিমাদের একটা কাল ছিল, যখন অবসর সময়ে তাঁরা বসতেন কৃত্তিবাস বা কাশীরাম দাস খুলে কিংবা কোনও মঙ্গলকাব্য বা চৈতন্যজীবনী। লক্ষ করতে হবে যে সেও তো ঠিক কবিতা নয়, ছন্দোবদ্ধ গল্পকথা মাত্র। আজ তাই সহজেই তার জায়গা করে নিতে পারে গল্পোপন্যাস, ছন্দ থেকেই অনেক দূরে সরে যায় সাধারণের অভ্যাস৷ মেনে নিতে প্রথমে একটু অসুবিধা হলেও, একথা সত্যি যে সাধারণভাবেই আমরা কবিতাবিমুখ।

কবিতাবিমুখ? রবীন্দ্রনাথের দেশে? আমরা কি অবিরতই রবীন্দ্রনাথ পড়ছি না? হয়তো সত্য অর্থে তাও পড়ছি না। রবীন্দ্রনাথের গান আমরা শুনি, তাঁর নৃত্যনাট্য আমরা দেখি, তাঁর কোনও কোনও গল্প বা দু চারটি উপন্যাস আমরা পড়ি। আর কবিতা? কবিতাও কিছু পড়ি বটে (কিংবা পড়েছি অনেকদিন আগে), কিন্তু কোন সে কবিতা? ‘বীরপুরুষ’ বা ‘লুকোচুরি’ মতো শিশুতোষ কবিতা কয়েকটি, ‘অল্পেতে খুশি হবে দামোদর শেঠ কি’-র মতো হালকা ছড়া কিছু, ‘কথা ও কাহিনি’র ইতিহাসমিশ্রিত কবিতাগুলি কিংবা আরেকটু এগিয়ে এসে ‘এবার ফিরাও মোরে’, ‘শা-জাহান’, ‘পৃথিবী’, ‘আফ্রিকা’, ‘ওরা কাজ করে’, ‘সাধারণ মেয়ে’, বা ‘ক্যামেলিয়া’র মতো আবৃত্তিধন্য কয়েকটি রচনা- এই হলো আমাদের রবীন্দ্রকাব্য পাঠের ইতিবৃত্ত। এ তালিকাকে আরেকটু প্রসারিত করা যায় নিশ্চয়, বিশেষত সম্প্রতিকালে আবৃত্তিশিল্পের ব্যাপক প্রচারের ফলে আরও কিছু নতুন কবিতার সংগ্রহ বাড়াতে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ থেকেও। কিন্তু এ তালিকাকে লক্ষ করলে আমরা বুঝতে পারবো, কবিতারও ঠিক সেইদিকে আমাদের প্রধান ভর যেখানে কোনও গল্প আছে, কিংবা বর্ণনা আছে, কিংবা একটা বাগ্মী ধরণ আছে। অর্থাৎ, আমাদের কবিতাবিমুখতা অল্পস্বল্প কেটে যায় কেবল তখন, যখন আমরা হাতের সামনে পাই কোনও ছন্দোবদ্ধ কাহিনি বা ছন্দোবদ্ধ বর্ণনা বা ছন্দোবদ্ধ ঘোষণা।

কিন্তু যিনি কবি, তিনি তো কেবল এই কাহিনি বা বর্ণনা বা ঘোষণার মধ্যে নিজেকে নিবদ্ধ রাখতে পারেন না। ‘কে কবি’– ক’বে কে মোরে’ — এই প্রশ্ন একদিন তুলেছিলেন মধুসূদন। ‘শবদে শবদে বিয়া দেয় যেই জন’ সেই পদ্যকারকে তিনি কবি বলেননি, ‘কল্পনাসুন্দরী/ যা’র মনঃকমলেতে পাতেন আসন’ তাঁকেই তিনি কবি বলে মানতে চেয়েছিলেন। এই কল্পনা সমস্ত জগৎজীবনকে ব্যাপ্ত করে ছেয়ে থাকে। এরই আভার মধ্যে দিয়ে কবি আমাদের পরিচিত দৈনন্দিন জীবনের  পরিধিতেও একটা অপরিচয়ের দ্যুতি পেয়ে যান, অনেক সাধনাবেদনার তরঙ্গকে তিনি ছুঁতে পান আমাদের চারদিকের পরিবেষ্টনের মধ্যেই। সেই অস্ফুটকে স্ফুটতর করে তোলা, সেই অব্যক্তকে ব্যক্ত করে তোলার মধ্যেই কবির যে শ্রান্তিহীন অভিযাত্রা, সেইখানেই আছে তাঁর কবিতার মর্মমূল। বড়ো শিল্পী যিনি- সে ছবির শিল্পই হোক, সুরের শিল্পই হোক, কথার শিল্পই হোক — তিনি যে নিজেকে তাঁর শিল্পরূপের মধ্যে প্রকাশ করতে চান সে তো এক স্বপ্নের আবেশ থেকে। এই যে তাঁর জীবন, আকস্মিক জন্ম আর আকস্মিক মৃত্যুর মধ্যবর্তী এই যে তাঁর বাঁচার অভিজ্ঞতা, এর কি কোনও তাৎপর্য আছে? চারপাশের মানুষের সমাজের সঙ্গে, চারপাশের প্রকৃতির বিস্তারের সঙ্গে অথবা মহাসৃষ্টির এই ঘূর্ণ্যমান বলয়ের সঙ্গে কোথায় তাঁর যোগ, কী তাঁর সম্পর্ক? এই সমাজ, এই প্রকৃতি, এই সৃষ্টি কোথায় চলেছে, কোন পথে কোন পরিণামের দিকে? আছে কি কোথাও কোনও পরিণাম? এইসব প্রশ্নকে ভিতরে ভিতরে প্রচ্ছন্ন রেখে প্রতিমুহূর্ত-যাপনের একটা রূপরেখা তৈরি করে যান কবি, আর তৈরি হয়ে উঠবার পর দেখি যে সেই রূপরেখার মধ্যে গাঁথা হয়ে আছে আমারই অভিজ্ঞতার, আমারই অনুভবের, আমারই বেদনার কত প্রত্যক্ষতা। তখন আমরা বুঝতে পারি যে কবিতা শুধু ছন্দের কারুকাজ নয়, কবিতা শুধু শব্দের সুবিন্যাস নয়, কবিতা শুধু প্রতিশ্রুতি বা পরিকল্পনার ঘোষণা নয়, যদিও এর সবই কবিতার বহিরাবয়বকে ধরে রাখে কখনও কখনও। কবিতা হলো তা-ই যার মধ্য দিয়ে আমাদের বেঁচে থাকাকে গভীরতম আর ব্যাপকতমভাবে ছুঁয়ে থাকতে পারি আমরা। কবিতা হলো তা-ই, যা আমাদের অধিচেতনা আর অবচেতনার সঙ্গে কেবলই যুক্ত করে দেয় আমাদের সময়ের চেতনাকে। কবিতা হলো তা-ই, যা আমাদের অতীত আর ভবিষ্যৎকে বর্তমানের একটা বিন্দুতে এনে বাঁধে। কবিতা যিনি পড়বেন, তাঁকে এগোতে হয় এরই বিশ্বাস থেকে, এরই আগ্রহ থেকে।

কিন্তু এখানেই আসে সংকট। সমাজগত, পরিবেশগত নানা প্রতিবন্ধকের কারণেই নিশ্চয় এটা ঘটে যে, আমরা অধিকাংশ মানুষ কেবল উপরিতলের ভাসমান একটা জীবনকে ছুঁয়ে থাকি শুধু, কায়ক্লেশে প্রাত্যহিক জীবনযাপনকেই বেঁচে থাকার চূড়ান্ত অবস্থান ভেবে নিশ্চিন্ত থাকি৷ দুধারে গর্জিত এই প্রবল বহমান সংসার এতই আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে যে, কোনও এক জীবনপ্রশ্নের দিকে পৌঁছবার আর কোনও সময় বা গরজ হয় না আমাদের। আর তা হয় না বলেই সেই শিল্পের প্রতি আমাদের আগ্রহ বা অভিমুখিতা কম, যথার্থ কবিতা থেকে তাই বেশির ভাগ সময়েই আমরা মুখ ফিরিয়ে থাকি। বোধের যে তন্ত্রে আঘাত করবে কবিতা, তাকে আমরা এতই অসাড় করে রাখি, অধিকাংশ সময়েই আমাদের প্রশ্ন, আমাদের উৎসুকতা, আমাদের আকাঙ্ক্ষা আর কল্পনা এতই ক্ষীণ হয়ে থাকে যে, শিল্পের জগৎ থেকে প্রায়ই যেন আমরা যক্ষের মতো নির্বাসিত। আর এই নির্বাসন থেকে, হঠাৎ-হঠাৎ কোনও বোধময় কবিতা পড়তে গেলে অনভ্যাসের চাপে তাকে আমরা মনে করি দুর্বোধ্য, যে দুর্বোধ্যতার দায়ে তাঁর সমকালে একদিন অভিযুক্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, , যে দুর্বোধ্যতার দায়ে পরে একদিন ধিক্কৃত হয়েছিলেন জীবনানন্দ। অন্তত এইসব ক্ষেত্রে যাকে আমরা দুর্বোধ্যতা বলে ভেবেছি, সে হলো আমাদের বোধকে জাগ্রত করে তুলবার অক্ষমতা, প্রশ্নহীনভাবে আমাদের জীবনযাপনের প্রবণতা। এর বাইরে এসে দাঁড়াতে পারলে হয়তো একদিন আমাদের সামনে খুলে যাবে

শিল্পের এক আশ্চর্য রংমহল, যেখানে পৌঁছবার পর গিনসবার্গের এই প্রশ্নেরও ত্বরিত একটা উত্তর দেওয়া সম্ভব হবে যে, ‘কাল রাতে ঘুমোবার আগে কার কবিতা তোমার পড়তে ইচ্ছে হয়েছিল?’ কেননা, কবিতা তখন হয়ে উঠবে আমাদের দিনযাপনেরই প্রগাঢ় পদ্ধতি।

*বানান অপরিবর্তিত