Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সীতায়ন থেকে শুরু যে দ্রোহকাল; মল্লিকা সেনগুপ্তর প্রবন্ধ ও উপন্যাস

সীতায়ন থেকে শুরু যে দ্রোহকাল; মল্লিকা সেনগুপ্তর প্রবন্ধ ও উপন্যাস -- রিমি মুৎসুদ্দি

রিমি মুৎসুদ্দি

 



গল্পকার, কবি, প্রাবন্ধিক

 

 

আমি যদি সমুদ্রকে পুরুষ বলি সেটাও মেয়েদের বিষয়, ধর্ষণ বা ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণ নিয়ে লিখি তো সেটাও, আবার যদি বলি ভারতে নিরস্ত্রীকরণের প্রথম প্রবক্তা ছিলেন সীতা, কারণ রাম যখন হাজার হাজার অনার্য রাক্ষসকে মেরে ফেলেছিলেন তখন সীতাই বলেছিলেন, ‘অকারণ রৌদ্রতা পুরুষকে হিংস্র করে।’

–পুরুষ নয়, পুরুষতন্ত্র, আমার কথা, মল্লিকা সেনগুপ্ত

২৭ মার্চ মল্লিকা সেনগুপ্তর জন্মদিন। সীতা আর ডেসডিমোনাকে তিনি এক পংক্তিতে রেখেছেন। তাঁর সাহিত্য রচনার বিশ্লেষণে ‘নারীবাদ’ শব্দটি ব্যবহার একেবারেই সঠিক নয়। তিনি মানবতাবাদের কথাই বলেছেন। মানবীবিদ্যা এই শাখার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। মল্লিকা সেনগুপ্তের কবিতা ও সমগ্র রচনায় এই স্বরটিই বারবার ধ্বনিত হয়েছে।

‘নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, কেউ-কেউ নারী হয়ে ওঠে।’ সিমোন দ্য বোভায়ার এই উক্তিটির নির্যাস তাঁর রচিত ‘পুরুষ নয় পুরুষতন্ত্র’ ও ‘স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ’ বই দুটোতে ও বহু আলোচনায়, বহু ব্যাখ্যায় ফিরে পাই। সীতা ও ডেসডিমোনার প্রসঙ্গে আসি। ‘স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ’ বইটিতে তিনি ডেসডিমোনার হত্যার সঙ্গে সীতার পাতালপ্রবেশের সাদৃশ্য তুলে ধরেন। দুটোই হত্যা। দুটোই পিতৃতন্ত্র দ্বারা সংঘটিত হত্যা। যে পিতৃতন্ত্র কেবল একটা ধারণা মাত্র। এই ধারণায় এঁকে দেওয়া গণ্ডীর মধ্যে নারী যতক্ষণ বিরাজ করছে ততক্ষণই সে পুরষদ্বারা সুরক্ষিত। যেমন ওথেলোর প্রত্যাশামতো ডেসডিমোনাকে হতে হবে, ‘সহ্যশীল, সরল, মুগ্ধ, নিশ্চিন্ত প্রেমিকা’। তা না হলে নারী সে সম্রাজ্ঞী হলেও পুরুষদ্বারা বধ্য।

সীতাকে জ্যান্ত কবর দেওয়ার কথা লিখেছেন তাঁর স্ত্রীলিঙ্গ নির্মাণ বইটিতে। আবার সীতায়ন উপন্যাসে তাঁর প্রোটাগনিস্ট ‘সীতা’ স্বয়ং এক দ্রোহ। অবাস্তব আদর্শের খোলস খুলে ফেলে একদিকে মল্লিকার সীতা ঘোষণা করছে, রামের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠ প্রেম পত্নীব্রতা ধর্মের জন্য নয়। কেবল ভালোবাসার জন্য এই একনিষ্ঠতা। অনুশাসন বা সমাজের নিয়ম নয় ভালোবাসাই একমাত্র সমর্পণের হেতু। বাল্মীকির কাছে সীতা অকপট স্বকীর করতে পেরেছেন, রাবণ তাঁকে ধর্ষণ করতে পারেনি কিন্তু শরীর ছুঁয়েছিল। উন্মাদের মতো তাঁর স্তনে মুখ ঘষতে ঘষতে রাবণ বলেছিল, ‘সীতা, সীতা, তুমি প্রসন্না হও। তোমার ঐশ্বর্য থেকে আমাকে কণামাত্রও দিলে আমি এই পৃথিবীর ঈশ্বর হব।’ শেষপর্যন্ত ব্রহ্ম অভিশাপের কথা স্মরণ করিয়ে তিনি রাবণকে নিবৃত্ত করেন।

মল্লিকার সীতা নির্ভীক। তাই তিনি অগস্ত্যকে প্রশ্ন করেছিলেন,

কেনই বা নারী ও শূদ্রকে স্বেচ্ছাধীন ধর্মাচরণ করতে দেবেন না আপনারা? এই আমি যদি এখন ঈশ্বরসাধনায় নিজেকে সমর্পণ করতে চাই, আপনি কি আমার স্বামীকে এনে দিতে পারবেন? পারবেন না আপনারা, তথাপি স্বামীর ধর্মসহচরীমাত্র করে রাখবেন নারীকে?

আজ এই ২০২১ সালে ‘লাভ জেহাদ’ একটা শব্দবন্ধ যাকে কেন্দ্র করে হিংসা উত্তেজনা, তত্ত্ব ও ইতিহাসের বিকৃতির মধ্যে দিয়ে একটা রাজনৈতিক দল চাইছে সমগ্র দেশকে পিছিয়ে নিয়ে যেতে আরও কয়েকশো বছর। মল্লিকা সেনগুপ্তের ‘সীতায়ন’ আজ সর্ব অর্থেই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।

শৈবল পর্বতে অরণ্যবাসী অনার্য শূদ্র শম্বুক তপস্যারত হলে অগস্ত্যমুনি সহ অন্যান্য মুনিরা রামচন্দ্রকে শম্বুকবধ করতে প্ররোচিত করছেন। এই সংবাদটি পেয়ে বাল্মীকিমুনি শৈবলপর্বতে শম্বুক দর্শনে যেতে চাইলেন। উদ্দেশ্য যুবক অনার্যপুত্রটিকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তপস্যা থেকে বিরত করবেন। বাল্মীকি নিজের অতীত স্মৃতি বিস্মৃত হননি। হিংস্রতার পথ যে ভয়াল আর আত্মধ্বংসী তা তিনি জানেন। তাই শম্বুকবধ থেকে রামচন্দ্রকে বিরত করার কোনও উপায় না পেয়ে তিনি শঙ্কিত।

রামচন্দ্রের সঙ্গে অরণ্যবাসের সময় সীতা তাঁর স্বামীর কারণে অকারণে অনার্যনিধন সমর্থন করেননি। সীতার মুখে উচ্চারিত হয়েছিল অধিকার ও ন্যায়বোধের কথা।

অনার্য মানুষগুলি যুগ যুগ ধরে অরণ্যভূমির বাসিন্দা ছিল। ওই অরণ্যের ইঙ্গুদি, আমলকি, বিল্ব খেয়ে তাদের পিতৃপুরুষেরা বেঁচে থেকেছে, তারাও ওই ফলের অধিকারী। শুষ্ক বৃক্ষ থেকে তারা সহস্রবছর ধরে অরণি সংগ্রহ করেছে। ওই তমসা, সরযূ, গঙ্গা মন্দাকিনীর জল থেকে চিরদিন তারা মৎস্য শিকার করেছে। কিন্তু আর্য ঋষিরা জনপদ ত্যাগ করে অরণ্যভূমি অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে বনের ঐশ্বর্যে টান পড়ল। অনার্যদের খাদ্যের উৎস কমে গেল। অরণ্যের অধিকার যদি তারা ছাড়তে না চায়, দোষ দিতে পারেন কী?

শম্বুকবধের আয়োজনের খবর পিতা বাল্মীকির মতো সীতাকেও বিচলিত করেছিল। মহর্ষির সঙ্গে তিনি নিজেও শম্বুক দর্শনে সঙ্গী হতে চেয়েছিলেন। অথচ বাল্মীকি তাঁকে যুগধর্ম ও নারীধর্মের অজুহাতে আশ্রম থেকে বের হতে নিষেধ করেন। তিনি আরও বলেন, অনার্য পুরুষের সঙ্গে আর্য নারীর সাক্ষাৎ কখনওই বাঞ্ছনীয় নয়। এতে অনুলোম প্রতিলোম বিবাহের সম্ভাবনা থাকে। যা সমাজের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত অমঙ্গলকর। ভাবনাটা অত্যন্ত চেনা চেনা লাগছে না আমাদের? এই একই কথার ধ্বনি প্রতিধ্বনি আমরা আজকের ভারতবর্ষেও কি শুনতে পাচ্ছি না?

মল্লিকার সীতা মেনে নেয়নি সেই চাপিয়ে দেওয়া মঙ্গল অমঙ্গলের শর্ত। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন,

আমার শ্বশ্রুপিতার তিনশত পঞ্চাশটি বিবাহের মধ্যে অনেকগুলোই ছিল অনুলোম, নিম্নবর্ণের উপপত্নী গ্রহণ করা তো বন্ধ হয়নি!

মহর্ষি পুরুষের সংযম হারানোকে দোষের নয় বলে বিধান দিলে তিনি বলেন,

এ তো স্পষ্টতই দ্বিমুখী বিচার!

সীতার অগ্নিপরীক্ষাকে মল্লিকা ‘নারীমেধ’ বলেছেন। ‘মানুষের অধিকার চেয়েছিল যে অন্ত্যজ’, আর্য নৃপতি রামচন্দ্র কর্তৃক সেই শম্বুক বধকে তিনি ‘শূদ্রমেধ’ বলে অভিহিত করেছেন। এই দুই ‘মেধ’ যেন আর্যসভ্যতায় অশ্বমেধের মতোই গৌরবজনক!

আজকের ভারতবর্ষ কতটুকু এগিয়েছে এই নৃশংসভাবনা থেকে? সাম্প্রদায়িকতা ও বর্ণবিদ্বেষের বিষফল আজও সমানভাবে সর্বত্র কার্যকর। অ্যালিস ওয়াকার অ্যামেরিকায় কালো মেয়েদের আন্দোলনের নাম ছিলেন। ‘A black feminist or feminist of color’— আজ সেই আন্দোলনেরই আরেক নাম ‘Black lives matter’।

পশ্চিমি সাম্যবাদের ধারণাকেও তিনি প্রশ্ন করেছেন। ‘প্রথম যুগের নারীবাদ সব অর্থেই বুর্জোয়া নারীবাদ’ একথাও যেমন তিনি লিখেছেন আবার ভক্তকবি তুলসীদাসের দোঁহায় তিনি শুনেছেন নারীমুক্তির প্রতিধ্বনি। তুলসীদাস গেয়েছেন,

ঢোল গাঁওয়ার শূদ্র পশু নারী
ইয়ে সব হ্যায় তাড়নকে অধিকারী।

তাঁর গবেষণায় ও বিভিন্ন রচনায় তিনি উল্লেখ করেছেন, মূলস্রোতের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম থেকে সাহিত্য রাজনীতি শিক্ষা সর্বত্র নারীকে মানুষরূপে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং সুফি, সহজিয়া, আউল বাউল ও ভারতবর্ষের মাঠে ঘাটে, বনে অরণ্যে বেড়ে ওঠা সাধনায়, সংস্কৃতিতে তিনি খুঁজে পেয়েছেন প্রকৃত সাম্যবাদের রূপ। সাঁওতালদের ধর্মের আদিমাতা রাজহংসীই প্রমাণ করে তারা মেয়েদের মানুষরূপে স্বীকৃতি দিয়েছে বহুযুগ আগেই।

আম্বেদকার জওহরলাল নেহেরুর মিলিত রচনা সংবিধানের আইনকে তিনি সৎ বললেও এই আইনকেই তিনি সন্দেহ করেছেন। তাঁর মতে, এই আইনের মধ্যেই নিহিত আছে এমন কিছু সূক্ষ্ম ফাটল যা ‘পিতৃতান্ত্রিক মৌলবাদকে চাঙ্গা করার পক্ষে যথেষ্ট।’

বাংলা ভাষায় মানবীবিদ্যাচর্চার এক অন্যতম গবেষক ও সাহিত্যিক মল্লিকা সেনগুপ্তর সমগ্র রচনায় আমরা পাই নারীর শ্রম থেকে ভালোবাসা সবটুকুর মর্যাদাপূর্ণ স্বীকৃতির দাবী। যে দাবীকে অস্বীকার করলে মানবসভ্যতার ইতিহাসকে, বির্বতনের ক্রমকে অস্বীকার করতে হয়। নারীশ্রমের মর্যাদা প্রসঙ্গে তাঁর ‘মাতৃত্ব ও সমাজিকীকরণ’ প্রবন্ধের একটি লাইন খুব উল্লেখযোগ্য মনে হল। ‘প্রতিটা মা-ই জানেন আয়া এক মরীচিকার নাম, প্রতিদিন সকালে প্রতীক্ষার নাম।’

একথা খুবই সহজেই আজকাল বুঝতে পারি, সভ্যতা কেবল ক্যালেণ্ডারের পাতায় ফুরিয়ে আসা সংখ্যা নয়, সভ্যতা কেবল চাপিয়ে দেওয়া কোনো সংজ্ঞাও নয়। সন্ত্রাস, অসাম্য ও সবরকম অত্যাচারের বিরুদ্ধে সভ্যতাই পারে কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হতে,

ভালোবাসার বৃষ্টি আনো
সন্ত্রাসের শেষে
ও মেঘ তুমি শান্তি আনো
বারুদলাগা দেশে।

-–পূর্বমেঘ শান্তিমেঘ, মল্লিকা সেনগুপ্ত