Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

পাঁচ লাখ না কি পাঁচশো কোটি— খাচ্ছে কিন্তু দেখছে না

পাঁচ লাখ না কি পাঁচশো কোটি— খাচ্ছে কিন্তু দেখছে না -- শৈলেন সরকার

শৈলেন সরকার

 

উত্তেজনার আর শেষ নেই। এই দু মাস ধরে ইলেকশান গেল তো এবার নারদা কাণ্ডের অ্যারেস্ট। না, ফুটপাথে আলু-পটল নিয়ে বসা লোক নয়, একেবারে হেভিওয়েট। যারা একবেলা জেলে থাকলে জনসেবা না করতে পারার জন্য কান্নাকাটি করেন। সেই ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি-র কার্যকর্তারা তাদের দিল্লি অফিস থেকে কিছু ভিডিও ছাড়লেন। একজন কেউ কিছু টাকা দিচ্ছেন আর একজন তা বেশ খুশিমনে কাগজে প্যাক করে রাখছেন। কেউ বা তার অফিসে তাঁর বিশ্বাসযোগ্য লোকের হাতে দিয়ে আসতে বলছেন। কেউ বা টাকার মাত্র ‘পাঁচ লাখ’ পরিমাণের জন্য— এই টাকা যে তাঁর বাচ্চাদের দিতেই লেগে যাবে তা জানালেন। কিন্তু তাতে কি এল-গেল? ইলেকশানে জিতে এই নেতারাই আরও বিরাট সংখ্যা নিয়ে এলেন।

আমি যেবার হায়ার-সেকেন্ডারি পাশ করি তার পরের বছর মহামান্য মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর পুত্র চন্দন বসু হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেন। আমার ছিল ফার্স্ট ডিভিশন, আর এই ফার্স্ট ডিভিশনটাই বেশ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াল। সায়েন্স নিয়ে ফার্স্ট ডিভিশন মানেই ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে ভর্তি হও কোথাও। আরে ভাই সেটা প্রায় দুর্ভিক্ষের যুগ। একবেলা কম খেয়ে পরের বেলার জন্য কিছু জমাও। ভাত কোথায়, আর মিষ্টি আলু সেদ্ধ থাকলে ভাতের কথা আসবেই বা কেন? ভাতই নেই তো কলেজ ভর্তির টাকা। আর চেয়েচিন্তে ভর্তির টাকা যদিও বা মেলে কিন্তু কলেজের পড়াশোনা? বই? না, জ্যোতি বসুর ছেলে চন্দন বসুর সে চিন্তা ছিল না। তাঁর ছিল থার্ড ডিভিশন, সায়েন্স নিয়েই। কিন্তু ইচ্ছে ছিল ডাক্তারি পড়ার। থার্ড ডিভিশনের ছেলেকে বাংলার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির চাপ ছিল অনেক। বাবা জ্যোতি বসু— তিনিও তো আমার আপনার মতোই বাবা একজন। ধরলেন বন্ধু কাশ্মিরের মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আব্দুল্লাকে। ফারুক বন্ধুর ছেলেকে ভর্তির ব্যাবস্থা করে দিলেন শ্রীনগর মেডিক্যাল কলেজে। না, ডাক্তারি পড়া শেষ না করেই সেই ছেলে ফিরলেন কলকাতায়। চাকরি জোটালেন বেঙ্গল ল্যাম্পে। আর সেই বেঙ্গল ল্যাম্পে চাকরির সুবাদে কিছু অর্ডারের ব্যাপারে বাদ সাধলেন মন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী। ব্যস। চাকরি গেল মন্ত্রীমশায়ের। আর বক্সার মন্ত্রীমশায়ের এমন দুর্দশা হল, যে শেষ জীবনে আর দেখার লোক নেই। না, জ্যোতি বসু পুত্রের এরপর ব্যাবসা। মাছের ভেরি, তেল। এরপর তার সম্পত্তি কয়েকশো কোটি টাকা। না, দুর্নীতি কোথায়? দুর্নীতি কোথাও নেই, প্রমাণ কোথায়? জ্যোতি বসুর ধবধবে পাঞ্জাবিতে এক ফোঁটাও দাগ লাগল না। বড়ঘরের বিলাত ফেরত ব্যারিস্টার বলে কথা।

ভালো কথা, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ঘুষের দায়ে অভিযুক্ত ফিরহাদ, সুব্রত, মদনের জন্য এত কিছু করলেন, কই ভোট দিয়ে আসার রাতে এনআইএ যখন ছত্রধর মাহাতোকে তুলে নিয়ে গেল ঘর থেকে, কিছু করলেন না তো!

আমাদের কলকাতার পাঁচলাখি কেসের প্রমাণ হবে কিছু? কেস পাঁচ লাখের কিন্তু যে উকিলরা তাঁদের হয়ে কেস লড়ছেন, তাদের এক-একদিনের ফিজ কত? এক-একটা পাঁচ লাখ থেকে বাঁচার জন্য খরচ অন্তত পাঁচ কোটি করে। এবার আমার আপনার ঘরের কথা ভাবুন, না, আমি আপনিও ঠিক লোক জোগাড় করে ফেলতাম আমাদের ছাড় করাবার জন্য। আর আমরা যেহেতু হেভিওয়েট নই, আমাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অভিসন্ধিও থাকত না কারও। মোট কথা আমরা একে ধরে তাকে ধরে থানায় পয়সা গুঁজে ছাড় পাওয়ার ব্যবস্থা করে নিতাম। কিন্তু ফুটপাতের কোনও আলু-পটলওয়ালার কথা ভাবুন। বেচারাদের না থাকত পুলিশের হাতে পয়সা গোঁজার সামর্থ্য না থাকত তাদের হয়ে কোনও বলার কেউ। তাহলে যাও জেল হেফাজতে, গিয়ে বিচারের জন্য বছরের পর জেলের ভাত খাও, দশ-বিশ বছর পর কারও কিছু মনে পরে তো ভাল, নইলে—। ও তুমি যতই দেশের কাজ করার জন্য কান্নাকাটি করো না কেন, কে শুনছে কার কথা? দেশের কাজ করার লোক আলাদা।

ভালো কথা, ২০১৯-র নির্বাচনে পাঁচ লাখ করে টাকা হস্তান্তরের একেবারে টাটকা ভিডিও দেখেও মানুষ বলল না কিছু? মানে মানুষ পাত্তাই দিল না দুর্নীতির একেবারে আঁখো দেখা হাল-কে, কেন? কেন আবার, এরা মানুষ হল? মানুষ হলে এত কিছু নিজের চোখে দেখে ভোট দেয় তৃণমূলকে? শুধু ভোট দেওয়া তো নয়, একেবারে এক লাফে ওদের আরও উঁচুতে তুলে আমাদের একেবারে শুইয়ে দিল?

সেটা সম্ভবত ১৯৮৯। বিখ্যাত বা হিংসার জন্য কুখ্যাত কুলতলির মৈপীঠ গ্রাম। সিপিএমের বিবরণে ওরা পাড়া অ্যাটাক করতেই এসেছিল। ক্যাডার এসইউসি-র। ধরা পড়েছে হাতেনাতেই। হাতেনাতে মানে বোমা-বন্দুক সহ একটা ঘরেই। এবার যা করার ঘিরে ফেলা হল চারদিক। একজন কোনও মতে ফুটোফাটা দিয়ে কীভাবে বের হয়ে—। সে বেচারা গুলিতে গুলিতেই শেষ। ওর পরিণতি দেখে ভেতরে আটকে পড়াদের সারেন্ডার করাটা ছিল স্রেফ সময়ের ব্যাপার। বাকিটা গ্রামের সাধারণ মানুষের বলা। রেজাউলের সঙ্গে মৈপীঠের মোল্লাপাড়ায় গিয়েছি। সাক্ষাৎকার নেব এক নব্বই উত্তীর্ণ বৃদ্ধার। সাক্ষাৎকার নেব সেই ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের দিনগুলি নিয়ে। বৃদ্ধার বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, রেজা বলল, কথা বলবেন? ‘কার সঙ্গে?’ অন্য এক বাড়ির বাইরে বসে রোদ পোহাতে থাকা এক মহিলাকে দেখিয়েই বলে যাচ্ছে রেজাউল। বললাম, কেন? বলল, ওর স্বামীও ছিল সেদিন, মানে ওর স্বামীরও অণ্ডকোষ কেটে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওর হাতে। গা শিরশির করে উঠল। এর আগে যতবারই বিবরণ শুনেছি ঘটনাটার ততবারই দম আটকে এসেছে আমার। নিজেকে সেই ঘরে ধরা পড়া এসইউসি কর্মী মনে হত। আর নিজেকে দড়ি দিয়ে গাছের গায়ে আটকে রাখা কেউ। চোখ খোলা, তাকাতে বলা হচ্ছে সামনের দিকে। সেখানে আমার বউ-মেয়ে। আমাকে নগ্ন করা হচ্ছে। আমার বউকে তাকিয়ে থাকতে বলা হচ্ছে আমার দিকে। এবার ছুরি বের করা আমার অণ্ডকোষ— আমার বউকে তাকিয়ে দেখতে হবে সব, আর আমার সেই অণ্ডকোষ ধরিয়ে দেওয়া হবে তার হাতে।

পাঁচ লাখ টাকার হস্তান্তরের দৃশ্য এই দৃশ্যের তুলনায় আসবেই বা কীভাবে? বা, হাওড়ার সেই সিপিএমকে ভোট না দেওয়ায় হাত কেটে নেওয়া বা গলায় জ্যান্ত কইমাছ ঢুকিয়ে দেওয়া? মানুষের প্রতি ন্যূনতম ভালোবাসা থাকলে এই নৃশংসতার কথা আদৌ ভাবতে পারত কেউ?

মানুষ জ্যোতি বসু বা বুদ্ধদেবকে দেখে ভোট দিত না, ভোট দিত পাড়ার লোকগুলিকে দেখে। পাড়ায় পাড়ায় সিপিএমের লোকমাত্রই যে ঘৃণার পাত্র হয়ে যাচ্ছে তা আর কে খেয়াল করল। কেউ না। এবার ইলেকশানে হারা মাত্র সেই পাড়ার লোকগুলি যাবে কোথায়? ওরাই তো পার্টির হাত বলো হাত, তো মুখ বলো মুখ। এই লোকগুলি পালটা মার খাওয়ার ভয়ে মুখ লুকাল। সারেন্ডার করল। নৈতিক বল পুরোপুরি হারিয়ে গেছে তাদের। নিচের দিকে সিপিএম একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল। সর্বত্র। উলুবেরিয়ার এক দাপুটে নেতাকে দেখি মদ খেয়ে চুর। হাঁটতে পারছেন না। পাড়ার বাচ্চারা খেপাচ্ছে। হ্যাঁ, সেই নেতাকে, যার এক ডাকে অন্তত দশটা পাড়ার মানুষের পিলে চমকে যেত।

ইলেকশানের আগে সিপিএমের এক তরুণ নেতার সঙ্গে দেখা। তরুণ অর্থে চল্লিশ-বেয়াল্লিশ। কলকাতা পার্টির। বলল, তৃণমূল এবার সরকার গড়তে পারবে না আর। কেন? না, বিজেপি অন্তত ১২০টা সিট তো পাচ্ছেই। তাহলে ওরাই বা সরকার গড়বে কীভাবে? এবার চান্স আছে হ্যাং বিধানসভার। তোমরা কী করবে তাহলে? কী আর করব, আমরা তো আর সমর্থন করতে পারব না কাউকে, রাষ্ট্রপতি শাসন হবে, ভোট হবে আবার। ভোটে আমরা—। মানুষ নাকি তৃণমূলকে আর—। তৃণমূলের জন্যই তো আমরা জায়গা হারালাম, ওদের অত্যাচারের জন্যই আমাদের কর্মীরা—। ওকে বললাম, কেন, তৃণমূলের জন্য তোমাদের পার্টি উঠে যাবে কেন? ও বলল, তৃণমূলের অত্যাচারে। বললাম, তাহলে তোমাদের সময়ে তৃণমূল পার্টি করল কী করে? ওর কথায়, ওদের সময়ে পার্টি করতে বাধা দেওয়া হয়নি কাউকে। বললাম, ঠিক আছে, তোমাদের শেষ দশ বছর আর তৃণমূলের প্রথম দশ বছরের দু-তিনটি প্যারামিটার ধরে তুলনা করো। ধরা যাক, পুলিশের গুলিতে মৃত্যু। বা পুলিশ কাস্টডিতে মৃত্যু বা গণহত্যা, হ্যাঁ আমি মাস-কিলিং-এর কথা বলছি। বললাম, তোমাদের শেষ দশ বছরের সঙ্গে সংখ্যার দিক ধরলে তৃণমূলের প্রথম দশ বছর এতটাই নগন্য যে তোমাদের শেষ দশ বছরের তুলনায় তা প্রায় উল্লেখের অযোগ্য। তাহলে? তোমাদের শেষ দশ বছরে ওরা লড়তে পারল, আর ওদের প্রথম দশ বছরে তোমরা লড়তে পারলে না। আর এরপর বিজেপি এসে শাস্তি দেবে ওদের ভেবে নিজেরা চুপচাপ বসে থেকে ভোটগুলি বিজেপিকে দিয়ে দিলে?

কিন্তু এই লোকগুলির ছেলেমেয়েরা লজ্জিত হয় না? হ্যাঁ, আমি পাঁচলাখ হস্তান্তরের লোকগুলির কথাই বলছি। তাদের বাবা নিজের হাতে টাকার বান্ডিল—। এই টাকা তাদেরই জামা-প্যান্ট বা শাড়ি বা গাড়ি—। টিভিতে বা মোবাইলে লাখ লাখ লোক—। আর মানুষ এতসব দেখেও জেনেবুঝে দেশসেবার ভার—। তার মানে যারা দেশসেবা করবে তাদের চুরি বা ঘুষ নেওয়ার অধিকারও দিতে হবে?

মানুষ কি তাহলে দুর্নীতিকে গ্রাহ্য করে না? অবশ্যই করে, করবেও। কিন্তু সিপিএমের সেই ভয়ঙ্কর অত্যাচারের দিনগুলিকে ভুলতে দিন একটু। না, শুধু অত্যাচার নয়, দুর্নীতিরও। সেই সব সঞ্চয়িতার মালিকের সাততলা বিল্ডিং-এর জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া বা কেউ বলবে সাক্ষী লোপের জন্য ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া। বা মরিচঝাঁপি বা নানুর বা বছর-দু বছর পরপর একটা করে গণহত্যা।

আর একটা কথা, একটু আগে ছত্রধর মাহাতোর কথা বললাম। বৈষম্য হয়তো আদিবাসী হওয়ার জন্যই। নইলে এতদিনের পরীক্ষিত সৈনিক দেবলীনা হেমব্রমকে বাদ দিয়ে হঠাৎ করে আসা মীনাক্ষী মুখার্জি, ঐশী ঘোষ বা দীপ্সিতা ধরকে নিয়ে সিপিএমের এত মাতামাতি কেন? তা কি শুধু ঐশী-দীপ্সিতা বা মীনাক্ষীদের জেএনইউ বা শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত হওয়ার জন্যই? মীনাক্ষী নাকি ভবিষ্যতের মুখ্যমন্ত্রী বা মীনাক্ষীকে পাশে নিয়ে এক পলিটব্যুরো সদস্যের একেবারে গদগদ হয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে সাংবাদিক সম্মেলন। হায় দেবলীনা তোমার দিন গিয়াছে। কিন্তু ছত্রধর মাহাতোর মতো এটাও কি কাস্ট হিন্দু সিনড্রোম নয়?