পার হতে হতে

পার হতে হতে : শৈলেন সরকার

শৈলেন সরকার

 

কী বললেন? যতটা ফর্সা মনে হচ্ছে ততটা নয়? ফ্ল্যাশের জন্য? মানে, চমকানো আলোর জন্য? ঠিকই ধরেছেন। আমাকে বরং শ্যামবর্ণ বলে চালাতে পারেন। যদিও শ্যামবর্ণ বলতে যে ঠিক কী রং বোঝায় আমি জানি না। তবে ফর্সা নয়। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, চোখটা ছোট ছোট। না, নাকটা অত খারাপ নয় আমার। আর ছবিতে নাক কীভাবেই বা বুঝবেন আপনি? কী বললেন, মোটা, থ্যাবড়ানো? ভুল করলেন প্রবীরবাবু। না, নিজের সম্বন্ধে মিথ্যে বলব না আমি। কী লাভ! ছবি দেখেই তো কেউ আর আমাকে বিয়ে করতে আসবে না। বড়জোর দেখতে আসার কথা ভাবতে পারে। চুল কিন্তু খুব খারাপ নয় আমার। না ফলস নেই। সেই ছোটবেলা থেকেই। একদম মায়ের মতো। হাইট তো পিছনেই লেখা আছে। ঠিক পাঁচ-দুই। বাবার নিজের হাতের মাপ। মানছি, দু-এক চুল ছোট হতে পারে। তবে পাঁচ দেড়ের উপর তো বটেই। আপনার কাজটাকে আমি— না, ঘটকালি বলব না, বিশ্রী লাগে কথাটা শুনতে, বরং ‘বিয়ে ঠিক করার কাজ’ বলাটাই ভাল শোনায় অনেক। আপনার শুনেছি হাতযশ আছে খুব, কী মনে হচ্ছে, চালাতে পারবেন?

ছবিটা খুব যত্ন নিয়ে তোলা কিন্তু। পেছনে দেখুন সুন্দর পাহাড় একটা। গা জুড়ে সবুজ। কিছু গাছ কেমন আকাশের বুকে ঢুকে গেছে, পাহাড়ের নীচে জল। ওটা সম্ভবত হ্রদ কোনও। আলো পড়ে চিকচিক করছে। আকাশে দু-তিন টুকরো মেঘ। আর চাঁদটাকেও দেখুন। পুরো হলুদ। গোল। আর চাঁদকে ঘিরে কেমন বলয় একটা। হ্রদের পাড় জুড়ে ঘাসজমি। ভেড়ার পাল। সুন্দর আর নরম চোখওয়ালা। আচ্ছা ভেড়া কি চরায় কেউ? কেউ কি আছে আর? মানে ছবির মধ্যে আর কি কারও থাকার কথা ছিল? সিনারিটা দেখে আমারও মনে হচ্ছিল। কী যেন একটা বাদ থেকে গেছে। কারও যেন থাকার কথা ছিল। আরও? ওটা কল্যাণী স্টুডিওতে তোলা।

ভালো কথা, ছবিটা দেখে কত পুরনো মনে হচ্ছে? এক মাস, দু মাস, নাকি তারও বেশি? আসলে গত বছরের। পুজোর। অষ্টমীর দিনের।

জামাইবাবু এলেন হঠাৎ। দিদিকে বাদ দিয়েই। সেই জামশেদপুর থেকে। আমরা তো অবাক। বললাম, দিদি? পুপুন? জামাইবাবু বললেন, অফিসের কাজে হঠাৎ। বললেন, দশমীর দিন চলে যাবেন। মা একটু গজগজ করছিল। ওদের নিয়ে আসতে পারলে না? যত হঠাৎ-ই হোক। জামাইবাবু বললেন, ওখানেও তো পুজো হচ্ছে সেক্টরের। বললেন, দিদি নাকি ওখানে জমে আছে ঠিক। ওদের একমাত্র ছেলে পুপুনও।

যা বলছিলাম, সেই অষ্টমীর বিকেলে জামাইবাবু বললেন, চলো, ঠাকুর। দেখে আসি। আমারও যে ইচ্ছে করছিল না তা নয়। ভাবলাম মাকে বলি, চলো তুমিও, ভেবেও বলা হল না কিন্তু। আর সেই বিকেল নাগাদই জামাইবাবু একেবারে চমকে দিলেন আমাকে। একটা শাড়ি। নামী কোম্পানির। চমৎকার নকশা করা পাড়ওয়ালা হলুদ। গায়ে হালকা নীলের লতা। মানে লতার মতোই। ঢেউ খেলে ঢেউ খেলে নেমে আসা। হ্যাঁ, যেটা দেখছেন ছবিতে। ওটা জামাইবাবুরই দেওয়া। মজা করে বললাম, দিদি জানে? উনি মুচকি হাসলেন। কী বলতে চাইলেন কে জানে? লোকটা একটু বেহায়া কিন্তু। আমাদের দেখুন সব মিলে দুখানা মাত্র ঘর। ভাড়া বাড়ি। একটাতে আমি আর মা। আর একটাতে বাবা। বাবা আর ভাই। ভাই মাধ্যমিক দেবে এবার।

যা বলছিলাম, কী বলছিলাম যেন? জামাইবাবুর কথা বলছিলাম, নাকি ছবির শাড়ি, নাকি এই ছবি তোলার কথাটা বলছিলাম? যা হোক একটা থেকে আরেকটায় চলে আসা যাবে। সেই অষ্টমীর বিকেলে যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখছি নিজেকে, মানে নতুন শাড়ি পরা আমাকে এই ভাস্বতী মিত্রকে, সত্যি বলছি, একদম বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছিল না। এই কি আমি? আমি কি সত্যিই দেওয়ানপাড়ার টুকুনি? টুকুনি আমার ডাক নাম। আমি তখন আয়নায় দেখছি কীভাবে একটিমাত্র শাড়ির জন্য আর ম্যাচ করা ব্লাউজের জন্য আর একটি টিপ আর লিপস্টিকের জন্য দেওয়ানপাড়ার টুকুনি কয়েক মিনিটেই অন্য একজন হয়ে যায়। অন্য একজন। অন্য একজন মানে, এই ভাস্বতী মিত্র, যাকে এখন দেখছেন আপনি। হ্যাঁ, যার ছবি হাতে রেখে আপনি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিকে ডাকলেন। আর হয়তো দেওয়ানপাড়ার টুকুনি পাল্টে গিয়ে ভাস্বতী মিত্র হয়ে যাওয়াতেই জামাইবাবুও অমন একটা কাজ করতে পারলেন। আচমকাই। থাক। কেমন অপরাধী মনে হচ্ছিল নিজেকে। ওঁকে বাইরে পাঠিয়ে আটকে দিলাম দরজাটা। কয়েক মিনিট বসে রইলাম চোখ বুজে। কী বললেন? না দেখেনি কেউ। না দেখুক, আমার সম্বন্ধে যা যা আপনি জানতে চান জেনে নিন। হ্যাঁ, এই সেই ছবি। এরপর এই জামাইবাবুর সঙ্গেই আমার বেড়াতে বেরোনো। কল্যাণী স্টুডিওর সামনে এসে জামাইবাবুর বায়নাতেই ছবি তোলা। না, তখনও ভাবিনি এত সব। মানে, এই ছবি আমার কোন কোন কাজে লাগতে পারে, অন্তত সেই মুহূর্তে ভাবিনি। লোকটা পীড়াপীড়ি করছিল খুব। আর, আর আমার সৌন্দর্য নিয়ে এত সৰ কথা… বিশ্বাস করুন, না, খুব একটা খারাপ লাগছিল না শুনতে। ঠিক ধরেছেন। এসব কথা, এর আগেও যে না শুনেছি তা নয়। এবং কী অদ্ভুত দেখুন, একই কথা তবু নিজের সম্বন্ধে বলা সেই একই কথাগুলি শুনতে খারাপ লাগে না কিন্তু। অনেক ঠাকুর দেখলাম সেদিন। প্যান্ডেল থেকে প্যান্ডেল। রাস্তা থেকে রাস্তা। জামাইবাবু আমার হাত ছাড়লেন না একদম। আমার বাঁ হাত ওর ডান হাতে। আমার সরু আঙুলগুলি নিয়ে ওঁর যত খেলা। রিকশা নিলেন একবার। একটু ফাঁকায়। একটা প্যান্ডেল থেকে আরেকটা প্যান্ডেল বেশ দূরের যখন। যখন দুপাশে সার দেওয়া দেওয়াল কি গাছপালা। মোটমাট আমরা তখন বড় রাস্তা ছেড়ে ছোট রাস্তায়। মেন রোড ছেড়ে কোনও একটা পাড়ায়। প্যান্ডেলের মাইকের গান তখন অস্পষ্ট প্রায়। আর দূর থেকে ভেসে আসা ঢাকের আওয়াজ কী অদ্ভুত তখন। আর অদ্ভুত বাতাস। আমার আঙুল নিয়ে খেলা বন্ধ করে ওর ডান হাত হঠাৎ— আমার গলা শুকিয়ে আসে, ওর ডান হাত— যেন একটা সাপ পেঁচিয়ে ধরছে আমাকে, আমার—। কী বললেন, ছবি দেখে বোঝা মুশকিল। কী বুঝবেন আপনি? কী বুঝতে চান? কী করবেন এত সব বুঝে? সেদিন রাত করে ফিরলাম খুব। রিকশায়। দেখি, ভাই বাড়ি ফেরেনি তখনও। বাবা জেগে। খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না একদম, তবু, জামাইবাবুর জন্যই রান্নাঘরে বসতে হল। আর তখনই জানলাম শুধু আমাকে খুশি করা নয়, খুশি করতে চেয়েছেন বাবা, মা আর ভাইকেও। অর্থাৎ টাকা দিয়েছেন ভদ্রলোক। মা বলল, এক হাজার। এক হাজার। ভাবুন একবার। আমার শাড়ির দাম ধরলে সব মিলে অন্তত আঠারাশো। আমার শাড়ি আন্দাজমতো অন্তত আটশোই। পরদিন বাবা নিজেই বললেন, শহরে ঠাকুর দেখিয়ে নিয়ে আয় না জামাইবাবুকে।

হ্যাঁ, এই যে, আপনি তো ভাস্বতী মিত্রকেই দেখছেন। পাশের লোকটি কে হয় আপনার? বন্ধু? না স্রেফ পরিচিত একজন? কী বললেন ওকে? চলবে কিনা? মানে, চালাতে পারবেন কিনা আমাকে? চালাবেন আপনি, ও কী বলবে? আর কী চোখ দেখো লোকটার, যেন গিলে খাবে আমাকে। চোখের এত সামনে নেওয়ার কী আছে? বলুন, বলে দিন ওকে, দেওয়ানপাড়ার মেয়ে। বাবা রিটায়ারমেন্টের মুখে। দুই বোন, এক ভাই। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট ভাই মাধ্যমিক দেবে। বলে দিন, ভাল নাম ভাস্বতী মিত্র। গায়ের রং শ্যামবর্ণ, নাইনটিটুতে হায়ার সেকেন্ডারি, ইংরেজিতে ব্যাক। বলুন, লেখা আছে পেছনে। কী বলল? কী বলছে লোকটা? আমার শরীর নিয়ে, আমার কোমর নিয়ে, আমার ঠোঁট নিয়ে কী বলছে লোকটা? হাতে আধপোড়া বিড়ি, বিড়ির টুকরোটা ফেলতে বলুন আগে, ফেলতে বলুন! হঠাৎ করেই কেমন ঠান্ডা নেমে গেল, না? এমনিই হয় কিন্তু, হঠাৎ করেই একদিন দেখলেন, দূরে কুয়াশা জমছে কেমন। হঠাৎ করেই দেখলেন, জল ঝরছে পাতা বেয়ে। অনেকটা বৃষ্টির মতোই, অথচ বৃষ্টি নয়। হঠাৎ করেই কনকনে শীত। ভেতরটা শুকিয়ে দেয় একেবারে। এক এক সময় মনে হয়, আসলে শীত নয়, কোনও ভয়ই। সত্যি! সেভেনে পড়ার সময় অমন ভয় পেয়েছিলাম একবার। না, একবার নয়। বলা ভালো প্রথমবার। আহ্‌, প্রথমবারের সেই ভয়। অন্ধকারের। প্রবল শীতের। আমার মামা। হঠাৎ করেই। মনে পড়ে এখনও। বাইরে কুয়াশা খুব। মামার হাত ধরে কোনও এক বাড়ির সিঁড়ি ধরে নামছি তখন। মামার হাত আর হাতের আঙুল সেই শীতে, সেই প্রবল ঠান্ডায় যেন অন্য কিছু খোঁজে। হাত, হাতের আঙুল। আমার হাত বেয়ে বেয়ে অনেকটা সাপের মতোই আমার কাঁধ, আমার—। আমি তখনও জানি না কিছুই, আমি তখনও আমি—। প্রবল শীতে আমার শরীর কাঁপে তখন। আর সেই প্রথম ভয় পাওয়া। শরীরের। শরীরের সেই ভয়। কী অদ্ভুত দেখুন, সেই শরীর এখন কী চমৎকার মুড়ে দেওয়া। একেবারে নামী কোম্পানির কাপড়ে। জামাইবাবুর দেওয়া। বলা যেতে পারে ওর নিজের হাতে কেনা। আর যে ছবি হাতে করে আপনি দেখাচ্ছেন সবাইকে, তা ওই জামাইবাবুর— ওই লোকটার পীড়াপীড়িতেই। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছে লোকটা, স্বভাব-চরিত্র। ছবি দেখে সত্যিই কি বোঝা যায়? স্বভাব-চরিত্র? দেখুন তো। ভালো করে লক্ষ করুন। না, সময় আছে হাতে এখনও। ট্রেন আসতে এখনও অন্তত দশ মিনিট। জানি, ব্যাগে আপনার অন্তত খান পনেরো ছবি। তবু, দেখুন না একটু। বা, ছবি দেখে একটি মানুষের, একটি মেয়ের সম্বন্ধে আপনি কতটা কী অনুমান করতে পারেন বলুন তো শুনি। বরং চা নিন একটা। দেখুন, চায়ের দোকানের ছেলেটা তাকিয়ে আছে কেমন। ও কিন্তু আমার ভাইয়ের থেকেও ছোট। কী অত দেখছে ও? ওইটুকু একটা ছেলে ওভাবে তাকিয়ে থাকবে কেন? ওইভাবে অদ্ভুত চোখে। ওইটুকু ছেলের চোখে পুরুষের তাকানো থাকবে কেন? কী হল, আবার ওই ভদ্রমহিলার কাছে কেন? কী বলছেন উনি? দেখবেন? কী জন্য? ওঁর আছে কেউ? মানে ছেলে কিংবা ভাই? দেখান, দেখান একটু, প্লিজ। হ্যাঁ, আমার গায়ের রং, আমার চোখ, চোখের ভুরু। আমার নাক, আমার ঠোট, আর, আর—। আমার বাবার চাকরির এটা শেষ দু বছর। ভাড়া বাড়ি। ছোট ভাই মাধ্যমিক দেবে। ছবির পেছনটা দেখুন। লেখা আছে সব। নাম, ডাকনাম, গায়ের রং, ঠিকানা। ভদ্রমহিলা কী জানতে চাইছেন? গান জানি কিনা? তাও জানি। ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে—।’ সেই ছোটবেলায় শেখা। স্কুলের কী একটা অনুষ্ঠানে। সম্ভবত পুরস্কার প্রদানের কোনও দিনেই। না  না, আমাদের নয়। ওই যে বললাম, উচ্চ মাধ্যমিকের ইংরেজিতে ব্যাক। গানটা আমাদের দল বেঁধে গাওয়া। চার পাঁচজন হবে। নাচের মতো কী একটা হয়েছিল যেন। জানি, বলছেন, দল বেঁধে গাওয়া হলে, ‘মম চিত্তে’ হবে কেন? কেন হবে কে জানে? হয়তো আমাদের প্রত্যেকের চিত্ত নিয়ে আলাদা করে না বলে এক সঙ্গেই বলা। হ্যাঁ, ‘চিত্ত’ মানে মন। আমাদের মন। আমার মন। আমার মনের ভেতর প্রতিনিয়ত কে নাচছে? কে? কার নৃত্য? কী বললেন? মানে, মাসিমা। উনি কী যেন বললেন আপনাকে? স্বভাব-চরিত্র? কী বলছেন উনি, দেখে ভালো মনে হচ্ছে না? কী দেখে? চোখ? চোখ দেখে সত্যিই কি স্বভাবচরিত্রের বোঝা যায় কিছু? কী বললেন, ছাপ পড়ে গেছে মুখে? কীসের ছাপ? বয়সের? নাকি অভিজ্ঞতার? পাপের? আমার মামা সেদিন কী জিজ্ঞেস করেছিল বলুন ত? জিজ্ঞেস করেছিল, তোর কি শীত করছে টুকুনি? হ্যাঁ, এই একটি কথাই। এই একটি কথার এখনও মুখ ফুটে জবাব দিতে পারলাম কই? আমার কিন্তু সত্যিই শীত করছে। ঠান্ডা। বরফের ফলার মতো শীত আমার শরীর ফুটো করে ঢুকছে। আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছে। আর দুটো মাত্র বছর। দুটো মাত্র বছর শেষ হওয়া মাত্র বাবার রিটায়ারমেন্ট। ভাই তখন হায়ার সেকেন্ডারিতে। হায়ার সেকেন্ডারির খরচ অনেক। অন্তত চারটে মাস্টার। চারটে মাস্টার মানে মাসে অন্তত আটশো টাকা। এরপর বইপত্র। সাইকেল। জামা-প্যান্ট। মল্লিকবাগানে জায়গার খোঁজ আছে একটা। জায়গা কিনে বাড়ি। অর্থাৎ এককালীন টাকা। বেশ বড় মাপের টাকা। বাবা কিন্তু চেষ্টা করবে। দিদির বিয়ের ধার পুরোপুরি শোধ হয়নি এখনও। তবু, বাবা হয়তো সব কিছু ভুলে আমার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। সব কিছু মানে ভাইয়ের ভবিষ্যৎ, জমি, বাড়ি, ঘর।

কী হল, ঢুকিয়ে ফেলছেন কেন ব্যাগে? ও প্রবীরবাবু, দেখুন! ওই যে কালো ধুমসো মতো লোকটা ডাকছে আপনাকে। দেখতে চাইছে আমাকে। দেখান, হ্যাঁ, দেখতে দিন। হয়তো ওর ভাই বা কোনও পাড়াপ্রতিবেশী কি কোনও আত্মীয়ের জন্য। আপনি বরং চা খান আয়েস করে। আমার জন্য আপনি সেদিন পরিমল হালদার নামের কোনও একটি লোকের কথা বলছিলেন। হ্যাঁ, লোক। বলছিলেন, বয়সটা একটু বেশি যদিও। আপনার স্ত্রীকেই বললেন। আপনার কথায় ওখানে হলেও হতে পারে। বলছিলেন, লেখাপড়া না থাকলেও ভালো রোজগেরে। ছোটখাটো দোকান আছে স্টেশনারি গুডসের। বলছিলেন, হাজার পঞ্চাশ নগদের ব্যাপারটাই সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। পরিমল নামের লোকটার নাকি আমাকে দেখে পছন্দ হয়েছে। আমাকে মানে, আমার ছবিকে। জামাইবাবুর দেওয়া কাপড়, ম্যাচিং ব্লাউজ আর সাজার জিনিসে মোড়া আমাকে। এক বছর আগেকার আমাকে।

ওহ্‌, কী হল, আঙুলটা সরান আপনার। প্রবীরবাবু লোকটাকে বলুন, ওর মোটা আর থ্যাবড়ানো আঙুলটা সরিয়ে নিক আমার শরীর থেকে। প্রবীরবাবু, বরং চেয়েই নিন ছবিটা। লোকটার দেখুন যেন লালা গড়িয়ে পড়ছে। ও প্রবীরবাবু, বরং নিজের হাতেই রাখুন আপনার। যে দেখবার দেখুক। ডানদিকে দাঁড়িয়ে থাকা কলেজের ছেলেটিকে দেখুন, কেমন না দেখবার ভান করে দেখে নিতে চাইছে। বরং ওকে দেখতে দিন একটু। হ্যাঁ, এমনি করে রাখুন। যাতে ও—। ভাবুন তো, গত মাস দুয়েকের চেষ্টায় মাত্র একজন। এক পরিমল হালদার। আমি কি সত্যিই এত ফ্যালনা? এত বাজে? হ্যাঁ, পরিমল হালদারকে মনে পড়ছে আমার। বাবার কথা জিজ্ঞেস করল। কত মাইনে, কোথায় কাজ করেন, কদিন পর রিটায়ারমেন্ট, মাথার উপর কেউ আছে কি? যে দোকানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল লোকটা, ওটাই তো ওর নিজের। মানে ওটাই ওর দোকান তো? ফুটপাথের। আমাদের রান্নাঘরের চেয়েও ছোট। পারবে? যদি উঠিয়ে দেয় কোনওদিন? যে কোনওদিনই তো। লোকটা কি তবে সে জন্যই এত টাকা চাইছে? টাকা, কালার টিভি, আলমারি। ফ্রিজ, ড্রেসিং টেবিল, খাট।

এক বছরে মধ্যে জামাইবাবু আসেননি আর। দিদিও। ফোন করলে রিং হয়ে যাবে। নিজের থেকে করবে ওই ক্কচিৎ কখনও। দিন সাতেক আগে মাকে ফোন করল একটা। একটাই। বাড়ির সবাই কেমন আছে জিজ্ঞেস করে, পুপুনের পড়াশুনার কথা বলল। আর ঘরসংসার নিয়ে ওর ব্যস্ত হয়ে পড়ার কথাও। ও নাকি একদম সময় বের করতে পারছে না।  আর আমার সম্বন্ধে? আমার সম্বন্ধে বলল, ওর বিয়ের কথা ভাবো। ভাবো। অর্থাৎ ওর কোনও দায়িত্ব নেই। ওর ভাবনায় আমি নেই।

পরিমল হালদারের একটা কথা আমার মনে পড়ছে। মনে পড়ছে মানে, মনে রেখেও আমার করার কিছু নেই। জানতে চেয়েছিল, ইংরেজি ব্যাক সুযোগ পেয়েও দিইনি কেন আর? ওকে কি বলা যাবে? দ্বিজুদার কথা ওকে কি বলা যাবে? এই দ্বিজুদার জন্যই, দ্বিজুদার জন্যই পরীক্ষাটা দিতে পারলাম না আর। ভাইয়ের মাধ্যমিকের জন্য মাস্টার রাখতে হল দুখানা। হাজার হোক ছেলে তো! ভবিষ্যৎ বংশধর। মুখ ফুটে কিছু না বললেও মা-বাবার মনের কথা টের পাই তো আমি। নতুবা বছর কুড়ির কোনও অবিবাহিতা মেয়েকে কেউ বাইরের একটা লোকের সঙ্গে সারাটা দুপুর এক ঘরে কাটাতে দেয়? নিজের বাড়িতে? পাশের ঘরে? তাও দিনের পর দিন। দ্বিজুদা মানে আমার প্রাইভেট মাস্টার। এমএ। এখন অবশ্য কলকাতায় কাজ পেয়েছে কীসের। লোকটা পড়াতে আসত বিনেপয়সায়। বিনেপয়সায় দিনের পর দিন। আর কী বোকা দেখুন, হ্যাঁ, এই আমি, একেবারে গলে গেলাম। লোকটাকে দিলাম অনেক কিছু। অনেক কিছু। আমার মা-বাবাকে দেখুন। দেখুন প্রবীরবাবু, অনেক চেষ্টা করেও ওরা কিন্তু চালাতে পারল না আমাকে। দ্বিজুদা একদিন বলে বসল, তোমার দ্বারা হবে না কিছু। অর্থাৎ ইংরেজির। হায়ার সেকেন্ডারির। হঠাৎ করেই। সারাটা পাড়া জুড়ে একেবারে ঢি ঢি। সবাই জানত, হবে একটা কিছু। আমাদের সামনে কেউই অবশ্য স্পষ্ট করে বলেনি কোনও কথা। তবু, টের পেতাম। দ্বিজুদা যেদিন শেষবারের মতো চলে গেল, বলে গিয়েছিল, আসবে পরের শনিবার। যেমন আসে। আমি কিন্তু ভাবতেই পারিনি। ভাবতেই পারিনি, যে লোক দিনের পর দিন—, যে লোক—, যাক। দিন সাতেক পর খবর নিতে গিয়ে বাবা শোনেন, চাকরি পেয়েছে দ্বিজুদা। কলকাতায়। গভর্নমেন্টের। রাস্তায় কবে যেন মায়ের সঙ্গে দেখা হতে জানিয়েছিল ব্যস্ত খুব, তবে আসবে শিগগিরই। আর আসে? তা না আসুক, পরিমল হালদারকে বলুন, আমি ওকে ভালোবাসব খুব। ভালোবাসতে পারব। বলুন, ইংরেজিতে পাশ না করলেও অনেক খাটতে পারব আমি। বলুন, সামান্য কটা টাকা আর জিনিসপত্রের জন্য—।

প্রবীরবাবু, ও প্রবীরবাবু, ট্রেন চলছে, শব্দ পাচ্ছি। চাকার, রেললাইনের, ক্রসিং-এর। আর গালগল্পেরও। আপনার গলার আওয়াজ পাচ্ছি আমি। শুধু আমি নই, আমরা আপনার পুরনো গন্ধওয়ালা ফোলিও ব্যাগের অন্ধকারে আপনি যাদের রেখেছেন যত্ন করে, পরপর সাজিয়ে। সুন্দরী, স্বাস্থ্যবতী, গৃহকর্মে নিপুণ। সঙ্গীতে পারদর্শিনী। ইংরেজিতে এমএ। সরকারি চাকুরিরতা। পিতামাতার একমাত্র সন্তান। প্রবীরবাবু, ও প্রবীরবাবু, ফোলিও ব্যাগের এই অন্ধকারে আমরা একজন আর একজনকে দেখতে পাচ্ছি না। প্রবীরবাবু, আমরা আপনার দেশলাই জ্বালানোর শব্দ টের পাচ্ছি। আপনার ঠোঁটে আটকে থাকা বিড়ি, কী জোরে ছুটছে ট্রেনটা ভাবুন—, একটার পর একটা কাঠি—, একটার পর একটা কাঠি জ্বলে উঠেও কেমন—। জানালার বাইরে পর পর পার হচ্ছে বাড়িঘর, মাঠ, ভাঙা ফ্যাক্টরি, বাসস্ট্যান্ড। পার হচ্ছে রেলস্টেশন। পার হচ্ছে লেভেল ক্রসিং। পার হচ্ছে ক্রসিং-এ দাঁড়িয়ে থাকা বাস। বাসের জানলা। জানালায় অবাক হওয়া কোনও চোখ। পার হচ্ছে রেলকেবিন। সবুজ পতাকা হাতে কোনও লোক। পার হচ্ছে বড় রাস্তা, পার হচ্ছে ন্যাশনাল হাইওয়ে। প্রবীরবাবু, ও প্রবীরবাবু, প্লিজ, আপনার ব্যাগটা খুলুন না ফের! ছবিগুলি একবার একবার করে নিজের মনেই দেখুন। কেউ না কেউ তো থাকতেও পারে এ কামরায়! আমার না হোক, কারও না কারও তো হতেও পারে। ফর্সা, রুচিশীলা, দীর্ঘাঙ্গী স্লিম, এমএ বিএড— লেগেও তো যেতে পারে কারও। এত বড় কামরা, এত এত লোক, অন্তত একজনকে মনে লাগার মতো থেকেও তো যেতে পারে কেউ। ও প্রবীরবাবু, প্লিজ, ট্রাই নিন, ট্রাই নিন না একটু!

দেখুন, ওই পেটের রোগের ওষুধওয়ালা কেমন, কেউ নেবে না জেনেও, কারও কোনও আগ্রহ নেই জেনেও, কেউ তাকাচ্ছে না জেনেও কেমন বলে যাচ্ছে। কেমন একের পর এক গল্প বানিয়ে, কেমন চমৎকার মোহজাল তৈরির চেষ্টা করছে। প্রবীরবাবু, ও প্রবীরবাবু, প্লিজ আপনি একবার বের করুন, একবার ছবির পর ছবি দেখিয়ে দিন, বলুন, এই যে এমএ-বিএড কুমারী, এই গৃহকর্মনিপুণা, এই যে পিতামাতার একমাত্র এই যে শ্যামবর্ণা, হায়ার সেকেন্ডারিতে ব্যাক— বলুন না প্লিজ! প্রবীরবাবু, জানালার বাইরে পার হয়ে যাচ্ছে বাড়িঘর, পার হচ্ছে রাস্তাঘাট, মাঠ। পার হচ্ছে রেলস্টেশন, ওয়েটিং রুম। পার হচ্ছে রেলকেবিন, পার হচ্ছে অধৈর্য হয়ে ওঠা যাত্রিবাহী বাস, সামনে পড়ে থাকা লেভেল ক্রসিং। প্রবীরবাবু, পার হচ্ছে সময়, ও প্রবীরবাবু, আমরা শুধুমাত্র একটি মুহূর্তের। এই আমরা—। জামাইবাবুর দেওয়া শাড়ি আর ম্যাচিং ব্লাউজে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকা আমরা, পেছনে পাহাড়। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা সবুজ-সহ, আর আকাশের। নীল-সহ, আর রুপোর থালার মতো চাঁদ-সহ, আর হ্রদের জল আর জলতলসহ আমরা পার হয়ে যাচ্ছি। পার হয়ে যাচ্ছি আমরা আমাদের ঠোঁট নিয়ে, আমাদের চোখ নিয়ে, আমাদের চুল আর খোঁপা নিয়ে পার হয়ে যাচ্ছি আমরা। আমাদের হাত আর খেলা করতে থাকা আঙুল নিয়ে, পার হয়ে যাচ্ছি যাবতীয় শীতকাল আর তার যাবতীয় ভয় নিয়ে, আমাদের উরু আর কোমর নিয়ে, আমাদের পায়ের নখ আর নাভিমূল নিয়ে।

প্রবীরবাবু, ও প্রবীরবাবু—।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...