Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কবিবর

কবিবর -- সলিল বিশ্বাস

সলিল বিশ্বাস

 

কোভিড আক্রান্ত হয়ে চলে গেলেন সলিল বিশ্বাস (১৯৪৫-২০২১)। তাঁর পরিচয় দিতে গেলে পরপর অনেকগুলি বিশেষণ বসাতে হয়— সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ, অধ্যাপক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের সার্থক রচয়িতা ও আলোকচিত্রী। এরপরেও তাঁর আরও বেশ কয়েকটি পরিচয় বাদ পড়ে গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। সর্বোপরি তিনি ছিলেন এক আদ্যন্ত বিজ্ঞানমনস্ক ও যুক্তিবাদী মানুষ। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম পেয়েছিল তাঁর স্নেহ ও প্রশ্রয়। আজ তাঁর প্রয়াণ-ক্ষণে আমাদের স্টিম ইঞ্জিন বিভাগে আমরা সলিল বিশ্বাসকে স্মরণ করছি তাঁরই অনূদিত একটি কল্পবিজ্ঞান গল্পে। মূল গল্পটি আইজ্যাক আ্যাসিমভ-এর 'দ্য ইমমরটাল বার্ড'। গল্পটির একটি স্বাদু বাংলা রূপান্তর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সলিল বিশ্বাস রচিত 'খোয়াবওয়ালা ও আরও বারো' গ্রন্থে। তেরোটি কল্পবিজ্ঞান গল্প (মৌলিক এবং অনূদিত গল্প) ছাড়াও এই গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশে রয়েছে বিশ্বের কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য ও বাংলা ভাষায় কল্পবিজ্ঞান চর্চা নিয়ে লেখকের কিছু মৌলিক ভাবনার কথা। ঋতাক্ষর প্রকাশিত (জানুয়ারি, ২০১৯) ও সুমুদ্রিত এই গ্রন্থটি বাংলা ভাষায় কল্পবিজ্ঞান চর্চার একটি জরুরি মাইলফলক হয়ে থাকবে।

‘পারি-ই তো!’ ডক্টর ফিনিয়াস ওয়েলচ বললেন, ‘অতীত যুগের বিখ্যাত মৃত ব্যক্তিদের আত্মা বর্তমানে টেনে আনতে অবশ্যই পারি আমি!’

ভদ্রলোকের তখন বেশ বেসামাল অবস্থা। নইলে কথাটা উনি বলতেন না বোধহয়। কলেজে ফ্যাকালটি ক্লাবে ক্রিসমাস ইভের ককটেল পার্টিতে দু-পাত্র বেশি চড়ানো কিছু নীতিবিরুদ্ধ নয়। মন একটু-আধটু রঙিন না হলে আর মজা কী!

ইংরেজি সাহিত্যের তরুণ অধ্যাপক স্কট রবার্টসন চশমা ঠিক করতে করতে এদিক-ওদিক দেখে নিলেন কথাটা শুনে। অন্য কেউ শুনছে না তো! ‘ডক্টর ওয়েলচ, আপনি বোধহয় একটু বেশি টেনে ফেলেছেন!’

‘ধ্যাৎ! কিচ্ছু বেশি টানিনি। আরে, সত্যি বলছি। শুধু আত্মা কেন? তাদের সশরীরে হাজির করাতে পারি আমি।’
‘তা কী করে সম্ভব?’ রবার্টসন আদৌ বিশ্বাস করতে পারে না। ‘যত আষাঢ়ে গল্প!’
‘কেন সম্ভব নয়? নিছক একটু টাইম ট্রাভেলের ব্যাপার।’
‘আপনি বলতে চান কালান্তরে ভ্রমণ, এইচ জি ওয়েলস-মার্কা টাইম ট্রাভেল? তা আবার হয় নাকি?’
‘খুব হয়! করতে জানলেই হয়!’
‘কী করে হয়?’
‘হুঁ হুঁ বাবা, বলব ভেবেছ তোমায়? পদার্থবিদ ওয়েলচ গম্ভীর। আশেপাশে তাকিয়ে ভদ্রলোক আরেক পাত্র ককটেলের সন্ধান করে নিলেন। না পেয়ে রবার্টসনের দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, ‘বেশ কয়েকজন বৈজ্ঞানিক আমার দৌলতে এই বর্তমান কালে বেরিয়ে গেছেন, জান? আর্কিমিদিস, গ্যালিলিও, নিউটন, লিওনার্দো! দ্য ভিঞ্চি। কিন্তু সহ্য হল না বেচারাদের।’ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেন ওয়েলচ।
‘কেন? পছন্দ হল না বর্তমান যুগ? আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতি দেখে ওদের তো ভয়ানক খুশি হওয়ার কথা!’ এবারে রবার্টসনের বেশ মজাই লাগতে শুরু করেছে।
‘হ্যাঁ, খুশি তাঁরা হয়েছিলেন বটে। বিশেষ করে আর্কিমিদিস। আহ্লাদে আটখানা একেবারে। আমাকে অবশ্য একটু গ্রিক শিখতে হয়েছিল ওঁর সঙ্গে কথা বলার জন্যে। আর্কিমিদিসের কাছে একটা ঘটনা জানলাম, জান! ওই যে বলে না, সেই বাথটাব থেকে লাফিয়ে উঠে ইউরেকা বলে ছুটেছিলেন আর্কিমিদিস৷ সেটা সত্যি কথা। তবে স্রেফ জন্মক্ষণের পোশাক পরেছিলেন সেটা সত্যি নয়, একখণ্ড কৌপীন ছিল পরনে।’

পাশ দিয়ে একটা বেয়ারা যাচ্ছিল। তার ট্রে থেকে একটা ককটেলের গ্লাস ছোঁ মেরে তুলে নিলেন ডক্টর ফিনিয়াস ওয়েলচ।

রবার্টসন একেবারে অসহিষ্ণু। ‘তা তো হল। কিন্তু ওঁরা কী করলেন? আর বেচারা বলছেন কেন ওঁদের?’

‘সহ্য হল না শেষ পর্যন্ত। আমাদের জীবনযাত্রা আচার-আচরণের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারলেন না ওঁরা। ভীষণ নিঃসঙ্গ, ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়লেন সকলে। আসলে আমাদের এই নতুন ধরনের সংস্কৃতি ওঁদের ভড়কে দিল।  ‘কালচার শক’ বলে একটা কথা আছে জান তো?’
‘যাচ্চলে!’
‘আর বল কেন! বিরাট বিরাট সব প্রতিভা, কিন্তু মনগুলো বড্ড একটেরে। একটুও নমনীয় নয়। প্রসার নেই মোটেই। তাই, যাকে বলে, ইউনিভার্সাল মনওয়ালা লোক খুঁজতে গিয়ে মনে পড়ল শেকসপিয়ারের কথা।’
‘কী’ চেঁচিয়ে উঠলেন রবার্টসন। ‘আপনি শেকসপিয়ারকে এনেছিলেন?’
‘চেঁচিয়ো না।’ চোখ পিটপিট করে ককটেলে চুমুক মেরে ওয়েলচ বললেন, ‘চেঁচালে আমার মাথা ধরে। হ্যাঁ, এনেছিলাম শেকসপিয়ারকে। এমন একজন প্রতিভা দরকার ছিল আমার যে মনুষ্যচরিত্র ভালো বুঝবে এবং যেকোনো পরিস্থিতিতেই মানুষের সঙ্গে বাস করতে পারবে। তার নিজের যুগের বহু শতাব্দী পরেও। উইলিয়াম শেকসপিয়ার হল সেই লোক। দেখবে? তার অটোগ্রাফ দেখবে? সঙ্গেই আছে।’

এ-পকেট ও-পকেট হাতড়ে ওয়েলচ বার করলেন একটুকরো মোটা কাগজ৷ তার এক পিঠে ছাপা রয়েছে ‘এল ক্লাইন অ্যান্ড সনস৷ ওয়াইন মার্চেন্ট’, অন্য পিঠে ত্যাড়াব্যাঁকা অদ্ভুত হরফে সই করা ‘William Shakespeare’।

রবার্টসনের চক্ষু চরকগাছ। কয়েক সপ্তাহ আগে দেখা একটা লোকের কথা মনে পড়ল তার৷ তাহলে কি… কী সর্বনাশ! ‘কে-কেমন দেখতে শেকসপিয়ারকে?’ তোতলাতে থাকেন রবার্টসন।

‘ছবিগুলোর মতো একটুও নয়। মস্ত টাক, আর বিশ্রি একটা গোঁফ। আর কথা বলার ভঙ্গি? কী যেন সেই কবির কথা… ‘Warble his native woodnotes wild’ না কী যেন? কচু! কথা শুনলে মনে হবে জংলি ভূত! আমি অবশ্য ওকে খুব বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম যে আমরা ওর নাটকগুলোকে খুব উঁচুদরের সাহিত্য বলে মনে করি, আর এখনও ওগুলো স্টেজে অভিনীত হয়। বলেছিলাম, ওর নাটকগুলো ইংরেজি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। শুধু ইংরেজি কেন, বিশ্বসাহিত্যেও ওগুলোর জুড়ি মেলা ভার।’
‘ঠিকই তো, ঠিকই তো!’ রবার্টসন ভয়ানক উত্তেজিত।
‘আরও বলেছিলাম, ওর নাটক নিয়ে কত আলোচনা হয়েছে, কত প্রবন্ধ আর বই লেখা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। খুব উৎসাহী হয়ে ও একটা বই পড়তে চাইল। একটা বই এনেও দিলাম লাইব্রেরি থেকে।’
‘কী বললেন উনি?’ দম প্রায় আটকে আসে রবার্টসনের।
‘খুব অবাক আর মুগ্ধ হল, আবার কী! অবশ্য তখনকার ভাষা আর লেখার ধরন বুঝতে একটু অসুবিধা হচ্ছিল ওর। তাছাড়া ১৬০০ সালের পরের ঘটনাগুলোর উল্লেখ থাকলে ধরতেও পারছিল না ঠিক। আমি বুঝিয়ে-টুঝিয়ে দিলাম আর কি! বেচারা বিল! এইরকম চুল-চেরা বিচার আর খুঁটিয়ে আলোচনা যে হয় তা ওর ধারণাই ছিল না। বারে বারে বলতে লাগল, ‘হা ঈশ্বর! সামান্য শব্দ হইতে পাঁচশত বৎসরে কতই-না অর্থ দোহন করা যাইতে পারে! ইহা যেন একটি সিক্ত কৌপীন নিংড়াইয়া প্রবল জলোচ্ছাস ঘটাইবার প্রচেষ্টা!’
‘শেকসপিয়ার এমন কথা বলতেই পারেন না!’ রবার্টসন খেপে যান।
‘ঘণ্টা জান তুমি! আরও কী বলল জান? বলল, ‘হ্যামলেট’ লিখতে ওর মোট ছ-মাস লেগেছিল। ওর দলের পরিচালক খুব তাড়া দিচ্ছিল কিনা! গল্পটা পুরোনো৷ ও শুধু একটু ঘষে-মেজে দিয়েছিল।’
‘তা-ই তো! কাচের টুকরো ‘ঘষে-মেজে’ যেমন শক্তিশালী টেলিস্কোপ তৈরি হয়।’ রবার্টসনের কণ্ঠে শ্রদ্ধা ঝরে পড়ে।

ওয়েলচ ওর কথাকে আমলই দিলেন না। বললেন, ‘কবিবরকে আমি আরও বললাম, আমাদের কলেজে ওর নাটকের উপরে অনেকগুলি ‘কোর্স’ আছে।’

‘আছেই তো। আমারই তো একটা কোর্স আছে বড়দের জন্যে সান্ধ্য বিভাগে।’
‘জানি। তোমার ক্লাসে ওকে দিলাম ভর্তি করে। বেচারা বিল। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ওকে কী মনে করে তা জানতে এত আগ্রহ আমি আর কারও মধ্যে দেখিনি। খুব খেটে পড়াশুনো করতে লাগল ও।’
‘আমার ক্লাসে শেকসপিয়ার ছাত্র!’ মাতালের প্রলাপ হিসেবেও কথাটা সাংঘাতিক। আর মাতালের প্রলাপ কি সবটাই? রবার্টসনের মনে পড়ল, হ্যাঁ, তাই-তো, একজন টাকমাথা লোক, অদ্ভুত বাচনভঙ্গি… সর্বনাশ!
‘অন্য নামে ভর্তি হয়েছিল ও অবশ্য। নামে কী আসে-যায়! কাজটা খুব ভুল করেছিলাম হে! ওইজন্যেই ওকে শেষ পর্যন্ত ফেরত পাঠাতে হল আমার। আহা বেচারি!’ মাথা নাড়তে লাগলেন ওয়েলচ।
‘কী ভুল হল? কী হয়েছিল?’ রবার্টসন রুদ্ধবাক।

এইবার চটে গেলেন ওয়েলচ। ‘ভুল নয়? তোমার জন্যই শেকসপিয়ারকে ফিরে যেতে হল সপ্তদশ শতকে। একটা মানুষ কত অপমান সহ্য করতে পারে বল?’

‘আমি… আমি কী করলাম?’
‘শেকসপিয়ারের নাটকের উপর পরীক্ষা দিতে বসেছিল শেকসপিয়ার নিজে। আর তুমি তাকে সেই পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দিলে, হাঁদারাম! তারপরেও জানতে চাইছ কী করেছ? যত্তসব!’

বিড়বিড় করতে করতে চোখ পাকিয়ে অন্য দিকে হাঁটা দেন ডক্টর ফিনিয়াস ওয়েলচ। হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন রবার্টসন।


*আইজ্যাক অ্যাসিমভ-এর ‘দ্য ইমমরটাল বার্ড’ অবলম্বনে। বানান অপরিবর্তিত