Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সর্বনাশের অভি-স(শ)প্তপদী: নাগরিক আইন এবং অতঃপর

সঞ্জীব দেবলস্কর

 




প্রাবন্ধিক, ভাষাতাত্ত্বিক, গল্পকার, কলামনিস্ট

 

 

 

অবশেষে “সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ২০১৯”, ইংরেজি সংক্ষেপে “ক্যা” বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হল। বর্তমান সরকারের সপ্তম বর্ষ পূর্তিতে ভারতবাসীর এই আরেক প্রাপ্তি, যা নাকি জুলাই মাসেই কার্যকরী হয়ে যাবে। কোভিড সংক্রমণ, অতিমারি এসব এতে কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের জারি করা এক নোটিফিকেশনে বলা হল আমাদের এই সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, সামাজবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, প্রজাতন্ত্রে বসবাসকারী শরণার্থী উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। অবশ্য এটা স্পষ্ট করে দেওয়া আছে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, শিখ, পার্সি এবং খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরাই এ আইন মোতাবেক নাগরিকত্ব লাভ করতে পারবেন। (মুসলমানকে তো আর এ আইনের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে না, এমনকি ওদের দেশে “ধর্মীয় কারণে” অত্যাচারিত হলেও না, হায় হায় ধর্মনিরপেক্ষতা!)। এ সুবিধাটা অবশ্য পাবেন দেশবিভাগের প্রত্যক্ষ আঘাতের বাইরে যে অঞ্চলের অবস্থান সেই গুজরাট, ছত্তিশগড় এবং অবশ্য পশ্চিম সীমান্তসংলগ্ন পাঞ্জাব ও হরিয়ানার ১৩টি জেলার শরণার্থীরাই। হ্যাঁ, যাঁরা স্বাধীনতা বা দেশভাগের অব্যবহিত পরে ভারতে (হিন্দুস্তানে, অনেকে আবার এরকমও বোঝেন যে, হিন্দুস্তান = হিন্দুদের স্থান, হিন্দুস্তান বানানটি লক্ষ্যণীয়) এসেছেন এঁরা তো বটেই, সে সঙ্গে যাঁরা এসেছেন ১৯৫১, এবং ১৯৭১ সালে, এমনকি ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদেশে নিপীড়িতরাও। দেশবিভাগ এবং বাস্তুচ্যুতির আঘাত যে-বর্ডার সংলগ্ন অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি অনুভূত হয়েছে, এর মধ্যে আন্যতম অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গ-অসম-ত্রিপুরাই এ থেকে বাদ!

আপাতত ব্যাপারটা যত সহজ মনে হচ্ছে আসলে কি ততটুকু? দান যখন দুহাতের নাগালের বাইরে চলে যায়, তখন এ কর্ম আর সহজ থাকে না। এ নাগরিকত্ব আইনের সুযোগ নেওয়ার মানুষ এ অবস্থায় যথেষ্টের চাইতেও কম হবে। যত গর্জেছে ততটা বর্ষণ কি হবে? তবে হ্যাঁ, বিদেশের মাটিতে বসবাসকারী হিন্দুদের দু হাত তুলে ভারতের মাটিতে এই সাদর আমন্ত্রণের (অবশ্য retrospective আমন্ত্রণ) মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন দাদাগিরিও বোধহয় নিহিত আছে। সেটা বিদেশি হিন্দুদের মনের মধ্যে নতুন করে পালাই পালাই ভাবনা না জাগিয়ে তুললেই হয়। বাংলাদেশে তো বেচারাদের মাঝেমধ্যে শুনতে হয় এদের নাকি একটা পা হিন্দুস্তানের দিকে বাড়ানোই আছে।

সে যাই হোক্‌, যে-দেশে রয়েছে প্রবল শক্তিধর সীমান্তরক্ষী, ততধিক প্রতাপশালী প্রতিরক্ষাবাহিনি, যে-দেশের সীমান্তে রয়েছে দুর্ভেদ্য কাঁটাতারের বেড়া, এবং অধিকন্তু প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যে-দেশের সীমান্ত এলাকায় (বিশেষ করে পাকিস্তান, বাংলাদেশের সঙ্গেও) রয়েছে প্রতিনিয়ত ঝগড়া বিবাদ, গোলাগুলি— এর মধ্যে ২০১৪ সাল পর্যন্ত অনুপ্রবেশের ঢল যে অব্যাহত ছিল, সে কথাটা কিন্তু এ বয়ানের মধ্যে প্রকারান্তরে স্বীকার করাও হয়ে গেল। ব্যাপারটা বাস্তবতার সঙ্গে কতটা সঙ্গতিপূর্ণ এটাও সন্দেহাতীত নয়। তাহলে দুর্জনেরা (বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে) যে কী-সব বলে বেড়ায় তা কি সত্যি? দেশের বর্ডার তাহলে স্বীকৃতভাবেই অরক্ষিত? যদি তা-ই সত্যি হয় তবে দোষটা যতটা ঘুসপেটিয়াদের, ততটাই তো সীমান্তসুরক্ষা বিভাগেরও, এবং দেশের প্রশাসনেরও। এ খাতে এত হাজার কোটি টাকা কি জলে ঢালার জন্য?

আচ্ছা সেও না হয় গেল, এখন কথা হল যে-সব ঘুসপেটিয়াদের ক্ষমাঘেন্না করে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে শোনানো হল, এরা কী করে সার্টিফিকেট দাখিল করবেন যে, নিজ দেশে ধর্মীয় পীড়নের শিকার হয়ে এদিকে পালিয়ে এসেছেন? প্রাণের ভয়ে পালাবার সময় কি প্রমাণপত্র নিয়ে আসার ফুরসৎ কারও থাকতে পারে? একটা পদ্য আছে না, “কী যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কীসে/ কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।”

সংসদে গৃহীত আইনের একখানা কপি দেখিয়ে ওপার থেকে একটি পীড়ন-পত্র আনার প্রস্তাব নিয়ে পাকিস্তান বা আফগানিস্তানে গেলে যে ঘোড়াও হাসবে। অবশ্য যে-দেশে একটু বুঝিয়েসুজিয়ে ঘোড়াদের হাসি চাপানো যেতে পারত, পক্ষান্তরে যে-রাষ্ট্র দেশের সর্ববৃহৎ সংখ্যক বহিরাগত চালানের অভিযোগে অভিযুক্ত, সে-দেশের কাছে এরকম একটা আবদার নিয়ে একবার না হয় কাউকে পাঠানো যেতেও পারত, এ সম্ভাবনার মূল উৎপাটন করেই বুঝি বুদ্ধি করে ওই দেশ থেকে আগত শরণার্থীদের— যাঁদের সিংহভাগ আশ্রয় নিয়েছেন অসম আর বাংলায়, সেই দুটো প্রদেশকেই সরিয়ে রাখা হল আইনের আওতা থেকে।

কে না জানে অসম এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে বঙ্গীয়মূলের অভিবাসীরা রয়েছেন কয়েক শতাব্দী ধরে। পাছে এঁরা এ নাগরিকত্ব আইনের ছিটেফোঁটাও লাভ করে ফেলেন তাই বুঝি এ অঞ্চলকে নাগরিকত্ব আইনের আওতার বাইরে রাখা হল? কিন্তু বিগত দিনগুলোতে “ক্যা” নিয়ে যত চিৎকার হল্লা দাঙ্গাহাঙ্গামা আন্দোলন প্রতিরোধ এবং সে সঙ্গে বিদেশি অনুপ্রবেশ সমস্যা নিয়ে যত অভিযোগ, সমস্ত কিছুর আঁতুড়ঘর তো এই অসম রাজ্যই।

অসমের কথা বললে বলতে হয়, এটা ঐতিহাসিক সত্য পাকিস্তান থেকে পূর্বোত্তরে যত শরণার্থী এসেছেন এর এক বিরাট অংশ এসেছেন অসমে। দেশভাগের সময় অসমের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ সিলেট (সঙ্গে কাছাড়-গোয়ালপাড়ার কিছু অংশ) পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তরিত হয়ে গেলে সঙ্গতকারণেই যাঁরা ১৮৭৪ থেকে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত অসমের নাগরিক (যাঁরা আবার ধর্মে হিন্দুই) আর, যাঁদের ইসলামীয় পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টিতে কোনও ভূমিকা থাকার কথাও নয়, সেই সরকারি কর্মী, শিক্ষক, বেসরকারি কর্মী, উকিল-মোক্তার-মুহুরি, ডাক্তার-বৈদ্য, বাস্তুকার, ব্যবসায়ী, এমনকি নেতামন্ত্রী, চাষি, মাঝি যাঁদের সুযোগ ছিল তাঁরা অসমেই চলে এলেন। অসম তো তাঁদের সাবেক রাজ্যও বটে। এটা তো অনুপ্রবেশ বলা চলে না (অবশ্য এনআরসি-র মরশুমে এদের উত্তরসূরিদেরও নাগরিকত্বও প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন)। এরা তো ভারতের হারিয়ে যাওয়া ভূখণ্ড থেকে যে খণ্ডটিকে ভারতে রাখা গেছে সেখানেই সরে এসেছেন মাত্র। কিন্তু হায়! এ সংশোধিত নাগরিক আইনে এই জনগোষ্ঠী— যাঁরা আদি অকৃত্রিম হিন্দু, এবং হিন্দুত্ব রক্ষা করার জন্যই ইসলামীয় রাষ্ট্র ছেড়ে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে এসেছেন, যাঁদের নাগরিকত্ব নিয়ে এত প্রশ্ন, সংশয়— এঁদের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হল।

তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান এবং অতঃপর বাংলাদেশে হিন্দু-নিপীড়নের কাহিনি তো কথঞ্চিৎ উচ্চগ্রামেই প্রচারিত হয়ে আসছে এপারে। আজ যখন এর প্রতিবিধানের সময় এল তখন সেই রাষ্ট্রের প্রকৃত নিপীড়িতদের নাগরিকত্বের কোন সংস্থানই রাখা হল না সংশোধিত এ আইনে। কীসের জন্য? এ উৎপীড়িতরা তো মুসলিম নয় (সাতচল্লিশ থেকে একাত্তর পর্যন্ত মুসলিম রাষ্ট্রে বসবাস করে যবন দোষে দুষ্ট হল কি না কে জানে!)। তবে কি এদের মুখের ভাষাই এখানে একটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে? কিন্তু ভাষা নিয়ে একটি কথাও তো এ আইনে নেই। নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতির ক্ষেত্রে আপাতত আমরা ধর্মে আছি, ভাষাতে নেই। তাই নয় কি?

স্বাধীনতা বা দেশবিভাগের সূচনার কথা বাদ দিলেও সুস্পষ্টভাবে দু হাজার চার সাল থেকে এই “ক্যা” নিয়ে ভারতবর্ষে যে রাজ্যটি সবচাইতে বেশি আন্দোলিত হয়েছে তা হল অসম। আর, যে-জনগোষ্ঠী এর পক্ষে-বিপক্ষে আন্দোলনে নেমেছে এরা আবার অসমিয়া এবং বাঙালি উভয়ই। বাঙালি হিন্দুরা যেমন “ক্যা” সমর্থন করেছেন, তেমনি অনেকে আবার “ক্যা” বিরোধিতাও করেছেন। আরও বিশেষ উল্লেখনীয় হল, ২০১৬ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে যে যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠিত হয় সে কমিটি অসম থেকে একাধিক বিভিন্ন নাগরিক প্রতিনিধিদের নিয়ে দিল্লি, গৌহাটি এমনকি শিলচরে ব্যাপক আলোচনায় বসেছে। এতে এটা তো পরিষ্কার এ বিলের সঙ্গে অসম সবচাইতে বেশি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।

এই বিলকে ইস্যু করে রাজ্যে এবং কেন্দ্রে দু দুটো নির্বাচনও হয়ে গেল। “ক্যা”-বিরোধিতা জারি রেখেও অসমে ক্ষমাতাসীন দলকে পুনর্নিবাচিত করেছেন যে-অসমিয়া জনগোষ্ঠী, তাঁদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে এই বিগত নির্বাচন তক্‌ যাঁরা লড়াই করেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন প্রচুর বঙ্গসন্তান, প্রতিনিয়ত যাঁদের সন্দেহজনক নাগরিক, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ইত্যাদি অভিধা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।

একই সঙ্গে এই “ক্যা”-র সমর্থনেই অসমের দক্ষিণাঞ্চলে বরাক উপত্যকার বাঙালিরা দু দুবারই ঝুলি ভরে ভোট দিয়ে কেন্দ্র-রাজ্যে সরকার গড়তে সহায়তাও করেছেন। এঁরা “ক্যা” সমর্থন করে গেছেন এই বিবেচনায় যে, যদিও তাঁরা প্রশ্নাতীতভাবেই বৈধ ভারতীয় নাগরিক তবুও এ সংশোধনী তাদের ডি-ভোটার হওয়া, ডিটেনশন ক্যাম্পের যাওয়ার আশঙ্কা, এনআরসি হেনস্থা, খিলঞ্জিয়া বা স্থানীয় অধিবাসী হিসেবে অস্বীকৃতির সম্ভাবনা থেকে হয়তো মুক্তি দেবে।

সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে নাগরিকত্ব বিলটি আজ আইনে পরিণত হয়ে গেছে। তবুও এর পেছনে সংবিধানের কতটা স্বীকৃতি রয়েছে বা কোথাও ভারতীয় সংবিধানের কোনও ধারা লঙ্ঘিত হল কি না এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয়ই তাঁদের মতামত দেবেন, তবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে এ সংশোধনীতে আরও একটি ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর দিকটি একেবারেই বিবেচনায় না আনাটা কতটা যুক্তিযুক্ত সেটাও দেখার প্রয়োজন।

যে সব রাষ্ট্রে হিন্দু-খ্রিস্টান-জৈন-বৌদ্ধ-পার্সিদের নিপীড়নের কথা রয়েছে সে সব রাষ্ট্রেই এই ধর্মীয় কারণেই যে অসংখ্য মুসলিম ধর্মাবলম্বীও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, হচ্ছেন— তাঁদের জন্য একটা সংস্থান রাখলে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা আজ বিশ্বের কাছে একটা বিশেষ উদাহরণ হয়ে থাকত।

পরাধীন ভারতে যে-মুসলিমরা দেশের অখণ্ডতার জন্য লড়াই করেছেন, কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে, গান্ধি মহারাজের শিষ্য হিসেবে, আজাদ হিন্দ বাহিনির সেনা হিসেবে, অথবা জমিয়ত-এ হিন্দ-কর্মী হিসেবে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর ওপারে তাঁরাও প্রবল নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এ ইতিহাস কি আমরা ভুলে যাব, না ভুলতে পারা সম্ভব? হিন্দুদের মতো এদের অনেকেও নিজেদের স্বপ্নের দেশ ভারতবর্ষে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। অন্য রাজ্যে জানি না, তবে পশ্চিমবঙ্গ এবং অসমে হিন্দুদের মতো এরাও রিফ্যুজি বলে (নিন্দিত না হলেও) আখ্যায়িত হন। ভারতবর্ষের মত একটি মহান রাষ্ট্রের এঁদের কথা কি একেবারে অস্বীকার করা বা করতে পারা উচিত? এত গুরুত্বপূর্ণ একটা নাগরিকত্ব আইন গৃহীত হল অথচ এটাকে সম্পূর্ণ করে তোলার সেরকম কোনও প্রয়াস দেখা গেল কি?