Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মোদিনমিক্সের সপ্তম বর্ষপূর্তি

সুশোভন ধর

 



প্রাবন্ধিক, রাজনৈতিক কর্মী ও বিশ্লেষক

 

 

 

 

প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি সাত বছর পূর্ণ করলেন। তিনি ও তার বিশ্বস্ত সহচর অমিত শাহ যতটা প্রচারের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে থাকতে ভালোবাসেন সেই তুলনায় বেশ সাদামাটা ও আড়ম্বরহীন কাটল তাঁর এই সপ্তম বর্ষপূর্তি। হয়ত অতিমারির সঙ্কট ও পশ্চিমবঙ্গ সহ চার রাজ্যে হারের মুখ দেখতে না হলে মোদি তাঁর ৫৬ ইঞ্চি ছাতি থাবড়ে দেশবাসীকে নিজের ‘অউকাত’ বোঝাতে পিছপা হতেন না। মোদি-শাহ জুটি পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ নিয়ে বেশ নিশ্চিত ছিলেন এবং তাঁদের আচরণ থেকে স্পষ্ট যে এই ফলাফলে তাঁরা বেশ মুষড়ে পড়েছেন। দ্বিতীয়ত করোনা সঙ্কট মোকাবিলায় কার্যত ব্যর্থ কেন্দ্রীয় সরকার এই মুহূর্তে বেশ চাপে আছে।

 

মোদি-মহলের দাবী

জনসমক্ষে আড়ম্বরপূর্ণ উদযাপন করা থেকে বিরত হলেও কিন্তু মোদি-মহল সরকারের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরতে পেছপা হয়নি। আরএসএস-এর পত্রিকা অর্গানাইজার-এ বেশ কিছু লম্বা চওড়া দাবি রেখেছেন অর্থনীতিবিদ, বিজেপির মুখপাত্র এবং বেস্টসেলার লেখক সঞ্জু ভার্মা। শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ এবং ফিনান্স পুঁজির জগতের এই ব্যক্তি মনে করেন যে মোদি সরকারের ঐতিহাসিক সাফল্য সংবিধানের ৩৭০ এবং ৩৫এ ধারা বাতিল করা। এছাড়া তালিকায় আছে তিন তালাক বাতিল, চিন-বিরোধী সামরিক জোট ‘কোয়াড’ গঠন, কেরল ছাড়া দেশের অন্যান্য অংশে বামপন্থীদের বিলুপ্তি এবং অতি অবশ্যই মোদিনমিক্স। মোদি সরকারের মনমোহিনী অর্থনৈতিক সাফল্য হিসাবে তিনি তিনটি প্রধান পদক্ষেপ তুলে ধরেছেন— নয়া কৃষি আইন, নতুন শ্রম কোড এবং ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সংস্কার। বিজেপি শাসনকালে ভারতের ব্যাঙ্ক-শিল্প অভুতপূর্ব সঙ্কটে নিমজ্জিত হওয়া সত্ত্বেও সঞ্জু ভার্মা ভারতীয় ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার মুশকিল-আসান হিসাবে নরেন্দ্র মোদিকে তুলে ধরেছেন।

তাঁর মতে ‘আত্মনির্ভর’ ভারত গঠন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে দেশি-বিদেশি বেসরকারি পুঁজির কাছে পাবলিক সেক্টর সংস্থাগুলো বিক্রি ও ৫ ট্রিলিয়ন (লক্ষ কোটি) ডলারের অর্থনীতি নির্মাণের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্য মোদির কোনও বিকল্প নেই। যে সমস্ত দুষ্টু এনজিও মোদি সরকারের নীতির বিরোধিতা করে তাদের বিদেশি অনুদান পাওয়া বন্ধ করার জন্য তিনি মোদির কাছে কৃতজ্ঞ।

৫ ট্রিলিয়ন অর্থনীতির গপ্পো

অবশ্য বহু বিশেষজ্ঞের মতে ৫ ট্রিলিয়ন-এর গল্প সাম্প্রতিক কালের অন্যতম বড় জুমলা বা মিথ্যাচার। আজ থেকে বছর দুই আগে এক সমালোচক মনে করিয়েছিলেন যে “উৎপাদনক্ষেত্রের বৃদ্ধি হলেই (…) শ্রমিকের কাজের সুযোগ বাড়বে এমন নিশ্চয়তা কোথায়? এই প্রশ্ন উঠছে কারণ এই মুহূর্তে শুধু আর্থিক বৃদ্ধি নয়, অর্থনীতিতে কাজের সুযোগ বৃদ্ধি করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত। তথ্যগতভাবে প্রমাণিত সত্য এটাই যে ভারতীয় অর্থনীতির বৃদ্ধির যা চরিত্র, তা কাজের সুযোগ তৈরি করছে না। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৯ সাল আর্থিক বৃদ্ধির হার ৬.৮ শতাংশ, কাজের সুযোগ বেড়েছিল ১ শতাংশ হারে; ১৯৯৯ থেকে ২০০৪ সাল অর্থনীতি বাড়ছে ৫.৭ শতাংশ হারে আর কাজের সুযোগ তৈরি হচ্ছে মাত্র ২.৮ শতাংশ হারে; ২০০৪ থেকে ২০০৯ এই দুই হারের প্রথমটা ৮.৭ শতাংশ আর দ্বিতীয়টা মাত্র ০.১ শতাংশ; ২০০৯ থেকে ২০১১ প্রথমটা ৭.৪ শতাংশ আর দ্বিতীয়টা ১.৪ শতাংশ; ২০১১ থেকে ২০১৫ প্রথমটা ৬.৮ শতাংশ আর দ্বিতীয়টা ০.৬ শতাংশ।[1]

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকার এক রিপোর্ট থেকে আমরা জানতে পারি যে ২০১৭-১৮ আর্থিক বছরের উচ্চ বেকারত্বের হার তার আগের ৪৫ বছরের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দেয়। জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশনের দেশের কর্মসংস্থানের তথ্য এবং পরিসংখ্যান সংক্রান্ত সমীক্ষার একটি ‘গোপন’ রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে ওই বছরে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৬.১ শতাংশ। সরকার ওই রিপোর্ট প্রকাশ করতে চায়নি এবং অতঃপর কেন্দ্রের বিরুদ্ধে এই রিপোর্ট চেপে রাখার অভিযোগ তুলে ইস্তফা দেন ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল কমিশন-এর ভারপ্রাপ্ত প্রধান পি সি মোহনন এবং আর একজন সদস্য, প্রাক্তন ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল সার্ভিস অফিসার এবং দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্স-এর অধ্যাপক, জে ভি মীনাক্ষী।

বিশ্ব ক্ষুধা সূচক র‌্যাঙ্কিংয়ে ভারতের ক্রমাগত পতন ইঙ্গিতবাহী ছিল। ২০০০ সালে ১১৩টা দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ছিল ৮৩। দুই দশক পরে, GHI-2019 অনুযায়ী ১১৭ দেশের মধ্যে ভারত ১০২ নম্বর স্থানে। আমাদের সমস্ত প্রতিবেশী দেশ, চিন (২৫), শ্রীলঙ্কা (৬৬), মায়ানমার (৬৯), নেপাল (৭৩), বাংলাদেশ (৮৮) এবং পাকিস্তান (৯৯) ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে।

এসব অতিমারির প্রকোপে সৃষ্টি হওয়া অর্থন‌ৈতিক সঙ্কটের আগের গল্প। গত বছর সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি বা সিএমআইই-এর রিপোর্ট অনুযায়ী এপ্রিল-জুলাই ২০২০-র মধ্যে ১ কোটি ৮০ লক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীর চাকরি গেছে। পরবর্তীকালে অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে এর বহুগুণ বেশি মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্রের পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে ঠিক কত কোটি শ্রমিক-শ্রমজীবী আসলে কর্মচ্যুত-জীবিকাচ্যুত হয়েছেন তা ঠাহর করা মুশকিল।

কর্মসংস্থানের প্রশ্ন বাদ দিয়ে যদি দেশের মোট বার্ষিক আয় বা জিডিপি-র দিকে তাকাই তাহলে দেখব যে ভারতের জিডিপি এই মুহূর্তে ২.৭২ ট্রিলিয়ন ডলার। এখান থেকে ২০২৪-এ ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি গড়ে তুলতে গেলে প্রায় ২৩ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রয়োজন যা এককথায় অসম্ভব বললেও কম বলা হবে। অবশ্য ভারতীয় অর্থনীতি কোনও একদিন নিশ্চয় ৫ ট্রিলিয়ন ডলার পার করবে— সে মোদি থাকুন আর নাই থাকুন।

সংবাদ সংস্থা রয়টার্স ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থার গতি-প্রকৃতি বুঝতে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ফিনান্স-পুঁজি জগতের ২৯ জন নামকরা অর্থনীতিবিদের মতামত নেয়। তাঁদের অভিমত, টীকাকরণ কর্মসূচি ধীর গতিতে চলার ফলে— গত অর্থবছরে সবচেয়ে গভীর মন্দার পরে— চলতি অর্থবছরে অর্থনীতির গড় বৃদ্ধি বড়জোর ৬.৮ শতাংশ হতে পারে। রয়টার্সের এই পোলে দেখা গেছে, ভারতের অর্থনৈতিক দিশা আবারও খানিকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে যে অতিমারির সঙ্কট ঠিকঠাক মোকাবিলা না করতে পারলে আগামী দিনগুলিতে আরও বহু মানুষ কর্মচ্যুত হবেন। এই ২৯ জনের কেউই মনে করেন না ভারতবর্ষের অর্থনীতি এই মুহূর্তে ব্যাপকভাবে চাঙ্গা হতে পারে।

এরই মধ্যে সিএমআইই জানিয়েছে যে চলমান অর্থনৈতিক মন্দার ফলে, বেকারত্বের হার ২০২১-র মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে, এক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে বেড়ে হয়েছে ১৪.৭৩ শতাংশ। যে ২৯ জন অর্থনীতিবিদ মতামত দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম, ডাচ বহুজাতিক ব্যাঙ্কিং ও ফিনান্সিয়াল সার্ভিস সংস্থা, আইএনজি-র সিনিয়র এশিয়া ইকোনমিস্ট, প্রকাশ সকপাল বলেছেন, বাজারে চাহিদা ভয়ানক ধাক্কা খেতে চলেছে। এমনকি বেশ কিছু ক্ষেত্রে তা স্থায়ীভাবে বিলুপ্তও হতে পারে। এর প্রভাব পড়বে চাকরির বাজারে এবং আগামী কয়েক বছর বেকারত্বের হার বেশ ওপরে থাকবে।

অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে যখন গোটা দেশ বিপর্যস্ত, সেই সময় আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সাস্টেনেবল এমপ্লয়মেন্ট একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে যাতে বলা হয়েছে যে ২০২০ সালের শেষেও কর্মসংস্থান এবং আয় প্রাক-অতিমারি পর্যায়ে ফিরে আসেনি এবং করোনার সাম্প্রতিক ছোবল কেবলমাত্র এই সর্বনাশা সঙ্কটকে দীর্ঘায়িত করবে। গত ৫ মে প্রকাশিত, “স্টেট অফ ওয়ার্কিং ইন্ডিয়া ২০২১— কোভিড-১৯-এর এক বছর” শীর্ষক প্রতিবেদনটি থেকে আমরা জানতে পারি কীভাবে গত বছর অতিমারিতে পুরুষদের তুলনায় মহিলারা অনেক বেশি কাজ হারিয়েছেন, সংগঠিত ক্ষেত্রের প্রায় অর্ধেক শ্রমিক অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন এবং লকডাউনের ফলে দেশের দরিদ্র পরিবারগুলি আয়ের দিক থেকে অনেক বেশি ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে।

মোদির বিদেশি ভক্ত

এতদসত্ত্বেও, দেশে-বিদেশে মোদির গুণগ্রাহীর সংখ্যা খুব একটা কম নয়। যেমন মার্কিন থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ। ১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত এই দক্ষিণপন্থী, নিও-কনজারভেটিভ সংস্থাটি সারা বিশ্বে রক্ষণশীল এবং কমিউনিস্ট বিদ্বেষী বলে পরিচিত। এদের মূল কাজ পৃথিবীতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের পক্ষে জনমত গঠন করা যেমনটি তারা করেছিলেন রেগন প্রশাসনের কুখ্যাত নিকারাগুয়া নীতি নিয়ে বা ১৯৮৫ সালে মার্কিন সামরিক বাহিনির লিবিয়ার ওপর বোমাবাজির সময়ে। এই ধরনের আরও অজস্র উদাহরণ রয়েছে যা তালিকাবদ্ধ করতে বসলে পেনের কালি শুকিয়ে যাবে। এছাড়াও তারা মার্কিন প্রশাসনে নিযুক্তির জন্য দক্ষিণপন্থী অফিসারদের আঁতুড়ঘর হিসাবে কুখ্যাত। এহেন সংস্থটি মোদির কাজকর্মে বেশ উদ্দীপ্ত। তারা মোদি সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে একটা রিপোর্ট কার্ড বার করেছে। জিএসটি চালু করা, ডিজেলের দামের ওপর থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তোলা, রেলে ৫০ শতাংশের ওপর বিদেশি বিনিয়োগের ছাড়পত্র, নির্মাণ শিল্পে আরও বেশি বেশি করে বিদেশি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা, কয়লা খনন দেশি-বিদেশি পুঁজির জন্য উন্মুক্ত করা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল লাইসেন্সিং-এর ক্ষেত্রে সামাজিক ও পরিবেশগত আইনকানুন শিথিল করা, ব্যাঙ্করাপ্টসি আইন শিথিল করা, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য নির্ধারিত ক্ষেত্রগুলি বড় পুঁজির জন্য খুলে দেওয়া ইত্যাদির জন্য তারা মোদিকে ভুরি ভুরি নম্বর দিয়েছে। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের আরও অনেকগুলি পদক্ষেপ নিয়ে আশায় বুক বাঁধছে। যেমন, বিদেশি পুঁজির জন্য কর ছাড়, ন্যাচারল গ্যাসের দামের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ হ্রাস, বিমা-শিল্প, সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদন ও সরাসরি খুচরা পণ্যদ্রব্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিক্রি করা অর্থাৎ ই-রিটেল বাণিজ্যে ৫০ শতাংশের ওপর বিদেশি বিনিয়োগে ছাড়, মাল্টি-ব্র্যান্ড ও সিঙ্গল ব্র্যান্ড খুচরো বাণিজ্যে বিদেশি বিনিয়োগের নিয়মকানুন শিথিল করা, কর্পোরেটদের মর্জিমাফিক শ্রমিক ছাঁটাই করার অধিকার, ব্যাঙ্কের প্রায়রিটি লেন্ডিং বন্ধ করা। ব্যাঙ্কিং পরিভাষায় প্রায়রিটি লেন্ডিং হল কৃষি সহ অন্যান্য ছোট উদ্যোগে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণপ্রদান করা। তারা আশাবাদী যে কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রের দ্বারা জমি অধিগ্রহণ নীতি আরও শক্তিশালী করবে। মোদ্দা কথা হল বড় পুঁজির পক্ষে দাঁড়ানোর পরীক্ষায় মোদি সরকার লেটার মার্কস নিয়ে সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছে। এছাড়াও আগামীদিনের কর্মসূচি হিসাবে তারা ভারত সরকারকে একটা লিস্ট ধরিয়েছে যা মূলত দেশি-বিদেশি পুঁজির লুঠপাঠের রাস্তা সুগম করতে পারে।

 

এক ভয়ানক অসাম্য

২০২০-র মার্চে লকডাউন চালু হওয়ার পরে আমরা যেমন একদিকে দেখেছি হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারগুলির আর্তনাদ-হাহাকার, আবার অন্যদিকে বেশ কিছু বড় পুঁজিপতি ফুলেফেঁপে ঢোল হয়ে উঠেছে। যেমন ধরা যাক মুকেশ আম্বানি। করোনা পরিস্থিতিতে রিলায়েন্সের এই কর্ণধার ২০২০-২১ অর্থবর্ষে কোনও বেতন না নিলেও এই সময়ের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে তাঁর সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২১ সালের হুরুন গ্লোবাল লিস্টে বিশ্বের অষ্টম ধনী ব্যক্তি হিসেবে তিনি জায়গা করে নিয়েছেন। ২০২০-২০২১ অর্থবর্ষে তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬.০৯ লাখ কোটি। তার কিছুদিন আগে তিনি ব্লমবার্গের তালিকায় এশিয়ার ধনীতম ব্যক্তি হিসেবে ঠাঁই পেয়েছেন চিনা ধনকুবের ঝাং শানশানকে পিছনে ফেলে।

মোদি-ঘনিষ্ঠ আরেক বড় পুঁজিপতি গৌতম আদানি। গত এক বছরে আদানি গোষ্ঠীর উল্কার মতো উত্থান হয়েছে। বিশেষ করে, কোভিড-১৯ অতিমারি কালে, আদানি গোষ্ঠীর প্রায় সবকটি সংস্থার শেয়ার ফুলেফেঁপে উঠেছে। ২০২১ সালের গোড়া থেকে প্রথম পাঁচ মাসে গৌতম আদানির সম্পত্তি দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তিনি তরতর করে ওপরে উঠে ব্লুমবার্গ বিলিয়নেয়ার ইন্ডেক্সে বিশ্বের ১৫তম ধনী হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। এভাবে আর কিছুদিন চালাতে পারলে তিনি খুব শীঘ্রই এশিয়ার ধনীতম ব্যক্তি হিসেবে মুকেশ আম্বানিকেও সিংহাসনচ্যূত করবেন।

এই সুখবরগুলো এমন সময় আসছে যখন যখন দেশ অতিমারির ধাক্কায় জর্জরিত। একটি তথ্য বলছে, এই সময়কালে ভারতীয়রা ৬৬ হাজার কোটি টাকা খুইয়েছেন কারণ করোনাকালে চিকিৎসা বাবদ খরচ ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তার ওপর রয়েছে সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধি, আয় হ্রাস পাওয়া। ২০২১-এর জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত অক্সফ্যামের একটি রিপোর্ট— দ্য ইনিকুয়ালিটি ভাইরাস— বলছে যে ভারতে স্বাধীনতার পরে অসাম্য হ্রাস পেয়েছিল কিন্তু সম্প্রতি তা আবার ঔপনিবেশিক আমলের অবস্থায় ফিরে গেছে।

অতিমারি মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকারের প্রথম ত্রাণ প্যাকেজে সামাজিক সুরক্ষায় জিডিপির মাত্র ০.৮ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছিল যার জন্য খেসারত দিতে হয়েছে দেশের ৪ কোটি অভিবাসী শ্রমিককে। সরকারি উদাসীনতার কারণে স্বাধীনতার পরে আমরা সবচেয়ে বড় মাস-মাইগ্রেশনের সাক্ষী থেকেছি। প্রায় কোটি খানেকের ওপর মানুষ হাজার হাজার মাইল হেঁটে নিজেদের গ্রামে ফেরার চেষ্টা করছিলেন। এঁদের এক উল্লেখযোগ্য অংশ রাস্তায় মারা গেছেন বাড়ি ফেরার মরিয়া প্রচেষ্টার মাঝে। এদেশে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় কোন সরকারেরই ট্র্যাক রেকর্ড খুব একটা উজ্জ্বল নয়। এবং এই সঙ্কটে যখন সমাজের শ্রমজীবী মানুষ দিশেহারা, ঠিক তখনই অতিমারিকে হাতিয়ার করে বেশ কয়েকটি রাজ্য সরকার উদ্যোগী ছিল শ্রমিকদের কাজের সময় বৃদ্ধি করতে এবং ন্যূনতম মজুরি দেওয়ার আইনি কর্তব্য থেকে মালিকদের ছাড় পাইয়ে দিতে।

মহামারির কারণে অর্থনৈতিক সঙ্কটের ফলে সমাজের অধিকাংশ মানুষের আয় হ্রাস পেয়েছে। এর প্রত্যক্ষ উদাহরণ, আরও ২৩ কোটি মানুষের, জাতীয় ন্যূনতম মজুরি-ভিত্তিক দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়া। এবং কোনওরকম সামাজিক সুরক্ষা না থাকার ফলে এক বিরাট অংশের শ্রমজীবী জনগণ, বিশেষ করে সমাজের দরিদ্রতম পরিবারগুলি, তাঁদের উপার্জনের তুলনায় অনেক বেশি ঋণ নিতে বাধ্য হয়েছে। এই ঋণের অধিকাংশ উচ্চ সুদে বেসরকারি সংস্থা, বিশেষ করে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলির থেকে নেওয়া। ইতিমধ্যে দেশজুড়ে বহু মানুষ এই টাকা শোধ না করতে পেরে আর্থসামজিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছেন।

অবশ্য অন্যরকম কিছু হওয়ার মতো আর্থিক পদক্ষেপ নেওয়ার কথা মোদি সরকার কখনও ভেবেছে কি? ক্ষমতায় আসার পর থেকেই প্রচারের ঢক্কানিনাদের আড়ালে, তারা পুঁজির পক্ষে এবং একইসঙ্গে শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে একের পর এক নীতি গ্রহণ করেছে। অধিকাংশ সময়ে সরকারি প্রচারযন্ত্র এবং তাঁর পেটোয়া সংবাদমাধ্যম শুধুমাত্র সত্য গোপন করেনি, রীতিমতো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আর ভাঁওতা পরিবেশন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। ফিনান্সিয়াল ট্রান্সপারেন্সি কোয়ালিশনের এক রিপোর্ট বলছে যে অতিমারি মোকাবিলার প্যাকেজের সিংহভাগ ছোট সংস্থা বা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের পরিবর্তে বড় কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।

আর কোনও বাড়তি তথ্যের দ্বারা লেখাটিকে ভারাক্রান্ত না করেও বলা যায় যে সমাজের শ্রমজীবী অংশ যখন কোনওরকম টিকে থাকতে এক অসম লড়াই করছেন তখন ধনীদের আয় ও সম্পদ হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মজার কথা, ২০১১-১২ সালের পর থেকে দারিদ্রের কোনও সরকারি তথ্যই নেই। চারিদিকে এই হাহাকার আর ভয়াবহ স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সঙ্কটের মাঝেও কয়লা, তেল, টেলিযোগাযোগ, ওষুধ, শিক্ষা এবং খুচরো বিপণন শিল্পে পুঁজি বিনিয়োগ করা মুকেশ আম্বানি, গৌতম আদানি, শিব নাদার, সাইরাস পুনাওয়ালা, উদয় কোটাক, আজিম প্রেমজি, সুনীল মিত্তাল, রাধাকৃষ্ণ দামানি, কুমার মঙ্গলাম বিড়লা এবং লক্ষ্মী মিত্তালের মতো বিলিয়নেয়ারদের, ২০২০ সালের মার্চ থেকে আজ অবধি, ধনসম্পত্তির দ্রুত বৃদ্ধি ঘটেছে। ঠিক একই সময়ে আমাদের দেশে বিশ্বের সবচেয়ে বড় লকডাউন ঘোষণা করার ফলে অর্থনীতি স্থবির হয়েছে যার ভয়ানক প্রভাব পড়েছে সমাজের তলার অংশের ওপর।

 

পথের শেষ কোথায়?

পরিশেষে বলা যেতে পারে যে বর্তমান অবস্থার দায় কেবলমাত্র মোদির ঘাড়ে চাপালে চলবে না, আমাদেরও নিতে হবে। প্রগতিশীল এবং বামপন্থী রাজনীতির পিছু হঠা মোদির ফ্যাসিবাদী রাজনীতির সামনে আসার পথ সুগম করেছে। সাম্প্রদায়িক ও উগ্র-জাতীয়তাবাদী এই তীব্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির মোকাবিলায় প্রয়োজন এক নতুন বামপন্থার। মনে রাখা দরকার যে নরেন্দ্র মোদি-রাজ অবসানের দাবীতে সীমাবদ্ধ থাকা কোনওমতেই যথেষ্ট নয়। মোদি বা সঙ্ঘ পরিবার দেশের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে ক্ষমতাচ্যুত হলে আমরা অবশ্যই সাময়িক রাজনৈতিক রিলিফ পাব, কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অবস্থার বিশেষ হেরফের হবে বলে মনে হয় না। নয়া-উদারবাদী যুগের ঊষালগ্ন থেকেই সারা বিশ্বে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার দিকে যাওয়ার এক স্পষ্ট প্রবণতা দেখা গেছে, এদেশেও তার কোনও ব্যতিক্রম ঘটেনি। সঙ্ঘ পরিবারের সরকারি আধিপত্য তাকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এই লেখার পরিসরে ফ্যাসিবাদ ঠিক কী বস্তু এবং সমাজের অন্যান্য দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলোর থেকে কী কী কারণে এবং কতটা স্বতন্ত্র, তাই নিয়ে আলোচনার অবকাশ নেই। কিন্তু একটা কথা বলে শেষ করতে চাই, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে উত্তরণের রাজনীতির কথা না ভাবতে পারলে এই ফ্যাসিবাদী শক্তি ও নয়া-উদারবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বেশিদূর অগ্রসর হওয়া মুশকিল। আমাদের সেই ব্যবস্থার দিকে যাওয়ার কথা মাথায় রেখেই পথে নামতে হবে, যার গণতান্ত্রিক কাঠামোকে হতে হবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার থেকে বহুগুণ উন্নত।


[1] https://www.anandabazar.com/editorial/dream-of-five-trillion-dollar-economy-is-difficult-1.1032227