হিন্দুত্বের সাঁড়াশি চাপে ভারত-নেপাল সম্পর্ক

সুশোভন ধর

 


লেখক রাজনৈতিক কর্মী ও ভাষ্যকার

 

 

 

নেপাল-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক এই মুহূর্তে যে খুব ভালো অবস্থায় নেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দীঘদিন ধরেই এই সম্পর্কের আকাশে টানাপোড়েনের কালো মেঘ সঞ্চারিত হচ্ছিল। সাম্প্রতিক কালে উত্তরাখণ্ড রাজ্যের প্রান্তে ভারত-নেপাল সীমান্তের বিতর্কিত কালাপানি অঞ্চলের কাছে লিপুলেখ এলাকার মধ্যে দিয়ে ভারত সরকার চিন সীমান্তে পৌঁছনোর উদ্দেশ্যে একটি পাকা রাস্তা নির্মাণ করে। ভারতের দাবি তিব্বতে অবস্থিত কৈলাস-মানস সরোবরের তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে এই সড়ক তৈরি করা হয়েছে। নেপাল সরকার এই রাস্তা তৈরির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং তাদের দাবি ভারত নেপালের সীমানা লঙ্ঘন করেই এই রাস্তা তৈরি করেছে। নেপাল জুড়ে, বিশেষত রাজধানী কাঠমান্ডুতে, বেশ কিছু ভারত বিরোধী প্রতিবাদ সংগঠিত হয়। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি ওই বিতর্কিত সীমান্ত এলাকায় বাড়তি সৈন্য পাঠানোর হুমকি দেন। এর কিছুদিন পরে নেপাল সরকার এক নতুন মানচিত্র প্রকাশ করে যেখানে ওই এলাকাটিকে নেপালি ভূখণ্ড হিসাবে দেখানো হয়েছে।

 

সীমান্ত বিতর্ক

ভারতের দাবি লিপুলেখ গিরিবর্ত দিয়েই চিরকাল ভারত থেকে তিব্বতে রাস্তা গেছে। এবং চিনের সঙ্গে ১৯৫৪ সালের চুক্তিতে সীমান্তর বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র হিসাবে এর উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৫ সালে আরেক ভারত-চিন বাণিজ্য চুক্তিতেও আবার ওই বিষয়টির পুনরুক্তি করা আছে। ১৯৮১ সাল থেকে যখন চিন ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের জন্য পুনরায়  কৈলাস-মানস সরোবরের দরজা খোলে তখন থেকেই পায়ে হেঁটে তিব্বতে যাওয়ার জন্য এই পথটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

নেপালের দাবি ১৮১৬ সালের সুগৌলি চুক্তি অনুসারে এই ভূখণ্ড তাদের দেশের অংশ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং নেপালের মধ্যে শতাধিক বছরের পুরনো এই চুক্তির মাধ্যমে নেপাল ও ভারতের সীমা নির্ধারণ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল কালী নদীর পূর্বদিকের অংশ নেপালের আর পশ্চিম দিকের অংশ ভারতের। সমস্যা হচ্ছে যে এই নদীর উৎস কোথায় তা নিয়ে দু দেশের পরস্পরবিরোধী মতামত বিষয়টিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছে।

নেপাল সরকার দাবি করছে যে তারা ২০১৫ সালের ভারত-চিন বাণিজ্য চুক্তিতে ওই এলাকাটিকে ভারতীয় ভূখণ্ডে দেখানোর প্রতিবাদে উভয় দেশকে চিঠি দিয়েছে কিন্তু ভারত সরকার সেই চিঠির কোনও জবাব আজ পর্যন্ত দেয়নি। এরপর ২০১৯ সালে তারা ভারত সরকারের নতুন রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক মানচিত্রের প্রতিবাদে আবার চিঠি দেয় যে বিষয়ে ভারত আজও নিরুত্তর। একথা মানতেই হবে যে মোদি সরকার বিষয়টি নিয়ে অহেতুক টালবাহানা করছে। এমনকি বর্তমান বিতর্কের শুরুতেই মে মাসের প্রথমে নেপাল সরকার সীমান্ত নির্ধারণ করতে আলোচনার দাবি জানালেও এদেশের বিদেশ মন্ত্রক লকডাউনের অজুহাতে বিষয়টি উড়িয়ে দেয়।

একইসঙ্গে মোদি সরকার নিজেদের অবস্থানের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে আরও কিছু গল্প বাজারে ছাড়ে যা এদেশের মিডিয়া রং চড়িয়ে পরিবেশন করতে থাকে। এক, নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কারণে এবং বিশেষ করে সেদেশের কমিউনিস্ট পার্টির গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে কে পি ওলির গদি টালামাটাল। তিনি নিজের গদি সুদৃঢ় করতে উগ্র-জাতীয়তাবাদী অবস্থান নিয়েছেন। দুই, চিনের প্ররোচনায় নেপাল ভারতের সঙ্গে অহেতুক সীমান্ত বিতর্ক তৈরি করছে। একথা অনস্বীকার্য যে সাধারণ মানুষের বিপুল প্রত্যাশার ওপর ভর করে এক বিরাট সংখ্যক আসন জিতে কে পি ওলি সরকার ক্ষমতায় এলেও নয়া-উদারবাদী পথে হাঁটার ফলে নেপালের বহু মানুষ এই সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। কিন্তু নেপালের রাজনৈতিক প্যাঁচঘোচ কাজে লাগিয়ে মোদি সরকারের নিজের কোলে ঝোল টানার এই খেলার মধ্যে যে দুরভিসন্ধির গল্প লুকিয়ে আছে সে ব্যাপারে আমাদের ধোঁয়াশা রাখলে চলবে না। নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি ও তার রাজনৈতিক পথ ও দিশা নিয়ে অবশ্যই সমালোচনামূলক মূল্যায়ন জরুরি। কিন্তু সেকথা স্বতন্ত্র এবং তা কখনওই নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর ধামাধরা মিডিয়ার দেখানো পথে হতে পারে না।

চিনের পুঁজি রপ্তানির পরিকল্পনায় নেপালের ব্যাপক গুরুত্ব আছে। বড় বাঁধ, বিমানবন্দর, সড়ক নির্মাণ, ইত্যাদি খাতে চিন নেপালে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে। চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে নেপাল একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ চিনের একটি মহাপ্রকল্পের নাম যার উদ্দেশ্য তিনটি মহাদেশজুড়ে যোগাযোগ পরিকাঠামো নির্মাণ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অঞ্চল ও করিডোর প্রতিষ্ঠা। নেপালের বাজার দখলের লড়াইতে ভারত ও চিন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু এত হট্টগোলের পরেও নেপালে চিনের তুলনায় ভারতীয় বিনিয়োগ আর্থিক অঙ্কে এখনও অনেক বেশি। এছাড়া ভারত-নেপাল সীমান্ত বিতর্কে চিনের মাথা গলানোর কোনও সরাসরি প্রমাণ এখনও পর্যন্ত নেই। বরং চিন এক সরকারি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে এই বিষয়টি ভারত ও নেপালের দ্বিপাক্ষিক ইস্যু এবং তারা আশা করে যে উভয় দেশ আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে। তাহলে সমস্যা কোথায়?

 

ভারতীয় প্ররোচনা

নেপাল-ভারত সম্পর্কের রাজনৈতিক সমস্যার দিকে একটু গভীরভাবে মনোযোগ দিলে আমরা দেখতে পারব যে এর আগে বিভিন্ন ব্যাপারে ছোটখাট ঝামেলা লেগে থাকলেও মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই সমস্যার দ্রুত অবনতি হয়েছে। এর আগেও নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মাথা গলানোর অভিযোগ উঠেছে বিজেপির বিরুদ্ধে। নেপালের দক্ষিণের তরাই অঞ্চলের মধেশিয়া জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কাঠমান্ডু উপত্যকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে মধেশিয়াদের প্ররোচনা দিয়ে বিজেপি চেষ্টা করেছিল নেপাল সরকারকে দুর্বল করতে। এই মধেশিয়াদের মধ্যে ব্যাপক হিন্দুত্বের প্রচার চালায় বিজেপি এবং নেপালের দক্ষিণাঞ্চলের তুলনামূলক অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার সুযোগ নিয়ে আরএসএস ওখানে ভালোই গেঁড়ে বসেছে। নেপালি জনগণের আশঙ্কা যে বিজেপির সক্রিয়ভাবে সচেষ্ট ওই অঞ্চলকে নেপাল থেকে বিচ্ছিন্ন করতে।

২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে ভারত নেপালের ওপর এক অঘোষিত অর্থনৈতিক অবরোধ শুরু করে। দু মাস ব্যাপী এই অবরোধের ফলে নেপালে অর্থনৈতিক ও মানবিক সঙ্কট দেখা দেয় এবং সে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ল্যান্ড-লকড বা একক স্থলবেষ্টিত দেশ নেপালকে তার সমস্ত পেট্রোপণ্য ভারতীয় বন্দর দিয়ে আমদানি করে সড়কপথে নিয়ে যেতে হয়। পেট্রোলের অভাবে নেপাল কার্যত অচল হয় পড়ে। তদুপরি কলকাতা বন্দরে নেপালি ট্রাক থামিয়ে দেওয়া হয়। এই অবরোধটি কেবল পেট্রোপণ্যে সীমিত ছিল না। এর ফলে ওষুধ এবং ভূমিকম্পের ত্রাণ সামগ্রীর আমদানি ব্যহত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে সেবছর এপ্রিল মাসে এক ভয়াবহ ভূমিকম্পে কাঠমান্ডু সহ নেপালের এক বড় অংশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বভাবতই এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় নেপালি জনমানসে। ভারত-বিরোধিতা বৃদ্ধি পায়।

 

হিন্দু রাষ্ট্র থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার পথে

বিজেপি সরকারের সঙ্গে নেপালের আসল সংঘাত কোথায়? আসলে ২০০৬ সালের জন-আন্দোলনের পরে রাজতন্ত্র হঠিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার পথে নেপালি জনগণের যাত্রা এদেশের হিন্দুত্ববাদীদের কাছে এক বড় ধাক্কা। ব্যবহারিক এবং আদর্শগত— দুই দিক থেকেই। গোদের ওপর বিষফোঁড়া বামপন্থীদের উত্থান। হিন্দুত্ববাদীরা ঠিক যা যা আমাদের গেলাতে চান নেপালে তার বিপরীতধর্মী ঘটনা ঘটেছে। সেই কারণেই আরএসএস নেপালের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি ও বামপন্থীদের টুঁটি চেপে ধরতে চায়।

ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাওয়া সঙ্ঘ পরিবারের জন্য নেপালের ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে প্রাপ্তিগুলি নস্যাৎ করা ভীষণ জরুরি। বিশেষ করে তাদের নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা ভেবে। তারা যেখানে আমাদের হিন্দুত্বের আফিম খাইয়ে নেশায় বুঁদ করে রাখতে সচেষ্ট সেখানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিরাজমান আমাদের এই প্রতিবেশী হিন্দু রাষ্ট্রটি দুর্নিবার গণ অভ্যুত্থানের চাপে চুরমার হয়ে গেছে। আরএসএসের কাছে এই উদাহরণ চরম অনাকাঙ্ক্ষিত। মোদি বা অমিত শাহ আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক কারণে এ ব্যাপার নিয়ে জনসমক্ষে বিশেষ ট্যাঁ ফো না করতে পারলেও অন্যান্য মেজ-সেজ কর্তাদের চুপ করে থাকার বাধ্যবাধকতা বা দায়— কোনওটাই নেই। আরএসএসের বহু শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এ ব্যাপারে রাখঢাক না করেই বহুবার বলেছেন কেন নেপালের হিন্দুত্বের পথেই ফিরে আসা উচিত। নেপালে তাদের দুই শতাধিক শাখা এ ব্যাপারে বিশেষভাবে সক্রিয়। ২০১০ সালের মার্চে রাজনাথ সিংহ নেপালের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী গিরিজা প্রসাদ কৈরালার শেষ যাত্রায় অংশ নিতে গিয়ে বলেন “নেপালের হিন্দু রাজতন্ত্রের ব্যাপারে আমরা গর্ববোধ করতাম, আশাকরি নেপাল আবার হিন্দু রাষ্ট্র হবে।”

এদেশের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি হিন্দু রাষ্ট্রের পক্ষে প্রচার করতে তাদের সাধু এবং নেতাদের নিয়মিত নেপালে পাঠায়। হিন্দু রাষ্ট্রের পতন এবং ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্রের জয়জয়কার নিঃসন্দেহে এদেশের হিন্দুত্ববাদী বাহিনীকে হতাশ করেছে, ক্ষুব্ধ করেছে। বিজেপি এই রাগের শরিক হলেও তা সরকারিভাবে প্রকাশ্যে ব্যক্ত করতে পারে না। নেপালের ব্যাপারে মোদি সরকারের এই নেতিবাচক অবস্থান বুঝতে গেলে আমাদের এই কথাগুলি বিশেষভাবে মাথায় রাখতে হবে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সাম্প্রতিক একটি উক্তি। সীমান্ত বিতর্ক নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে এ মাসের শুরুতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি নেপালের জনগণকে তিব্বতের কথা মাথায় রেখে চলতে বলেন। এ কথার মানে কী তিনি তা ব্যাখ্যা করেননি। তিনি কি এই বলে হুমকি দিতে চাইছেন যে দিল্লির সরকারের বা নাগপুরের কার্যকরী সরকারের কথা শুনে না চলে নেপাল যদি নিজের স্বাধীন পথ বেছে নেয় তাহলে তার দশা তিব্বতের মতো হবে? অর্থাৎ চিন যেভাবে অনৈতিকভাবে তিব্বত দখল করেছে ভারত সরকার প্রয়োজনে একই কাজ করতে পারে? এই ধরনের নির্লজ্জ কথাবার্তা আর যাই হোক আমাদের গণতন্ত্রের বুনিয়াদ শক্তিশালী করে না। তার মূলে কুঠারাঘাত করে। এই সমস্ত কথাবার্তা আর দখলবাজির বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হওয়া উচিত। জোর গলায় বলা প্রয়োজন “Not in our name”! শুধুমাত্র নেপালের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নয়। আমাদের নিজেদের স্বার্থে। আমাদের ভবিষ্যৎ বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...