Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

যেখানে ডাক্তার নেই

বিবর্তন ভট্টাচার্য

 


বিজ্ঞানকর্মী

 

 

 

২০২০ সালের মার্চ মাসে থালা-বাটি বাজিয়ে যখন করোনা তাড়ানো গেল না, তখন এই ৩০০ মৎস্যজীবী যাদেরকে নিয়ে চাকদহ বুড়িগঙ্গা সংস্কারের আন্দোলন, তাঁরা কী খাবেন কীভাবে চলবেন, তাঁদের সংসারে সরকারি যে ডোল তাতে আবার রেশন কার্ডের যে ফ্যাঁকড়া, তাতে আমরা সবাই বিভ্রান্ত। এর মধ্যে রাষ্ট্র যা চায় তাতে তারা সফল। ‘সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স’— একেই গ্রামেগঞ্জে মানুষ বিচ্ছিন্ন, তারপর আরও দূরত্ব তৈরির পরিকল্পনা, আর মিডিয়াকে দিয়ে ভয়ের প্রচার। তখন কিন্তু মারা যাচ্ছেন বড়লোক আর বুড়োলোক। আমরা একটা ছোট সংগঠন হয়ে কী করতে পারি? শুরু হল অসম লড়াই। রাস্তায় দাঁড়াতেই আমাদের ২৫ বছরের নিরবচ্ছিন্ন পথ চলার ফল পেতে শুরু করলাম। ব্যবসায়ী সমিতি ৩০০ মানুষকে প্রায় ১৫ দিনের খাদ্যসামগ্রী দিলেন, আমরা যাঁদের তালিকা দিয়েছিলাম। নৈহাটি কলেজের অধ্যাপিকা ভাস্বতীদি (কবি সৃজন সেনের স্ত্রী) মুম্বাইতে পরের বাড়িতে কাজ করেন যে সব অভিবাসী মহিলা শ্রমিক তাঁদের ৬০ জনের ১৫ দিনের খাবারের টাকা দিলেন। দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম, যে সংস্থায় মৎস্যজীবীগণ মাছ চাষ, মাছ বিক্রি, সব্জি বিক্রি বা অন্য যে কোনও কাজ করে সংসার চালাতে পারেন তাঁদের জন্য ৪০০০ টাকা করে সুদবিহীন লোন দিলেন। এক বছর এই টাকা খাটিয়ে বছরের শেষে যাঁরা ৪০০০ টাকা ফেরত দেবেন তাঁদেরকে ১০০০ টাকা দেওয়া হবে। এছাড়াও স্কুলশিক্ষক, বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করা মানুষেরা যে অর্থ দিলেন তা দিয়ে আমরা প্রায় ১০০০ মানুষের পাশে দাঁড়াতে সক্ষম হলাম। কিন্তু তখন থেকে আমাদের মাথায় একটা বিষয় ঘুরছিল। তা হল করোনা নিয়ে যে ভয়ঙ্কর কুসংস্কার চলছে তা দূর করা। খুব ভালো করে আমরা লক্ষ করলাম সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে তেমন কোনও হেলদোল নেই। কিন্তু আমরা তো ডাক্তার নই। ভালো করে পড়া হল ডেভিড গার্নারের লেখা বই “যেখানে ডাক্তার নেই”। শুরু হল একটা গ্রামে কাজ, গঙ্গাপ্রসাদপুরের কালীমন্দির পাড়ায়। যে গ্রামে প্রায় ৫০০ মানুষের বসবাস। তার মধ্যে অধিকাংশই কৃষিজীবী ও মৎস্যজীবী। বুড়িগঙ্গার পাড় আর খোলা মাঠে গাছের তলায় চেয়ার টেবিল পেতে শুরু হল কাজ।

প্রসঙ্গক্রমে বলি আমাদের যে ওজন মাপার যন্ত্র, প্রেশার মাপার যন্ত্র, অক্সিমিটার আর দুটি কাপড়ের স্ট্রেচার তা কেনার টাকা দিল মৎস্যজীবীগণ চাঁদা তুলে। স্ট্রেচার এই কারণে, গ্রামের ক্লাবে বা অন্য কোথাও স্ট্রেচার নেই। আর অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নেওয়ার কথা কল্পনাতেও আনতে পারেন না এই অঞ্চলের মানুষ। সবাই রিক্সাভ্যানে হাসপাতালে যান।

স্ট্রেচারে কাঁথা চাদর দেওয়া থাকলে ডেলিভারি রোগিণী সহ সমস্ত রোগীই সুন্দরভাবে হাসপাতালে পৌঁছাবে এবং রাস্তার ঝাঁকুনিও কম লাগবে।

কী নাম হবে? ঠিক হল ‘স্বাস্থ্য ভাবনা’। আমরা ভাবলাম ও গ্রামের মানুষকে ভাবালাম, বর্তমান যে চিকিৎসা ব্যবস্থা তাতে অবহেলাতেই বেশিরভাগ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। তাই সবাইকে সুস্থ থাকার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে নিজেদেরই। আমরা খুব ঠেকায় না পড়লে MBBS-মুখো হব না। আর করোনা থেকে দূরে থাকবার জন্য গ্রামে ঢোকার মুখে একটা নাদাতে সাবানগোলা জল রাখা হল। তাতে পা ধুয়ে আর কাপড় কাচা সাবানে হাত ধুয়ে আমরা গ্রামে ঢুকব। গ্রামে আমরা কেউ মাস্ক ব্যবহার করব না, কিন্তু যখন হাটে কাঁচা সব্জি বিক্রি করতে যাব তখন মাস্ক পরে যাব। অবশ্য সার্জিক্যাল মাস্ক আমরাই সরবরাহ করব। ৩৫০ জনকে মাস্ক প্রদান করা হল যাঁরা নিয়মিত আমাদের স্বাস্থ্যশিবিরে আসেন। আরও বোঝানো হল যেখানে ডাক্তার নেই সেখানে মানুষ কীভাবে বাঁচেন। আর যে অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে তাকে লাথি মেরে ভেঙে দিতে হবে।

আর টিভিতে খবর দেখা একদম বন্ধ। আমরাই তো এই আধুনিক ব্যবস্থায় একেবারে অন্ধকারে। তাই এই অন্ধকারেই আমরা আলো ফোটাব। আজ ৯.৬.২০২১, বুধবার, আজ পর্যন্ত ঐ গ্রামে একজন মানুষও করোনাতে আক্রান্ত হননি। একটু জ্বর হলে গ্রামীণ ডাক্তারবাবুর সহায়তা ও আমাদের বিজ্ঞানমনস্ক স্বাস্থ্যকর্মীদের ব্যবস্থাতে সুস্থ হয়েছেন মানুষ।

যেমন জ্বর হলে ৩টে প্যারাসিটামল, ৩টে অ্যান্টাসিড আর ১ প্যাকেট ৫ টাকা দামের গ্লুকোজ বিস্কুট।

গ্লুকোজ বিস্কুট এই কারণে যে তাঁরা খালি পেটে যেন ওষুধ না খান। ভদ্রলোকেদের স্যানিটাইজার থেকে এই গ্রামের মানুষ বহু দূরে। আমাদের জানা নেই কমিউনিটি মেডিসিন নিয়ে পড়া ডাক্তারবাবুগণ এই সাধারণভাবে রোগনির্ণয় ও রোগ সারানোর কথা ভুলে গিয়েছেন নাকি! এই এলিট চিকিৎসাব্যবস্থাতে আমরা যারা আধুনিক চিকিৎসা থেকে অনেক দূরে, একজন MBBS পাশ করা ডাক্তারবাবুকে দেখাতে গেলে তাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। তারপর মুখঝামটা আউটডোরে। তাই ‘স্বাস্থ্য ভাবনা’র কার্ডটা বালিশের তলায় রাখেন গ্রামবাসী, সকালে উঠে দেখেন আমার প্রেশার আমার ওজন আমার পালস বিট ঠিক আছে কিনা। তাহলে আমি ঠিক। তারপর মাথায় ঝুড়ি নিয়ে কেউ মাঠে, কেউবা নদীতে। আমরা ডোল চাই না। উন্নয়নের যে রাজনৈতিক মডেল তার পরিবর্তন হোক চায় আপামর সাধারণ মানুষ। ৫০০ মানুষের গ্রাম এই কালীমন্দির পাড়া তার উদাহরণ।