Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

জলবায়ু পরিবর্তন: প্রান্তজনের কথা

মৃণাল মুখার্জী প্রীতম কংসবণিক

 


ডঃ মৃণাল মুখার্জী ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অফ টিচার্স’ ট্রেনিং, এডুকেশন প্ল্যানিং এন্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, কলকাতা-র অধ্যাপক। প্রীতম কংসবণিক আইজিএনসিএ, নিউ দিল্লি-র স্কলার গাইড।

 

 

 

 

 

বাঘারু তিস্তাপার ও আপলচাঁদ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। মাদারিও চলে যাচ্ছে। যে কারণে তিস্তাপার ও আপলচাঁদের শালবন উৎপাটিত হবে, সেই কারণেই বাঘারু উৎপাটিত হয়ে গেল। যে কারণে তিস্তাপারের হরিণের দল হাতির পাল, পাখির ঝাঁক, সাপখোপ চলে যাবে— সেই কারণেই বাঘারু চলে যায়। … বাঘারুর কোনো অর্থনীতি নেই, বাঘারুর কোনো উৎপাদনও নেই। বাঘারু তাই ব্যারেজকে, এই অর্থনীতি ও উন্নয়নকে প্রত্যাখ্যান করল।

(‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’, দেবেশ রায়)

হ্যাঁ, আমাদের বাঘারুরা এইভাবেই প্রত্যাখ্যান করে তার পারিপার্শ্বিক সভ্যতা ও সমাজকে। বাঘারুদের প্রত্যাখ্যানের ভাষা নেই, তাদের যা আছে তাহল শরীর। “সেই শরীর দিয়েই সে প্রত্যাখ্যান করল” আমাদের নাগরিক বিস্ময়কে, আমাদের শিক্ষিত বোধ, এর ব্যবস্থা ও তার চলাচলের হিসেবকে। সে চলে গেল। বাঘারুর মত প্রান্তিক মানুষেরা সামাজিকভাবে এই তথাকথিত উন্নয়নের কালগর্ভে হারিয়ে যায়; আবার কখনও বা এই প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে নিজেদেরকে অভিযোজিত করে উঠতে না পেরে সংগ্রামে পরাজিত হয়। এই পৃথিবী ও তার প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ইতিহাসে জীব তার জীবনধারণের প্রক্রিয়ায় এই পরিবেশকে নানাভাবে পরিবর্তিত করেছে। এই পরিবর্তনের সূত্রেই মানুষ নিজেকেও পাল্টে ফেলেছে। প্রাণীকুলের সর্বশেষ পরিবর্তিত রূপ আমাদের মতো মানুষেরা।

বাঘারুদের মতো মানুষেরা; আমাদের নগর ও শহরের বাইরে অথবা প্রকৃতির কোলে বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী আদি-জনজাতির মানুষেরা আধুনিক শিল্পসভ্যতার বিকাশের শুরু থেকে আজ অবধি বিবিধ কারণে তাদের বাসভূমি থেকে উৎখাত হয়েছে। তথাকথিত উন্নয়নের প্রাথমিক খেসারত দিতে হয়েছে এই জনজাতির মানুষকে। আদিম জনজাতির জীবন, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ধ্বংসের বিনিময়ে গড়ে উঠেছে আমাদের সভ্যতা। আমরা একমুখী উন্নয়নের জয়যাত্রায় এগিয়ে চলেছি। আজ আমরা সবকিছু লার্জার স্কেলে দেখছি। বড় ব্রিজ, বড় রাস্তা, বড় বাঁধ, কিংবা সমুদ্র দখল করে পর্যটন, জঙ্গলের গভীরে মানুষের স্পর্ধার ইমারত, পাহাড়কে ভেঙে বদলে দিয়ে উন্নয়নের উৎকর্ষের অভিযানে মশগুল আমরা। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উন্নয়নের অভিযানের পেছনে এক সুসংগঠিত প্রয়াসে নেতৃত্ব দিচ্ছে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ ও কর্পোরেট পুঁজির যুগলবন্দি। সত্যিই কি এই উন্নয়নের জয়যাত্রা সব মানুষের জন্য? উন্নয়নের এই রোলমডেল কি বেশিরভাগ মানুষের জীবনের সমস্যার সুরাহা করছে? নাকি কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থসিদ্ধি করছে? খুঁজে দেখলে দেখা যাবে সচেতনভাবেই রাষ্ট্র পরিবেশকে সঙ্কটাপন্ন করেছে; আর সেই সঙ্কটের কারণে হারিয়ে গিয়েছে বিভিন্ন জনজাতি ও তাদের সভ্যতার ইতিহাস।

জলবায়ুর এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে যারা সর্বপ্রথম আক্রান্ত হয় ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা হল দরিদ্র প্রান্তিক মানুষ; এদের মধ্যে আবার আদি জনজাতিরাই সর্বাধিক বিপন্নতার মধ্যে আছে। উল্লেখ্য জাতিসঙ্ঘের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে জন-জাতির সংখ্যা প্রায় ৩৭০ মিলিয়ন যারা অন্তত কয়েক হাজার জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত; পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪-৫ শতাংশ এই মানুষেরাই পৃথিবীর ভূভাগের এক-চতুর্থাংশ রক্ষা করে; আগলে রাখে ১১ শতাংশ বনভূমি, ৮০ শতাংশ জৈববৈচিত্র্য ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৮৫ শতাংশ। আজ নেতিবাচক উন্নয়নের কারণে জলবায়ুর অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনের ফলে তারাই বিপন্ন বাস্তুহারা হচ্ছে। ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যনেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ তাদের ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ ভূভাগ এবং ৬৬ শতাংশ সমুদ্র মনুষ্য আগ্রাসনে বিপন্ন ও ভারসাম্যহীন। তাদের প্রাকৃতিক বসতি ধ্বংসের কারণে প্রায় এক মিলিয়ন প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্তির সম্ভবনার মুখে দাঁড়িয়ে। জাতিসংঘের দি ওয়ার্ল্ড মাইগ্রেশন রিপোর্ট-২০২০ এই আশঙ্কা প্রকাশ করছে যে ২০৫০ সালের মধ্যে ২০০ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য হবেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল জেরাড ২০১৮ সালে গবেষণায় দাবি করেছেন যে, মানুষের এই অভিবাসন জলবায়ুর পরিবর্তন এবং পানীয় জলের সঙ্কটের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্ক যুক্ত। আফ্রিকা, মেক্সিকো, চিনে এই বাস্তুচ্যুত প্রান্তিক মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি; তবে ভারত উপমহাদেশও প্রবল সঙ্কটের সম্ভাবনার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।

আবার অন্যদিকে নানা প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারির মতো নানা ঘটনা এই প্রান্তিক সভ্যতাকে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে; ফলত বেঁচে থাকার তাগিদে নিজস্ব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখার অভিপ্রায় নিয়ে তাঁরা তাঁদের প্রিয় বাসভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। চলে গিয়েছেন অন্যত্র, অন্য কোথাও বাঁচার আশায়। এই কারণেই আধুনিক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের অ্যাকাডেমিক পাঠচর্চায় জায়গা করে নিয়েছে এক নতুন পারিভাষিক শব্দ— ‘জলবায়ু শরণার্থী’। আধুনিক ভূবিশ্বে ক্রমাগত ঘটে চলা জলবায়ুর পরিবর্তন অচিরেই আমাদের সামনে এক নতুন সামাজিক প্রকল্পের পাঠ হাজির করেছে। জলবায়ু সম্পর্কিত নানা প্রকার ফলাফল— যেমন, খরা, বন্যা এবং তুষারপাতের কারণে প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত হবেন এইরকম আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইন্টার গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ তাদের জলবায়ু সম্পর্কিত চতুর্থ মূল্যায়নের প্রতিবেদনে জনবসতির মাইগ্রেশনের কারণ হিসেবে খরা, সামুদ্রিক ঝড়, ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঘটনাকে দায়ী করেছে। এই জলবায়ু সংক্রান্ত নানা প্রকার পরিবর্তন ভারতের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর বৃহৎ প্রভাব ফেলবে এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। ইপিডাবলু জুন ২০০৯ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে উল্লিখিত হয়েছে যে ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন অংশে বসবাসরত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৪.১ মিলিয়ন। ইতিমধ্যে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ ২০২০ সালের মধ্যে শুধু ভারতেই গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। মানুষের বসতি ধ্বংসের, সম্পত্তি ও জীবনহানি সম্পর্কিত প্রাপ্ত তথ্য জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আশঙ্কাগুলিকেই সত্য প্রমাণ করছে। ভারতে মানুষের বসতি ও চাষযোগ্য ভূমির ১০ শতাংশ সমুদ্রগর্ভে বা নদীগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এর মধ্যে অসমে ৪০ শতাংশ জমি প্রায় ধ্বংসের পথে। কেবলমাত্র ২০১৭ সালে ভুরগাঁও অঞ্চলে ৪০টি গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মালদা, মুর্শিদাবাদের ভাঙনপ্রবণ এলাকাতে জীবন-জীবিকা থেকে বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন অসংখ্য প্রান্তিক মানুষ।

হিমালয়, কারাকোরাম এবং হিন্দুকুশ পর্বতে প্রায় ৫৫০০০ হিমবাহ আছে। উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু বাদ দিলে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মিষ্টি জলের ভাণ্ডার হল এই হিমবাহগুলি। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই হিমবাহগুলিতে গলন শুরু হয়েছে, যা গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জলসঙ্কটের কারণ হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ায় সিন্ধু গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এই তিনটি নদী বরফগলা জলে পুষ্ট এবং এই তিনটি নদীর পাশে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন। এই ধরনের হিমবাহ গলন এবং বৃহৎ হিমবাহখণ্ডের স্থানান্তরণের ফলে একদিকে যেমন পার্বত্য ভূমিভাগের জনবসতি বিপন্ন হবে, মানুষ হারাবে তার জীবন ও জীবিকা; আবার এই হিমবাহ গলে যাওয়ার কারণে নদীগুলির উপকূলভাগ ব্যপকভাবে প্লাবিত হবে; নতুন করে বহু মানুষ হবেন জলবায়ু শরণার্থী।

আমরা যদি আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের সাপেক্ষে বিগত বছরগুলোর দিকে ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাব ২০০৯ সাল থেকে আয়লা, বুলবুল, আম্ফান ও অতি সম্প্রতি ইয়াসের মতো ঘূর্ণিঝড় রাজ্যের বিভিন্ন উপকূলবর্তী জেলার নিম্নবিত্ত প্রান্তিক মানুষের জীবনে চরম অনিশ্চয়তা ডেকে এনেছে। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন এলাকা এবং মেদিনীপুর জেলার উপকূল সংলগ্ন এলাকাকে প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিশেষত সাম্প্রতিক ২০২১ সালের ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের তাণ্ডবে এই অঞ্চলের ঘোড়ামারা দ্বীপ পুরোপুরিভাবে জলের তলায়। গৃহহীন হয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। এই মানুষদের আবাসস্থল উপকূলের ঝড়ঝাপটা জলোচ্ছ্বাস সামলানোর উপযুক্ত নয় এবং এই ধরনের নির্মাণ উপকূলের খুব কাছে হয়তো কাঙ্ক্ষিতও নয়। তদুপরি এই সকল অঞ্চলের সামাজিক গঠনের স্তর বিন্যাসে চিরকালীন প্রশাসনিক উদাসীনতা থেকেই গেছে। ফলত স্বাস্থ্য থেকে শিক্ষা— যাবতীয় জীবন-জীবিকা সব কিছু থেকে এক অগণিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বঞ্চিতই থেকে গেছেন।

ভারতের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে সামুদ্রিক ঝড়ঝঞ্ঝাপ্রবণ এক দেশ। সমাজ-গবেষক ব্রাউনের ২০০৯ সালের গবেষণায় দেখতে পাওয়া যায় শুধুমাত্র বন্যার কারণে প্রতিবছর কয়েক লক্ষ মানুষ বাংলাদেশ থেকে ভারতবর্ষে চলে আসতে বাধ্য হন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই ধরনের অন্তর্দেশীয় শরণার্থীর সংখ্যাবৃদ্ধি একটা প্রবণতা থেকেই যাবে। হোমার ডিকসনের ১৯৯৪ সালের গবেষণায় দেখা গেছে পরিবেশের জলবায়ু কেন্দ্রিক সঙ্কটের কারণে গত ৪০ বছরে বাংলাদেশি অভিবাসীরা ভারতের জনসংখ্যাকে ১২ মিলিয়ন থেকে ১৭ মিলিয়নে পৌঁছে দিয়েছেন। ফলে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত সংবেদনশীল জায়গায় অবস্থান করছে।

গ্রীষ্মমণ্ডলীয় যে সমস্ত উন্নয়নশীল দেশ আছে তারা এখনও পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের সাপেক্ষে তীব্র বিরূপ প্রভাবের সাক্ষ্য দিচ্ছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন করে মানুষের মধ্যে আভ্যন্তরীণ বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। এখানেও সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক মানুষেরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ব্রাজিলের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের গবেষণায় উঠে এসেছে দরিদ্র অঞ্চলগুলি তুলনামূলকভাবে বড় শহরগুলির থেকে বেশিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত; ডব্লিউজিআইআই-এর প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই সামাজিক অর্থনৈতিক অসাম্যের নানা বর্ণনা স্পষ্ট। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র উপকূলীয় অঞ্চল নয়, বনাঞ্চল ও পার্বত্য অঞ্চলেও বৈষম্যের এই সমস্যা স্পষ্ট হচ্ছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সুন্দরবন অঞ্চলে অবস্থিত এই সমস্ত দ্বীপপুঞ্জ ও সেখানকার প্রাকৃতিক স্বাভাবিক উদ্ভিদ মুখ্যত যাকে আমরা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বলি, তা আমাদের কলকাতা শহরকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এই দ্বীপপুঞ্জ যখন কলকাতা শহরের জন্য বাফার জোনের মতো কাজ করে, তখন বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না ওই প্রান্তিক মানুষদের বিপন্নতার মধ্যে দিয়ে রক্ষিত হয় শহরের সঙ্গতিসম্পন্ন নাগরিক জীবন। আবার এ-ও লক্ষ করা গেছে যখন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই প্রাকৃতিক ঝড়-ঝঞ্ঝা জলোচ্ছ্বাস অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত শহরকে বিপন্ন করে তখনও সর্বাধিক অসুবিধার মধ্যে থেকে, জীবনের ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় নগরের প্রান্তজনেরা। সরল সমীকরণ এটাই বলে। আমাদের উন্নয়নের নীতি, যা তৈরি করছে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক জলবায়ুর অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন, যাকে আমরা বলছি ক্লাইমেট চেঞ্জ বা জলবায়ু পরিবর্তন; আর সেই জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাতে ৮০ ভাগ ক্ষতি সম্পন্ন হচ্ছে এই প্রান্তিক মানুষদেরই।

জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ভারতবর্ষে প্রধানত দুই ধরনের অভিবাসন হতে পারে। প্রথমত, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেমন অতিরিক্ত খরার প্রবণতা, ভূমিভাগের মরুভূমিতে রূপান্তর, সমুদ্রপৃষ্ঠে জলস্তরের বৃদ্ধি, এবং অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ জলস্তর কমে যাওয়া ইত্যাদি। দ্বিতীয় আর এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা যেতে পারে। সেই পরিবর্তনের প্রভাবগুলি আরও তীব্রতরভাবে পরিলক্ষিত হতে পারে। যেমন, প্রতিবেশী দেশ থেকে অভিবাসনের হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে যেতে পারে। ভারতবর্ষ এবং ভারতীয় উপমহাদেশে একটা বিপন্নতার দিক হল খরা। এক্ষেত্রে একটি তথ্য উল্লেখ্য। আনুমানিক তিন লাখ শ্রমিক প্রতিবছর ওড়িশার খরাপ্রবণ এলাকা বলাঙ্গীর জেলা থেকে বিভিন্ন রাজ্যে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশেষত পশ্চিমভারতে খরার তীব্রতা বেশি পরিলক্ষিত হয়; রাজস্থানে প্রায় ৬০ শতাংশ অঞ্চল তীব্রভাবে জলসঙ্কটের সমস্যায় ভুগছে। গরীব প্রান্তিক মানুষেরা দৈনিক সবচেয়ে কম জল ব্যবহারের সুযোগ পায়! এইসকল ক্ষেত্রে সবসময়তেই প্রান্তিক মানুষেরা জীবনের ন্যূনতম অধিকারগুলি থেকে বঞ্চিত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আঞ্চলিক উপদ্বীপ ভারত ও পশ্চিমভারতে খরার পরিমাণ আরও তীব্রতর হবে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলত প্রান্তিক মানুষের একটা বড় অংশ অচিরেই ভূমিহীন হয়ে পড়বে। এছাড়াও ভারতীয় উপকূলীয় অঞ্চলের একটি বিরাট অংশে সমুদ্রপৃষ্ঠের জলতলের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই অংশগুলোতে ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি অধিক পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভারতবর্ষ একটি ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল হওয়ার সুবাদে এখানে নয়টি উপকূলীয় অঞ্চলে প্রায় এক কোটি মানুষ বসবাস করে। এমনকি তাদের দৈনন্দিন আর্থিক সংস্থানের জন্য এই অঞ্চলের কৃষিব্যবস্থার ওপরই নির্ভর করতে হয়। আবহাওয়া ও জলবায়ুর এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, আর্থিক সংস্থান সবকিছুতেই যে বিরাট প্রভাব ফেলবে তা সহজেই অনুমেয়। শুধুমাত্র সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ভারতে প্রায় এক মিলিয়ন মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। মুম্বাই ও কলকাতার মতো ভারতের বহু জনসংখ্যার বৃহৎ শহরগুলি সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছাকাছি অবস্থিত হওয়ার কারণে এই অঞ্চলগুলি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলের ৩২ শতাংশ ভূমিভাগ এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। আশঙ্কা করা যায় জলোচ্ছ্বাস ও অতি প্লাবনের কারণে প্রতিবছর ৫ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে।

সব মিলিয়ে এই ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের প্রবণতা আমাদের চেতনার সামনে নানা প্রশ্ন তুলে ধরছে। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রেও আদিবাসী প্রান্তিক জনজাতির মানুষদের প্রকৃতির সঙ্গে আত্মিক সংযোগ সবচেয়ে গভীর; এই অনন্য জনজাতির বসতিগুলি ক্রমান্বয়ে অবলুপ্ত হলে শুধু মানুষগুলি হারিয়ে যাবে তাই নয়, এই মানুষগুলোর পরম্পরায় অর্জিত যে জ্ঞানভাণ্ডার তাও বিলুপ্ত হবে তাদের সঙ্গে। শুধু তাই নয় জনজাতির মানুষগুলো যদি বেঁচেও যায় কিন্তু তাদের জীবনযাপনের পদ্ধতি বদলে গেলে সেটাও সভ্যতার কাছে জ্ঞান ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার একটি বড় সঙ্কট নিয়ে আসবে, যা আসলে প্রকৃতিকে রক্ষা করার কাজে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। জনজাতির প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে তাদের বসতির ভূমিভাগের একটি আত্মিক সম্পর্ক থাকে। এই পরিবেশের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক পরিবেশকে রক্ষা করতে তাদেরকে উৎসাহিত করে ও সক্ষম করে। তাই জলবায়ু শরণার্থী যত বাড়বে ততই পরিবেশের সঙ্কটের মাত্রা তীব্র রূপ ধারণ করবে। আধুনিকতা ও উন্নয়নের নামে আমরা যদি এই সকল মানুষের জীবন ও সংস্কৃতিকে বিপন্ন করি, তা এই সকল মানুষের ভাষা সংস্কৃতি ও প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত প্রজ্ঞাকেই ধ্বংস করবে। এই আঞ্চলিক জ্ঞানভাণ্ডার আজকের সময় প্রকৃতিকে রক্ষা করার যুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠতে পারে। আমাদের বিবেচনা করতে হবে শুধু আধিপত্যবাদী মেইনস্ট্রিম জ্ঞানচর্চা চাপিয়ে না দিয়ে, কীভাবে জনজাতির জ্ঞানকে তাদের অভিজ্ঞতাকে মেইনস্ট্রিম জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়। মানুষ রেসিলিয়েন্স স্পিসিস, বহুবার সে নিজের ভুল থেকে শিখেছে; এটা ঠিক যে আজকের সঙ্কটের মাত্রা ভিন্নতর, যেখানে পুঁজি ও রাজনৈতিক মাফিয়ার বিশ্বজোড়া দাপাদাপির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা জনশিক্ষা জনহিতৈষী বোধের পেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে মানুষকে বিচার করতে হবে। মানুষ-ই শেষ কথা বলে। ব্যক্তিগত স্তরে, সমষ্টিগত স্তরে এক গুরুত্বপূর্ণ জন-আন্দলন গড়ে তুলতে হবে। চেতনায় স্পর্ধা দেখানো এখন আশু কর্তব্য। মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ, আমরা আমাদের বসুন্ধরাকে রক্ষার কাজে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, আমরা পারব, পারবই আমাদের প্রিয় আবাসভূমিকে রক্ষা করতে— এই প্রত্যয় খুব-ই জরুরি।