তিস্তাপারের দেবেশ রায়

বর্ণালী ঘোষ দস্তিদার

 



লেখক অধ্যাপক, কথাকার ও সঙ্গীতশিল্পী

 

 

 

 

দেবেশ রায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আটের দশকের গোড়ায়। ‘প্রতিক্ষণ’ বলে একটি পাক্ষিক পত্রিকা তখন প্রকাশিত হচ্ছে। বনেদি সাপ্তাহিক ‘দেশ’ তখন রীতিমতো এলিট। তবে তাতে সাহিত্যের অংশ বেশি। খবর মুখ্য সাহিত্য গৌণ— এমন আর একটি সাপ্তাহিক প্রকাশিত হত ‘পরিবর্তন’। এরই মধ্যে খবর আর সাহিত্যের ভারসাম্য নিয়ে বাজারে এল ‘প্রতিক্ষণ’। সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। তিনি তখন প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী-কবি-গদ্যকার ও চলচ্চিত্র পরিচালক। আর ছিলেন বাংলা ভাষাসাহিত্যের অধ্যাপক কথাকার দেবেশ রায়। মেসোমশাই মানে পূর্ণেন্দু পত্রীর ছেলে পুণ্যব্রত আমার সহপাঠী, বিশেষ বন্ধু। আমি একটু-আধটু লেখালেখি করি জেনে আমাকেও একটু লেখার সুযোগ দিলেন ‘প্রতিক্ষণে’। নিয়মিত কলাম, কিন্তু কী লেখা… এখন মনে পড়লে হাসিই পায়। বেশ কাঁচাই লিখতাম বোধহয় তখন। বয়স কতই বা… উনিশ-কুড়ির বেশি তো নয়ই।

লিখতাম রেডিও আর দূরদর্শনের অনুষ্ঠানের রিভিউ। তাতেই কত উত্তেজনা। বাণিজ্যিক কাগজে ছাপার অক্ষরে নামসহ নিজের লেখা। গর্ব তাতেই।

এসএন ব্যানার্জি রোডে ছিল ‘প্রতিক্ষণে’র সম্পাদকীয় দপ্তর। সেখানে লেখা নিয়ে গেলে প্রায়ই দেখা হত দেবেশদার সঙ্গে। ধুতি-পাঞ্জাবি পরা ধারালো চেহারা। খুব আন্তরিকভাবে হেসে কথা বলতেন। কুল্যে তিনশোটি শব্দের স্পেস আমার জন্য বরাদ্দ। তখন কলেজ পাশ করে সবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে পা বাড়িয়েছি। দেবেশদার এক-আধটা লেখা পত্রপত্রিকায় পড়েছি। শুধু এটুকু জানতাম যে এই কন্যাপ্রতিম মেয়েটির সঙ্গে তিনি যে সহজিয়া ঢঙে কথা বলেন আসলে তাঁর লেখাজোখা মোটেই তেমন সহজ নয়। রীতিমতো মেধাবী মননশীল এক অনন্য গদ্য ও বিষয় তিনি বাঙালিকে বাংলা সাহিত্যকে দান করছেন। ভাষার তরতরে সাবলীলতা বলতে যা বোঝায় সেই পাঠকপ্রিয়তা তাঁর লেখায় অনুপস্থিত। গদ্যে এক পরীক্ষামূলক বৈশিষ্ট্য ও স্বতন্ত্র ঘরানার নির্মাতা তিনি।

মাস্টারমশাই অলোক রায়ের সঙ্গে আলোচনায় তাঁর কথা উঠলে জানলাম তিনি উত্তরবঙ্গের কলেজে অধ্যাপনা করেন। বামপন্থী। সিপিআই-এর পার্টি মেম্বার। পার্টি ভাগ হবার পরও পুরনো ঘর ছাড়েননি। বাগুইআটি এলাকার বাসিন্দা। খুবই সাদামাটা জীবন। ফ্ল্যাট লেখা লেখেন না। কিছু না কিছু এক্সপেরিমেন্ট সবসময়ই খেলা করে তাঁর কলমে।

সত্তর সালে প্রকাশিত দেবেশ রায়ের ছকভাঙা একটা চটি উপন্যাস ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে’ হাতে এল। পড়েই তীব্র ঝাঁকুনি। এ তো কোনও ট্রাডিশনাল মেথডে লেখা নভেলই নয়। দুদিকেই নির্মমভাবে প্রথা ভেঙেছেন ঔপন্যাসিক। এক, আমাদের রাজনৈতিক-সমাজনৈতিক জীবনে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য অসঙ্গতি, পরস্পরবিরোধিতা নিয়ে অবলীলায় প্রশ্ন তুলেছেন। যা প্রচলিত প্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করে। দুই, বঙ্কিম থেকে রবীন্দ্রনাথ এমনকি বাংলা সাহিত্যের তিন বাঁড়ুজ্যের যাবতীয় স্ট্রাকচারাল স্টাইলও ভেঙেচুরে এলোমেলো করে দিয়েছেন এই বিকল্প ধারার কথাকার। কিন্তু তীক্ষ্ম মননশীলতা সত্ত্বেও অনুভবের মরমি ছোঁয়ার অভাব নেই। তরল গদ্য না হয়েও কিন্তু কর্কশ লাবণ্যহীন মোটেই নয়। অনুভূতির সৎ মাধুর্য এর পরতে পরতে।

শ্রদ্ধা বেড়ে গেল এই লেখকের প্রতি। বেশ কিছু গল্প পড়লাম। ‘পশ্চাৎভূমি’র ভূমিকা অংশ পড়ে ভাবতে লাগলাম এ কি কবিতা? না গদ্য?… লেখাটা অনেকটা ছিল এরকম— “বাতাস ছিল এলোমেলো সারাটাদিন। সারাটাদিন চৈত্রমাসের মতো বাতাস ছিল এলোমেলো— সারাটাদিন।………….. সন্ধেবেলায় বাতাস পড়ন্ত। কৃষ্ণপক্ষের প্রথম চাঁদ বিলম্বিত। পরন্তু বাতাসে রাত্রির কঠোরতর শীত। পথের ধুলোবালি পরিষ্কার।” গল্পের মূল চরিত্র বিনয়ের সঙ্গে অশোকের স্কুলের মাঠে ক্রিকেট খেলার কথা। কিন্তু কবরের কোণের ইউক্যালিপটাস গাছ, বাবুই নামের কিশোরী বিনয়কে প্রেমিক ও যৌনকাতর ছাব্বিশ বছরের যুবকে পরিণত করল। জলপায়রা হয়ে বাবুই বিনয়কে গান শোনায়। রবিঠাকুরের গান। “সে কথা কি নানা সুরে বলে মোরে চলো দূরে”…

“এই অন্ধকারে তারা দুজন রবীন্দ্রনাথের একটি গানের পান্ডুলিপি হয়ে যায়। কেটে দেওয়া কথা, ভাঙা চরণ, ইতস্তত হস্তাক্ষর। আর অন্তর্বর্তী সুরে ভরাট।” গল্প এখানেই শেষ। কী অসম্ভব রোমান্টিক। সেইসঙ্গে ক্রিকেট, ড্রয়িংস্কুল, তার একঘেয়েমি, আর শহুরে অচলায়তনের বিরুদ্ধেও জোরালো জেহাদ।

ছয়ের দশকে এ গল্প লিখেছিলেন দেবেশ। যখন পরাবাস্তবতা ছুঁয়ে আভাঁগার্দের ধারণা বাংলা সাহিত্যে সেভাবে আসেইনি। দেবেশ কিন্তু অনেক মেসেজ দিলেন। পরিণত বয়সে রবিঠাকুরের ছবির বিমূর্ত ভাষ্য বিনয় আর বাবুইয়ের প্রেমের স্বরলিপি হয়ে প্রাণ পেল গানে।

দেবেশের গল্প বলি বা উপন্যাস, কোনওদিনই সেই অর্থে জনপ্রিয়তা পায়নি। তাঁর মেধাবী চিন্তননির্ভর গদ্যের পাঠক সীমিত। পরিচিত পথ ও কাঠামো অনুসরণ করা নয়, ভিন্ন পথের সন্ধান আর কাঠামো ভাঙাই তাঁর স্বাতন্ত্র্য। তাঁর রচনার মধ্যে তাই ইতিহাসের উৎসের অক্লান্ত অনুসন্ধান। একই সঙ্গে ভৌগোলিক বিস্তার। সমাজ-রাজনীতি-মানুষ তাঁর সৃষ্টির বিস্তৃত পটভূমিতে অস্তিত্বের বহুমাত্রিক জিজ্ঞাসা নিয়ে আকুল হয়ে থাকে। এরই সার্থক প্রমাণ পাঠক পেয়ে যান তাঁর পাঁচশো চার পাতার অ্যাকাডেমিক মহাকাব্যোপম ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ উপন্যাসে।

সগ্ গ হতে নামিল্ তিস্তাবুড়ি
মন্ চে দিয়া পাও
মন্ চ হতে নামিল তিস্তাবুড়ি
চ্যাতন করিল গাও….

রাজনীতি সমাজনীতির আজকের দিনে সর্বাধিক আলোচিত ও বিতর্কিত ডিসকোর্সগুলি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এসেছে এই এপিক মহাআখ্যানে। “তিস্তা”র গ্র্যান্ড ন্যারেটিভসের বহুমাত্রিকতা আজ তো বটেই আগামী বহুকালই ভীষণভাবেই প্রাসঙ্গিক থাকবে। এই বিপুলাকায় সন্দর্ভের সুপার স্ট্রাকচার মানবসভ্যতার প্রাগৈতিহাসিক পরম্পরার গভীর থেকে খনন করে আনা। অরণ্যচারী জান্তবদশা থেকে মানুষের সভ্যতা অর্জনের আখ্যানে লেখক তুলে ধরেন বিরল কিছু প্রশ্ন… যা আমাদের চেনা নাগরিক সংস্কৃতির পক্ষে বেশ অস্বস্তিকরও বটে। স্থিতাবস্থাকেও তা আঘাত না করে ছাড়ে না।

“হু-জু-র, মুই ফরেস্টারচন্দ্র আসি গেইছু। দেখি নিছেন তো মোকে? মোর নামখানা ফোমে রাখিবেন হুজুর, ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারু বর্মন। তোমার টর্চের আলোখান মোর চোখদুটা ঝলঝলাইয়া দিছে হে হুজুর। য্যানং তিস্তার চরত বালি চমকায়।”… বাঘারুদের ক্ষয়িষ্ণু অস্তিত্বের আদিম কান্না কৃষ্ণ-ভারতের গহ্বর থেকে উঠে এসে এক মুহূর্তের জন্য হলেও টলিয়ে দ্যায় মধ্যবিত্ত বিবেক। “শুন হে কাথা মোর একখান…। মোর জমিঠে মোর নামখান তুমি কাটি দাও। মোর একখান তো জমি আছিল্। ঐ জমিখান লিখি দাও গয়ানাথ জোতদারের নামত্। বলদ যার, বিছন যার, হালুয়া যার, ধান যার— জমি ত তারই হবা নাগে হুজুর। লিখি দাও, ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারু বর্মনক এই জমিঠে উচ্ছেদ দেয়া গে-এ-এ-ই-ই-ল্। হুজুর, কালি আমি গয়ানাথকে সব শিখাই দিম, ক্যানং করি হাল দিবার নাগে, মই দিবার নাগে, কদা করিবার নাগে, রোয়া গাড়িবার নাগে”… ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু “বাঘারু”দের আত্মপরিচয়কে গায়ের জোরে লুপ্ত করতে চাইলেই কি পারা যায়? “মুই ফরেস্টারচন্দ্র বাঘারু বর্মন আছি। সগার পাছাত হাগা আছে, বাঘা নাই। মুই মোর পাছাখান এমন উদলা করি দিম”…।

“তিস্তা”র অববাহিকায় যৌবনের অনেকগুলি রাজনীতিঘনিষ্ঠ দিন কাটিয়েছিলেন দেবেশ। পরিবেশহন্তারক বড়বাঁধ প্রকল্প, দুর্নীতিপূর্ণ প্রশাসন, উন্নয়নের বিলিতি রোলমডেল, উন্নয়নের অছিলায় কৃষিজমি হাসিলের নামে জঙ্গল উৎপাটন, আদিবাসী ও মূলনিবাসীর ভিটে হারিয়ে উদ্বাস্তু হওয়া, আগ্রাসী পুঁজির মুখোশে, ক্ষমতালোভী প্রশাসনের প্রশ্রয়ে নির্লজ্জ সামন্ত শাসন, মাঝে সুবিধাভোগী মধ্যশ্রেণি, দালাল-আড়কাঠি… সবাইকে একসূত্রে নিয়ে গাঁথা হয়ে যায় স্বাধীন ভারতের কায়েমি শাসকগোষ্ঠীর নিষ্ঠুর প্রতারণার উলঙ্গ ছবি। এমনকি সংসদীয় বামপন্থী দলের আদর্শচ্যুতির বেদনাটুকুও গোপন থাকে না। চটুল সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষণা, ঢক্কানিনাদে ভণ্ড প্রশাসনের আব্রু খসে পড়তে থাকে। আমোদ-জলসার নীচে চাপা পড়ে মধ্যযুগীয় বর্বরতার চাপচাপ অন্ধকার। বাঘারুরা শেষ অবধি কোনও মানুষ নয়। বন্ডেড লেবার। গয়ানাথ ও প্রগতিশীল প্রশাসনের ঝান্ডা বওয়া, মিছিল করা কেনা গোলাম।

“সমকালকে ধরতে না পারলে উপন্যাস বাঁচে না…।” … “দারিদ্র্যের মধ্যে কোনও গৌরব নেই, বড় বেশি অপমান আছে।”… এ সবই দেবেশের উপলব্ধি। “বনের পশুর নিয়মে বাঁচা” মর্যাদাহীন পার্টিহীন, বাঘারু ধুতি-পাঞ্জাবি-ব্রিফকেসে পাক্কা সাহেব এমএলএকে কাঁধে নিয়ে স্রোতসঙ্কুল তিস্তা ব্যারেজ যখন পেরোয় তখন লকগেট খুলে বনভূমিতে আছড়ে পড়ছে বিপুল ক্রুদ্ধ জলরাশি। এ কি বন্য পশুবৎ “না-মানুষ”গুলোর বিদ্রোহের প্রতীক? রাজবংশী-মদেশিয়া-আধিয়ার-কৃষকমজুর শ্রেণি-ঐক্যের মিলিত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে হয়তো দিনবদলের রঙিন স্বপ্নও দেখতেন দেবেশ। সেই খণ্ড স্বপ্নেরই মালা গাঁথা দীর্ঘ বয়ান “তিস্তা”।

“তিস্তা” নিছকই কোনও উপন্যাস নয়। ভ্রষ্ট সময়ের কথকতা। বাঘারু-শ্রীদেবী-মাদারির বৈষম্যময় পারস্পরিকতার সঙ্গে একাকার হয়ে থাকে কাব্যিক রোম্যান্টিকতা, জনজাতির ইতিহাস, জীবনের গান, কহাবত। শৌখিন ভারতের মলাটের ভেতরে শতচ্ছিন্ন মলিন ভারতের মহাআখ্যান। নেগেটিভ অবজেক্টিভিটি থেকে দেখা ঝাঁ চকচকে ভারতের আঁধার অন্দরমহল।

দেবেশদা চলে গেলেন। বাঘারুরা এখন রূপ বদলে বাস্তুচ্যুত কর্মহারা পরিযায়ী শ্রমিক। তাদের জীবনে আলোর রেখা ফোটেনি। অন্ধকার আরও জমাট বেঁধেছে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...