গোর্কির নিচামহলের খবর রাখতেন দেবেশ

চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য

 



লেখক সাংবাদিক, কবি ও প্রাবন্ধিক। লিটল ম্যাগকর্মী।

 

 

 

 

সালটা সম্ভবত ১৯৮৭ কি ’৮৮। দিল্লিতে বামপন্থীদের একটি সমাবেশ। কালান্তর-এর কর্মী হলেও সেই সমাবেশে যাই স্ব-ইচ্ছায়। গোটা ট্রেন বুক ছিল। একটা ছোট সস্তার ক্যামেরা ছিল। ‘কালান্তর’-এর প্রেস কার্ডের দৌলতে সমাবেশে ইন্দ্রজিত গুপ্তর ভাষণের সময় মঞ্চে উঠে ছবি তুলতে পেরেছিলাম। প্রায় দশ লাখের সমাবেশের সেই ছবি তোলার সময় গর্ব হচ্ছিল। ইন্টারনেট ছিল না তখন। সেই রাতেই কিছু ছবি নিজের খরচে ওসিএস সিস্টেমে কালান্তরে পাঠিয়েছিলাম। কালান্তরে তখন কাঠের ব্লক বানিয়ে লেটার প্রেসে ছাপা হয়। সেই ছবি আর ছাপা হয়নি।

ফেরার পর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, সম্ভবত নৃপেন বন্দ্যোপাধ্যায় বা গৌতম চট্টোপাধ্যায়, বললেন, আমার ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলি নিয়ে প্রতিক্ষণ পত্রিকার অফিসে দেবেশ রায়ের সঙ্গে দেখা করতে। দেবেশ রায় যে বিরাট লেখক এবং পরিচয় সম্পাদক ছিলেন, সেটা জানি। দিল্লি সমাবেশের ছবি দিয়ে কী করবেন, বুঝলাম না। পরদিন দেখা করে ছবিগুলি দেখালাম। ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করে উনি কিছু নেগেটিভ চেয়ে নিলেন। অনেকক্ষণ ধরে প্রশ্ন করে করে দিল্লির সেই সমাবেশ সম্পর্কে আমার মতামত শুনলেন, তারপর দিন দশেক পরে দেখা করতে বললেন।

দ্বিতীয়বার যখন গেলাম, উনি আমার মতো একটি অভাজনের হাতে দুটি প্রতিক্ষণ পত্রিকা আর খামে ভরা নেগেটিভগুলি দিলেন। বললেন, ‘ছোট ছবি তো, খুব কঠিন ছিল ব্যবহার করা, তবু কয়েকটা করেছি।’ আমি তো আনন্দে আটখানা! না-ফটোগ্রাফার আমার তোলা ছবি ছাপা হয়েছে প্রতিক্ষণে! এরপর অবাক করে একটি খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এটা আপনার। কিছু টাকা আছে।” আমার কাছে অবিশ্বাস্য!

পরে অনেকবার ভেবেছি, আমার ওই ছবিগুলি কি সত্যিই ব্যবহারের যোগ্য? এত বাঘা বাঘা ফটোগ্রাফার থাকতে আমার তোলা ছবি কেন ছেপেছিলেন? পরে মনে হয়েছে, চাকরি ছেড়ে কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হওয়া একজন নিজের খরচে দিল্লি গিয়ে ছবি তুলে পাঠিয়েছে কালান্তরে। কালান্তরের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যের থেকে শুনে উনি স্থির করেন, একে উৎসাহ দেওয়া যাক। আমি তখন একেবারেই প্রাথমিক স্তরের সদস্য। কাঁচা মাটি। আমাকে আরও বেশি করে খেটেখাওয়া মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ করতেই হয়তো এই সিদ্ধান্ত। বোধ বলছে, এটাই অন্য কমিউনিস্ট নেতাদের থেকে দেবেশ রায়ের কমিউনিস্ট সত্তার ফারাক। কিছু না বলে অনুভবে যে বোধটা তিনি অপরের হৃদয়ে জাগ্রত করতে পারতেন, তা যদি সাতের দশকের কমিউনিস্ট নেতাদের থাকত, হয়তো ইতিহাস অন্যরকম হত।

পরবর্তীকালে জেনেছি, কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মধ্যে আবহমান কাল চলমান ‘সংখ্যাগুরুর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত’ মতে দেবেশ রায় বিশ্বাস করতেন না। সংখ্যালঘু মতামতেও যে সারবত্তা থাকতে পারে এবং সেটাও প্রকাশ হওয়া জরুরি, এই ছিল তাঁর মত। লেনিন আর রোজা লুক্সেমবুর্গের বিতর্কে লেনিনবাদী দেবেশ রায় নিশ্চয়ই রোজার পক্ষে। দলের সিদ্ধান্তের প্রকাশ্য সমালোচনাতেও তিনি পিছিয়ে থাকেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট প্রদান নিয়ে দুই কমিউনিস্ট পার্টির তীব্র সমালোচনাকে বিদ্ধ করেছেন ‘নিরাজনীতি’ পর্বে তার লেখায়— “বামফ্রন্টের ও দুই কমিউনিস্ট পার্টির আচরণ— কমিউনিস্ট ও বামপন্থী হিসেবেই অরুচিকর, অভব্যতা ও অসামাজিকতা।”

নিজের এই অবস্থান প্রসঙ্গে বলেন— “আমি প্রকাশ্যেই জানাতে চাই যে, আমি স্কুল ছাড়ার পর থেকেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও পার্টির শাখা সম্পাদক, জেলা সম্পাদক, রাজ্য পরিষদের সদস্য হিসেবে কাজ করেছি। সর্বভারতীয় স্তরেও কোনও কোনও প্রতিষ্ঠানে আমাকে কাজ করতে হয়েছে। পার্টির ভিতরে ও বাইরে মার্কসবাদের ফলিত প্রয়োগ নিয়ে অনেক সময়ই পার্টি নীতির সঙ্গে ও বামপন্থীদের নীতির সঙ্গে আমার বেশ বড় রকমের মতপার্থক্য ঘটেছে। এখনও ঘটছে। তাতে আমি পার্টিনিরপেক্ষ মার্কসবাদী হিসেবেই হয়তো পরিচিত থাকতে পারতাম ও অনেকে হয়তো তেমন একটা ভূমিকাই বেশি ফলপ্রসূ মনে করেন। কিন্তু সংগঠনের ভিতর থেকে কাজ করার অভিজ্ঞতা ও লেনিনের লেখা থেকে আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, সংগঠন ছাড়া সমাজের পরিবর্তন করা যায় না।”

‘অরুচিকর, অভব্যতা ও অসামাজিকতা’-র সমালোচনা করলেও বামপন্থীদের ভালটাও লিখলেন একই নিবন্ধে, “সেই সঙ্গে একথাও বলে রাখা উচিত, পার্টি ও বামফ্রন্ট থেকে স্বতন্ত্র মত আমি কাগজে লিখেছি ও সেকারণে পার্টি বা বামফ্রন্ট কখনও আমার মতপ্রকাশে আপত্তি করেনি। তারা আমাকে পার্টির ও বামফ্রন্টের কর্মী বলেই বিবেচনা করছে। এমন বিবেচনা নিশ্চয়ই তাদের উদারতা ও সহনশীলতা।” বরং, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েও লেখেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীক্ষান্তিক ভাষণে যেবিনয়, যেআন্তরিকতা ও যেআত্মসচেতনতার প্রকাশ ঘটেছে তা বিরল। তাঁর এই গুণগুলি বামপন্থী ও কমিউনিস্টদের আয়ত্ত করা দরকার।”

দেবেশ রায় আকৈশোর কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। ১৯৫৯ থেকে ১৯৭২ সারাক্ষণ কমিউনিস্ট পার্টিটাই করতেন। কেন এসেছিলেন এই দলে? সম্ভবত, দেশভাগের সময় ও তার পরে উদ্বাস্তুদের অধিকার আন্দোলনে কমিউনিস্টদের সক্রিয় ভূমিকা একটা কারণ। সামাজিক আন্দোলনের কারণে নিরন্ন নিম্নবর্গ ও দলিতরা সেই সময় এসেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির কাছাকাছি। এছাড়া, ফ্যাসিস্ট বাহিনীকে রুখে লাল ফৌজের জার্মানির মাটিতে হিটলারকে পরাস্ত করার কাহিনি হয়তো কিশোর দেবেশকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। শুরুতে তিনি শ্রমিক আন্দোলনে জড়ালেও মূলত কাজ করেছেন কৃষিজীবী রাজবংশীদের মধ্যে। রাজবংশী পাড়ায় যাওয়া, থাকা, মেলামেশার দ্বারা তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের শরিক হয়েছিলেন। শিখেছিলেন রাজবংশী ভাষা, ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে ভাষায় বক্তৃতা করতে পারতেন। মাওপন্থী না হয়েও মাওয়ের ‘জলে মাছের মতো মিশে থাকার’ তত্ত্ব নিজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছিলেন।

১৯৫০ সালে, মাত্র ১৪ বছর বয়সে বেআইনি কমিউনিস্ট পার্টি করার কারণে জেলে গেছেন। বিপ্লবী চেতনা না থাকলে ওই বয়সে জেলবাসের পর কেউ আর রাজনীতির পথে আসে না। ‘বিজ্ঞাপন পর্ব’-তে দেবেশ রায় লিখেছেন, “আমি খুব ছোটবেলা থেকে কমিউনিস্ট পার্টি করছি। কমিউনিস্টদের মধ্যেই বরাবর আছি, কখনো বাইরে থাকিনি।” জানিয়েছেন, পার্টি আইনি হওয়ার পর জলপাইগুড়িতে প্রথম জনসভা। “মাঠে সেদিন একটা মাত্র লাল ঝান্ডা, একা বসে অনিল মুখার্জি, লোকজন সামান্য।” সেদিন একাই পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন কিশোর দেবেশ। তার আদর্শবোধ ও চেতনা-মননে মনে হয়েছিল, “কমিউনিজমই হবে নিজের ও সমাজের চালিকা শক্তি।”

সেই চালিকাশক্তিকে উনি যান্ত্রিক হতে দেননি কখনও। জনপ্রিয়তা বা সংখ্যাগুরুর মতামতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করাতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। গ্রামশ্চি আর রবীন্দ্রনাথের আলোয় অবলম্বন করেছেন ‘মানুষের সমাবেশের ওপর, সমবেত বিদ্রোহের ওপর, চৈতন্যের উন্মেষের ওপর, মানব সত্তার জাগরণের ওপর’। এই মানুষ অবশ্যই একটা শ্রেণির মানুষ। ঘোষণা করেছেন, “সেই অবলম্বনটুকু নিয়েই লিখব, বাঁচব। এটাও কেবল আশাই, যে আশা ছাড়া জীবন ধারণ করা যায় না, যতটুকু জীবৎকাল অবশিষ্ট থাকুক না কেন, এই আশাটুকু ছাড়া সেটুকুও পাড়ি দেওয়া যাবে না।” (গল্প সমগ্র)

সেই পাড়ি দেওয়ার পথে প্রথম চ্যালেঞ্জ এল ১৯৬২-র ভারত-চিন যুদ্ধের সময়, কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজনে। তার স্মৃতিচারণ করেছেন এইভাবে, “১৯৬২-র সাধারণ নির্বাচন, শেষে চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধ— রাজনীতি আমার ওপর সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো শ্বাসরোধী হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অথচ, তখন কমিউনিস্ট আন্দোলনের পক্ষে সবচেয়ে দুর্বিপাকের কাল।” দল ভাঙার পক্ষে পার্টির অধিকাংশ সদস্য। যতটুকু না রাজনৈতিক কারণে, তার চেয়েও বেশি দলের ক্ষমতার দ্বন্দ্বে নতুন দল তৈরি হল। দেবেশ রায় সিপিআই-তেই রইলেন। দুর্বিপাকের দিনগুলি প্রসঙ্গে অকপট, “…’৬২-র চীন-ভারত সীমান্তের ঘটনার ফলে পার্টি যখন ভাঙছে, তখন ঘটনাচক্রে জলপাইগুড়িতে আমি প্রায় একক এবং সম্পূর্ণ একা। বাকি যারা সিপিআই-তে এসেছিলেন, তাঁরা কিছু পরে এসেছিলেন। প্রায় বছর দুয়েক প্রবল রাজনৈতিক, তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক একটি লড়াই গেছে।”

দেবেশ রায়ের সক্রিয় কমিউনিস্ট হওয়ার পিছনে বিরাট ভূমিকা জলপাইগুড়ির বিশিষ্ট নট, নির্দেশক, আবৃত্তিশিল্পী ও জলপাইগুড়ির গণনাট্য আন্দোলনের পুরোধা গণেশ চন্দ্র রায়ের। গণেশ রায়ের নাতি নাট্যনির্দেশক জয়জিৎ রায় লিখেছেন, “আমাদের রায় বাড়ির সাথে দেবেশ রায়ের ছিল আত্মার টান। সন্ধ্যাবেলার প্রগতিশীল কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকর্মী, সঙ্গীত শিল্পীদের ঠেকই তো ছিল পাওয়ার হাউসের পিছনের রায়দের একান্নবর্তী কুঠি। গণেশ রায়ের সান্নিধ্যেই তৈরি হচ্ছিলেন দেবেশ রায়, কার্ত্তিক লাহিড়ী, অমিতাভ দাশগুপ্ত, সুরজিৎ বসু, সমর চৌধুরীদের মতো বম্বশেল। তাঁরা অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়ে বামপন্থী আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলনের লড়াই, পরে পার্টি ভাগ হয়ে যাবার পর সিপিআই-তে থেকে গিয়ে সিপিএমের সাথে দ্বান্দ্বিক তাত্ত্বিক সংগ্রাম, আবার সত্তরের উত্তাল সময়ে দুষ্কৃতীদের কাছে আক্রান্ত হওয়া কিংবা ফ্যাসিবিরোধী প্রগতিশীল সাহিত্য সভা, কিংবা রবীন্দ্র জন্ম শতবর্ষে পাঁচদিনব্যাপী নাট্য ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশগ্রহণ… মার্ক্সবাদী দেবেশ রায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অটুট বিশ্বাস রেখেছেন বামপন্থায়…।”

“তিস্তা নদী, তাঁর অববাহিকায় গড়ে ওঠা জনপদের ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ বিজ্ঞান তাঁর ভাবনার একটা বড় অংশ নিয়ে ছিল আজীবন,” লেখেন জয়জিৎ, “তিস্তাপারের বৃত্তান্তকে দেবেশ রায় ছাপিয়ে গেছেন তিস্তাপুরাণে, যেটা এক জোতদার ও এক রাজবংশী ঘাটোয়ালের (মাঝি) একটা জার্নি, তিস্তাকে ছুঁয়ে দুটো শ্রেণির দুটো মানুষের গভীর অরণ্যে পথ হারিয়ে ফেলা। গুলিয়ে যায় তাঁদের শ্রেণি চরিত্র। সমাজ চেতনার সাথে মিলে মিশে যায় প্রকৃতি চেতনা, মিথ। শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্বে বিশ্বাসী দেবেশ রায় এভাবেই ধরেছেন গুলিয়ে যাওয়া শ্রেণি চরিত্রের অবস্থান। তাঁর কাছে দলিত বা রাজবংশীর রাজনৈতিক পরিচয় কখনও শ্রেণি পরিচিতির চেয়ে বড় ছিল না। সমাজে সেই শ্রেণিচরিত্র গুলিয়ে যাওয়ার পর্বেই দেবেশ রায় ও কমরেডরা গ্রামশ্চিকে আঁকড়ে ধরেন – ‘আমার প্রথম দায়বদ্ধতা শ্রেণির প্রতি, তারপর পার্টির প্রতি। পার্টি যদি শ্রেণির প্রতি দায়বদ্ধতায় ভুল করে, আমি পার্টির অবস্থানের বিরোধী, এটা গ্রামশ্চিরই শিক্ষা। শ্রেণি পরিচিতির খোঁজ করতে শুরু করেছেন সমাজের ইতিহাস, ঐতিহ্য, জীবনবোধ, সংস্কৃতিতে। স্বীকার করেছেন, “গ্রামশ্চির একটি বাক্যকে স্লোগান করে তুলেছিলামচাই রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিবান রাজনীতি’।”

১৯৬৭-তে রক্তঝরা খাদ্য আন্দোলনের পথ ধরে পশ্চিমবঙ্গে দ্বিখণ্ডিত কমিউনিস্টদের দূরত্ব সত্ত্বেও একসঙ্গে ক্ষমতা দখলকে সেই ‘সংস্কৃতিবান রাজনীতি’-র আয়নায় দেখেছিলেন। সে এক নতুন অভিজ্ঞতা— “১৯৬৭-র নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টিগুলির দুটি জোট। উলফ আর পুলফ। শেষ পর্যন্ত তারা ক্ষমতায় চলে আসে। মানুষ কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের দুটি জোট সত্ত্বেও তাদেরই বেছে নিলেও পার্টিগুলি কিন্তু ততটা আশা করেনি। প্রস্তুতিও ছিল না।” ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটা বারবার হয়েছে, যখন মানুষ তৈরি বদল ঘটাতে, কমিউনিস্টরা সেটা ধরতেই পারেনি। দেবেশ রায়ের মতে, এটা ছিল রাজনৈতিক উত্তরণের ‘আরম্ভক্ষণ’— “আমরা সত্যিই নিজেদের এই আরম্ভক্ষণের কর্মী বলে আবিষ্কার করেছিলেম।”

কিন্তু অচিরেই বাংলার বাম রাজনীতির কুৎসিত রূপের ইঙ্গিত পেয়েছেন। সেই কুৎসিত রাজনীতি এক দশক চলেছে, যখন কেন্দ্রে আর রাজ্যগুলিতে নানা দলের সরকার তৈরি হতে থাকে, ভাঙতে থাকে। তিনি লিখেছেন, “… ’৬৭ থেকে ’৭৭ কী এক আক্রমণের দশক, বামপন্থীদের আত্মহননের দশক, ভুল যুদ্ধে, ভুল পক্ষে আত্মবিসর্জনের দশক।… ১৯৬৭-র সরকার ভেঙে গেলে ১৯৬৯-এ ফের ক্ষমতায় ফেরে বামেরা।” কিন্তু, ১৯৬৯-এর পর “পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী ও সহযোগী পক্ষগুলি ক্লিন্ন আত্মকলহে মেতে উঠল… ’৬৯-এর প্রতিরোধ আন্দোলন পালটে আক্রমণের আন্দোলনে রূপ নিল। সিপিআই ও নকশালরা সম্মুখ যুদ্ধে আটকা পড়ে গেলেন।” আর তার সুযোগে ‘এক কলঙ্কজনক নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে’ সিদ্ধার্থ রায়ের ক্ষমতা লাভ। “সেই ক্ষমতা দখলে সহযোগিতা করল সিপিআই।”

লক্ষ করুন, প্রকাশ্যে পার্টির সমালোচনা করছেন। অথচ, তিনি তখন জলপাইগুড়িতে দলের জেলা নেতৃত্বে এবং রাজ্য কমিটিতেও। সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব মানছেন বলেই দলে থাকছেন, কিন্তু দল দিয়ে ঘটনার বিশ্লেষণ না করে দলের ভুল সিদ্ধান্তের সমালোচনা করছেন প্রকাশ্যে। সিদ্ধার্থ রায়কে রাজ্যে ‘কাউন্টার-ইন্সারজেন্সি তত্ত্বের আমদানিকারী’ আখ্যা দিয়ে বলছেন, “রাষ্ট্র তার সমস্ত শস্ত্র দিয়ে আমাদের গলা টিপে ধরেছিল, শ্বাস নেওয়ার মতো ফাঁক ছিল না। সমস্ত রকম রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সম্পর্কে এক অবিশ্বাস আমার একেবারে ভেতরে সেঁধিয়ে গেল।”

বাম রাজনীতির ভুল পদক্ষেপ যেমন তার ভিতরে প্রতিক্রিয়া ঘটাচ্ছিল, তেমনই ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সম্পর্কে এক অবিশ্বাস’ চেতনাকে আলোড়িত করছিল। সিদ্ধার্থ রায়কে ক্ষমতা দখলে সিপিআই-র ভূমিকার পর তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে সক্রিয়তা কমাতে থাকেন। তার কাছে, রাষ্ট্রযন্ত্রের স্বৈরতান্ত্রিক পীড়নের চেয়েও পার্টির রাজনৈতিক ভুল বেশি পীড়াদায়ক লেগেছিল। মনে হয়েছিল, ‘সে অবিশ্বাস বোধহয় আর কখনোই কাটবার নয়।’ সুযোগ পেলেন, কর্মস্থল জলপাইগুড়ি ছেড়ে কলকাতায় বদলে হওয়ায়। তিস্তার প্রেম হৃদয়ে নিয়ে চলে এলেন ভাগীরথী তীরে। গ্রামশ্চি-কথিত ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিবান রাজনীতি-র খোঁজে রাজনীতির থেকে সাহিত্যে বেশি মনোযোগ দিলেন।

জলপাইগুড়ির গণেশ রায়ের মতো কলকাতায় দেবেশ রায় পড়লেন পরিচয় পত্রিকা সম্পাদক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজরে। দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় পরে কালান্তর পত্রিকার ‘রবিবারের পাতা’ ও কালান্তর শারদ সংখ্যার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। জহুরির চোখ রত্ন চিনেছিল। আর, দেবেশ রায়ের অনুভূতি, “কলকাতায় আসার পর দীপেন আমাকে কোন প্রস্তুতির অবকাশও দেয়নি। তার কাজকর্মে একেবারে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল।” ধীরে ধীরে দেবেশ রায় প্রগতি লেখক সঙ্ঘে যোগ দিলেন, অন্যতম সম্পাদক হলেন। সমরেশ বসু পরিচয় পত্রিকাকে বলেছিলেন, “আমার সাহিত্যের আঁতুরঘর।” পরিচয় হয়ে গেল দেবেশ রায়ের বিচরণভূমি। দীপেনের প্রশ্রয়ে, অমিতাভ দাশগুপ্তর সাহচর্যে দেবেশ রায় লিখেছেন, “পরিচয় এরকম সচল থাকায় কলকাতায় আসার পর আমি জলের মাছ জলে ভিড়ে গেলাম। ‘পরিচয়’-এর সেই আড্ডা প্রতি সন্ধ্যাতেই বসত আর শেষ হত প্রায় মধ্যারাতে।” দীপেনের মৃত্যুর পর দেবেশ রায়কেই ধরতে হয়েছিল সিপিআই-র প্রচ্ছন্ন সমর্থনে পরিচালিত পরিচয় পত্রিকার হাল। দেবেশের পর এসেছেন তরুণ সান্যাল, অমিতাভ দাশগুপ্তরা।

১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। শান্তিময় রায়ের সঙ্গে তরুণ সান্যাল, দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, কার্তিক লাহিড়ি, অমিতাভ দাশগুপ্তদের সঙ্গে কাজ করছেন দেবেশ রায়ও। সিপিআই তখন বহু ক্ষেত্রে সংগঠনের নাম বাদ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ও এপারে আসা মানুষদের সহায়তা দিচ্ছে। দীপেনের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সহায়ক শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী সমিতি’। দেবেশ রায়ও আছেন সেখানে। এরপর, সাতের দশকের শেষ থেকে আটের দশক শেষ হওয়ার আগে এক দশকে তাঁর মনোজগতে এল কয়েকটা ধাক্কা। ১৯৭৮এ বড় দাদা আর ১৯৭৯তে দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায় মারা গেলেন। দেবেশের মনে হল, “লেখালিখির কাজটা ফাঁকা অর্থহীন হয়ে গেল। হঠাৎ কেমন বন্ধুশূন্য ও সমর্থনশূন্য হয়ে গেল। যেন আমার কারো কাছে কোন দায় রইল না।”

এক দশকও কাটল না, তাঁর ‘কমিউনিজমই সমাজের চালিকাশক্তি’ ধারণাটাও ধাক্কা খেল গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রৈকায়। “আশির দশক শেষ হতে না হতেই আণবিক বিস্ফোরণের মত প্রচণ্ডতায় অথচ প্রায় বিস্ময়কর নীরবতায় বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা এক দ্রুত ধ্বংসের মধ্যে ঢুকে গেল। আর, বছর তিন চারের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি মানচিত্র থেকে মুছে গেল।” দলের গোপনীয়তার গণ্ডিকে অতিক্রম করা দেবেশ রায় ‘নিরাজনীতি’-তে লিখেছেন, “একটা ঘটনা রাজনীতিতে তাৎপর্যে যত স্বচ্ছ হয়– সেই রাজনীতির বিপরীত পক্ষ তার কৌশল-দক্ষতার স্বচ্ছতা তত হারিয়ে ফেলে। গান্ধীজি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে বারবার এই স্বচ্ছতা দিয়েই হারিয়ে দিয়েছেন।” সেই দেবেশ রায়ই হতাশ হলেন এই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ঘটনাবলিতে। গল্প সমগ্র-র পঞ্চম খণ্ডে লিখছেন, “আমার চেতনার কোন অস্পষ্ট শুরু থেকে সমাজতান্ত্রিক স্বপ্ন এক রাজনৈতিক কল্পনা হয়ে উঠেছিল। সে কল্পনা প্রতিদিন পুষ্ট হয়েছে ভারতীয় বাস্তবতার দৈনন্দিনে। সমালোচনা ছিল, আপত্তি ছিল, সংশয় ছিল তবু এসব কিছুর ওপর ছিল এক ধ্রুব বিশ্বাস, সে বিশ্বাসের আর কোনও মাটি রইল না, রইল না কোনও বিকল্প কল্পনা রচনার উপাদান।”

এই দেবেশ রায় আনন্দবাজারের কর্মীদের আন্দোলনে অমিতাভ দাশগুপ্তদের সঙ্গে আনন্দবাজারের কর্মীদের পাশে পথে নেমেছেন। যে কারণে সাহিত্য আকাদেমি পেলেও আনন্দ পুরস্কার তার জোটেনি। তাতে অবশ্য আনন্দ পুরস্কারেরই ঔজ্জ্বল্য কমেছে, বাড়েনি। অমিতাভ দাশগুপ্ত সেই সময়েই ঘোষণা করেন, যারা নিজের কর্মীদের লাঠি পেটায়, সেই আনন্দবাজারে কখনও লিখব না। দেবেশ, অমিতাভরা কথা রেখেছিলেন।

শ্রেণিচেতনাকে পুঁজি করে ৭০ বছর রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত দেবেশ রায়ের উপন্যাসগুলিতে বার বার এসেছে সেই সবহারাদের কথা। তিস্তাপারের বৃত্তান্তে বাঘারু যেন এক নতুন শ্রেণির প্রতীক, যারা সর্বহারা শ্রেণির চেয়েও নিচে। মহাদলিত। অন্ত্যজ। ক্ল্যাসিকাল মার্ক্সইজমের ধারণার বাইরে এই সর্বস্বান্ত শ্রেণির মধ্যেই আগুনের বীজের সন্ধান করেছিলেন। তিস্তাপারের বৃত্তান্ত তাই দেবেশ রায়ের ঘাড় ধরে লেখায় ‘তিস্তাপুরাণ’। মিথ থেকে জায়মান বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে যাওয়া এক কাহিনি, যা বৃত্তান্তের আখ্যানধর্মিতাকে অতিক্রম করে শাশ্বত হয়ে যায়।

দেবেশ রায়ের আরেক অসামান্য কাজ ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ উপন্যাস। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৭এর কালপর্বে বাংলার সর্বপ্রথম অবিসংবাদী দলিত নেতার রাজনৈতিক জীবনের আখ্যানকে দেবেশ রায় রেখেছেন এক নিরেট সত্যের উপলব্ধিতে। এই দশ বছরে সুভাষ চন্দ্র, একে ফজলুল হক, বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিতে পাল্লা দেওয়া বাংলার দলিত নেতার গুরুত্ব কিভাবে মুছে দিল ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনীতি। যোগেন কীভাবে যেন নিজের অজান্তেই হয়ে যান ইতিহাসের ট্র্যাজিক নায়ক। দেবেশ রায় বলেছিলেন, “ইতিহাসের চোখে একজন ভিলেনকে নায়ক করে তোলা বড় শক্ত হে।” রবি ঠাকুর বলেছিলেন, “কঠিনেরে ভালবাসিলাম।” যোগেনের জন্য দুষ্প্রাপ্য সব নথি ঘাঁটার পাশাপাশি চষেছেন ওপার বাংলার বরিশাল সহ অনেক জেলার অজ পাড়া গাঁ। স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম আইনমন্ত্রী দলিত নমঃশূদ্র সমাজে আজও প্রণম্য। অথচ, কার্যত তিনি প্রায় পালিয়েই ভারতে আসেন। তারপর? আমৃত্যু এক অকিঞ্চিৎকর রাজনৈতিক জীবন। কিন্তু উপন্যাসে সেটা নেই, আছে ১৯৪৭ পর্যন্ত। দেবেশ রায়ের ব্যাখ্যা ছিল, ব্রাহ্মণ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে দলিত নেতা হিসেবে যোগেনের আন্দোলনের গুরুত্ব আম্বেদকারের চেয়ে কম না। কিন্তু, পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় ভারতের ইতিহাস থেকে তাঁকে সচেতনভাবে মুছে দেওয়া হয়েছে। বিস্মৃতির জাল ছিন্ন করে তাঁকে ইতিহাসে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতেই তার কলম ধরা। “যোগেনের স্বপ্ন সত্যি হয়তো হয়নি, কিন্তু তাঁর তত্ত্ব যে মিথ্যে ছিল না, মিথ্যে ছিল না তাঁর সংগ্রাম, সেটা আজকের শাসকের এই ভয়ঙ্কর উগ্র মনুবাদী রূপ আরও স্পষ্টভাবে প্রত্যয়িত করছে প্রতি নিয়ত। যোগেনের স্পষ্ট উচ্চারণ এখনও ধ্বনিত হয় ভারতের নানা প্রান্তে অরণ্যে, বন্দরে, জনপদে ‘আমি হিঁদুও না মুসলমানও না, আমি শুদ্র— এক স্বতন্ত্র জাত।’”

দেবেশ রায় নিজেকে বলতেন ‘কথোয়াল’। গাড়োয়াল, ঘাটোয়ালের মতো তিনি কথোয়াল। মনে পড়ছে এমন আরেক লেখকের কথা, যিনি নিজেকে বলেন ‘লেখোয়াড়’। মনোরঞ্জন ব্যাপারী। তার কথা বলেই এই লেখা শেষ করব। বছর ছয়েক আগের কথা। শারদীয় কালান্তর-এ দেবেশ রায় কোনও গল্প বা প্রবন্ধ না দিয়ে মনোরঞ্জন ব্যাপারীর লেখা ‘ইতিবৃত্তে চণ্ডাল জীবন’-এর পুস্তক সমালোচনা দিয়েছেন। সেই লেখার সঙ্গে বইটির প্রচ্ছদের ছবি ছাপতে অনুরোধ করেছেন কিন্তু সেটি জোগাড় করে নিতে হবে। অকপটে জানিয়েছেন, বইটি তিনি নৃপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে এনে পড়েছেন। অর্থাৎ, বইটি তাঁর কাছে নেই। লেখককে তিনি চেনেন না। যে দেবেশ রায় সম্পর্কে অনেকে পিছনে ‘সিনিক’ বলতেন, সেই দেবেশ রায়ই অচেনা লেখকের পুস্তক সমালোচনার লেখাটির শিরোনাম দিয়েছেন ‘মনোরঞ্জন ব্যাপারীর এপিক’।

এপিক! দেখে চমকে গিয়েছিলাম। কথোয়াল দেবেশ কিন্তু অকপটে স্বীকৃতি দিয়েছেন জীবনে পাঠশালায় পা না রাখা স্বশিক্ষিত সাহিত্যিক ‘লেখোয়াড়’ মনোরঞ্জনের সাগরসম অভিজ্ঞতা ও লেখার মুন্সিয়ানার। এই জীবন আমাদের অভিজ্ঞতায় নেই, দেবেশ রায়ের ছিল। তিনি যে গোর্কির ‘নিচামহল’-এর সঠিক খবর রাখতেন।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...