আমার দেবেশ রায়

দেবেশ রায় | সাহিত্যিক

পীযূষ ভট্টাচার্য

 



লেখক গল্পকার, ঔপন্যাসিক

 

 

 

ভালোবাসা স্বয়ং দুঃখবহ। বলা যেতে পারে, সত্যিকারের বেঁচে থাকার দুঃখ। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে ভালোবাসার বেদনা জীবনেরই বেদনা, অন্যকিছুর নয়। জানি না বলা উচিত হবে কিনা যেখানে ব্যক্তির দুঃখ সেখানেই কেনই বা হাজির হবে অপর এক জীবন— কিছুই বুঝে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না।

গত পরশু থেকে কলকাতা মোবাইলে ধারাভাষ্য দিয়ে চলছিল— এইমাত্র ভেন্টিলেশনে নিয়ে যাওয়া হল। তখনই নিজের ভিতরে ভিতরে বিজন হয়ে বসেইছিলাম পরবর্তী ধারাভাষ্য প্রতীক্ষায়। যাঁরা খোঁজ দিচ্ছিলেন তাঁদেরকে ফোন করতেও সাহস পাচ্ছি না— কেননা আমি তো জানি ভালোবাসাই সব— সবকিছুকে বহন করে— সহ্য করতে শেখায় সবকিছুকে। যথারীতি রাতের ইনস্যুলিন, ঘুম ইত্যাদি নানান ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। ওষুধের রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় রাত ছিল স্বপ্নহীন। ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই মনে হল— জীবন তো এক দুঃস্বপ্ন, সেখান থেকে দিন শুরু করবার আগে লক্ষ করলাম মোবাইলে মেসেজ গতরাতেই এসেছে ‘আপনার শরীরের কথা ভেবে রাতে আর খবর দিইনি— দেবেশ রায় আর নেই।’

তারপর সারাটা দিন ভেবেছি জীবনের ভালো মুহূর্ত কোনটি— জরায়ুতে যে স্তরে মানুষ পশু থেকে আলাদা হতে যায় সেই স্তরটিই বোধহয় ভালোলাগার মতন। মানবসন্তান হয়ে ওঠার বিমূর্ত অনুভূতি যা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। অসম্ভব। তা সত্ত্বেও মানুষ পৌঁছাতে চায়— সে জানে এই উপলব্ধির জন্য অপেক্ষা করতে হয় মানবজীবন।

সেই জীবনের রাজনৈতিক কর্ম থেকে শুরু করে লিখনের চারণভূমিতে যে বিরান প্রান্তর সৃষ্টি হয় সেখানে একাকী এক বৃক্ষের ছায়ায় লেখক-পাঠক আলাপচারিতার মধ্যে যেন তিনি আকাশ দেখে নিলেন। উড়ানের সমস্ত সম্ভাবনাকে নিজের মধ্যে নিয়ে বুঝিয়ে দিলেন এ কৌশলও আয়ত্তের মধ্যেই ছিল।

অবশ্য অতিপ্রাকৃতিক এসব কিন্তু নয়। এটাই অমোঘতা। খাদহীন মানুষ যেমন আমার ভীতিভাবকে উসকে দেয়— ভালোবাসতে পারে না। দেবতা দেবতা উপলব্ধিতে নিজে ভীষণ ভয়।

তিনি তো ব্যক্তি মানুষ থেকে বাংলা সাহিত্যের ক্রুশবিদ্ধ যিশু। যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ অবস্থাতে ভীষণ আপন মনে হয়— ভালোবাসা যায়।

প্রথমেই এ লেখাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম অগ্রজ মানুষটির সঙ্গে নিজের সম্পর্কের উল্লেখ করব না অথচ একটা বিষয় আবার উল্লেখ করতেই হচ্ছে। এই স্বীকারোক্তিটি রাখা সমীচীন এই মুহূর্তে। অলোক গোস্বামী সম্পাদিত ‘গল্পবিশ্ব’ পত্রিকার নিজের উপর ক্রোড়পত্রে লিখিতভাবে স্বীকার করেছি ‘দেবেশ রায়ের লেখা থেকে গদ্যটা শিখে নিজের মতন সাজিয়ে নিয়েছি।’

আর তিনি শিখিয়েছেন শেক্সপিয়ারের উক্তির সারমর্ম— শিল্প হল প্রকৃতির দিকে ধরে থাকা আয়না, প্রকৃতি তো নিজেরই প্রকৃতি— সবই নিজের ভিতরের কাউকে নির্দেশ করে। এই নির্দেশিত পথ চলাটাই লেখা।

থাক এসব কথা, পরদিন দুপুরে খেতে বসেছি। সাধারণত খেতে বসার সময় ফোন ধরি না। সেদিন ধরলাম। ফোনে অমিতাভ গুপ্তের নাম ভেসে ওঠাতে। তিনি জানালেন বরানগর শ্মশানে সব শেষ হলে গেল। পাশে খেতে বসা স্ত্রীর কানে পৌঁছে গেল শ্মশান ধ্বনি, নিজের সংস্কারবশত আমার ভাতের থালা তুলে জল ঢেলে আবার জলের উপর রাখলেন থালা, নিজের থালার নিচে জল ঢেলে দিলেন। না, উনি দেবেশ রায়ের নাম শুনেছেন মাত্র, মানুষটিকে চাক্ষুষ দেখেননি, তবুও আশ্চর্য অনুভূতি। আর আমার যে চোখে সমস্যা বেশি সেখান থেকে জল পড়ে শেষপাতের খাবারের সঙ্গে মিলে গেল।

ঘরে এসে আর্তস্বরে কেঁদে উঠতে চাইলাম। পারলাম না। তার পরিবর্তে গমকে গমকে শিরা-উপশিরা জুড়ে নিঃশব্দ ভালোবাসার কান্না ছুটেই চলছে…

যদি এখানেই থেমে যেতাম তাহলে খুব একটা ক্ষতিবৃদ্ধি হত না। কিন্তু সত্যের অপলাপ হয়ে যেত। এতক্ষণ পর্যন্ত ব্যক্ত করা হয়েছে পুরোটাই ব্যক্তিক। তাঁর যেমন জলপাইগুড়ি জেলা নিজের তেমনই বালুরঘাট শহর, দুজনই উত্তরবঙ্গের জোয়ার-ভাঁটা হীন নদীতটে বসবাস ছিল বহু বছর ধরেই। তিস্তা একজনের— আত্রেয়ী আমার। আত্রেয়ীর ঘাটে পা ডুবিয়ে বসলে জলের শীতলতায় বুঝতে পারি তিস্তার বর্ষার জল উপচে পড়ে আত্রেয়ীতে মিলেমিশে এক জলযাত্রা শুরু হয়ে গেছে। আসন্ন বন্যার ধ্বনি শুনতে শুনতে চলে যাই ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’তে।

‘মৃত জংশন ও বিপজ্জনক ঘাট’ (১৯৬২) ও ‘উচ্ছেদের পর’ (১৯৭৯) এই দুটো গল্প সম্পর্কে দেবেশ রায় জানিয়েছেন, প্রথম গল্পটিতে তিস্তা পেরোনো আছে, নৌকায়; তখন তিস্তা ব্রিজ হয়নি। শেষ গল্পেও সেই একই তিস্তা পেরোনো আছে, হেঁটে: তখন তিস্তা ব্রিজ অনেকদিন হয়ে গেছে।

এই প্রসঙ্গটি উঠেছিল ২০০২-এ। বালুরঘাটে তিনি উঠেছিলেন এপার বাংলা-ওপার বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি মেলা ‘বাংলার মুখ’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তিনি দুটি দিন ও একটি রাত ছিলেন আমার সঙ্গে। মেলার কর্মকর্তারা এ দায়িত্ব আমার উপর দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন কেন না ততদিনে উভয়েই একে অপরের পরিচিত। সেখানেই প্রশ্ন উঠেছিল, এই দুটো গল্পেই ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’র বীজ রোপণের কথা। উত্তরে কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসেছিলেন এমনভাবে যেন জলপাইগুড়ি জেলার কমিউনিস্ট পার্টির জেলা সম্পাদকের মানসচক্ষুতে ছুটে চলেছে তিস্তা।

তারপর অবলীলায় তিস্তার বোরলি আর আত্রেয়ীর রাইখোর মাছের স্বাদের তুলনামূলক আলোচনায় চলে গিয়েছিলেন কোনওরকম প্রস্তুতি ছাড়াই।

যদিও এরকম পদ্ধতিই তার লেখাতেও পেয়েছি। উপন্যাস বা আখ্যানরীতি নিয়ে তিনি ছিলেন ভীষণ  অন্বেষণকারী একজন। সহজেই ‘বৃত্তান্ত’ সৃষ্টির মধ্যে পাঠককে নিয়ে গিয়ে সেই পাঠকের উদ্দেশেই প্রশ্ন ছুড়ে দেন— কী বৃত্তান্ত নিয়ে আসলে?

তিনি বিলক্ষণ জানতেন উমাবার্তো একোর ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র শৈলী নিয়ে উক্তিটির কথা। তথাপি দেশীয় কাহিনি বিন্যাসের জন্য সেই পথটিকে মান্যতা না দিয়ে romantic flowering of Gothic novel, a foundation epic-এর গুরুত্ব না দিয়ে খুঁজে নিয়েছেন শুধুমাত্র উপযুক্ত কথনভঙ্গি ও প্রকরণের মাধ্যমে কাহিনিকে তুলে ধরা যায় যদি, তবে তাতে আবেদন বৃদ্ধি পায় বহুগুণ এবং দীর্ঘায়িত হয় জীবৎকাল। এবং ন্যারেটিভে সংযোজন করেন বিশেষ ধরনের সাংবাদিকতা।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সভ্যতার ইতিহাসে বহু কাহিনি সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু কী ধরনের প্রেক্ষিত— কী ধরনের ঘটনা বা অভিজ্ঞতায় একটি সার্থক কাহিনি সৃষ্টি হয় তার কতকগুলো নির্দিষ্ট প্যাটার্ন লক্ষ করা গিয়েছে যা আর্কি-টাইপাল ন্যারেটিভ বা কাহিনির আদি উৎস। সেখানে ইতিহাস জুড়ে যায়, জনজীবনের উত্থান পতন ও ভূগোল মিলেজুলে তৈরি করতে থাকে নানান উপকথা। এগুলিই আগামী দিনের ইতিহাসের সাঙ্কেতিক বীজ।

তার লেখাতে পুরাণ আছে। কিন্তু পুরাণে আমরা অভ্যস্ত কেউ একজন ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়াতে। তাকে তিনি সচেতনভাবে প্রতিহত করেছেন। বলেছেন— নির্দিষ্ট কেউ একজন নয়, সম্মিলিত মানুষের দলবদ্ধ চলাটাই আধুনিক পুরাণ।

যদি ক্ষণিকের জন্য বাঘারু থমকে দাঁড়ায়, সেটিই হবে চিহ্ন। নতুন চিহ্নবিন্দু। সেখান থেকেই আবার পথ চলা…

উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষ— এবার তাঁকে ছুটতে হবে বালুরঘাট থেকে মালদা স্টেশন— সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা। ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে রেস্ট হাউসে। ড্রাইভারকে তার রাতের খাবারটি মালদাতে কোথায় পাওয়া যাবে তার হালহকিকত বুঝিয়ে দিচ্ছি।

ঘরে পৌঁছাতেই শুনি টেলিফোন কথা বলছেন… ‘ময়া মাছ’, কলকাতায় যাকে বলে মৌরালা… মৌরালা তো কাগজে টিপ পরে থাকে, এ ময়া মাছ একেবারে আটপৌরে সাজসজ্জাহীন— স্বাদই আলাদা।

ও প্রান্তের কথা শোনার কথা নয়। ফোন রেখে জানালেন তোমার বৌদির ফোন।

ট্যাক্সিতে উঠে দরজা বন্ধ করবার আগে বললেন, গল্পদুটি ‘দুই দশক’ গল্পগ্রন্থে আছে— বইটি তোমার বৌদিকে উৎসর্গ করা।

মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝাতে চাইলাম— জানি।

উৎসর্গপত্রটি এখানে রাখছি এই কারণে, তাঁরা দুজনই আজ আমাদের মধ্যে নেই…

কাকলি-কে
এ-দুই দশকে

If I should chose Posterity
Where would you get contemporary fun?

Goethe, Faust, Prelude
৫ মে, ১৯৮২

ফাউস্টের লাইনদুটির বঙ্গানুবাদে দাঁড়িয়েছে:

যদি আমি অমরত্ব চাই
তবে তুমি এই মুহূর্তে মোহময়তা কোথায় পাবে?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...