স্মৃতিচারণ: আমার শিক্ষক, আমার মেন্টর

সুচন্দনা চট্টোপাধ্যায়

 


লেখক ইতিহাসের গবেষক ও অধ্যাপক। ডিরেক্টর, টেগোর সেন্টার ফর ন্যাচারাল সায়েন্সেজ অ্যান্ড ফিলসফি, কলকাতা

 

 

 

 

পরিচিত মহলে অধ্যাপক হরি বাসুদেবন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, ইতিহাসবিদ, সোভিয়েত ও রুশ বিশেষজ্ঞ হিসেবে সমাদৃত ছিলেন। আমিও এই চেনা গণ্ডির মধ্যে ওঁর পুরনো ছাত্রী ও পোস্ট-সোভিয়েত গবেষক হিসেবে পরিচিত। কিন্তু যাঁর জন্য আমার আজকের এই পরিচিতি, তিনিই আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। সম্প্রতি কোভিড-১৯-এর সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

ইউরেশিয়া এবং রাশিয়ার পরিবর্তনশীল সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে স্যারের বিদগ্ধ আলোচনা সবার জানা। কলকাতা শহরে ওঁকে ছাড়া সোভিয়েত-চর্চা নিতান্তই ম্লান। আমরা কয়েকজন সেই স্বর্ণযুগের সাক্ষী হয়ে আছি, যখন এই কলকাতা শহরে বসে স্যার সোভিয়েত স্টাডিজের ধারাবাহিকতা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতেন। ভারত-রাশিয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত মতামত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সেমিনারে অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল।

স্যারের সঙ্গে আমার ৩৪ বছরের সুদীর্ঘ যোগাযোগ। এই পরিসরে সেই সময়ের কিছু কথা বলার চেষ্টা করছি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে নক্ষত্রখচিত ইতিহাস বিভাগে হরি বাসুদেবন ছিলেন একটি উজ্জ্বল তারা। স্যার উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় ইতিহাস পড়াতেন। রুশ ইতিহাস ছিল ওঁর পাঠক্রমের মূল বিষয়। স্যার যা পড়াতেন, আর যেভাবে যত্ন নিয়ে পড়াতেন, তা অতুলনীয়। বক্তৃতার সারাংশ, এমনকী নির্বাচিত অবশ্যপাঠ্য রেফারেন্সগুলিও সযত্নে বোর্ডে লিখে দিতেন।

ইন্দো-রুশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্যারের অবদান বিরাট। এই ক্ষুদ্র নিবন্ধে তা নিয়ে আলোচনারও সুযোগ নেই। তবে, যে কয়েকটি বিষয় উল্লেখ না-করলেই নয়, সেগুলি হল স্যারের নিকিতিন এক্সপিডিশন ও আরও দুটি এগজিবিশন: (১) ইন্ডিয়া অ্যান্ড এশিয়াটিক রাশিয়া: দ্য নর্দার্ন রিচ অব বুদ্ধিজ্‌ম, এবং (২) ইন্ডিয়া অ্যান্ড দ্য রাশিয়ান স্টেট: কমেমোরেটিং সেভেন্টিয়েথ অ্যানিভার্সারি অব ইন্দো-রাশিয়া ডিপ্লোম্যাটিক রিলেশন্‌স।

স্যারের আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয় হল অধ্যাপক পূরবী রায় ও অধ্যাপক শোভনলাল দত্তগুপ্তের সঙ্গে করা একটি যৌথ প্রকল্প। স্যার এবং পূরবীদি মস্কো-র RTsKhidni আর্কাইভ-এ এবং GARF-এ দুষ্প্রাপ্য সব নথি ঘেঁটে বলশেভিক রাশিয়ায় আশ্রয় নেওয়া ভারতীয় বিপ্লবীদের সম্পর্কে নানা তথ্য উদ্ধার করেছিলেন।

১৯৯০-৯১ থেকে আমি গবেষণার মূল স্রোতে প্রবেশ করলাম। এমফিল ডিসার্টেশন, অর্থাৎ আমার জীবনের প্রথম গবেষণাপত্র লেখার সময়ে সোভিয়েত-চর্চার গুরুত্ব আমার কাছে স্পষ্ট হল। সোভিয়েত দেশে তখন গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা নিয়ে নিত্যনতুন বিতর্ক চলছে। সোভিয়েত সংশোধননীতির দোষগুণ বিচার না-করে স্যার আমাকে পরামর্শ দিলেন ‘ট্রানজিশন ডায়নামিকস’-এর ওপর নজর দিতে।

এর ঠিক পরে এল পিএইচডি করার সুযোগ। ততদিনে আমি ‘এরিয়া স্টাডিজ’ নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করে দিয়েছি। মধ্য এশিয়ার ট্রানজিশন-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে স্যারের কাছে আলোচনা করতে গেলাম। উনিশ শতকের বুখারা কীভাবে বলশেভিক আদর্শে পালটে গেল, এই ছিল গবেষণার মূল বিষয়। কিন্তু এই জানা ইতিহাসে কিছু অজানা তথ্য যোগ করার পরামর্শ দিলেন স্যার। উনি আমাকে শিখিয়েছিলেন, ‘প্যারালাল ন্যারেটিভ্‌স’ কীভাবে ইতিহাস রচনাকে সমৃদ্ধ করে। আত্মজীবনী (মেময়ার্স) ইতিহাসের ঘটনাগুলিকে কীভাবে আরও জীবন্ত করে তোলে। মনীষীদের আত্মকথা, ডায়েরি কীভাবে মেলে ধরে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, যাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে পরিবর্তনশীল সমাজের চেহারা।

পিএইচডি-র পাশাপাশি, আমি আমার কর্মক্ষেত্র অর্থাৎ মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট-এ মধ্য এশিয়া নিয়ে কয়েকটি গবেষণা প্রকল্পে দুই দশক ধরে কাজ করি। গবেষণার ক্ষেত্র ছিল প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর ইসলামীয় ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও তাঁদের আত্মপরিচয়-সংক্রান্ত বিষয়সমূহ। আমার পরম সৌভাগ্য, স্যার ২০০৭ থেকে ২০১২— এই পাঁচ বছর সেখানে প্রধান আধিকারিক ছিলেন। এই সময়ে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত শক্ত করতে পারস্পরিক বিনিময় কর্মসূচির ওপর উনি খুব জোর দিতেন। এইভাবে, আমাদের গবেষণাকেন্দ্র হয়ে উঠল এক আন্তর্জাতিক মিলনক্ষেত্র। স্যার ভারতে পোস্ট-সোভিয়েত স্টাডিজ-এর ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবনাচিন্তা করতেন। বর্তমান ও পরবর্তী প্রজন্মকে গ্রুপ ডিসকাশনের মাধ্যমে নানাভাবে উৎসাহিত করার চেষ্টা করতেন।

সব মিলিয়ে, আমি এমন একজন মেন্টরকে পেয়েছিলাম, যিনি আমার কাছে শুধুমাত্র সোভিয়েত-চর্চার খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে জ্ঞানের ভাণ্ডার উজাড় করে দিতেন তাই নয়, আমাকে স্বাধীন গবেষক হিসেবে বেড়ে ওঠার ব্যাপারে পথ দেখাতেন, উৎসাহ দিতেন।

সেই সুযোগ আমি প্রথম পেয়েছিলাম নিতান্ত অল্প বয়সে। ১৯৯০ সালে মাস্টার্স পরীক্ষায় সবে উত্তীর্ণ হয়েছি। সোভিয়েত জমানার একাল-সেকাল সম্পর্কে জানবার আগ্রহ দেখে স্যার আমাকে একটি ছোট্ট কাজ দিলেন। গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রইকা-র ঢেউ তখন সোভিয়েত দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। খবর কাগজ থেকে সেই পরিবর্তনশীল সমাজ ও রাজনীতির ওপর ছোট-বড় খবর জোগাড় করে একটা স্ক্র্যাপ বুক তৈরি করা— এই ছিল কাজ।

তার সঙ্গে আমি জুড়ে দিলাম ‘ট্যাবুলার ফর্ম’-এ ঘটনাগুলির সারাংশ। সন-তারিখ বসিয়ে সাজিয়েছিলাম এক একটি সাদা পাতায়। তিনমাসে একটা বড়সড় ফাইল তৈরি করে স্যারকে দেখাতে, উনি আমার কাজের দারুণ প্রশংসা করলেন। এতে আমার উৎসাহ আরও বেড়ে গেল। সেই অভিজ্ঞতা আমাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল গবেষণার পথে।

এই অসামান্য পণ্ডিত মানুষটির সংস্পর্শে আসতে পেরে আমার জীবন ধন্য হয়েছে। সদাহাস্যময়, সংবেদনশীল ও পরোপকারী প্রিয় শিক্ষককে হারিয়ে সত্যিই এক অদ্ভূত শূন্যতা অনুভব করছি।


লেখকের গবেষণার কেন্দ্রীয় বিষয় উত্তর-সোভিয়েত সময়কালের মধ্যপ্রাচ্য। মৌলানা আজাদ ইনস্টিটিউটে থাকাকালীন তাঁর গবেষণাগুলির ওপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ভারতীয়দের ভূমিকা নিয়ে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব হিস্টরিক্যাল রিসার্চ-এর (আইসিএইচআর) একটি প্রকল্পের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...