স্যার বেঁচে থাকবেন

অর্পিতা বসু রায়

 


লেখক সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর সিনিয়র অ্যাডজাঙ্কট ফেলো; মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ-এর প্রাক্তন ফেলো; কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে প্যাভেট র‍্যাংলার ফেলো, ২০১০। কলকাতার বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, দক্ষিণ এশিয়া এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিবিধ কোর্সে শিক্ষকতা করেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অফ ফরেন পলিসি স্টাডিজে এম ফিল ছাত্রদের গাইড করেছেন।

 

 

 

 

নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্য লেশ
সেই পূর্ণতার পায়ে, মন স্থান মাগে,
আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে,
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে

–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অধ্যাপক হরি এস বাসুদেবনের মৃত্যুতে শোকে অভিভূত অধ্যাপনা-জগৎ ও অন্যত্র তাঁর পরিচিত ও অনুরাগীরা। কিন্তু তাঁর আলোকসম উপস্থিতির স্পর্শে সঞ্জীবিতজনেদের মধ্যে তিনি বেঁচে থাকবেন। আমরা যারা তাঁকে চিনতাম, তারা এই প্র‍য়াণ সংবাদে বিলাপ করছি, তাও সেই মহাপ্রয়াণের দিনকয়েক বাদে যখন এই লেখা লিখছি, তখন বিশ্বাস জন্মাচ্ছে যে তাঁর জীবনকে উদযাপন করাই উচিত হবে। উচিত হবে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করা, তাঁর জীবনবোধের চর্চা করা, জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ের গভীরে অন্বেষণ করে আনন্দের সন্ধান করা। নিঃসন্দেহে তাই হবে তাঁর প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন৷

আমি নিজে যদিও প্রথাগতভাবে তাঁর ছাত্র ছিলাম না, কিন্তু নিজেকে তাঁর শিষ্য বিবেচনা করি। কারণ যখন তিনি কলকাতার এক নামকরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর ছিলেন, (ভারত সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রকের অধীনস্থ মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ) তখন তাঁর থেকে অনেক শিখেছি। বিনয়ের সঙ্গে শিখেছি, কীভাবে ছাত্রছাত্রী/গবেষকদের সমানুভবী হতে হয়, কীভাবে প্রাণিত করতে হয় তাদের, কীভাবে মঙ্গলকারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয় তাদের স্বার্থে, কীভাবে আমার মতের পরিপন্থী হলেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গির কথা শুনতে হয়, তাদের শক্তির জায়গাগুলি চিহ্নিত করে জ্ঞানজগতের উন্নতিসাধনের কাজে কীভাবে সেই শক্তিগুলিকে নিয়োজিত করতে হয়। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় তিনি রেখেছিলেন সেই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে, যেখানে বিবিধ ক্ষেত্রে তিনি গবেষণার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। শিখেছি তা থেকেও। শিখেছি কীভাবে এশিয়ান স্টাডিজ সম্পর্কিত কনফারেন্সে আলোচনা, বিতর্ক ও ভাবনার আদানপ্রদানের মাধ্যমে জ্ঞানমার্গের পথ খুলে যায় ও নীতিনির্ধারণেও দিশা পাওয়া যায়।

স্যারের সঙ্গে আমার আলাপ শুরু ২০০৭ সালের দিকে, যখন তিনি ডিরেক্টর হিসেবে প্রতিষ্ঠানে এলেন, যে প্রতিষ্ঠানকে ঐতিহাসিক বরুণ দে, অধ্যাপক দেবেন্দ্র কৌশিক, অধ্যাপক রণবীর সমাদ্দার ও অধ্যাপক জয়ন্ত কুমার রায় প্রমুখ মহারথীরা লালন করেছেন, যার এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল আলো করে আছেন প্রফেসর সুরঞ্জন দাস, প্রফেসর ওম প্রকাশ মিশ্র, প্রফেসর উমা দাশগুপ্তারা। আমি তখন এক তরুণ স্কলার, আফগানিস্তানে ঘুরছি নিজের আগ্রহ অনুসন্ধানে, যে ভূখণ্ড তখন শুধু ভৌগোলিকভাবে দুর্গম নয়, গবেষণার পরিবেশের দিক থেকেও দুরূহ। ফিল্ডওয়ার্কের জন্য ঘুরে বেড়ানো বা গবেষণার প্রয়োজনে ভাষাশিক্ষা তখন রীতিমতো কঠিন পশ্চিমের এই প্রতিবেশী দেশে, কারণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাব্যবস্থার অভাব। ভারত-পাক সম্পর্কের কারণেও আফগানিস্তানের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে কথা বলা মুশকিল হচ্ছে। কিন্তু তিনি চিরকালই আমার গবেষণার বিষয় নিয়ে উৎসাহিত ছিলেন। আমাকে উৎসাহ দিতেন এবং এই সূত্রে আরেকটি প্রাসঙ্গিক প্রান্তর, ইউরেশিয়া, যা কিনা তাঁর আগ্রহের বিষয়, তা নিয়েও আলোচনা করতেন। যখনই দেখা হত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে নতুন কী কী ঘটেছে তা জানতে চাইতেন। তাঁর আগ্রহ আমাকে সদা সজাগ রাখত, চিন্তাকে প্রসারিত করত। ২০০৭ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকেই যখন আমি গবেষণার্থে পাড়ি দিই, তখন তাঁর সম্পূর্ণ সহযোগিতা পাই। তালিবান পতনের পর ভারতের কোনও গবেষণা কেন্দ্র থেকে আফগানিস্তান সফর সেই ছিল প্রথম।

মনে আছে, আমাদের দলগুলি সফলতার সঙ্গে যখন আফগানিস্তান থেকে ফিরল, তখন তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন আমাদের যখন আফগানিস্তানের বিদ্বজ্জন মহলের সঙ্গে খাতির হয়েই গেছে, যখন আমরা নানা নজির গড়েই ফেলেছি, তখন প্রতিষ্ঠানে এবার একটা আফগানিস্তান প্রোগ্রাম শুরু করা উচিত। তাঁর সেই অনুপ্রেরণা সঙ্গে নিয়েই, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরান, মধ্যএশিয়া ও রাশিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে, শুরু হয়েছিল আফগানিস্তান বিষয়ক সুসংগঠিত এক প্রোগ্রাম। আফগানিস্তানের সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে বিদগ্ধ মানুষদের আমরা পেলাম আমাদের জ্ঞানান্বেষণের সঙ্গী হিসেবে। তিনি আরও ভেবেছিলেন, আফগান চর্চার ক্ষেত্রে, জামিয়া মিলিয়ার মতো কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কাজ করতে হবে, যা আমরা করেছিও বটে। তিনি জানতেন, এই প্রোগ্রামগুলির জন্য ঠিক কী প্রয়োজন এবং তা আমার মতো এক তরুণ স্কলারকে প্রণোদনা জোগাত। একইভাবে তিনি একে একে ইউরেশিয়া, চিন ও পশ্চিম এশিয়া প্রোগ্রাম শুরু করেন প্রবল উৎসাহে। তিনি সবসময়েই প্রাণোচ্ছ্বাসে ফুটতেন, গলার স্বরে ছিল উদ্দীপনার আঁচ৷ তাই আমার মতো তরুণ গবেষকরা তাঁর পথপ্রদর্শনের মুখ চেয়ে থাকতাম।

স্যারের বৌদ্ধিক উৎকর্ষ তাঁর বক্তৃতায় প্রতিফলিত হত। যদি কেউ নিজের অজ্ঞতার কারণে তা বুঝতে অক্ষমও হয়, তবুও তাঁর ইংরাজি উচ্চারণে মুগ্ধ না হয়ে পারত না।

যেভাবে তিনি তাঁর আকাদেমিক চিন্তাসূত্র বিস্তার করতেন কোনও রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি পক্ষপাত ছাড়াই, তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আকাদেমিয়ায় বিরল ছিল। নানা বিষয়ে নিজে জ্ঞানের আকর হওয়া সত্ত্বেও, তিনি অন্যের মত শুনতেন, তাদের হয় সমর্থন করতেন, নয় তাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন৷ অর্থাৎ তিনি নানা ভাবনাকে, বিকল্প চিন্তাকে সদা স্বাগত জানাতেন। কখনও নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অন্যের উপর চাপাতেন না। আইন্সটাইনের নীতি মেনে চলতেন তিনি— “Try not to become a man of success, but rather become a man of value.”

তার বিবিধ কীর্তি, প্রকাশনা, বিভিন্ন গবেষণা ও প্রকল্পে অবিসংবাদিত ভূমিকার কথা তো বিভিন্ন শোকবার্তায়, প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছেই, যা কিনা তিনি কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর ছাপা হয়েছে৷ আমি তাঁর কাজ নিয়ে মন্তব্য করার যোগ্য নই। আমি চিনতাম সেই মহান জ্ঞানীকে যিনি কেমব্রিজে পড়েছিলেন, যিনি জামিয়া মিলিয়া বা কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়েছিলেন, যিনি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অফ এশিয়ান স্টাডিজ-এর ডিরেক্টর ছিলেন, এনসিইআরটি-র টেক্সটবুক কমিটির চেয়ারপার্সন ছিলেন এবং যিনি ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ ও এশিয়াটিক সোসাইটির মতো প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আরেক ঐতিহাসিক, প্রফেসর তপতী গুহঠাকুরতাকে বিয়ে করার পর কলকাতাই হয়ে উঠেছিল তাঁর দ্বিতীয় বাড়ি। কলকাতার বাড়িঘর, শিল্পকর্ম, সৌধ, লাইব্রেরিতে সঞ্চিত দলিল সম্পর্কে তিনি শহরের জ্ঞানী মানুষদের থেকে বেশিই জানতেন৷

আমি যখন সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (CSIRD)-এ যোগদান করলাম, তখন আবার তাঁর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেলাম নানাভাবে। CSIRD ছিল আজাদ ফাউন্ডেশনের প্রাক্তন ফেলো ডঃ বিনোদ কুমার মিশ্র পরিচালিত আরেকটি প্রতিষ্ঠান। CSIRD-র প্রোগ্রামে তিনিই আমাদের গাইড করতেন এবং তার কানমিং টু কলকাতা (K2K) প্রকল্প বা বিমস্টেক কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করে তিনি খুব খুশি ছিলেন।  CSIRD ব্যানারের তলায় তিনি আমাকে আফগানিস্তান প্রোগ্রাম শুরু করতে আবার উৎসাহ দেন। আজ জামিয়া মিলিয়ার প্রফেসর রেশমি দোরাইস্বামীর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত শেষ আফগান কনফারেন্সটির কথা মনে পড়ে ভালো লাগছে৷ আফগানিস্তানে প্রাক্তন ভারতীয় দূতদের ও ভারতে বর্তমান আফগানিস্তান দূতদের আনা হয়েছিল। আফগানিস্তান ও ভারতের বিভিন্ন পণ্ডিতরা বক্তব্য রেখেছিলেন। প্রফেসর হরি বাসুদেবনও যোগ দিয়েছিলেন ও অনুষ্ঠানের সাফল্যে যারপরনাই আনন্দিতও ছিলেন।

তাঁর সঙ্গে আমার শেষ সুখ-স্মৃতি সেই ফোনকলগুলি ঘিরে, যেগুলো ফেব্রুয়ারিতে ঘটেছিল। তিনি ভারত ও উজবেকিস্তানের পণ্ডিতদের সম্মেলন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক-এ অংশ নিতে উৎসাহিত করেছিলেন৷ বলেছিলেন, আমি যেহেতু ওই অঞ্চলের সঙ্গে দীর্ঘদিন পরিচিত, তাই নিশ্চয় কিছু মূল্যবান আলোচ্য বিষয় তুলে ধরতে পারব৷ অন্যান্য কিছু কাজকর্মের ঝামেলায় বক্তৃতা প্রস্তুত করতে পারব কিনা তা নিয়ে আমি অনিশ্চিত ছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর কথা শুনতে হল আমাকে৷ পাড়ি দিলাম নিউ দিল্লির ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স-এর উদ্দেশে। তাঁকে বলেছিলাম, শুধু তাঁর কথাতেই আমি যাচ্ছি। একথা তাঁকে খুশি করেছিল। আজ ভাবতে ভালো লাগছে যে তাঁর শেষ নির্দেশটি আমি পালন করতে পেরেছিলাম। ফেরার পর তিনি আবার ফোন করেছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন মিটিং-এর বিষয়ে, যা যা নতুন ভাবনার আদানপ্রদান হল, তার বিষয়ে। স্যার ছিলেন এরকমই। যেচে জুনিয়রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাতে, নিঃশর্তভাবে তাদের অনুপ্রেরণা জোগাতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার।  আমার ও আমার মতো অনেকেই, যারা তাঁর উষ্ণ ব্যবহার ও পথপ্রদর্শনের দ্বারা উপকৃত হয়েছে, তাদের স্মৃতিতে তিনি অমলিন থাকবেন। তিনি ছিলেন মহান পণ্ডিত, শিক্ষক, প্রশাসক এবং সর্বোপরি এক মহৎ মানুষ।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...