Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শ্রাবন্তী মজুমদার

ছটি কবিতা -- শ্রাবন্তী মজুমদার

ছটি কবিতা

 

দাম্পত্য

ভালোবেসে বিয়ে বলে
আমার তথাকথিত কোনো প্রেমিক নেই
যেরকম এই কেতাদুরস্ত শহরেরই আশপাশের গলিগুলো
স্ট্রিট লাইট ছাড়াই কাটিয়ে দিল…

এমনই হয়, আষাঢ় পেরিয়ে যাবার পর
ছাতার প্রয়োজন ফুরিয়ে আসে
তেল-নুন-কালোজিরে আনতে আনতে ক্লান্ত স্বামীটিকে
দেখেও মায়া হয়। রাতজাগা, ফিসফিস এই তো সেদিন…

আর দু-চারটে দম্পতির মতো হয়তো এরপর
আমরা মা হব, বাবা হব
স্ট্রিট লাইট ছাড়াই কাটিয়ে দেওয়া গলিগুলোতে
প্রাতঃভ্রমণকারীরা হেঁটে যাচ্ছে দেখে বাচ্চাদের ঘুম থেকে তুলে দেব
মেইল চেক করব, পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরব এবং মাঝেমধ্যে
এক ফোঁটাও না ঘুমিয়ে কাটানো রাতের পর
একটা ভেজা বালিশ, একটু অভিমানের জন্য আকুল হয়ে উঠব…

 

অসুখলতা

ক’দিন থেকে ঘর বন্ধ
সকালের রোদ এসে তেরছাভাবে পড়ে
আর আমি জল হাতে এসে বসি সোফায়
তোমার পাঠানো গান শুনি, বইটই গোছাই
এভাবেই কাটছে ক’দিন জানো তো…
দুপুরগুলো ভেঙে যাচ্ছে নিমপাতা ভাজার গন্ধে

বিষাদ এবং কল্পনা ছাড়া আপাতত সব বন্ধ

এই মহানগরের অসুখ সেরে গেলে
আবার তুমি কলেজস্ট্রিটের মোড়ে এসে দাঁড়াবে তো!
আবার আমরা অল্প মুখ তুলে তাকাব
টিস্যুপেপারে মুছে নেব ঘাম, খুব বেশি সময় বোধহয়
আমরা কেউ-ই নিতাম না! তবু
কাপে-চামচে রিন্‌রিনে শব্দ হতেই
আমি উঠি উঠি করব…

তুমি আটকাতেও পারো না, আগলাতেও না…

শুধু সদ্য ছেড়ে আসা চেয়ার দুটো দখল করা
ছেলেমেয়েদের দিকে হাত নেড়ে কী যেন একটা বলতে চেষ্টা করো

 

সেদিন

মাস্কে মুখ ঢেকে কে হেঁটে গেল!
আচমকা শূন্যপথে দ্রুত কে ওই যায়
কণিকার মতো… বড় গোল টিপ কাজল চোখে
নাকি আর কেউ চেনা গেল না তো!
আজ যদি গোটা পৃথিবীর মাথায় হাত
কার কী বা যায় আসে…

এ জীবনে কত না মানুষ কণিকার মতো দ্রুত, অকালে…

দীর্ঘ অন্তর্ধান ছাড়িয়ে চলো আমরাও
চকিতে পার হই ব্রিজ, শব্দহীন সময়ের অপরাধী চাঁদ
দূরত্বচিহ্ন তুমি তো করুণাধারার মতো
মুছে নেওয়া সামান্য ক’ফোঁটা স্যানিটাইজার…

 

তারপর

এই যে শহর ছেড়ে, ঝড় ও মহামারি পেরিয়ে যেতে পারলে তুমি
দূরে যে গ্রাম ত্রাণের আশায় বসে আছে
ভেসে যাওয়া মাঠ, ধানবন
আধখানা মাটির দেওয়াল…

এই যে তুমি ধুসর জিন্স গুটিয়ে নেমে পড়ো
কবেকার না কাটা চুল বাতাসেতে ওড়ে
ভাঙা তেজগাছপাতা গাছ, ঝুঁকে পড়া শিরিষের ডাল…
এসে দ্যাখো অক্ষর চেনেনি যে পাড়ার কৃষক
দুঃখী দুঃখী মুখ করে সেও আজ স্কুলদালানের ভীড়ে
কতদিন পর পুরনো ক্লাসগুলো লোকে গমগম…
হাতের পাতায় শুধু জলের ক্ষত! বইহীন খাতাহীন
ডুবো ডুবো নিকেতনে তুমিও শেষে কিনা মেলে দিলে নীল ত্রিপল…

 

বাদলকাল

আজকাল মনে হয় সারাদিন বৃষ্টি হোক
কারেন্ট চলে যাক, ঘন্টার পর ঘন্টা কেউ ফোন না করুক
রান্নাঘর থেকে খিচুড়ির গন্ধ ভেসে আসুক
আর আমি তারের ওপর ভেজা পাখি দেখে দেখে
একটা গোটা দিন কাটিয়ে দিই…

আজকাল এরকম করেই ভাবি
দূরে কোথাও কেউ বৃষ্টি চোবানো শাড়িতে হেঁটে যাক
ডেকে জিজ্ঞেস করি কটা বাজে, কী বার!

এ জীবনে যতগুলো শ্রাবণ এসেছে

সব ভেসে যাক! অলিভঘন রেইনকোট পরে
আজকাল খুব মনে হয়
গোপনে লালন করি একশো আষাঢ়…

 

বৃত্ত

প্রতিবার বাড়ি বদলাবার কদিন আগে থেকেই টের পাই
বিষাদঋতু শুরু হল…
ছেঁড়া পাপস, দুটো ঘরোয়া চটি, পুরনো ফ্লাওয়ারভাসের জন্য
অদ্ভুত এক মায়া হয়
মায়া হয় ছবিমাসি, টুম্পা, সবিতাদিদের জন্যে

একটা শহর, একটা গলি, গলির মাথার ছাতিমগাছ নিয়ে
যে জীবন অনায়াসেই কাটিয়ে দেওয়া যেত
সেসব ফেলে আবার ব্যাগ গোছাতে বসি

কোনও বাড়িকেই আর বিশ্বাস করব না
সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেও আবার যখন নতুন করে
পর্দা, কুশন, জলের বোতল কিনতে বেরোই
চারদিকের বাতাসে ক্যামন এক প্রতারণার গন্ধ খুঁজে পাই