Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দশ মাসের কৃষক আন্দোলন এবং প্রতীকী ভারত বন্ধ: একটি রিপোর্ট

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

আন্দোলনের কি স্মৃতিরোমন্থন হয়? বিপ্লব, বিদ্রোহ, আন্দোলনের বর্ষপূর্তি ইত্যাদি তখনই সম্ভব হয় যখন সময় ও স্থানের নিরিখে তা কোনও লার্জার দ্যান লাইফ-এর ক্ষেত্র নির্মাণ করে, যা নাড়িয়ে দেয় শাসকের ভিত। আসমুদ্রহিমাচল থরথর করে কেঁপে ওঠে। তথাকথিত ম্যাচো এবং নামুমকিন ইমেজ খসিয়ে শাসকের নির্লজ্জ বাস্তবটা দেখিয়ে দেওয়া এক ঐতিহাসিক বিপ্লবের এমনই এক দশটা মাসের গল্প। যে গল্প আগেও বহুবার হয়েছে। যে গল্পের সম্ভবত শেষ নেই।

কৃষক আন্দোলন। বাস্তবের সঙ্গে কোনওরকম সাযুজ্য না থাকা হাস্যকররকমের কর্পোরেটপন্থী তিন তিনটে কৃষি আইনের বিরুদ্ধে এই কৃষক আন্দোলন ভারতীয় জনতা পার্টি সরকারের ক্রমশ সমর্থন হারানো এবং শেষমেশ মুখে এককথায় চুনকালি মাখিয়ে দেওয়া সময়ের দিকে নিক্ষেপ করার একটা পদক্ষেপ। বিভিন্ন বিরোধী দলগুলির সমর্থন এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে সুযোগ পেয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র করে দিলেও যাকে কোনওভাবেই বিরোধী প্ররোচিত, এভাবে দাগিয়ে দেওয়া যায় না। কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ার বাইরে এক এক অভূতপূর্ব আন্দোলন। যার ব্যাপ্তি, ওই যে বললাম, আসমুদ্রহিমাচল।

এই আসমুদ্রহিমাচলের কথায় ২৭ সেপ্টেম্বরের ভারত বন্ধ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ৪০টি কৃষক ইউনিয়নের সমঝোতাকারী প্রধান সংস্থা সংযুক্ত কিসান মোর্চার ডাকা এই ভারত বন্ধ দশ মাসের রেট্রোস্পেক্টিভ হিসেবে ভোর ছটা থেকে বিকেল চারটে— অর্থাৎ দশ ঘণ্টা ধরে চলা এক ইতিহাস। আশ্চর্যের কথা এই, শাসক পরিচালিত সংবাদমাধ্যমগুলির নির্লজ্জ তাবেদারির পরেও এটি খুব পরিষ্কার, দিল্লি-পাঞ্জাব-হরিয়ানার চিরপরিচিত সঙ্কুচিত সীমানা ছাড়িয়ে এই বন্ধ সমগ্র ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ল কোনও এক ম্যাজিকাল টানে। একটু দেখে নেওয়া যাক সেসবেরই এক ঝলক।

আন্দোলনের আঁতুড়ঘর অর্থাৎ পাঞ্জাব-হরিয়ানায় স্বভাবতই এর সরাসরি প্রভাব পড়েছিল। দুটি রাজ্যের প্রায় গোটাটাই এককথায় ছিল সম্পূর্ণ শাটডাউন। পাঞ্জাবের অমৃতসর, রূপনগর, জলন্ধর, পাঠানকোট, সাংগ্রুর, মোহালি, লুধিয়ানা, ফিরোজপুর, বাথিন্দার মতো জেলার প্রধান সড়কগুলি বিক্ষুব্ধ অংশের দ্বারা অবরুদ্ধ ছিল। পড়শি হরিয়ানায় যা আছড়ে পড়ে সিরসা, কুরুক্ষেত্র, ফতেহাবাদ, পানিপত, হিসার, চারখি দাদরি, কার্নাল, কাইথাল, রোহতক, ঝাজ্জার এবং পাঁচকুলার মতো জেলাগুলিতে। কৃষকদের ট্রাক্টর র‍্যালি, বা হেঁটে মিছিল, কোথাও শুয়ে পড়ে সড়ক অবরোধ অথবা রেল রোকো অভিযান— আন্দোলনের ঢেউ থেকে বাদ যায়নি কোনও প্রচেষ্টাই। রেল অবরোধের খবর আসতে থাকে শাহবাদ, সোনিপত, বাহাদুরগড়, চারখি দাদরি, ঝিন্দ, হিসার, অমৃতসর এবং লালরুর মতো জায়গায়। এবং পাশাপাশি এসবের পরেও মানবিকতার খাতিরে আটকে পড়া যাত্রীদের জন্য পাতিয়ালা, কার্নাল ইত্যাদি জায়গায় লঙ্গর খুলে খাবার বিতরণও চলেছিল সমান তালে। আন্দোলন কখনও সাধারণ মুখগুলোকে ঢেকে দেয় না। যারা অন্নদাতা, তাদের সবদিকটা দেখতে হয়। মানুষের বাঁচা মরা, ভালো বা খারাপ থাকা, সব…

মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র-চম্বল, মালওয়া-নিমার, বিন্ধ্য এলাকা, ভূপালের কাছে রাইসেন, বিদিশা ও সেহোরের মতো জেলায় সকাল ৯টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত সবকিছুই বন্ধ ছিল। শুধুমাত্র রাইসেন ও সেহোর জেলাতেই ১৪টি র‍্যালির পাশাপাশি দশটি গ্রাম থেকে কৃষকেরা একজোট হয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আইনগুলি তুলে নেওয়ার আর্জি জানিয়ে একটি স্মারকলিপি জমা দেন। রাষ্ট্রীয় কিসান মজদুর মহাসঙ্ঘের পক্ষ থেকে বেশ কিছু নুক্কুড় নাটক বা পথনাটিকার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো হয়। ভূপালের করোন্ধ কৃষি উপজ মান্ডিতে দিগ্বিজয় সিং-এর নেতৃত্বে দুঘন্টার বিক্ষোভ প্রদর্শন হয়। জমা হন ৪০০-র বেশি কৃষক ও অন্যান্য পেশার মানুষজন।

তামিলনাডুতে অভূতপূর্ব এক সাড়ায় রাস্তায় নামেন ৫০০০০-এর উপর কৃষক-শ্রমিক। অল ইন্ডিয়া কিসান সভা, সিটু, লেবার প্রোগ্রেসিভ ফন্ট, অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস, হিন্দ মজদুর সভা এবং আরও অনেক বামপন্থী দলগুলির মিলিত প্রচেষ্টায় সম্ভবত পাঞ্জাব-হরিয়ানার পর দেশে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয় এই রাজ্যটিই। মাদুরাইয়ে সিপিআই(এম) বিধায়ক এস ভেঙ্কটেশের নেতৃত্বে বিশালাকার এক বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। কিঝভেলুর, তিরুত্তানি ও মাইলাদুথুরাইতে রেল অবরোধ সংগঠিত হয়।

আন্দোলন আছড়ে পড়ে তুলনামূলকভাবে শাসকঘাঁটি হিসেবে পরিচিত দেশের পশ্চিমাঞ্চলেও। মুম্বই-এর আন্ধেরি, সিওন, গোরেগাঁও, আজাদ ময়দান, থানে শহরের জিলা পরিষদ দপ্তর, অথবা ওসমানাবাদ, সেলু, তালোডা, ওয়াই বাজার, পারলি, সুরগনার মতো জায়গায় বিক্ষোভ ও সম্পূর্ণ বন্ধ পালিত হয়। কোলহাপুরের চাঙ্গদাদে ওয়াকাথন আয়োজিত হয়। পিম্প্রি চিঞ্চওয়াড় অঞ্চলে ভোসরি ও চাকানের মতো শিল্পাঞ্চলগুলি দখল করে নেন মজদুরেরা। আহমেদনগর, নাসিক ও সাংলি বিক্ষোভ চলে লাগাতার। অমরাবতী, পালঘড়, সোলাপুর, পারভানি, বিদ ইত্যাদি জায়গায় বেশ কিছু রাস্তা রোকো অভিযানের খবর আসতে থাকে।

গুজরাটে দলিত শ্রেণির যোগদান ছিল চোখে পড়ার মতো। ঢোলকা থানার সারদা গ্রামে ১৫ জন দলিত মহিলা রাস্তা অবরোধ করেন, পুলিশি দাপটে যা একটা সময়ে টললেও সাড়া ফেলে গোটা রাজ্যেই। ভদোদরা ও সুরেন্দ্রনগরের কৃষকেরা আহমেদাবাদ রাজকোট হাইওয়ে অবরোধ করেন। সুরাট ও ভারুচে প্রায় সমস্ত দোকানপাট বন্ধ ছিল গোটা দিনটাই। কামরেজের কাছে আট নম্বর জাতীয় সড়কে টায়ার পোড়ানো এবং কিছুটা হলেও অতিমাত্রায় বিক্ষোভের আঁচ ছড়িয়ে পড়ে, অবরোধের পাশাপাশি। রাজ্যের বৃহত্তম কৃষক সংস্থা গুজরাত খেদুত সংঘর্ষ সমিতির নেতৃত্বে ওলপাদ পুলিশ স্টেশনের কাছে ৩০ জন বিক্ষুব্ধ গ্রেপ্তার হন। দক্ষিণ গুজরাটে ১২ জন কৃষক নেতা গৃহবন্দী হন। পরিমল প্যাটেল, পিনাকী প্যাটেল, হিমাংশু ভাশির মতো নেতার বাড়ির বাইরে পুলিশি টহলদারি চলে।

সুরাটের রাস্তা

অন্ধ্রে সরকারি ঘোষণাতেই দুপুর একটা অবধি চলেনি একটিও বাস। তিরুপতি, অনন্তপুরামু ও কাদাপ্পার মতো জায়গায় বিক্ষোভের আঁচ পাওয়া যায়। অবশ্য বিপুল বৃষ্টি একটু হলেও এই রাজ্যের আন্দোলনকে স্তিমিত করে দেয়। অন্যদিকে তেলেঙ্গানায় বনপারতি, নালগন্দা, নাগারকুরনুল, আদিলাবাদ, রাজন্যা-সিরসিলা, ভিকারাবাদ সহ বেশ কিছু জায়গায় লাগাতার রাস্তা অবরোধ চলে।

ওড়িশার ভুবনেশ্বর থেকে রেল অবরোধের দৃষ্টান্তমূলক কিছু খবর আসতে থাকে। রাজ্যের অন্যতম প্রধান কৃষক সংস্থা নবনিমান ক্রুশক সংগঠন ও অন্যান্য সহযোগী দলগুলির নেতৃত্বে ভুবনেশ্বর, বালাসোর, রাউরকেল্লা, সম্বলপুর, বোলাঙ্গির, বারগড়, রায়গড়, সুবর্ণপুর ইত্যাদি স্থানে পরিকল্পিত কিছু বিক্ষোভ-আন্দোলন প্রদর্শিত হয়।

বিহারে বিরোধী দলের অন্যতম শরিক মহাগঠবন্ধনের সমর্থক ও শ্রমিক মজদুরের নেতৃত্বে পাটনা, দ্বারভাঙ্গা, জেহানাবাদ, ভোজপুর ও ভাগলপুরে রাস্তা ও রেল রোকো অভিযান করা হয়। ছড়িয়ে পড়ে লাল, সবুজ পতাকা, ব্যানার। বিখ্যাত গান্ধী সেতু অবরোধ করে আন্দোলনকারীরা। কোথাও ভোজপুরি গান, কোথাও কলার কাঁদি মাথায় বা মোষের পিঠে করে ছোট ছোট দল করে নিজেদের মতো করে বিক্ষোভে মাতেন কৃষকেরা। অন্য মাত্রা পায় আন্দোলন।

সবশেষে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থানটিও ছিল চোখে পড়ার মতো। রহস্যজনকভাবে শাসকের কোনওরকম সমর্থন না পেলেও আন্দোলন চলেছিল তার মতো করেই। অখিল ভারতীয় কিসান সংঘর্ষ সমিতির ব্যানারে মিছিল, রাস্তা অবরোধ ও পথনাটিকা চলে বেশ কিছু জায়গায়। মৌলালি থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত একটি পথসভা আয়োজিত হয়ে শেষমেশ ডোরিনা ক্রসিং অবরোধ করা হয়। কৃষক, শ্রমিক ছাড়াও ছিলেন ব্যাঙ্ককর্মী এবং বেশ কিছু গণ আন্দোলনের নেতানেত্রীরাও। উত্তর দিনাজপুরের পাঞ্জিপাড়া, রায়গঞ্জ ও করণদিঘি, দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কুলতলি ও ভাঙ্গর, পূর্ব বর্ধমানের বাঁধের টুকুরি, শিরিষতলা, জাহাননগর, নিমো, বর্ধমান শহর ও কালনা, পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল, নদিয়ার কৃষ্ণনগর ও ধুবুলিয়া, বাঁকুড়া জেলার সদর বাঁকুড়া শহর ও পাচাল, পুরুলিয়া শহর, ঝাড়গ্রাম, উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি, নকশালবাড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি এবং বীরভূম জেলার বেশ কিছু বড়সড় এবং বিক্ষিপ্ত বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের ঘটনা ঘটে। শান্তিপুর এলাকার মালঞ্চ ময়দানে বন্ধের আগের দিন অর্থাৎ ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর শান্তিপুর জনউদ্যোগ-এর আয়োজনে ‘বিসর্গ’ নাট্যদলের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয় প্রতীকী নাটক ‘বাঘছাল’। অন্যদিকে মূল কলকাতা শহরে মাত্র তিরিশ শতাংশ যানবাহন চলাচলের ঘটনা ঘটে।

আসানসোল
শান্তিপুর, নাটক ‘বাঘছাল’

দশ মাসের প্রতীকী বন্ধ তাই সবদিক থেকেই ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। প্রয়াত কৃষক নেতা, শীতে কাঁপতে কাঁপতে চলে যাওয়া কৃষক বৃদ্ধা— স্মৃতিতে চলে আসেন সবাই। কৃষি আইন এখনও বলবৎ থাকার হতাশার পাশাপাশি তাই এই মুখগুলোও চলে আসে বেদনাজনকভাবেই। পাশাপাশি দেশের মেট্রো শহরগুলিতে আন্দোলনের আঁচ তুলনামূলক কম পড়ার ঘটনা আন্দোলনের ব্যাপকতার সঙ্গে কোথাও কোথাও অল্প হলেও নিরাশার আঁচ ফেলে দেয় কৃষক সংগঠনগুলির কাছে।

যদিও, এই হতাশা সাময়িক। দশ মাস কেন, বছর পেরিয়েও সরকারের টনক না নড়লে এ আন্দোলন একটা সময়ে আরও বৃহত্তর রূপ নেবে, বলাই বাহুল্য।