Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছায়াপাখি — নীল হ্রদের তীরে, পর্ব ৩ (শেষাংশ)

বিশ্বদীপ চক্রবর্তী

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

চাতকপ্রাণ

গুণদীপ তৈরি হয়ে বসেছিল। শট হওয়ার কথা দশটায়। এখন এগারোটা ছুঁইছুঁই, কিন্তু বসে আছে। রাগ হচ্ছে, কিন্তু কিছু করার নেই। ইউনিটের সবাই তো বসে আছে। ডিরেক্টার শুভ মিত্তির নিজেও অস্থির হয়ে মোবাইলে কথা বলছে। সব কিছু তৈরি থাকলেও শট নেওয়ার উপায় নেই। হিরোইন আসেনি।

গুণদীপ ভাবছিল ও নিজেই কি অনামিকাকে ফোন করবে? কিন্তু ধরবে যে তার নিশ্চয়তা নেই। দশবার ফোন করলে একবার পাওয়া যায়। অথচ একদিন গুণদীপের হাত ধরেই ইন্ডাস্ট্রিতে পা রেখেছিল।

অনামিকার সিনেমায় নামার পিছনে গুণদীপের অবদান ছিল। পদ্মপুকুরে থাকত মেয়েটা। বেশ ভালো নাচত। তখন ওর নাম ছিল লেখা। হরিশ পার্কের পূজোয় মেয়েদের ডান্স কম্পিটিশনে এসেছিল। সেটা আবার গুণদীপের পাড়া। সিনেমার কল্যাণে পাড়ায় একটু আধটু নামডাক, ফলে গুণদীপ জাজ। লেখা খুব ভালো নেচেছিল সেদিন। ওই ফার্স্ট হয়।

নাচের শেষে গুণদীপের কাছে হাজির। কেমন লাগল গুণদীপদা?

বয়েস বছর বাইশ কি তেইশ। খুব সুন্দর ফিগার। গভীর বড় টানা টানা চোখ, ভরাট ঠোঁট, একঢাল চুল কাঁধদুটোকে জড়িয়ে রেখেছে। পরনে ঘাগড়া চোলি, দোপাট্টা সরে যাওয়া বুকের ঢেউ চোখের পাড় ভাঙার জন্য যথেষ্ট। সিনেমায় স্টান্টম্যান হিসেবে অনেক হিরোইনের সঙ্গে কাজ করা হয়ে গেছিল গুণদীপের। তাই সৌন্দর্য যাচাই করার চোখ খারাপ নয়। ও কোনও হিরোইনের খোঁজ করছিল না। কিন্তু মেয়েটার উপস্থিতি নড়বড়িয়ে দিয়েছিল গুণদীপকে। না হলে এমন সাধারণ প্রশ্নের উত্তর হাতড়াতে এত দেরি হবে কেন? মেয়েটা ওর চোখ পড়ার চেষ্টা করছিল। বললেন না, কেমন লাগল।

–হ্যাঁ, হ্যাঁ ভালো। নিজেকে জড়ো করছিল গুণদীপ। খুব ভালো। না হলে তোমাকে ফার্স্ট করব কেন? খুব ভালো নাচো তুমি।
–পায়েলদির মত? না তার থেকে ভালো?

তখন উঠতি হিরোইন হিসেবে পায়েলের খুব নাম। মনজ্যোৎস্না ছবিতে ‘ভাঙলে কাঁচের চুড়ি তোমায় প্রেম দেব না’ গানের নাচটা সেইসময়ের হিট।

লেখা সেদিন একটা হিন্দি গানের সঙ্গে নেচেছিল। কিন্তু বুঝতে চাইছিল গুণদীপের চেনা হিরোইনদের তুলনায় সে কোন সারিতে আসে। লেখা এমনভাবে নিজের দৃষ্টিতে গুণদীপকে বেঁধে রেখেছিল, উত্তর না দিয়ে বেরোবার পথ নেই।

লেখা ততক্ষণে ওর পাশের খালি চেয়ারটার দখল নিয়েছে। এখনও বললেন না কিন্তু। তার মানে সেরকম কিছু নয়। ওর মুখে এবার যে দুঃখটা ফুটছিল সেটা সত্যিকারের না চাপ সৃষ্টি করার জন্য কে জানে! গুণদীপ ওকে আশ্বাস দিয়েছিল, না না বেশ ভালো নাচো তুমি। কোরিওগ্রাফারের ট্রেনিং পেলে তুমি পায়েলের থেকে বেটার করবে।

সত্যি? এই কথায় খুশিতে লেখার সারা মুখ থইথই। গুণদীপের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলেছিল, আর নাচ বাদে? বোঝা গেল শুধু নাচের প্রশংসা শুনতে মেয়েটা এই প্রশ্ন করেনি। গুণদীপ একটু অবাক। ভালোও লেগেছিল, কম বয়সের এই সারল্যে। আমাকে কেমন লাগল? আমি সিনেমায় নামতে পারি?

–তুমি তো বেশ সুন্দরী আছ। সত্যি চটক ছিল মেয়েটার। মুখ চোখ নিখুঁত একেবারে, সেটা নয়। কিন্তু খুঁতহীন সুন্দরীরা সিনেমায় অত কল্কে পায় না। আলাদা কিছু থাকতে হয়।

চলবে। শুধু বলার জন্য না, সত্যিই গুণদীপের মনে হচ্ছিল। তবে সে তো আর কাস্টিং ডাইরেক্টর না, স্টান্টম্যান। এতদিন ইন্ডাস্ট্রিতে থাকায় একটা আন্দাজ তৈরি হয়েছে, সেই দিক থেকে বলা। তবে মোদ্দা কথা অভিনয়টা জানতে হবে।

শুধু চেহারা দিয়ে হয় না সিনেমায়। সেটা নিজেকে দিয়ে জানে গুণদীপ। তার চেহারা ভালো। পাঞ্জাবি রক্ত শরীরে। লম্বা চওড়া পেটানো চেহারা, পাকা গমের মত গায়ের রং, চোখেমুখে ধার। সাঁতার, ঘোড়দৌড়, বাইকের কেরামতি, নাচ, পাহাড়ে চড়া সব জানত। ভেবেছিল সিনেমায় নামবে। টালিগঞ্জ পাড়ায় চক্কর কাটল অনেকদিন। একটা সিনেমায় সাইড রোলও জুটে গেছিল। কিন্তু অ্যাক্টিংটা হল না ওর। ডাইরেক্টর কাঁধ চাপড়ে কিন্তু কিন্তু করে বলল, এমন লম্বা চওড়া চেহারা তোমার, কিন্তু বুঝলে সেই ব্যাপারটা নেই। ততদিনে সিনেমার পোকা মাথায় ঢুকে গেছে একদম। নতুন করে কী করবে আর। ছোটবেলা থেকে ডাকাবুকো, হয়ে গেল স্টান্টম্যান। নিজের এই পরিণাম থেকে জানে গুণদীপ, শুধু চেহারায় কিছু হয় না।

–অভিনয় জানো?

কথা পড়তে পেলো না, লেখা যেন তৈরিই ছিল। পারি, দুই একটা নাটকে করেছি। দেখাব?

এখানে? এখন? আঁতকে উঠেছিল গুণদীপ। অষ্টমীর রাত। হরিশ পার্কে পূজোর ভিড় বাঁধ ভেঙেছিল। চারদিকে হই হট্টগোলে। রাত হলেও চারদিকে চন্দননগরের লাইটিং-এ রামধনু রং। লেখা যেখানে বসেছিল তার ঠিক ওপরেই শিবের মাথায় জল ঢালার লাইটিং বোর্ড লাগানো। সেই টুনি লাইটের নেভা আর জ্বলার বিচ্ছুরণ ওর মুখের মেকআপে গলে গলে পড়ছিল। সেই অবাস্তব আলোয় মেয়েটার এই অকপট চেষ্টা গুণদীপকে ছুঁতে পেরেছিল। তাই মেয়েটা যখন বলল, একটু আসবেন প্যান্ডেলের পিছনটায়? ওখানে আওয়াজ কম, লোকজনও থাকবে না। সত্যিই কি সেদিন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছিল গুণদীপ? না হলে এক কথায় ওর পিছন পিছন চলবে কেন? মেয়েটা যেতে যেতে বলছিল, আমি স্বপ্নের সওদাগর দেখেছি। ওখানে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে গড়াতে গড়াতে খাদে পড়েই লাফ দিয়ে উঠে আবার ভিলেনের পিছনে তাড়া করেছিল অনীক, ওটা আসলে আপনিই ছিলেন না?

হেসেছিল গুণদীপ। গড়ানো অবধি আমি। তারপরে উঠে দাঁড়াল হিরো।

থমকে দাঁড়িয়ে ওঁর মুখের দিকে আবার অকপট চোখে তাকিয়েছিল লেখা। আপনার ভয় করে না? যদি ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে পড়ে আপনার কিছু হত?

–হোতা রহতা হ্যায় হরবখত। ছোটখাটো কাটাছেঁড়া তো সবসময়। হাত পাও ভাঙে। কিন্তু ভয় পেয়ে তো লাভ নেই, ওটাই তো আমার কাজ। তাছাড়া ডেয়ার ডেভিল শট দিতে আমার ভালো লাগে খুব। শুধু সিনেমায় নয়, বাইরে আমি এর চাইতে অনেক বেশি রিস্কি অ্যাকশান করে থাকি। লিমকা বুক অব রেকর্ডসে আমার দুটো এন্ট্রি আছে।

এটা গুণদীপের শখ। একবার খালি হাতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মাথায় উঠেছিল। আর একবার পেটের ওপর দিয়ে জিপ চালিয়ে নিয়ে গেছিল। পেটের ওপর পাটাতন দেওয়া ছিল। কিন্তু ওজনটা তো নিতে হয়েছিল তাকেই। এই দুটোই লিমকার বইতে আছে। নিজের কথা নিজের মুখে বলে না সে তেমন। কিন্তু লেখাকে বলতে খুব ভালো লাগছিল।

হরিশ পার্কের পিছনে অনেকটা খালি। লোক ছিল, কিন্তু হট্টগোল নেই। ডেকরেশনের লাইটিংও নেই এদিকে, শুধু রাস্তার সাদা টিউব। টিউবের চারপাশে শ্যামাপোকা উড়ে উড়ে এক একটা কালো মেঘ তৈরি করছিল। লেখা দাঁড়িয়ে পড়ল, এখানে করি?

–ঠিক আছে। তোমার অসুবিধা না থাকলে দেখাও। যা হোক এক পাগলের পাল্লায় পড়েছে আজ। মনে মনে বলেছিল গুণদীপ।

লেখা একমুহূর্ত থমকে দাঁড়াল। তারপর গুণদীপের চোখের সামনে ওঁর মুখটা ভাঙতে শুরু করল। কাঁদছে। গুণদীপ ঘাবড়ে গেছিল। যাব্বাবা! সে কি কিছু করল? বলতে যাবে, মেয়েটা দুপা এগিয়ে এসে খপ করে হাতটা ধরল। প্লিজ গুণদীপ, কেন এমন করো তুমি? বোঝো না আমার বুক কাঁপে তোমার জন্য? তুমি এরকম একেকটা কাণ্ড বাঁধাও, আমি নাওয়াখাওয়া ভুলে যাই। আমার চোখের ঘুম উড়ে যায়। কেন আমাকে এমনভাবে কষ্ট দাও গুণদীপ? নিজের ওপর তোমার কোনও মায়া দয়া না থাকতে পারে, কিন্তু আমার? আমার কথাটা একবারও ভাবো না তুমি? বোঝো না তোমার কথা ভেবে একটা কচি মেয়ে কেঁদে কেঁদে মরছে? তোমার কী পাষাণ হৃদয় গুনা, কঠিন, নির্মম। মেয়েটার চুল সামনে এসে এখন গুণদীপের এত কাছে যে ওর চুলের গন্ধ ঢুকে যাচ্ছে তার চোখে মুখে। জোরে জোরে কাঁদছিল এখন মেয়েটা। আর ওঁর বুকের ওপর চুড়ি পরা দুই হাত মুঠো করে গুমগুম করে কিল মারছিল। নাচের জন্য দুই হাতে অনেক কাঁচের চুড়ি পড়েছিল মেয়েটা। তার দুচারটে ভেঙেও গেল। কী হচ্ছে, সত্যি না মিথ্যে, মেয়েটাকে কি তার থামানো উচিত— এইসব ভেবে গুণদীপ যখন কূলকিনারা পাচ্ছে না, মেয়েটা নিজেই হঠাত থমকে গিয়ে মুচকি হেসে বলল, কেমন হল গুণদীপদা, চলবে?

সত্যি অবাক হয়ে গেছিল গুণদীপ। মুখ থেকে কথা সরছিল না। অভিনয় যেটুকু জানে, বুঝেছিল প্রচুর ট্যালেন্ট। আর তেমনই চক্ষুলজ্জার বালাই নেই। যদি রাস্তায় দাঁড়িয়ে কোনও প্রস্তুতি ছাড়া এমন অভিনয় করতে পারে, সত্যিকারের শট দেওয়ার সময় কী করবে? অকপটে সেকথা বলেওছিল লেখাকে। সিনেমায় নামলে তুমি কাঁপিয়ে দেবে।

–সত্যি বলছেন? হবে আমার? তাহলে আমাকে একটু সুযোগ করে দিন না গুণদীপদা।
–তোমার বাড়িতে জানে?
–গুণদীপদা আমার বয়েস বাইশ, আমি কী করব সেটা ঠিক করার জন্য কি আমার বাড়ির লোকের কথায় চলতে হবে? তাছাড়া আমার বাড়ি, আমিই। আমি একাই থাকি।
–সিনেমায় নামবে বলে পালিয়েছ? এরকম দেখেছে গুণদীপ। এই নেশাটা এমন যে মা বাবা পরিবার পরিজন সব তুচ্ছ হয়ে যায়।
–সবার জীবন সরলরেখায় চলে না গুণদীপদা। একেকজনের জীবনের স্ট্রাগল একেক রকমের, দরকারটাও আলাদা।
–সিনেমার জগতটা খুব রঙিন মনে হয় তোমার কাছে? মনে হয় স্বপ্নের মহল, তাই না? এখানে কত স্ট্রাগল জানো?
–ভয় পাওয়াচ্ছেন? জীবনে এত বড় বড় বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে গেছি যে আমি কিছুতেই ভয় পাই না।

সিনেমায় সুযোগ নেওয়ার জন্য আগেও এমন কিছু পরিস্থিতি ঘটেছে। ডিরেক্টার প্রডিউসারের আশে পাশে ঘোরা মেয়েদের দেখেছে গুণদীপ। রুপোলী পর্দায় নামার হ্যাংলামিটা কোন পর্যায়ে যেতে পারে জানা আছে। লেখাও তেমনি করেই তো তার উপরে চড়াও হয়েছিল। অনেকটা নাছোড়বান্দা। কিন্তু ওর চাওয়ার মধ্যে একটা পিঠ ঠেকে যাওয়া লড়াই ছিল। অভিনয়টাও ভালো করবে বলে মনে হল গুণদীপের। তাই আরেকদিন দেখা করতে রাজী হয়েছিল।

–শুটিং দেখেছ কখনও?
–না।
–তাহলে একদিন ইন্দ্রপুরী স্টুডিওতে আসো। দেখো। আন্দাজ মিলেগা। উসকে বাদ ভি ইরাদা জারি রহে, কৌশিশ কর সকতা হুঁ।

এরকম একটি মেয়েকে মুহূর্তে ভালোবেসে ফেলা যায়। অন্য কোনও উপায় থাকে না। সেটা একতরফা হলেও। শুধু ওর অভিনয়ের গুণে না মনের কোণায় গড়ে ওঠা ভালোবাসার জন্য— যে কোনও কারণেই হোক, গুণদীপ করেছিল লেখার জন্য। একদিন নিয়ে এসেছিল নিজের শুটিঙে। চন্দননগরের গঙ্গার ধারে পুরনো জমিদারবাড়িতে শুটিং। হিরোইন জলে ঝাঁপ দিয়েছে, ডুবে যাচ্ছে। হিরো পিছন পিছন ঝাঁপ দিয়ে জল থেকে উদ্ধার করবে। হিরো হিরোইন কেউ ছিল না। গুণদীপ আর রুনা, ওদের ডাবল। শুটিঙের শেষে আলাপ করিয়ে দিল ডিরেক্টর বরেন সান্যালের সঙ্গে। লেখা বলিয়ে কইয়ে মেয়ে। ওইটুকুই যথেষ্ট। আলাপ জমাতে বেশি সময় নেয়নি। বরেনবাবু পরের সিনেমার জন্য সেকেন্ড লিড খুঁজছিলেন। ওকে কার্ড দিয়ে দিলেন। এই শুভ মিত্তিরের কাছেও নিয়ে এসেছিল গুণদীপই। ব্রেকও পায়। তখনই নাম বদলে হয় অনামিকা।

স্ক্রিন টেস্ট ক্লিয়ার করতেই দুটো সিনেমায় সুযোগ পেয়ে গেল। এর আগে গুণদীপ লেখাকে নিয়ে এদিক ওদিক গিয়েছে, রেস্তোরাঁয় খাইয়েছে। এবার ও বলল ট্রিট দেবে। গুণদীপ ওদের সম্পর্কটার কোনও কূলকিনারা করতে পারছিল না। নিজে পাগলের মত প্রেমে পড়েছে। লেখা মাঝে মাঝে এমনভাবে কথা বলে, গভীরভাবে তাকায় তখন ওর টলটলে চোখে ভালোবাসা খুঁজে পায় গুণদীপ। আবার মাঝে মাঝেই নিরাসক্ত, চোখ হারিয়ে যায় দূরে। তখন লেখা সমুদ্রে ভাসমান এক দ্বীপ। গুণদীপের ডিঙ্গি নৌকা অতদূর পৌঁছাতে পারে না। এই আশা নিরাশার দোলায় থাকতে থাকতে গুণদীপ অস্থির হয়ে ছটফট করছিল। সেদিন লাঞ্চ করতে বসে খপ করে লেখার হাতটা ধরল। লেখা, তুমি কি আমায় ভালোবাসো?

খিলখিল করে এমন হেসে উঠল মেয়েটা, গুণদীপ লজ্জায় পড়ে গেল। এমন প্রশ্ন করাটা উচিত হয়নি মনে হল। গুণদীপের হাতটা না সরিয়ে তার ওপর নিজের অন্য হাতটা রাখল লেখা। আমি জানতাম সবাই প্রথমে বলে আমি তোমাকে ভালোবাসি, তারপর জানতে চায়। তুমি কি শুধু পেতে চাও গুণদীপদা?

–আমি তোমাকে ভালোবাসি লেখা, সেটা তুমি খুব ভালো করেই জানো।
–তাহলে তোমারও জানা উচিত আমি তোমাকে ভালোবাসি কিনা। দুষ্টু হাসিটা ওর সারা চোখে মুখে চিকচিক করছিল। হঠাত উড়ে আসা শরতের মেঘের মত আলোর ঝলকানি আবার নিমেষে আড়াল। গুণদীপদা এই মুহূর্তে তোমার হাত আমার দুই হাতের মাঝখানে ধরা আছে, এই যে মুহূর্তটা সেটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটাই সত্যি। জানো আমার কী মনে হয়, জীবনটা একটা কাঁচের অ্যাকোয়ারিয়ামের মতো। আমরা কী জানি কেউ কোনও কোণায় একটা বড় লোহার ডান্ডা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিনা, যে কোনও মুহূর্তে এসে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দেওয়ার জন্য? সঙ্গে সঙ্গে জলের মধ্যে একটু আগের হেসে খেলে বেড়ানো মাছগুলো ছিটকে যেতে পারে চারদিকে। যে দুটো মাছ পাশাপাশি পাখনায় পাখনা মিলিয়ে জলে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছিল, এতদূরে ছিটকে যেতে পারে যে হয়তো আর কোনও জল পাবে না একজন আরেকজনের কাছে সাঁতরে পৌঁছাবার জন্য। যে গোল্ডফিশটা নিজের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে একা একা বুড়বুড়ি কাটছিল, এখন হয়তো মুখ ছেঁদরে হাঁসফাঁশ করছে দূরে জলের বাইরে।

গুণদীপ অবাক হয়ে গেছিল। ওর তো এখন উঠতির সময়। এত খুশির দিনে ওর মাথায় এরকম ডরাওনি ভাবনা আসে কেন? এইটুকু মেয়ে, বয়েসে তার থেকে অন্তত দশ বছরের ছোট, এমন শোচ আসে কী করে? তাছাড়া এইভাবে বলছে যেন ও চোখের সামনে এমন অ্যাকোয়ারিয়াম ভেঙে মাছেদের ছিরকুটে পড়ে থাকতে দেখেছে।

কিন্তু লেখা তখনও থামে নি। মুখে জমে ওঠা মেঘটাকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে বলল, আমি নিজের দিদিকে দিয়ে দেখেছি গুণদীপদা কীভাবে এক জীবনের ভালোবাসা এক লহমায় মাটিতে মিশে যেতে পারে। তাই অনেকদিনের ভালোবাসায় আমি ভয় পাই। তার বদলে আমি প্রতিটা মুহূর্তে বাঁচি। ভালোবাসি বললে যদি মনে হয় সারা জীবনের জন্য একবুক ভালোবাসা নিয়ে বসে আছি, অত ভালোবাসা আর বেঁচে নেই আমার। কিন্তু আজ একুশে নভেম্বরের দুপুর একটা বাইশে আমার গুণদীপকে ভালো লাগছে, আমি ভালোবাসছি। বলেই চেয়ার থেকে একটু উঠে মাথা নামিয়ে এনে গুণদীপকে চুমু খেয়েছিল লেখা।

লেখার সঙ্গে প্রতিটা মুহূর্ত ছিল এমনি চমক। গুণদীপ এমনি খোলা দোকানে বসে, আর লোকের সামনে এমন ঘাবড়ে গেছিল, যে চুমুর স্বাদটাও ভালো করে নিতে পারল না। কী করছ লেখা, সবাই দেখছে না? গুণদীপ কাউকে কখনও রাস্তায় চুমু খেতে দেখেনি, এমনকি শুটিঙের সেটেও নয়। তাই হালকা ঠোঁটের ছোঁয়ায় শিহরিত হলেও থতমত হয়েছিল।

–দেখুক, এর পরে সিনেমা রিলিজ করে গেলে এমন খোলা জায়গায় কাউকে চুমু খেলেই ক্যামেরাবন্দি হয়ে যাব আর আনন্দলোকে আমাকে নিয়ে গসিপ হবে। সেসব হওয়ার আগে নিজের স্বাধীন জীবনটা একটু ঊপভোগ করে নিই।

মোটে সিনেমায় সাইন করেছে, সিনেমা রিলিজ হতে এখনও অনেক দেরি। নিজের সাফল্য সম্পর্কে এতটা নিশ্চিত ভাবনা কী করে পেত লেখা কে জানে। বোধহয় এটাও ওর আকর্ষণী শক্তির আর একটা কারণ। চুম্বকের মত টেনে নিয়েছিল গুণদীপকে।

নিজের শুটিং না থাকলে গুণদীপই লেখাকে সঙ্গে করে লোকেশনে নিয়ে যেত। ফেরার পথে একসঙ্গে লাঞ্চ বা ডিনার। বাড়ি অবধি পৌঁছে দিত। যদিও লেখা একা থাকত, কিন্তু কোনওদিন ভিতরে আসতে বলেনি। গুণদীপও যেতে চায়নি। ওর বাড়ির লোকেদের সম্বন্ধে জানতে ইচ্ছা করত, কিন্তু কী উত্তর পাবে সেই ভাবনায় কখনও প্রশ্ন করেনি। ভেবেছিল যেদিন বলার হবে নিজেই বলবে। এখন অবশ্য অনেকটাই জানা, সিনেমা পত্রিকায় খবর হিসেবে।

লেখা কী গুণদীপকে ব্যবহার করেছিল? অবশ্যই স্টুডিওপাড়ায় ওর চেনাজানা থাকার সুযোগ নিয়েছিল। নিতেই হয়। সেটা নিয়ে কোনও ক্ষোভ নেই। লেখার ব্যবহারে কোনও মেকিপনা ছিল না। যা চাইত, খুব সহজে। যা করত, সেটা খোলাখুলি। যা দিত, নিজের ইচ্ছায়। গুণদীপ আর লেখা সেই একবছর একসঙ্গে ঘুরেও বেরিয়েছে। দু দুটো সিনেমার শুটিং চলছিল। যেদিন দুজনের কারও কাজ থাকত না, এদিক ওদিক টহল দিত। লেখা স্কুলের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিল। আর কাজের বাইরে তখন গুণদীপের জীবনে লেখা ছাড়া অন্য সবকিছুর অস্তিত্ব বিলীন।  লেখাকে নিয়ে শপিং করেছে, পছন্দ করে দিয়েছে নিজের চোখ দিয়ে। তখনও নতুন সিনেমার হোর্ডিং আসেনি। সেই সময় লেখাও কি ওর প্রেমে পড়েছিল? না হলে নিজেই একদিন দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা বলবে কেন? বলেছিল বাড়িতে দমবন্ধ হয়ে আসে। আমি একদম ছোটবেলার পর কোথাও বেড়াতে যাইনি কখনও। আমাকে নিয়ে যাবে? এইভাবেই ওরা দুদিনের জন্য ঘুরতে গেছিল মুর্শিদাবাদ। গুণদীপ বুঝতে পারছিল না একটা ঘর নেবে না, দুটো। লেখার মনে কোনও দ্বিধা ছিল না। একসঙ্গেই ছিল। বন্ধ দরজার আড়ালে গুণদীপের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিতেও দুবার ভাবেনি। ইতস্তত করেনি। যেন ওর জানাই ছিল, এমনটাই করবে। ওই দুটো দিন মুর্শিদাবাদে এসে গুণদীপ পেয়েছিল লেখাকে। ঘণ্টা মিনিট মুহূর্তের জন্য নয়, পুরোপুরি। লেখার বুকে মুখ গুঁজে গুণদীপ গুঙিয়েছিল, আই লাভ ইউ, লেখি, মেরি পেয়ারি লেখি। ঠিক সেই সময় ওর চুল ধরে টেনে মুখ সামনে এনে চোখে চোখ রেখেছিল লেখা। গুণদীপদা, তোমাকে আমার ভালো লাগে। তুমি আমাকে এতদিনে ভালো করেই চেনো। একবার দুজনে শুলাম মানেই আমরা একে অপরকে ভালোবাসি, লাইফ পার্টনার সেটা মনে করলে ভুল করবে।

তখনও দুজনে একে অপরের শরীরের গন্ধ মেখে পাশাপাশি শুয়ে আছে। লেখার হাতের আঙুলগুলো ওর শরীরকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। অথচ স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দিল কোনও ভালোবাসা নেই, শুধু ভালো লাগা। চেনা জানাটা শুধু শরীরের। কীরকম বেভুল লাগছিল গুণদীপের। লেখা বুঝতে পেরে উঠে এল ওর বুকের ওপর। গুণদীপের বুকের চুলে নিজের আঙুল জড়িয়ে হাসতে হাসতে বলল, এই যে আমি এখন তোমার বুকের ওপর বসে দাড়ি ওপড়াচ্ছি, তোমার ভালো লাগছে না? উত্তর দেওয়ার সুযোগ না দিয়ে আবার গুণদীপের ঠোঁটে নিজেকে মুছে দিয়ে ওর সমস্ত অন্তরাত্মাকে যেন শুষে নিতে চাইল। লেখার নরম বুকের চাপে গুণদীপ গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল। গুণদীপের শিশ্নে নিজেকে স্থাপন করে লেখা সমস্ত শরীর দিয়ে গ্রাস করছিল তাকে।

লেখার কাছে কী সেটা শুধুই শরীরের দাবী ছিল? গুণদীপ জানে সেটা নয়। এটা সেই আরব্য রজনীর একদিনের রাজা হওয়ার গল্প তার জীবনে। দুঃখটা এই যে ভোর হতে একদিনের সেই রাজত্ব রানি ফিরিয়ে নিল। কিন্তু উষ্ণীষ খুলেও রাজা জনসাধারণের মধ্যে নিজেকে মিলিয়ে দিতে পারল না। এখনও লেখার জন্য বুক চিনচিন করে, অনামিকার মধ্যে খুঁজে বেড়ায় তিন বছর আগের সেই চঞ্চল, হাসমুখ মেয়েটিকে। সিনেমার কাগজে ওর সম্বন্ধে কতরকমের গল্প বেরোয়, বেশিরভাগটাই কেচ্ছা। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না গুণদীপের।

মুর্শিদাবাদে যাওয়ার পরে পরেই ওর প্রথম ছবি মুক্তি পেল। যেমন বলেছিল তাই, সুপারহিট। দুমাস বাদেই  আরেকটা। বাংলা সিনেমায় অনামিকা হয়ে গেল একটা বড় নাম। দেখা হওয়া কমে গেল খুব। গুণদীপ চেষ্টা করেছে, কিন্তু আর সাড়া পায়নি। সেটে মাঝে মধ্যেই দেখা হয়, যেমন আজ হবে। কিন্তু এই অনামিকাকে সে যখন তিনতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে ভিলেনের হাত থেকে ছিনিয়ে নেবে, ও বলবে, Guna! Don’t hold me so tight, it hurts.

একটা কথা আজও ভাবে গুণদীপ। সেদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার স্টান্ট করা নিয়ে যা বলেছিল অনামিকা, সেটা কি ওর মনের কথা ছিল? সেদিন ওইভাবেই আসলে ভেবেছিল কী? অন্তত সেই মুহূর্তে? সে যখন নতুন রেকর্ড করার জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর কোনও চ্যালেঞ্জ নেয়, তখন কি আবার সেইরকম কোনও মুহূর্ত তৈরি হয় ওর মনে?

একসময় গুণদীপ নিজের সঙ্গে লড়াইয়ের আনন্দের জন্য মৃত্যুর সঙ্গে খেলত। এখন করে অনামিকার কাছে খবর হয়ে পৌছানোর জন্য।

ঠিক এই সময়ে অনামিকার গাড়ি এসে থামল। চোখে রোদ চশমাটা ভালো করে এঁটে সবাইকে হাত নাড়তে নাড়তে সাজ বদলাতে চলে গেল। শুধু এক চিলতে হাসি উপহার দিল শুভকে। Suvo Darling, I am so sorry. Promise I will make it up.

দরজার আড়ালে অপসৃয়মান অনামিকার দিকে চেয়ে রইল এক চাতক হদয়।

 

৪ 

অনামিকা শুটিং সেরে যখন ডোভার লেনের বাড়িতে ফিরল তখন প্রায় চারটে বাজে। আর কিছুক্ষণ বাদেই ভোর হবে। ব্যারাকপুরে গঙ্গার ধারে একটা পুরনো বাড়িতে শুটিং ছিল। লাস্ট শট যখন নেওয়া হল তখন দেড়টা। আজকের মত প্যাক আপ। মেক আপ তুলতে সময় লাগে। তখন একটু চোখ বোজার চেষ্টা করেছিল। সুদীপা গত দুবছর ওর সঙ্গে আছে। ওর হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে এলিয়ে নেওয়া যায়। মেয়েটার একটাই দোষ। বড্ড বকবক করে। গসিপ করার অভ্যাস। সুদীপাই বলল বরুণদা নাকি জিজ্ঞেস করছিল কালকে ম্যাডামের শিডিউল কী।

শুনেই অনামিকার ভুরু কুঁচকে গেছিল। কেন? কী চাই? তার চেয়েও বড় কথা জানতে হলে সোজা অনামিকাকে জিজ্ঞেস করতে কী হয়? এইভাবেই তো ফালতু গসিপ ছড়ায়। তুই কী বললি?

–আমি বাবা কিছু বলিনি। কালকে আসতে হবে না বলেছিলে তুমি। সেটা বলেছিলাম হয়তো কথায় কথায়।

গলাটা এবার কড়া হয়ে গেল অনামিকার। তোর অত কথা বলার কী আছে রে? হিরো দেখলে গলে যাওয়ার অভ্যাসটা কবে ছাড়বি?

সুদীপা তখন আমতা আমতা করছে। আমি কী করে জানব অনামিকাদি। এমনি কী একটা কথা হল, আমি বলেছিলাম আজ দেরি হলেও আমার ক্ষতি নেই, কালকে আমার ছুটি। সেই থেকেই—

বরুণ রায় নাম করেছে ইদানীং। হিরো হিসাবে একখানা ছবি হিট হয়েছে। আগেও কয়েকটা মুভিতে ছিল, কিন্তু সেকেন্ড লিড। স্বপ্ন দেখার দিন ছবিটা হিট করার পর এখন আর সেকেন্ড লিড নিচ্ছে না। অনামিকার সঙ্গে এই ছবিতেও ওই হিরো। যদিও অনামিকার বেশ আগে থেকে ইন্ডাস্ট্রিতে আছে, হিরো হিসাবে অনামিকার জুনিয়র। এই হিসাবগুলো খুব চলে। যদিও সেটা নিয়ে অনামিকার কিছু নয়। বরুণের হয়তো ওকে নিয়ে একটু দুর্বলতা থাকতে পারে। সেটা অনামিকা বোঝে না এত বাচ্চা নয়। কিন্তু তার মনে সেরকম কোনও ভাবনা জাগেনি এখনও। লোকটা বেশ ভালো, স্মার্ট। কথাবার্তায় পালিশ আছে, সিনেমায় আসার আগে নাটকের দুনিয়ায় ছিল বেশ কিছুদিন। শুটিঙের ফাঁকে আড্ডা মারতে খারাপ কিছু লাগে না।

সুজনকে গাড়ি আনতে খবর পাঠিয়ে ব্যাগ নিয়ে বেরোচ্ছিল, বরুণকে দেখতে পেল। সুদীপার কথাটা মাথায় ঘুরছিল, থমকে দাঁড়াল অনামিকা।

–এই যে বরুণদা, তুমি নাকি আমার খোঁজ করছিলে। কিছু কথা ছিল? গলার স্বর যতটা সম্ভব সমান্তরাল।

হা হা করে হেসে উঠল বরুণ। অ্যাই দেখেছ, এদের না পেটে কোনও কথা থাকে না।

–যাব্বাবা, তুমি আমার মেক আপ আর্টিস্টকে আমার শিডিউল নিয়ে জিজ্ঞেস করবে, সে আমাকে জানাবে না? অনামিকার গলার স্বরে একটু উষ্মা ছড়াল।
–রেগে যাচ্ছ কেন? কোনও বদ উদ্দেশ্য ছিল না। কালকে তোমার জন্মদিন সেই খবরটা পেয়েছি। ভেবেছিলাম একটা সারপ্রাইজ ভিজিট দেব তোমায়।

অবাক হল অনামিকা। এই জন্মদিনটা লেখার। সিনেমার নাম বদলের সঙ্গে সঙ্গে অনামিকার জন্মদিনটাও আলাদা রেখেছে। যেদিন প্রথম ছবির সাইন আপ করে অনামিকা নামে, সেই দিনটা। না হলে তো সেটেই কেক কাটা এইসব শুরু হয়ে যেত আজ। কিন্তু এই দিনটার কথা তো আর কেউ জানে না। বরুণ জানল কী করে?

সেটা জিজ্ঞেস করতে বরুণের মুখে অনাবিল হাসি। সারাদিন শুটিং করেও রাত দুটোর সময় এমন হাসি হাসতে পারাটা কম কথা নয়। ইন্ডাস্ট্রিতে সহজ স্বচ্ছ হাসির বড় অভাব। ভালো লাগতেই রাগটা একটু পড়ে গেল অনামিকার। কিন্তু বরুণ তার তথ্যের সোর্সটা ফাঁস করল না। বলব, বলব। আগে বলো কাল সকালে তুমি ফ্রি আছো না কি, তোমাকে উইশ করতে আসব।

–তার জন্য আর অপেক্ষা কেন করবে? কাল তো আজ হয়ে গেছে, ঘড়িটা দেখেছ তো।
–দেখো অনামিকা, আমি জানি তুমি কাউকে জানাতে চাও না যে কালকে তোমার আসল জন্মদিন। এখানে সবার সামনে কোনও আড়ম্বর করলে জানাজানি হয়ে যেত না?

ওর এই চিন্তাটা ভালো লাগল অনামিকার। থটফুল বরুণদা, অ্যাপ্রিসিয়েট ইট। কিন্তু আমার জন্মদিনে তুমি আড়ম্বরটাই বা কেন করবে? শুধু উইশ করার জন্য আমার বাড়ি চলে আসবে, উঁহু ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। অনামিকার মুখের হাসিটা তখনও ধরা ছিল। কথাটাও বেশ হালকা চালে বলা। না হলে অনামিকার একটু বদনাম আছে পছন্দ না হলে মুখের ওপর ফটফট শুনিয়ে দেওয়ার।

বরুণ উত্তর দিতে একটু সময় নিল। পুরো সময়টা চেয়েছিল অনামিকার মুখের দিকেই। সেটার জবাব না হয় একদিন বসে ভালো করে দেব। আসলে কালকে তোমার সঙ্গে আরও একটা ব্যাপারে কথা বলতে চাইছিলাম।

–তাহলে এখনই বলো না, বেশি সময় লাগবে? কালকে আমার অন্য একটা জায়গায় যাওয়ার থাকবে, পুরো দিন আমি ননকমিউনিকেটেড।

মুখের আলোটা ঝপ করে নিভে গেল বরুণের। একটু মায়া হল না অনামিকার সেটা নয়। কিন্তু এক ধরনের আনন্দও। কালকে যে জন্মদিনটা নিজের বাড়িতে মা বাবা দিদি আর মাসির সঙ্গে লেখা হয়ে কাটাতে চায় সেটা বিস্তার করার কোনও ইচ্ছাও ছিল না।

–তাই? ওকে, তাহলে বসি কোথাও? মিনিট পনেরো কথা বলা যেতে পারে তো? তুমি কি একটা ড্রিঙ্ক নেবে? নিশ্চয় খুব টায়ার্ড।

–না, আজ থাক বরুণদা। আমি ফিরে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে চাই। বললাম না কালকে এক জায়গায় যাওয়ার আছে।

আসলে এখন একবার গ্লাস নিয়ে বসলে কথা অনেকক্ষণ গড়াবে। বরুণের সঙ্গে বসে গেলে গসিপ হওয়াটাও আটকানো যাবে না। না হলে মাথাটা বেশ টিপটিপ করছিল, একটা পেগ হলে মন্দ হত না। কিন্তু সে গাড়িতে উঠেই হতে পারে।

মুখোমুখি বসতে বরুণ কথাটা ভাঙল। দেখো অনামিকা, তুমি তো জানো আমি নাটকের দুনিয়ার লোক। শুরুটা আমার ওখানেই। তারপর সিনেমায় আসার পর বেশ কিছু বছর নাটকের বাইরে চলে যাই।

বরুণ থেমে অনামিকার প্রতিক্রিয়াটা বোঝার চেষ্টা করছিল। কিংবা মনের মধ্যে কথাটা গোছাচ্ছিল। অনামিকা কিন্তু ভালো খারাপ কোনও শব্দই বের করেনি। অপেক্ষা করছিল।

–আমি যখন নাটক করতাম, প্রতিবিম্বতে ছিলাম। ওখানেই আমার হাতে খড়ি, বিমানদার দল। অতি উঁচুমানের পরিচালক। নাম নিশ্চয় শুনেছ। বিমানদা ওদের সঙ্গে একটা নাটক করতে বললেন।
–বা বেশ ভালো তো। করো। আমি বুঝতে পারছি না আমাকে কেন বলছ।
–হ্যাঁ হ্যাঁ সে কথায় আসছি। এই নাটকটা শুধু দুটো চরিত্রের, আমার ইচ্ছা নারী চরিত্রে তুমি থাকো।
–আমি? যদিও ওর কথার ধরনে কিছুটা আন্দাজ করতে শুরু করেছিল, তবুও যখন সত্যি শুনল বিস্ময়টা চাপতে পারল না অনামিকা। আমি কেন? তুমি তো জানো বরুণদা আমার হাতে এখন অনেক কাজ। এই দুদিন আগে একটা নতুন ফিল্মের অফার ফিরিয়ে দিলাম, ডেট দিতে পারছি না। নাটক কীভাবে করব? সময় কোথায়?
–কিছু করতে চাইলে সময় বের করে নেওয়া যায় অনামিকা। বরুণের গলায় একটা নাছোড়বান্দা সুর।
–কথা হল চাইব কেন? দেখো আমি তো তোমার মত নাটকের জগতের কেউ নই। তাহলে কেন ভাবছ নাটকের নাম শুনে আমি লাফিয়ে উঠব?
–সেই জন্যেই তো। দেখো তুমি খুব ভালো অভিনেত্রী। স্টেজে কক্ষনও আসোনি। এলে বুঝতে পারবে মঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শকদের সঙ্গে নাটক যেভাবে কমিউনিকেট করার সুযোগ দেয়, সিনেমাতে তুমি সেটা পাবে না।

এবার হাসল অনামিকা। তাই বুঝি? তাহলে তুমি কেন নাটক ছেড়ে সিনেমায় এসে পড়লে? দেখো তো সিনেমায় এসে গত কয়েক বছর দর্শকদের সঙ্গে তোমার যোগাযোগটা কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

অনামিকার বলার ভঙ্গিতে বিদ্রূপটা চাপা ছিল না। শব্দগুলো কেটে কেটে বসল বরুণের মুখে। একটা ব্যথার মেঘ উড়ে গেল যেন। ঠিক সেই মুহূর্তে অনামিকার মনে হল তার সঙ্গে নাটক করতে চাওয়ার পিছনে উদ্দেশ্যটা দর্শকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাওয়ার থেকে আলাদা। সেটা বুঝেই যেন এই প্রস্তাবটা আরও ঠেলে দিতে ইচ্ছা করল। বরুণদা লোকটা তো খারাপ নয়। দেখতে গেলে ভালোই লাগে অনামিকার। কিন্তু কারও বেশি কাছে যাওয়ার কথা মনে হলেই একটা অদৃশ্য হাত তাকে দূরে ঠেলে দিতে চায়।

ব্যাগটা টেনে নিয়ে উঠে দাঁড়াল অনামিকা। আমার মঞ্চে সেরকম অভিজ্ঞতা নেই বরুণদা, তুমি বরং স্টেজের থেকে কোনও নায়িকা বেছে নাও।

বরুণ তখনও ওঠেনি। একবার ভেবে দেখতে পারতে। অন্তত শুনতে স্ক্রিপ্টটা। খুব ইন্টারেস্টিং একটা সাবজেক্ট।

আচ্ছা করতেই যখন পারব না, তখন শুধু শুধু তোমার সময় বরবাদ করে কী লাভ বলো তো বরুণদা? দ্যাখো তো কত রাত হয়ে গেছে, কথা বলতে বলতে আধ ঘণ্টা লেগে গেল। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল হয়ে যাবে একেবারে।

বরুণ এবার উঠে দাঁড়াল। তোমাকে করতে বলার আর একটা উদ্দেশ্য ছিল।

ওরে বাবা বরুণদা, এক তীরে কতগুলো পাখি মারবে ঠিক করেছিলে? অনামিকা হাসলেও কথাটা যেন বরুণকে বেঁধানোর জন্যেই বিশেষ করে বলা।

শুকনো হাসল বরুণ। ব্যাপারটা হল বিমানদার প্রস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়েছে। জানোই তো, নাটকের লোকেরা অত কিছু টাকা রোজগার করে না। আমি এমনিতে কিছু হেল্প করতে গেলে নিতে চাইবেন না। সাত বছর ওঁর সঙ্গে ছিলাম তো, অভিনয় যা শিখেছি ওনার হাতেই বলতে পারো। কিন্তু জানি, এইসব ব্যাপারে উনি একটু ওল্ড টাইমার। সোজাসুজি আর্থিক সাহায্য নিতে চাইবেন না। তাই ভেবেছিলাম ওর দলের হয়ে একটা নাটক করব। তুমি আর আমি করলে কাটতি ভালো হবে, বেশ কিছু টাকা উঠিয়ে দিতে পারব বিমানদাকে।

থমকে গেছিল অনামিকা। এইভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে দেখলে ভালো লাগে। শুধু নিজেরটা ভাবে না লোকটা। নিজে এখন নাম কামিয়েছে, পুরনোকে ভুলে যায়নি। একটু দোনামনায় পড়ে গেল অনামিকা। আসলে আমার সময় কি হবে বলো? তোমার উদ্দেশ্যটা ভালো, সিনেমার স্টার দেখিয়ে ওনার জন্য টাকা তুলতে চাইছ সেটাও বুঝলাম। তুমি আর কোনও হিরোইনকে বলছ না কেন?

–সবাই স্টেজে পারে না অনামিকা। একটা চরিত্রের মধ্যে ঢুকে যাওয়া, একদম ভিতর থেকে। এ তো শুধু একটা শট নয়, পুরো দু ঘণ্টা ধরে তার মধ্যেই বেঁচে থাকা অত সোজাও নয়।
–আমি পারব কী করে বুঝলে? আমিও তো এক একটা শট দেওয়া হিরোইন। অনামিকার কথা এবং হাসি দুটোতেই গরম তাওয়ায় জল পড়ার মত ছ্যাঁকছ্যাঁকে আওয়াজ।

কপালে ভাঁজ পড়ল বরুণের। ক্রমে মিলিয়ে গিয়ে হাসিতে বদলাল। হাসলে বরুণের চোখের কোণায় ভাঁজ পড়ে। ওকে খুব হ্যান্ডসাম দেখায় তখন। কিন্তু উত্তরটা তোমার পছন্দ নাও হতে পারে।

–অনেক কিছুই তো বললে, আমার সেরকম পছন্দ হয়নি। তাই এটাও শুনে নেই।
–আমার কেমন যেন মনে হয়, তুমি সব সময় একটা চরিত্রের মধ্যে ঢুকে আছ, যেটা তুমি নও। অভিনয় করছ অনামিকার রোলে। এতটা সময় মুক্তমঞ্চে যদি এত সুন্দর অভিনয় করতে পারো, তাহলে স্টেজ তোমার কাছে কী?

উত্তরটায় এত অবাক হয়ে গেল অনামিকা যে কিছুক্ষণের জন্য কথা হারিয়ে গেল মুখ থেকে। এই লোকটা তাকে এত গভীরভাবে লক্ষ করেছে? সে কি সত্যিই অভিনয় করে যাচ্ছে, বাঁচছে না যেভাবে নিজের সত্তায় বাঁচা যায়? একসঙ্গে একঝাঁক প্রশ্ন বিনবিন করে উঠল মাথায়। তার মধ্যে চটজলদি জবাব আসে নাকি? এলেও অনামিকার প্রকাশটা এল রুক্ষভাবে। তার মানে সোজা কথায় বলতে গেলে, আমার মুখে আর মনে আলাদা কথা। বিশ্বাসযোগ্য নই আমি মানুষটা।

–উঁহু, আমি একেবারে সেটা বলিনি। নাটকের লোকেদের বিশ্বাসযোগ্যতায় তাহলে সন্দেহ করতে হয়। গলার স্বরটা এবার খুব নরম হয়ে গেল বরুণের। শব্দগুলো ঠিক যেন ভেলভেটের মতন স্পর্শ দিতে চাইছে। আমার এক অভিনেত্রী বন্ধু তার স্বামীর মৃতদেহ শ্মশানে রেখে স্টেজে শো করতে নেমেছিল একবার। নিজের দুঃখটাকে আড়াল করে রাখার ক্ষমতাও নাটকের জন্য একটা দক্ষতা।

কোনও কোনও লোক অনেকসময় এমনভাবে মন ছুঁয়ে দেয়, কথারা স্তব্ধ হয়ে যেতে চায়। তবু অনামিকা নিজেকে একটু গুছিয়ে তুলে বলল, আমাকে একটু সময় দেবে বরুণদা। একটু ভাবি?

–ব্যস, এইটাই আমার বড় পাওনা হয়ে থাক আজ। এবার হাসি ছড়িয়ে পড়ল বরুণের সারা মুখে। তোমাকে আর আটকাব না, অনেক দেরি হয়ে গেছে।

সারা রাস্তাটা বরুণদার কথাটা ঘুরেছে মাথায়। গাড়িতে উঠে ভেবেছিল একটা ড্রিঙ্ক নিয়েই চোখ বুঁজে ঘুমাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু ভাবনাগুলো ছটফট করছিল মাথার মধ্যে। বাড়িতে এসেও পিছু ছাড়েনি। সেই ভাবনায় বরুণ যেমন আসছিল, তেমনি নিজের জীবনের সত্যি মিথ্যার টানাপোড়েন আসছিল বারবার। মা, বাবা, দিদির কথা। তাও ভালো, এখন ওদেরকে কলকাতায় নিয়ে এসে রাখতে পেরেছে। তার চেয়েও আনন্দের, রেখার জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম বানাতে পেরেছে। বাইরে বের করতে পেরেছে দিদিকে আবার। পুরো দশ বছর বাদে। চিন্তাগুলো এরপরে একটু আনন্দের দিকে চলে গেল। কালকে দিদির জন্য একটা নতুন আয়না কিনেছে সেটা নিয়ে যাবে, বসাতে হবে দিদির ঘরে। এইসব ভাবনাগুলো মাথায় নিয়ে ঘুমাল বলেই হয়তো রাত্রে ঘুমের মধ্যে আবার ফিরে গেল সেই দুর্গাপুরের বাড়িতে। সে আর দিদি। লেখা আর রেখা। ছুটতে ছুটতে বাইরে থেকে এসে বাড়িতে ঢূকছে। স্বপ্নে তারা তখনও ছোট। কিন্তু লেখা অত ছোটও নয়। ঘুমের মধ্যে মাথার এই ছবিতে লেখা যেন প্রায় তার নয় বছরের বড় দিদির সমবয়সী হয়ে গেছে। দুজনে ফ্রক পড়ে উঠোন থেকে কিতকিত খেলা ছেড়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকছে। ঢুকতেই দেখে সারা ঘর জুড়ে প্রতিটা দেওয়ালে আয়না। শুধু অদ্ভুত এক এক দেওয়ালের আয়নায় তাদের প্রতিবিম্ব একেকরকমের। এ যেন তাদের নানান বয়সের ছবি। একটা আয়নার দিকে তাকিয়ে রেখা বীভৎস চিৎকার করে উঠতেই অনামিকার ঘুম ভেঙে গেল।

টেলিফোনটা বাজছিল। কটা বাজে কে জানে। ঘুমাতে এত দেরি হয়েছে, মা হয়তো ফোনে তাড়া লাগাচ্ছে। ব্যস্ত হাতে ফোন তুলতেই অন্যপ্রান্তে গুণদীপ।

–গুড মর্নিং, লেখা। হ্যাপি বার্থডে।

ইন্ডাস্ট্রিতে আরেকজনই জানে তার জন্মদিনের কথা। গুণদীপ। তবে কি ওই বলেছে বরুণকে? কিন্তু এখন সেই কথা তুলে জন্মদিনের সকালটা আচ্ছন্ন করতে চাইল না অনামিকা।

–থ্যাঙ্ক ইউ গুণদীপ। তোমার মনেও থাকে। আধশোয়া ভঙ্গিতে বসতে বসতে বলল।
–স্মৃতি নিয়েই তো বেঁচে থাকে মানুষ।

হেসে গড়িয়ে পড়ল অনামিকা। মনের মধ্যে লেখাটা টিকটিক করে উঠল, তুমি কি সত্যিই এখন হাসতে চেয়েছিলে নাকি শুধুই গুণদীপকে আঘাত দেওয়ার জন্য হাসলে? এইসব ভাবনাগুলোকে আমল দিলে তো চরিত্র থেকে বেরিয়ে যাবে, সেই ভাবনাটা তাকে আবার অনামিকার দিকে ঠেলে দিল। তার জন্য তো তাজমহল বানাতে হবে গুণদীপ। সেটা তো বিধ্বস্ত মানুষেরা করে। তুমি কেন নতুন কিছু করবে না?

গুণদীপ একটুক্ষণ চুপ। তারপর বলল, নতুন কিছু করছি। যাচ্ছি অযোধ্যা পাহাড়ে, একটা নতুন স্টান্ট নিয়ে।

–ও তাই নাকি? গ্রেট! কনগ্র্যাচুলেশানস!
–শুনতে চাইবে না কী স্টান্ট?
–সেটা তো লিমকা বুক অব রেকর্ডসে পেয়ে যাব। আচ্ছা বলতে চাইলে বলো।

হয়তো আঘাত পেল গুণদীপ। ঠিক আছে, সেটাই ভালো। রেকর্ডটা হোক, আমি তোমাকে বইয়ের একটা কপি পাঠিয়ে দেব। ভালো থাকো। জন্মদিন ভালো কাটুক।

গুণদীপ ফোনটা রেখে দেওয়ার পরেও রিসিভার হাতে নিয়ে বসে রইল অনামিকা। একবার শুনে নিলে কী হত তার? শুনলে কি গুণদীপকে বলত, প্লিজ যেও না? অনেকগুলো রেকর্ড তো তোমার আছে, কী দরকার আর একটা নতুন স্টান্টের?

মাথাটা টিপটিপ করছে। কাল বেশি রাতে গাড়িতে আসতে আসতে মদ খাওয়া হয়েছে। এখন একটা পেগ নিতে পারলে হ্যাংওভারটা যেত। কিন্তু মার কাছে সকালবেলায় মুখে গন্ধ নিয়ে যাওয়াটা ভালো লাগবে না, তাও আবার জন্মদিনের সকালে। হয়তো ঝাঁপিয়ে স্নান করলে ধুয়ে যাবে এই গ্লানি।

অনামিকা নিজেকে দিনটার জন্য প্রস্তুত করায় মন দিল।

 

(আবার আগামী সংখ্যায়)


ছায়াপাখি-র সব কটি পর্বের জন্য ক্লিক করুন: ছায়াপাখি — বিশ্বদীপ চক্রবর্তী