Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এ সফর সুফিয়ানা

অরুণপ্রকাশ রায়

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

সপ্তম পর্ব

উত্তরপ্রদেশের কোনও-কোনও প্রত্যন্ত এলাকায়, পরিবারে পুত্রসন্তান জন্মালে ‘বধাইয়া’ বলে একধরনের গান গাওয়া হত একসময়। বধাইয়া আসলে পূরব অঙ্গের লোকসঙ্গীতের একটা ফর্ম। সেসব অবশ্য এখন ইতিহাস— হয়তো পরিবারে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় সেখানে এখন ‘মানিকে মাগে হিথে’ গাওয়া বা বাজানো হয়। সে যাই হোক== তাতে যেহেতু আমাদের কোনও হাত নেই অতএব সে প্রসঙ্গ থাকুক। একটু তলিয়ে ভেবে দেখলে অবশ্য বোঝা যায়, হাত যথেষ্টই আছে— প্রত্যক্ষত না-হলেও, পরোক্ষে তো বটেই। তবু, আপাতত সে প্রসঙ্গ তোলা থাক। বধাইয়ার কথা উঠতে আমার আবার মিশ্রজির কথা মনে পড়ে গেল। আমার লেখায় আগে পণ্ডিত ছন্নুলাল মিশ্রজির উল্লেখ আছে, উনি ‘বধাইয়া’ বড় মিঠেগলায় গাইতেন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ওঁর স্ত্রী ও মেয়েকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছে এই সেদিন, আর তারপর থেকে পণ্ডিতজির সুর অনেকটাই স্তব্ধ হয়ে এসেছে। কিন্তু, কী আশ্চর্য সব গান রেখে গিয়েছেন তিনি আমাদের মতো নাদান মানুষের জন্য… ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। নানা ধরনের গান গেয়েছেন মিশিরজি, কিন্তু আমায় সবচেয়ে বেশি করে টানে ওঁর বধাইয়া। একটু খসখসে একটা ব্যাপার ছিল ওঁর গলায়— পুরনো গ্রামোফোন ডিস্ক-এ যেমন পাওয়া যায়— কিন্তু সেই ব্যাপারটাই ওঁর গানকে একধরনের বৈশিষ্ট্য দিয়েছিল— একটা অপূর্ব ‘গ্রেন’— যাকে আমরা গলার ‘আঁশ’ বলি… আর সেটা একটা ভারী মিঠে ‘রাগেডনেস’ এনে দিত তাঁর গানে। একটা পুরনো রেকর্ডিং-এর কথা মনে পড়ছে… “নন্দ ঘর বাজে বধাইয়া”… বিশ বচ্ছর আগে প্রথমবার সেটা শুনে ‘আহা কী শুনিলাম’ গোছের একটা অনুভূতি হয়েছিল, যেটার থেকে এখনও বেরোতে পারিনি!

দুর্গাপুজো শেষ হতে না-হতেই এবার মিলাদ-উন নবি, হজরত মহম্মদের আবির্ভাব-দিবস। প্রবাসী বন্ধুবান্ধবেরা উইকএন্ডের দুগ্গাপুজো সেরে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজয়া সম্মিলনীর ফোটো আর ভিডিও পোস্ট করতে ব্যস্ত। তেমনই এক ভিডিও-তে দেখলাম, কোনও এক পুজো-প্যান্ডালে আমার অতি শ্রদ্ধেয় এক সেতারবাদকের কনিষ্ঠপুত্র তাঁর অপটু হাতে আড়ি কুয়ারিতে পিটিয়ে বাজিয়ে, সঙ্গে অত্যন্ত ভুল সুরে ও কালামে আমির খুসরোর ‘এ রি সখী মোরে খাজা ঘর আয়ে’ গানটির সাড়ে-সব্বোনাশ করে দিচ্ছেন আর ফেসবুকে সেই লাইভ ভিডিও দেখে অনেকেই রোমাঞ্চিত হচ্ছেন! একজন তো খুব সন্তর্পণে জিজ্ঞাসাই করে বসলেন, ‘এ শিল্পী কি লখনঊ ঘরানার?’ আমি বেঙ্গালুরুতে বসে কেঁপে উঠলাম, শিল্পীর বাবা আজ বেঁচে থাকলে হয়তো শুনে হাহাকার করে উঠতেন! কেউ যদি ভেবে বসেন যে এ আমার ঔদ্ধত্য, বিষণ্ণ হওয়া ছাড়া আর কী করতে পারি! এই শিল্পীর ওয়ালিদ সাহেবের বাজনা শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে বেশ কয়েকবারই। শেষবার ওঁকে শুনেছি শ্রীমতী বিমলা পোদ্দারের কলকাতার গুলাববাড়িতে, বছর কুড়ি-একুশ আগে। বাজাতে বসার আগে হঠাৎ করে ওস্তাদজির আঙুল কেটে যাওয়ায়, মধ্যমায় একটি ব্যান্ড-এইড জড়িয়ে দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল এ নাদানের। আমার থুতনিতে একটা ছোট্ট খাঁজ আছে, সেটা দেখিয়ে হাসিমুখে আমার নাম জানতে চেয়ে বলেছিলেন, “বেটা, কিস ঘরানে কো বিলং করতে হো?” জবাব শুনে একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, “নাহ, তুম তো অরুণ আলি খান হো, উস্তাদ কে জখম আধা মিল দূর সে জান লেতে হো… কাশ তুম মেরে গান্ডাবন্ধ সাগিরদ হোতে!”

সে যাই হোক, ছোটে ওস্তাদের প্রসঙ্গে ফিরি। হজরত আমির খুসরো লিখে গিয়েছেন,

মোরে পিয়া ঘর আয়ে
এ রি সখী মোরে পিয়া ঘর আয়ে
ভাগ লাগে ইস আঙ্গন কো
বল-বল যাউঁ ম্যায় আপনে পিয়া কে
চরণ লাগায়ো নির্ধন কো…

আর ছোটে ওস্তাদটি বাজাতে-বাজাতে গেয়ে চলেছিলেন, “চরণ লাগু ম্যায় নির্ধন কো” (পান ইন্টেনডেড)। এই ‘অর্থমনর্থকারী বিনয়বোধ’ যদি আজকের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে থাকত, তা হলে দেশে সত্যিকারের ‘পরিবর্তন’ এসে যেত। কিন্তু হায়, খুসরো-র কালাম-এর মানে পালটে দেওয়ার গুরুদায়িত্ব যে ওঁকে কে দিয়েছে, সেটাই এ বান্দার বোধগম্য হল না!

ঈদ মিলাদ উপলক্ষে সুফি কাওয়ালরা একটা চমৎকার কালাম গেয়ে থাকেন, ‘বারো ঘি কে দিয়ে না, ভইলে আমনা কে লালনা’… এখানে ‘বারো’ মানে ‘জ্বালো’— অর্থাৎ বলতে চাওয়া হচ্ছে ‘ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে উৎসবে মেতে ওঠো, আমিনার ঘরে ছেলে হয়েছে।’ ঘরে পুত্রসন্তান হয়েছে বলে উৎসবে মেতে উঠতে চাওয়ার প্রসঙ্গ হয়তো আজকের শ্রোতাদের কানে একটু বেসুরো বাজতে পারে— অনেকেই এর মধ্যে পিতৃতন্ত্রের উদ্‌যাপন খুঁজে পেতে পারেন, যদিও এখানে আমি সেই তর্কে যেতে চাইছি না। আমার বলার কথাটা হল এই যে, ‘বধাইয়া’ এবং ‘নাত-এ-রসুল’ (নাত-এ-রসুল হল হজরত মহম্মদের জন্মবৃত্তান্ত-বিষয়ক গান)— এই দুই মিউজিক্যাল ফর্মের মধ্যে এমন অসাধারণ মিল কী করে সম্ভব হল! অননুকরণীয় স্টাইল-এ গাওয়া ফরিদসাবের একটি ক্লিপ শুনলে আমার বক্তব্য হয়তো আপনাদের কাছে কিছুটা বোধগম্য হবে।

ওপরের ক্লিপে ফরিদসাবের পাশে কিঞ্চিৎ আনুনাসিক গলাটি ওঁর ওয়ালিদসাব বাবা মুন্সি রাজিউদ্দিনের। দারুণ সব ঘটনার মুখ্য চরিত্র ছিলেন মুন্সিজি! একবার মদিনা গিয়েছেন তীর্থ করতে, মহম্মদের সমাধিস্থলে সবুজ গম্বুজের নীচে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে প্রার্থনা করছেন, হঠাৎ ওঁর মনে হল, যেন কে একজন কনুই দিয়ে গুঁতো মারছে সমানে। চোখ খুলে দেখলেন, এক গুজরাটি বৃদ্ধ তাঁকে যেন কী একটা বলছেন। একটু কান খাড়া করে শুনে বুঝলেন, বৃদ্ধ সমানে বলে চলেছেন, তাঁর আরবি ভাষায় একেবারেই নাকি ব্যুৎপত্তি নেই, তাই মুন্সিজি যদি বৃদ্ধের বকলমে প্রার্থনাটা একটু করে দেন, বড়ই উপকার হয়। মুন্সিজি তাঁর পানখাওয়া দাঁতে একগাল হেসে বৃদ্ধকে বললেন, “আরে ইয়ে কিসনে বাতায়া কে রসুল-আল্লাহ কো সির্ফ আরবি হি আতি হ্যায়, উনহে তো সির্ফ গুজরাতি হি আতি হ্যায়।” এ কথা শুনে বৃদ্ধ তো অবাক! এবং হয়তো বা আচমকাই বেশ খানিকটা কনফিডেন্সো পেয়ে গেলেন। বুক ফুলিয়ে বললেন, “এইসা হ্যায় ক্যা?” বলে বীরদর্পে গুজরাটিতে ঝড়ের গতিতে প্রার্থনা শুরু করে দিলেন চক্ষু মুদে। মুন্সিজি টুক করে বৃদ্ধের কাঁধে মাথা রেখে হাত জোড় করে বললেন, “য়া রসুল-আল্লাহ, ইনকি ফরিয়াদ সুন্ লে, সাথ মে মেরা ভি সুন্ লেনা।” চমৎকার এক ‘বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি’ গোছের অফার… খোদ ফরিদসাবের মুখে শুনেছি। পরবর্তীকালে এই ঘটনাটি ফরিদসাব ইসলামাবাদের একটি মেহফিলে বেশ রসিয়ে বলেছিলেন, শুমাইল জাঈদি নামে একটি মেয়ে ফোন-এ সে গল্প রেকর্ড করে সাউন্ডক্লাউড-এ আপলোড করে দিয়েছিলো প্রচুর বাহ বাহ কোলাহল সমেত। সে এক দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা…

মুন্সিজির পরে, এবার নুসরত ফতেহ আলি খানের একটা গল্প বলি। ব্যাপারটা হয়েছিল এরকম… তিনি ছেলেবেলায় একবার মাঝরাত্তিরে একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন যে, এক অপরিচিত দরগাহতে বসে তিনি কাওয়ালি গাইছেন আর ওঁর বাবা ফতেহ আলি খানসাব পাশে বসে পরের পর ফরমায়েশ করে চলেছেন। ঘুম ভেঙে নুসরত এই স্বপ্নের কথা বাড়ির সবাইকে বলেন, এবং বাড়ির লোকেদের মুখে মুখে সে গল্প পাড়ার সবাই জেনে যান। তাঁরা স্বপ্নের কাহিনি শুনে রায় দিলেন, এ নির্ঘাত আজমেঢ় শরিফের খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি-র দরগাহ। এর বহু বছর পরে নুসরত যখন আজমেঢ় শরিফ যান, তিনি দেখেন, আরে, এই তো সেই তাঁর ছেলেবেলায় স্বপ্নে দেখা দরগাহ! বিস্মিত, মন্ত্রমুগ্ধ নুসরত দরগাহর চাতালে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা গান গেয়েছিলেন সেদিন, আর আশপাশের সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছিল সেই ঐশ্বরিক সঙ্গীত। ‘এ রি সখী’-র একটা চমৎকার নুসরতীয় ভার্সন আছে, শুনলে আপনারাও সেই ঐশ্বরিক অভিজ্ঞতার খানিক অংশীদার হতে পারবেন…

এবার আমার গল্পটা বলি। গোস্তাকি মাফ করবেন, এ গল্পের সঙ্গে নুসরতজির গল্পের মিল প্রচুর! ২০১০ সালের জুন মাসে একদিন আমি ঠিক এইরকম একটা স্বপ্ন দেখে মাঝরাত্তিরে উঠে বসেছিলাম! আমার স্ত্রী সে সময় বাপের বাড়ি গিয়েছিল, কানপুরে। সকাল হলে আমি ওকে ফোনে জানাই, কাল রাত্তিরে আমি ঘুমের ঘোরে তেড়ে কাওয়ালি গেয়েছি ঘন্টাখানেক, একটি সুফি দরগাহতে বসে, কিন্তু সে দরগাহ যে কোথায়, ঠিক চিনতে পারলাম না। সে আগে আজমেঢ় গিয়েছে, বর্ণনা শুনে বলল, এ নির্ঘাত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি-র দরগাহ। অতঃপর আমি ঝোলা নিয়ে বেরিয়ে পড়ি আজমেঢ়ের উদ্দেশে। সেই প্রথমবার। কোথায় থাকব, কোথায় খাব কিছুই জানি না, দরগাহর দুয়ারে দাঁড়িয়ে গুনগুন করছিলাম, “মঈনুদ্দিন, কিরপা করো মহারাজ, তুমহারি দয়া কি ম্যায় সুনকে খবরিয়া, আন পঢ়ি আজমেঢ় নগরিয়া, সীস ঝুকাউঁ চুমুঁ দেহলিয়ান, জাহাঁ করো তুম রাজ।” এক খাদিমের আমায় দেখে কী মনে হল, এসে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন, মাথা ঢেকে দিলেন একটি গেরুয়া চাদরে, চাদরের অপর প্রান্ত ঢেকে রয়েছে খাজাসাহেবের সমাধি, বুঁদ হয়ে গেয়ে চলেছি একই কালাম, বারবার। কানে ভেসে এল যেন বহুদূর থেকে “বাগিরদাব এ বলা উফতাদা কাস্তি, জাইফানো সিকাস্তারা তু পুস্তি, বাহককে খাজা উসমান এ হারুনি, মদদ কুন্ য়া মঈনুদ্দিন চিশতি।”

তার পরের ঘটনাটি আরও চিত্তাকর্ষক। ২০১২ সালে এক বন্ধুর সঙ্গে আমি সপরিবার আজমেঢ় গিয়েছি। ঘটনাক্রমে আমার ফার্সি প্রার্থনামন্ত্রটি মুখস্থ ছিল (একটু আগেই যেটির উল্লেখ করেছি)। দরগাহের গর্ভগৃহে ঢুকে মন্ত্রোচ্চারণ করে বেরোতে যাব, দেখি সামনের চত্বরে এক দল কাওয়াল ‘কিরপা করো মহারাজ’ গাইছে, ঢোলক ও তালিসমেত। গুটিগুটি তাদের পেছনের দিকটাতে গিয়ে বসে পড়ে কোরাসে গলা মেলাচ্ছিলাম, খানিক পরে দেখি আমিই মুখ্য কাওয়াল, বাকিরা ধুয়ো ধরছে অথবা হাততালি দিয়ে লয় রাখছে। আমার দুচোখ ভেসে যাচ্ছে জলে, আর কুর্তার আঁজলা উপচে পড়ছে দশ, বিশ, মায় একশো টাকার নোটে। পরে সব নোট একজায়গায় জড়ো করে, দলটিকে দিয়ে এসেছিলাম। পরিবারের যিনি সবচেয়ে বড়, তিনি হাত ধরে বলেছিলেন, “বাবা, এইসে হি আপ আয়া করিয়েগা, বহত মেহেরবানী।” সে কথা শুনে আমি তো কোনওক্রমে পালিয়ে এলাম, ভারী অপ্রস্তুত হয়ে।

পরে যখন দরগার গদ্দিনশিন সায়েদ সলমন চিশতি-র নিকাহে গিয়েছিলাম, আলাপ হয়েছিল প্রখ্যাত সুফি দার্শনিক কাম কবি কাম ফ্যাশন ডিজইনার কাম ফোটোগ্রাফার ইউসুফ বশির কুরেশির সঙ্গে। সে গল্প অন্যদিন বলা যাবে’খন। আজ কেবল এইটুকু বলি, সকালে হোয়াটস্যাপ কল-এ জানতে চেয়েছিলাম যে উনি দীর্ঘদিন পরে চুল ছাঁটিয়েছেন কিনা, হো হো করে হেসে উঠে বললেন, “জুড়া বনা লিয়া হ্যায়”, বলে মাথার পেছনের এলো খোঁপা দেখিয়ে বললেন, “অব পুরা সর্দার লাগ রাহা হুঁ।”

ইউসুফসাবকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা জানেন, কী ভয়ঙ্কর সংক্রামক তাঁর হাসি। কোভিডের সবচেয়ে খতরনাক ভ্যারিয়েন্টও ওই হাসির কাছে যে কোনওদিন দশ গোলে হারবে। নেব্রাস্কার লিঙ্কন শহরের একটি ভুতুড়ে আইরিশ পাব-এর বেসমেন্টে একবার একখান বুটিক (নাম রেখেছিলেন ‘সিল্ক ক্যাফে’) খুলে জবরদস্ত ব্যবসা জমিয়ে বসেছিলেন ইউসুফসাব। তারপর হঠাৎ একদিন কী মনে হল, সেই ফ্যায়লা হুয়া ব্যবসা পত্রপাঠ ফেলে রেখে দেশে ফিরে এসে আর্টিস্টস কমিউন গড়ে তুললেন করাচিতে, এক পরিত্যক্ত তামাকের গুদামে। অসম্ভব সুবক্তা এই ভদ্রলোকের ফার্মহাউস-এ গোটাকতক বুনো ঘোড়া এবং একটি ‘পোষা’ উটপাখি আছে। নারায়ণ দেবনাথের ‘বাঁটুল দ্য গ্রেট’ ছাড়া আর কারও কাছে পোষা উটপাখি থাকতে পারে, এমন কথা, বিশ্বাস করুন, আমি কখনও স্বপ্নেও ভাবিনি! আমার নেমন্তন্ন আছে সেই ফার্মহাউসে-এ গত আট বছর যাবৎ। যাব নিশ্চয়ই, সময় ও সুযোগ পেলে।

আর একটি ঘটনা বড় মন ছুঁয়ে গেল, জানতাম না যে করাচিতে আজও দুর্গাপুজো হয় মহা ধুমধামে, হিন্দু মহল্লায়, আর আমার বন্ধু তথা ভরতনাট্যম শিল্পী, করাচির বাসিন্দা সীমা কিরমানি গত সপ্তাহে সেই পুজোয় তুমুল ধুনুচি নাচ নেচে এসেছে। ইউসুফসাব নিজেই জানালেন এই সুসংবাদটি। মনটা খুশিতে ভরে উঠল। আর সেই সঙ্গে, চোখের কোণটা একটু চিকচিকও করে উঠল, কেন, তা না হয় আর না-ই বা বললাম।

যাক সে কথা!। কুরেশিসাবকে নিয়ে অসংখ্য গল্প আছে, সেসব পরে কখনও আপনাদের নিশ্চয়ই শোনাব। কিন্তু তার আগে আপাতত শোনাই ফয়সলাবাদের আর একটি পরিবারের কথা। এঁরা পঞ্জাবি সুফিয়ান কালামের একেবারে শেষ কথা। জামির হাসান বেহারানওয়ালের সঙ্গে আমার আলাপ ফেসবুক-এ। একটা নাত শুনে তৎক্ষণাৎ মেসেঞ্জার-এ কল করে আরও গান শুনতে চাওয়াতে ভদ্রলোক ঘাবড়ে গিয়ে বলেছিলেন, “আমার তবলচি বাজারে গেছে, সে ফিরুক, আমি আপনাকে অডিও ক্লিপ বানিয়ে ঠিক পাঠিয়ে দেব।” আমি বারতিনেক তাগাদা দিয়ে একখানি মারাত্মক রেকর্ডিং হাসিল করেছি, শুনে দেখবেন কী জিনিস! অতি সুরেলা গলা এবং অসম্ভব ভালো বোঝাপড়া ওঁদের দলের প্রতিটি সদস্যের মধ্যে। জামিরভাই আর আমি যথারীতি মিউজিক্যাল আড্ডা শুরু করে দিয়েছি, ওঁর পঞ্জাবি সুফি কালামের ভাণ্ডারও অশেষ, তাই “কাল্টিভেট না-করে আর থাকতে পারলাম না…”

সারাদিন পৃথিবী পরিক্রমা করে সন্ধেয় যেমন সব পাখি ঘরে ফেরে, তেমনই শেষ করার আগে আমিও আবার ফিরি ফরিদসাবের গানে। বুল্লে শা তাঁর পির ও মুর্শেদ ইনায়েত শা-র উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “তুসি উঁচে, তুহাডি জাত উঁচি, তুসি উঁচ শরীফ দে রাহনেওয়ালে; আসি কসুরি, আসা দি জাত কসুরি, আসি শহর কসুর দে রাহনেওয়ালে…” ফরিদসাবের গলায় সে গান আপনাদের না-শোনালে আজকের দিনটা শেষ হবে না…

 

[ক্রমশ]


এ সফর সুফিয়ানা-র সব কটি পর্বের জন্য ক্লিক করুন: এ সফর সুফিয়ানা — অরুণপ্রকাশ রায়