এ সফর সুফিয়ানা

অরুণপ্রকাশ রায়

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ষষ্ঠ পর্ব

শাম হুয়ি হ্যায় ইয়ার আয়ে হ্যায় ইয়ারোঁ কে হামরাহ চলে,
আজ ওয়াহা কাওয়ালি হোগি ‘জোন’ চলো দরগাহ চলে।
আপনি গালিয়াঁ আপনে রামনে আপনে জঙ্গল আপনি হাওয়া,
চলতে চলতে ওয়াজেদ মে আয়ে রাহ মে বেরাহ চলে।

বছরদেড়েক আগে নিজামুদ্দিনের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ানো আর জোন এলিয়া-র কবিতায় আজ আর কোনও তফাত নেই।

বন্ধুরা সব সন্ধেবেলা সমস্বরেই বলি,
দরগাহ শরীফ প্রাঙ্গনে আজ আছে যে কাওয়ালি।
সবাই নিজের, পথঘাট সব, আপন ঘুঁজি-গলি
পথ হারিয়ে, বেভুল হয়ে, ভুল রাস্তায় চলি।

জ্বর বাড়ছিল, মাথাটাও বিচ্ছিরিভাবে ধরেছিল, আচ্ছন্নের মতো পড়েছিলাম বিছানায়, ঘড়িতে যে ঠিক কটা বাজে— সন্ধে না রাত— কোনও ঠিকঠিকানা ছিল না। কানের কাছে বিড়বিড় করে কে যেন এই কবিতার পংক্তিগুলো চোস্ত উর্দুতে আবৃত্তি করছিল। কে? সুমন মিশ্র? না, ওরও তো করোনা হয়েছে, আমার মতোই। তবে কি ফরিদসাব? নাহ্‌, ওঁর তো যদ্দূর জানি জোন এলিয়া ভাল লাগে না। তবে কে? ঠিক শুনেছি কি? দূর থেকে ভেসে আসছে বেগম আখতারের গাওয়া একটি সুফিয়ানা কালাম। কার লেখা যেন? বেদম? বোধহয়। না না, টুকরো টুকরো কালাম কানে আসছে— “এ হিন্দ কে ওয়ালী এ খাজা, আজমের কে দাতা জগ কে ধনী, সুলতানুলহিন্দ গরিবনওয়াজ, হাম পর ভি তো কর দো কুছ কিরপা।”

এ তো বেহ্জাদ লখনৌভি-র লেখা, “দিওয়ানা বনানা হ্যায় তো দিওয়ানা বনা দে”-খ্যাত কবি, কুমারবাবুর লেখায় পড়া বেগমসাহিবার সত্যি সত্যি দিওয়ানা। তিনি আবার কবে লিখলেন এরকম অপূর্ব সুফি কালাম? লখনউয়ের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো বেগমের প্রেমে অর্ধোন্মাদ সেই কবি, তিনি কি পরের দিকে আধ্যাত্মিক কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন? কী কাণ্ড! পরেরবার লখনউ গেলে একবার সলিম কিডবাইসাবকে জিজ্ঞাসা করতে হবে। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সালিমসাবের আখতারি বাইয়ের ওপর রিসার্চ ও বিষয়ে মোটামুটি শেষকথা।

49:30 মিনিট থেকে শুনতে থাকুন। জ্বর সারার ঠিক পরদিন, তিন হপ্তা পরে সেলফ আইসোলেশন থেকে বেরিয়ে লিঙ্ক খুঁজে দিয়ে দিলাম, এ জিনিস শুনলে আমি হলফ করে বলতে পারি, এথনোমিউজিকোলজিস্টরা তর্ক থামিয়ে চুপটি করে কিছুক্ষণ বসে থাকবেন।

গোয়ালিয়র ঘরানার উস্তাদ আব্দুল রশিদ খানের গলায় রামকেলিতে একবার ‘সুলতান নিজামুদ্দিন চিশতী’ শুনেছিলাম। উনি কলকাতার সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে রেসিডেন্ট গুরু ছিলেন, ২০১৬-য় মারা যান, ১০৭ বছর বয়সে। ‘রসন পিয়া’ নামে কিছু সুফি বন্দিশ লিখেছিলেন, আমার খুব একটা সুবিধের লাগেনি, “জয় জয় নিজামুদ্দিন, খুসরো কে প্রভু, আহমদ কে পুত, তনমন ধন করো নিবারণ, জগতারণ” শুনে আমার কান অভ্যস্ত নয়। যদিও উনি অতি বিশিষ্ট ও প্রণম্য শিল্পী, মিয়া তানসেনের বংশধর। শুনে দেখতে পারেন, ভাল লাগলেও লাগতে পারে। ইচ্ছে করে একটু অন্যরকম গান শোনালাম, যাতে পরবর্তীকালে তুলনা করতে সুবিধে হয়।

গোয়ালিয়রে আমার একটা দুর্লভ অভিজ্ঞতা হয়েছিল বছর বারো আগে। আমার এক মামাশ্বশুর কর্মসূত্রে ওখানে পোস্টেড ছিলেন, আমি সপরিবার সপ্তাহান্তের ছুটি কাটাতে গেছিলাম। নিতাই ঘোষ অতি সজ্জন মানুষ, জামাই আদরের কোনও ত্রুটি তো রাখেনইনি, উপরন্তু চিড়িয়াখানা ঘোরানো থেকে গোয়ালিয়র দুর্গের আলো-আঁধারি মিউজিকাল, কাবাব-পরাঠা-বিরিয়ানি-কোর্মার বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন তিন দিনে। ফেরার আগের দিন আমি একটু তানসেনের সমাধিটা আর হজরত মহম্মদ ঘাউস গোয়ালিওরি-র দরগাহ্‌ দেখতে চেয়েছিলাম, তা উনি মুখের কথা খসানোর আগেই নিজের ডিজায়ার চালিয়ে আমাকে সেখানে নিয়ে যান।

‘বাহার-আল-হায়াৎ (মোটামুটি ইংরেজি অনুবাদ করলে ওশান অফ লাইফ হবে)-এর রচয়িতা ঘাউস সাড়ে চারশো বছর আগে সুফিবাদ ও যোগশাস্ত্রের যোগাযোগ নিয়ে লেখালেখি করতেন। এই সুফি সন্তের দরগায় অর্বাচীন আমি চটি খুলে সটান ঢুকে পড়ে হাঁটু গেড়ে কদমবোসি করে খালি গলায় মিয়া মৌজের রচনা “মোসে বোলো না বোল, মেরি সুন্ ইয়া না সুন্, ম্যায় তো তোহে না ছাডুঙ্গি এ সাবরে” শোনাচ্ছিলাম মহম্মদ ঘাউসকে, সরাসরি। চোখ বন্ধ ছিল, একজন খাদিম পরমানন্দে হাততালি দিয়ে ওঠাতে আমার মৌতাত ভেঙে যায়। দরগাহ্‌ থেকে একটু দূরেই ছিল মিয়াঁ তানসেনের মকবরা, পাশে একটা বেড় কা পেড়, যাকে সায়েবরা জিউজুব ট্রি বলে। তা কথিত আছে যে, সেই গাছটির পাতা যদি কেউ কপালগুণে একবার খেয়ে ফেলে, তা হলে আর কোনও কথা হবে না, সে যে বা যতই বেসুরো হোক না কেন, রাতারাতি নাকি গলা সুরে ঋদ্ধ হয়ে উঠবে। নিন্দুকে গাছটিকে তেঁতুলগাছ বলে অভিহিত করে থাকেন। এবারে আমি যেই না তানসেনের সমাধি থেকে বেরিয়েছি গুনগুন করতে করতে, আমার মামাতো শ্যালক আশিস ঘোষমশাই আমার গিন্নিকে অত্যন্ত গম্ভীরভাবে বললেন, “দেখেছ মিনিদিদি, তানসেনের গাছের পাতার গুণ? অরুণদা যেই না চিবিয়েছে অমনি দেখেছ গলায় কেমন সুর খেলছে?”

ইতিমধ্যে আর একটা ঘটনা ঘটেছে। জেফরি লায়ন্স, ওরফে তাহির কাওয়াল একদিন হঠাৎ করে ফোন করেছিল তার ‘দ্য কাওয়ালি প্রজেক্ট’ কেমন লেগেছে শুনে জানানোর জন্য। আমি এই কানাডিয়ান কাওয়ালটিকে যে খুব বেশি শুনেছি তা নয় কিন্তু এর কাজে একটা নতুনত্ব আছে। জেসিকা রিপার বা বার্বি সামা (তাহিরের প্রাক্তন স্ত্রী) বা আলেকজান্দ্রা ‘আমি’ পার্বতী (বর্তমান স্ত্রী) যখন তবলা বা ভোকাল-এ তাহিরের সঙ্গে সঙ্গত করে, কাওয়ালি একটা নতুন মাত্রা পায়।

মন কুনতো মৌলা-র দুটো উদাহরণ দিলাম নীচে, একটা তাহিরের গানের দল ‘ফনা-ফি-আল্লাহ’ থেকে ও দ্বিতীয়টি ‘ইলাহি সুফি কাওয়ালি’ যেটি ওর দলের সব মহিলারা মিলে গেয়েছেন। সঙ্গে ফাউ হিসেবে আবি শম্পা-র গাওয়া একটি ভার্সনও রাখলাম, আমার ভারী ভালো লেগেছে উপস্থাপনাটি।

তাহির তার বন্ধুমহলে বেশ বিখ্যাত। বালি-তে ওর একটা আখড়া আছে যেখানে প্রচুর সঙ্গীতানুষ্ঠান এবং আলোচনাসভা চলতে থাকে। এমনকী এই প্রবল করোনাঋতুতেও, যখনই ভাইরাসের উপদ্রব একটু কমেছে, ওরা আসর বসিয়েছে। ওর প্রাক্তন স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদও ওরা দুজনে বেশ ধুমধাম করে সেলিব্রেট করেছিল। ‘আনকাপলিং সেরেমনি’-র উল্লেখ আমি ওর কাছেই প্রথম শুনি, একটা ছোট মালাবদল বা মালাফেরত গোছের কিছু একটা করে অগুনতি বন্ধুবান্ধবের উপস্থিতিতে ও সোশ্যাল মিডিয়া প্লাবিত করে ভেসে আসা অভিনন্দনের বন্যায় অনুষ্ঠানটি সুসম্পন্ন হয়!

তাহির হিমালয়ে সাধুসঙ্গ ও যোগসাধনা করেছে, রিপোর্টেডলি। তারপর নুসরত ফতেহ আলি খানের ভাইপো রাহত এবং পরবর্তীকালে আরেক ভাইপো মুয়াজ্জামের কাছে তালিম নিয়েছে। সারা পৃথিবীর সুফি দরগায় দরগায় ঘুরে ঘুরে অজস্র কালাম সংগ্রহ করেছে ও বিচিত্র উচ্চারণে গেয়েও থাকে।

কথা হচ্ছিল তাহিরের সঙ্গে, কী করে জানি ও আমার কথা জেনেছে নুসরত ফতেহ আলির ভাইপো আর অন্যতম উস্তাদ মুয়াজ্জামের কাছে। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে আমাকে নানা দেশের বহু কাওয়াল গানের ক্লিপ পাঠিয়ে থাকেন ফিডব্যাক-এর জন্য, রিজওয়ান-মুয়াজ্জামও তার ব্যতিক্রম নয়, আমি তাহিরের ‘মিউজিক অফ দ্য মিস্টিক্‌স‘ শুনেছি— অসাধারণ রিসার্চ, লিঙ্ক দিলাম, তৃতীয় গান খুসরো-র ‘নামি দানাম চে মনজিল’ না-শুনলে মিস করবেন, ফতেহ আলি-মুবারক আলি খানের গাওয়া এই ২৫ মিনিটের রেকর্ডিংটি দুর্লভ। যদি আরও অনেক শুনতে চান তা হলে ঊনত্রিশ ডলার খরচ করে অগুনতি কাওয়ালির মালিকানা পেয়ে যেতে পারেন। প্রবাসী শ্রোতারা যদি ডলারে কিনতে চান তা হলে খরচটা খুব একটা গায়ে লাগবে না, কারণ আজও আমরা ভাবব দু’হাজার টাকায় তো এখানে কোনও একটা প্লাটফর্মের দু’বছরের সভ্যপদ পেয়ে যাওয়া যায়। তাই ডিসিশনটা আপনাদের ওপর ছেড়ে দিলাম। তাহিরের রিসার্চ আমার যতটা ভালো লেগেছে গান যে ততটা ভালো লেগেছে তা কিন্তু নয়, তবে মহাশয়কে কাল্টিভেট করে জানতে পেরেছি যে, তিনি পনেরো বছর বয়েসে একটি শ্রুতি বাক্স বগলদাবা করে সুরের সন্ধানে গাহড়বালের পাহাড়ে গুহায় গুহায় ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং গোটাকয় উস্তাদ পাল্টে কাওয়ালি সংক্রান্ত বহু তথ্য আহরণ করেছেন। কিন্তু এতদ্‌সত্ত্বেও আমি ওর প্রজেক্টে ইনভেস্ট করে উঠতে পারিনি সাহস করে।

ঘুরে ফিরে চলে আসি ফরিদসাবের কথায়। গত রোববার হোয়াটস্যাপ কল-এ আড্ডা চলছিল, এ কথা সে কথার পর আমি জানতে চাইলাম যে, আজকাল কাওয়ালরা গাইতে বসে বড় শর্টকাটে সারছে, সে মজা আর পাচ্ছি না যেন সুফি কাওয়ালি শুনে। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল দুষ্টু হাসি, সেই সঙ্গে হায়দরাবাদ ডেকানের সুফি কবি কামিল সাত্তারির অননুকরণীয় কালাম “মেরে বনে কি বাত না পুছো, মেরে বনা হরিয়ালা হ্যায়”। আমিও মুখে এন-নাইন্টিফাইভ মাস্ক আর গাড়িতে সিটবেল্ট বাঁধা অবস্থাতেই গলা মেলালাম। “খুসরাভ খুবান সারভার এ আলম তাজ শফাতওয়ালা হ্যায়, হুসন কে চর্চা উসকে দম সে রৌনক এ আলম উসকে কদম সে, নূর কে সাঁচে মে কুদরত নে উসকো কুছ এইসা ঢালা হ্যায়।” জবাবে এল করাচির সবুজ দেয়ালঅলা ঘরের বিছানায় খালি গায়ে লুঙ্গি পরে বসে থাকা কাওয়ালির অবিসংবাদী শাহেনশার রেয়াজি গলায় প্রায় ত্রিশ বছরের পুরনো রেকর্ডে শোনা ওঁর বাবা মুন্সি রাজিউদ্দিন সাবের গাওয়া একটি অসামান্য হরকত, সঙ্গে গাওয়া পরের এক কলি, “নবী ওয়ালী সব উস কে বরাতী, কিস মে উস কি বাত হ্যায় আতি, কামিল মেরা রাজদুলারা সব সে আরফা-ও-আলা হ্যায়।”

মুন্সিজি পরবর্তীকালে একটা পুরব অঙ্গের শায়রি জুড়ে দিয়েছিলেন এই কালামটির সঙ্গে, আমাদের দুজনেরই একসঙ্গে সেই শায়রিটির কথা মনে পড়ে গেল। সমস্বরে গেয়ে উঠলাম, “মনমোহন বহুত্বেরে হি দেখে এইসা না দেখা না ভালা হ্যায়, দোনো জগৎ কো লুটকে বইঠা ফির ভি ভোলাভালা হ্যায়।” জুড়িয়ে গেল কান ও মন। ১৯৬১ সালে একটি হিন্দি সিনেমায় এই গানটিকে ব্যবহার করা হয়েছিল, হয়তো অনেকেই শুনে থাকবেন।

কিন্তু আসলটি না শুনলে আক্ষেপ রয়ে যাবে, তাই শেয়ার না-করে পারলাম না।

প্রায় বাইশ মিনিটের রেকর্ডিং, এ জিনিস সময় নিয়ে শোনার ও আত্মস্থ করার জিনিস— এককথায় লা-জবাব।

 

(ক্রমশ)


এ সফর সুফিয়ানা-র সব কটি পর্বের জন্য ক্লিক করুন: এ সফর সুফিয়ানা — অরুণপ্রকাশ রায়

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...