Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গড়চিরৌলি: এই সব হত্যাকাণ্ড প্রকৃত প্রস্তাবে রাষ্ট্রের পরাজয়ের পরিচায়ক

সৃজন দত্ত

 



লেখক ইতিহাসের স্নাতক, ছাত্র-রাজনীতির কর্মী

 

 

 

 

গত ১৩ নভেম্বর, বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে যে মহারাষ্ট্রের গড়চিরৌলিতে রাষ্ট্রীয় বাহিনির হাতে এনকাউন্টারে ২৬ জন ‘মাওবাদী’ নিহত হয়েছেন। পুলিশ কর্মকর্তারা এবং প্রশাসনিক আধিকারিকরা এই এনকাউন্টারকে মাওবাদী আন্দোলনকে মোকাবিলা করার প্রেক্ষিতে এক বিরাট জয় হিসেবে ঘোষণা করেছেন। পুলিশ-প্রশাসনের বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে সংবাদমাধ্যমে আগেই দাবি করা হয়েছিল যে এই ২৬ জন নিহত মাওবাদীদের মধ্যে রয়েছেন মিলিন্দ তেলতুম্বড়ে, একজন শীর্ষস্থানীয় মাওবাদী নেতা। এখন রাষ্ট্রের এই সাফল্যের কাহিনি সংবাদমাধ্যমের দরুন চারিদিকে অনুরণিত। পাশাপাশি নিষিদ্ধ সিপিআই (মাওবাদী) পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিও সংবাদ সংস্থার কাছে বিবৃতি দিয়ে মিলিন্দ ও অন্যন্যদের মৃত্যুসংবাদ নিশ্চিত করেছে এবং ২৭ নভেম্বর এই হত্যার প্রতিবাদে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ওডিশা, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশে বন্‌ধ ডেকেছে। এই ধরনের এনকাউন্টারের ঘটনার ক্ষেত্রে পূর্বে অনেক সময়ই দেখা গিয়েছে যে রাষ্ট্র এই ঘটনাগুলিকে নিজস্বার্থে ব্যবহার করতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে এবং পরে তা মানবাধিকারকর্মীদের এবং বৃহত্তর নাগরিক সমাজের উদ্যোগে তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এই এনকাউন্টারের ঘটনার ক্ষেত্রে অবশ্য মানবাধিকার সংগঠনগুলির কোনও প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি।

গড়চিরৌলির এনকাউন্টার নিয়ে দেশের নাগরিক সমাজের এক বৃহৎ অংশ এক অস্বাভাবিক নীরবতা পালন করছেন যা শুধুমাত্র এই ঘটনাটিকে নয়, বরং “encounter culture” বা ভারত রাষ্ট্রের এনকাউন্টার করে হত্যা করার যে সংস্কৃতি, সেটাকে আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করছে। নাগরিক সমাজের মধ্যে যে ভীতির সঞ্চার ঘটেছে তার কারণ খুঁজতে গেলে আমাদের বেশি গভীরে যেতে হবে না— গড়চিরৌলির এনকাউন্টারের ঠিক একদিন আগে, অর্থাৎ ১২ নভেম্বর, দেশের জাতীয় সুরক্ষা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল একটি বিস্ফোরক বক্তব্য রাখেন। হায়দরাবাদে সর্দার বল্লভভাই পটেল ন্যাশনাল পুলিশ আক্যাডেমির একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি বলেন যে নাগরিক সমাজই এখন নতুন যুদ্ধক্ষেত্র কারণ নাগরিক সমাজকে কাজে লাগিয়ে জাতীয় স্বার্থে আঘাত হানার চেষ্টা হতে পারে। তার বক্তব্যের থেকে একটি ছোট উদ্ধৃতি এখানে তুলে ধরলে হয়তো আমারা পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারব:

The new frontiers of war— what we call the fourth-generation warfare— is the civil society. War itself has ceased to become an effective instrument for achieving your political or military objectives. They are too expensive and unaffordable. It is the civil society that can be subverted… that can be divided, that can be manipulated to hurt the interest of a nation.

এখানে ডোভাল সরাসরি দেশের নাগরিক সমাজকে জাতীয় নিরাপত্তার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করছেন এবং নাগরিক সমাজের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বার্থের জুজু দেখিয়ে যুদ্ধ ঘোষণা করছেন। নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে মৌন সম্মতি প্রদর্শন করা হচ্ছে তা ভেঙে তারা নিশ্চয়ই ডোভালের এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিবাদে সংগঠিত হবেন এবং গড়চিরৌলির এনকাউন্টারের ক্ষেত্রে ভীত না হয়ে সত্যকে উন্মোচন করার নৈতিক কর্তব্যটি দৃঢ়তার সঙ্গে পালন করবেন।

ডোভালের বক্তব্য যেমন দেশের নাগরিক সমাজের ওপর রাষ্ট্রীয় দমন আরও তীব্র হওয়ার দিকে ইঙ্গিত করে, ঠিক তেমনই তা রাষ্ট্রের এক বড় পরাজয়কে এড়িয়ে যাওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পরিচয় দেয়— রাষ্ট্র মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সামরিক যুদ্ধ চালিয়ে গেলেও রাজনৈতিকভাবে মাওবাদীদের কাছে পরাস্ত হয়েছে— এবং গড়চিরৌলির এনকাউন্টার তা আরও একবার প্রমাণ করে দিয়েছে। একটি ‘গণতান্ত্রিক’ দেশে ‘এনকাউন্টার’, অর্থাৎ ‘বিচার-বহির্ভূত হত্যা’-কে রাষ্ট্র যখন তার নাগরিকদের আন্দোলনকে দমন করার জন্য একটি উপযুক্ত মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে তখন এটা খুব স্পষ্ট যে এই যুদ্ধের আদ্যস্থল থেকেই রাষ্ট্র মাওবাদীদের রাজনৈতিকভাবে বিরোধিতা করতে ব্যর্থ। আপনি হয়তো সশস্ত্র আন্দোলনের পক্ষে বা বিপক্ষে, মাওবাদীদের আন্দোলনকে সমর্থন করেন বা করেন না, ‘নকশালবাড়ি’-ই যে ভারতীয় জনগণের একমাত্র মুক্তির পথ তা মানেন বা মানেন না। কিন্তু, এক্ষেত্রে প্রশ্নটা একজন মানুষ হিসেবে আমাদের মৌলিক গণতান্ত্রিক চেতনা নিয়ে। কেউ যদি ভাবেন যে “মাওবাদীরা তো সশস্ত্র লড়াই চালাচ্ছে” বা “মাওবাদীরাও তো মানুষ খুন করে, তার বেলায় কী?”, তাহলে অনুরোধ করব যে অনর্থক ‘whataboutery’ তর্ক সরিয়ে রেখে একবার ভারতীয় রাজনীতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করে নিজে দেখুন তো ভারতের এই ‘মহান’ সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশগ্রহণকারী এমন কোনও রাজনৈতিক দল আছে কি যারা অস্ত্র হাতে রাজনীতি করে না? এই গণতন্ত্রকে টিঁকিয়ে রাখার জন্য কয়েক বছর অন্তর অন্তর নির্বাচন নামক যে ‘উৎসব’ পালিত হয়, শুধু সেই উৎসব পর্ব জুড়ে এবং নির্বাচন পরবর্তী সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলি তাদের ক্ষমতার নগ্ন প্রদর্শন করতে যে হিংসালীলায় মত্ত হয়ে পড়ে, তার দিকে তাকালেই আশা করি আমরা বাস্তব চিত্রটা বুঝতে পারব। হয়তো মাওবাদীরা এই ‘পবিত্র সংসদীয় রাজনীতির গণতান্ত্রিক পরিসর’ ত্যাগ করে ঘোষিতভাবে সশস্ত্র বিপ্লবী রাজনীতির অনুশীলন করছে তাই তাদের প্রতি এই ভিন্ন মনোভাব। মাওবাদীদের মানবাধিকারের পক্ষে সওয়াল করা এই জন্যই হয়তো অকল্পনীয়।