আতঙ্কবাদী রাষ্ট্র ও কয়েকজন মানুষের কথা

প্রবুদ্ধ ঘোষ

 




সাহিত্য-গবেষক, দাবা-প্রশিক্ষক

 

 

 

স্ট্যান লর্ডুস্বামী (৮৩)। তামিলনাড়ু। ক্যাথলিক গির্জার ফাদার ও আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের সক্রিয় নেতা। গ্রেপ্তার ৮ই অক্টোবর ২০২০। এনআইএ কর্তৃক আরোপিত ইউএপিএ। অভিযোগ ভীমা-কোরেগাঁও ঘটনায় যোগসাজশ এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)-র সঙ্গে সম্পর্ক। জটিল স্নায়ুরোগ, পার্কিন্সন্সে আক্রান্ত।

সুরেন্দ্র গ্যাডলিং (৪৭)। পুনে। আইনজীবী ও সমাজকর্মী। গ্রেপ্তার ৬ই জুন, ২০১৮। ,,। ,,। অ্যাকিউট আর্থ্রাইটিস ও রক্তচাপের অসুখে আক্রান্ত।

মহেশ রাউত (৩০)। বিদর্ভ। টিস-এর প্রাক্তন ছাত্র ও সমাজকর্মী। ,,। ,,। ,,। আলসারেটিভ কোলাইটিসে আক্রান্ত।

সুধীর ধাওয়ালে (৫৪)। নাগপুর। দলিত আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক ও ‘বিদ্রোহী’ পত্রিকার সম্পাদক। ,,। ,,। ,,। মধুমেহ ও রক্তচাপে আক্রান্ত।

রোনা উইলসন (৪৭)। কেরল-দিল্লি। জেএনইউ-র প্রাক্তনী ও রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি আন্দোলনের সংগঠক। ,,। ,,। ,,। পারিবারিক সদস্যেরা বিজেপি কর্মীদের দ্বারা মানসিক সন্ত্রাসের শিকার।

সোমা সেন (৬২)। নাগপুর। বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ও নারীবাদী আন্দোলনের সক্রিয় নেতা। ,,। ,,। ,,। নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপসারিত। গুরুতর আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত।

অরুণ ফেরেরা (৪৮)। মুম্বাই। আইনজীবী ও মানবাধিকার আন্দোলনের সৈনিক। গ্রেপ্তার ২৬শে অক্টোবর, ২০১৮। ,,। ,,। ,,। জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালীন প্রবল অত্যাচারের শিকার।

সুধা ভরদ্বাজ (৫৯)। ছত্তিশগড়। আইনজীবী ও ট্রেড-ইউনিয়ন আন্দোলনের সংগঠক। ,,। ,,। ,,। মধুমেহ ও ইস্কেমিক হার্টের অসুখে আক্রান্ত।

গৌতম নাভালখা (৬৮)। দিল্লি। সাংবাদিক, ‘ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’-র উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্য। ,,। ,,। ,,। কোলোনিক পলিপোসিস, উচ্চ রক্তচাপ ও গ্যাস্ট্রাইটিসে আক্রান্ত।

ভারভারা রাও (৮১)। তেলেঙ্গানা-পুনে। কবি এবং জনগণের অধিকার রক্ষা আন্দোলন ও সংস্কৃতি-আন্দোলনের নেতা। গ্রেপ্তার ১৭ নভেম্বর, ২০১৮। ,,। ,,। নড়াচড়ায় অক্ষম, উচ্চ রক্তচাপ ও স্মৃতিভ্রংশ রোগের শিকার।

আনন্দ তেলতুম্বড়ে (৭০)। মহারাষ্ট্র-গোয়া। আইআইটি ও গোয়া ইন্সটিটিউট অব্‌ ম্যানেজমেন্টের প্রাক্তন অধ্যাপক। গ্রেপ্তার ১৪ই এপ্রিল, ২০২০। ,,। ,,। শ্বাসকষ্টের রুগী ও সিওপিডি-তে আক্রান্ত।

এমটি হ্যানি বাবু (৫৪)। দিল্লি। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গন আন্দোলনের সৈনিক। গ্রেপ্তার ২৮শে জুলাই, ২০২০। ,,। ,,। অতিউদ্বেগ ও মধুমেহ রোগে আক্রান্ত।

জি এন সাইবাবা (৫০)। হায়দ্রাবাদ-দিল্লি। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও জনগণের আন্দোলনের অন্যতম মুখ। মার্চ ২০১৭ থেকে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)-র সঙ্গে সম্পর্কের অভিযোগে ও রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে ২০১৪ সাল থেকে জেলবন্দি। বিশেষভাবে সক্ষম (৮০% প্রতিবন্ধকতা), কার্ডিয়াক সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ ও অনাক্রমতাহীনতায় আক্রান্ত।

#

 

I’ve handed out clandestine pamphlets,
yelling: VIVA LA LIBERTAD! In the middle of the street
defying armed guards.
I participated in the April rebellion:
but I grow pale when I pass by your house
and one look from you makes me tremble.

– Ernesto Cardenal Martinez

এই তথ্যাবলি ও তালিকা দিয়েই লেখাটা চলুক। গণআন্দোলনের অন্যতম মুখ যাঁরা, প্রতিবাদের অন্যতম কণ্ঠ যাঁরা, তাঁদের নামের ভারে এই তালিকা বেড়েই চলেছে। উপরে যতজনের নাম রয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে দুটি বৈশিষ্ট্য সাধারণ–

(১) এঁরা প্রত্যেকেই নিপীড়িত মানুষের পাশে থেকেছেন ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। কেউ সংখ্যালঘুর অধিকার নিয়ে, কেউ শোষিত জনজাতির অধিকার রক্ষা নিয়ে, কেউ ট্রেড ইউনিয়নের দাবি নিয়ে, কেউ কৃষকদের পাওনা ফসলের ন্যায্য দামের বিষয়ে আর, কেউ সম্বলহীন মানুষদের হয়ে আদালতে সুঠাম, যুক্তিপূর্ণ ওকালতি করে সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করেছেন নিরন্তর। আর,

(২) রাষ্ট্র এবং পুলিশ-আইন-গোয়েন্দাদের মিলিত অভিযোগ এঁরা প্রত্যেকেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)-র সদস্য ও ঘনিষ্ঠ। এঁরা প্রত্যেকেই দেশের জনমানসে কমিউনিজমের প্রভাব বিস্তার করছেন এবং বিপ্লবের লক্ষ্যে জনগণকে একত্রিত করে শাসকশ্রেণিকে ব্যতিব্যস্ত করছেন– এই ‘ভয়ঙ্কর’ অভিযোগে তাঁদের গ্রেপ্তার ও শাস্তিদান করা হয়েছে।

বস্তুত, ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠার পরে এই কমিউনিস্ট পার্টিকে বহু দমনপীড়নেও এঁটে উঠতে পারেনি রাষ্ট্র। কেন্দ্রীয় সরকার কংগ্রেস-ইউপিএ হোক বা বিজেপি-এনডিএ, আপসহীন কমিউনিস্টদের এবং গণআন্দোলনকর্মীদের দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় ত্রুটি রাখেনি। সালওয়া জুডুম, অপারেশন গ্রিন হান্ট, অপারেশন সমাধান, কোবরা-গ্রেহাউন্ড-আধাসেনা আর বিচারব্যবস্থা– সপ্তরথীর মতো ঘিরে আছে চক্রব্যূহ। ‘আর্বান নকশাল’ তকমা দিয়ে কিংবা মিথ্যে অভিযোগে ইউএপিএ প্রয়োগ করে সরকারবিরোধী মতাদর্শের অনুশীলনকারীদের একা ক’রে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে রাষ্ট্র। কিন্তু, অর্থক্ষয়ী, শক্তিক্ষয়ী এমন সব প্রচেষ্টাতেও একা করে দেওয়া যায়নি তরুণ কিংবা বর্ষীয়ান দ্রোহীদের। আর, নকশালবাড়ির রাজনৈতিক মতাদর্শের গ্রহণযোগ্য প্রয়োজনীয়তা ভারতের আর্থ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আরও প্রতীয়মান হচ্ছে। আদিবাসীদের মুহুর্মুহু বিক্ষোভ, কৃষকদের আন্দোলন, শ্রমিকদের শাসকশ্রেণিবিরোধী প্রতিবাদ যত বাড়ছে, রাষ্ট্রের কাছে ততই ‘বিপজ্জনক’ হয়ে উঠছে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ।

স্ট্যান স্বামীর পরিচয় মাওবাদী কমিউনিস্ট নয় বরং ক্যাথলিক গির্জার ‘ফাদার’; রাষ্ট্রের কাছে এই পরিচয় বিপজ্জনক নয় কিন্তু আদিবাসী অধিকার রক্ষার আন্দোলনে স্ট্যান স্বামীর অগ্রণী নেতৃত্ব রাষ্ট্রের ভয়ের কারণ। কবিমাত্রেই রাষ্ট্রের চক্ষুশূল নয়; কিন্তু প্রায় চার দশক ধরে ভারভারা রাওয়ের সাংস্কৃতিক ভূমিকা, রাজনৈতিক সাংগঠনিক ভূমিকা এবং নিম্নবর্গ-নির্বিত্তের সঙ্গে মিশে দ্রোহচেষ্টার ফলে রাষ্ট্র তাঁকে জেলের বাইরে রাখার ‘ঝুঁকি’ নিতে পারেনি। স্ট্যান স্বামীর মতোই গিয়ের্মো সার্দিনাস ছিলেন গির্জার ফাদার। গিয়ের্মো কিউবার বিপ্লবের অন্যতম সেনাপতি। নিকারাগুয়ার ক্যাথলিক যাজক এর্নেস্তো কার্দেনাল নিজের কবিতা ও সক্রিয়তাকে বিপ্লবের আঁচে সেঁকে নিতে দ্বিধা করেননি। গির্জা ও ধর্মের বাঁধন কেটে স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে সান্দিনিস্তা জাতীয় মুক্তিফ্রন্টে যুক্ত হন, পরবর্তীতে সান্দিনিস্তা সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী হন। “Christ led me to Marx. I don’t think the pope understands Marxism. For me, the four gospels are all equally communist.” পোপের আদেশের বিরুদ্ধে শোষিত জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন কার্দেনাল। আজীবন জনগণের দ্রোহোৎসবের পক্ষে থেকেই ঘোষণা করেছেন, “I am a revolutionary, Revolutionary means that I want to change the world.”

ইতিহাসের এই পাঠগুলোর খোঁজ নিশ্চয় রাখে অন্যান্য দেশের ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্র। তিরাশি বছরের স্ট্যান স্বামীকে সেইজন্যেই ডরায় মোদি সরকার, কারণ তিনি আদিবাসীদের অধিকাররক্ষায় সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়ান, “What is happening to me is not something unique happening to me alone. It is a broader process that is taking place all over the country.  I am happy to be part of this process. I am not a silent spectator, but part of the game, and ready to pay the price whatever be it.” সোচ্চার হওয়ার মূল্য তাঁকে চোকাতে হচ্ছে। ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক শাসনশৃঙ্খলে রাষ্ট্রের দ্বারা শাস্তি পাওয়ার জন্যে কমিউনিস্ট মাওবাদী হওয়ারও প্রয়োজন নেই, সরকারবিরোধী যেকোনও প্রতিবাদই যথেষ্ট।

#

 

জেলকুঠুরির ছোট্ট জানলা দিয়ে দেখি
সমস্ত গাছ আমার দিকে, হাসছে।
সমস্ত ছাদ ভরে আমারই পরিবার
সব বিষণ্ণ জানলায় আমারই জন্যে দোয়া।
অন্ধকুঠুরির ছোট্ট জানলা দিয়ে
আমি তোমাদের বড় জেলখানা দেখতে পাই

–সামিহ-অল-কসিম (অনুবাদ: লেখক)

বিপ্লবীর কোনও নির্দিষ্ট বয়স হয় না; রাষ্ট্রই একথা প্রমাণ করে দিচ্ছে বারবার। ভারভারা বা স্ট্যান সেইজন্যেই জেলবন্দি এবং আইন-আদালত তাঁদের ন্যূনতম জিনিস পাঠাতেও বাধা দিচ্ছে।

ভারভারা রাওয়ের অসুস্থতা প্রবল হয়েছে গত জুলাই মাস থেকে। নড়াচড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। স্মৃতিভ্রংশ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এবং প্রলাপ বকছেন স্নায়ুরোগের জটিলতায়। বহু আবেদনের পরে জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার ‘দয়া’ দেখিয়েছে, কিন্তু হাসপাতালের শয্যায় দেহনিঃসৃত বর্জ্য-রেচনের মধ্যেই তাঁকে ফেলে রেখে দিয়েছিল। বারংবার তাঁর পরিবার ও দেশজোড়া মানুষের আবেদন অগ্রাহ্য করে জামিন নামঞ্জুর করেছে রাষ্ট্রীয় বিচারব্যবস্থা।

বৃদ্ধ ফাদার স্ট্যান পার্কিন্সন্স্‌ রোগে দীর্ঘদিন আক্রান্ত, এমনকি গেলাসে জল খেতেও পারেন না। এমন এক মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে জল খাবার স্ট্র, ‘সিপার’ দিতে দীর্ঘদিন টালবাহানা করেছে পুলিশ-প্রশাসন।

গত ২৭শে নভেম্বর জেল থেকে উধাও হয়ে যায় বর্ষীয়ান সামাজিক আন্দোলনের সৈনিক সাংবাদিক গৌতম নাভালখার চশমা। তাঁর পরিবারের সদস্যরা ৫ই ডিসেম্বর নতুন চশমা পাঠালেও, জেল কর্তৃপক্ষ তা নিতে অস্বীকার করে। গৌতম চশমা ছাড়া প্রায় অন্ধ; এছাড়াও অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতার শিকার তিনি। তা সত্ত্বেও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং মুম্বাইয়ের জেল কর্তৃপক্ষের এহেন অমানবিক আচরণের নিন্দা করেছে গণসংগঠনগুলি।

জেলবন্দি এই মানুষগুলোর অধিকাংশের অসুখ জেলে আসার পর শুরু হয়েছে বা বেড়েছে। ‘রাজনৈতিক বন্দি’দের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি এবং জেলের ভিতরে ন্যূনতম সুযোগসুবিধা দেওয়ার দাবি দীর্ঘদিনের। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকেই এই দাবি বারেবারে উত্থাপিত হয়েছে। কারাগার অন্তত ভারতে কোনওদিনই ‘সংশোধনাগার’ হয়ে ওঠেনি বরং আইনভঙ্গকারীদের (বিশেষতঃ বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে) শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের আইনসিদ্ধ স্থল হয়ে থেকেছে। কেন গৌতমকে চশমা দেওয়া হয়নি বা স্ট্যান লর্ডুস্বামীকে ২০ দিন সিপার-স্ট্র দেওয়া হয়নি কিংবা কেন ভারভারা রাওকে চিকিৎসা না করিয়ে ফেলে রাখা হয়েছিল, তার উত্তর সোজা। জেলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের আইনসিদ্ধ পন্থায় এই দ্রোহীদের বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত করা। আর, জনমানসে জাগরিত প্রতিবাদী চেতনাকে ভয় পাওয়ানো, যাতে এই রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের নমুনা দেখে তাঁরা প্রতিস্পর্ধার সাহস হারিয়ে ফেলেন। সরকারি লালফিতের ফাঁস পেরিয়ে ‘উন্নয়ন’ নিপীড়িত জনগণের কাছে পৌঁছতে পারে না, এটাকে আমরা গণতন্ত্রের স্বাভাবিকতা বলে মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে যাই। তেমনই সরকারি আদেশনামার হেরফের, অনুমতি-প্রত্যাখ্যান পেরিয়ে অভিযুক্ত রাজনৈতিক বন্দি সুবিচার বা সুযোগসুবিধে পান না– এটাও গণতন্ত্রের স্বাভাবিকতা বলেই মেনে নেওয়া হয়। আর, অসুস্থ রাজনৈতিক কমিউনিস্ট বন্দিকে জেলের ভেতর আইনসিদ্ধ উপায়ে খুন করাও ভারতরাষ্ট্রের কাছে জলভাত! চারু মজুমদার, স্বপন দাশগুপ্ত, সুদীপ চোংদার– বাংলাতেও এই উদাহরণ অনেক। কোবাড ঘান্দির ওপরে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বাক্‌বিতণ্ডা হয়েছে।

#

 

The foundation of Peshwa regime was caste system. Same is perpetrated by Modiji through modern methods. To me, Modi is a neo-liberal Peshwa.

–Jignesh Mevani

১৮১৮ সালের জানুয়ারিতে দলিত মাহার সৈন্যরা দ্বিতীয় পেশোয়া বাজিরাওয়ের সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দেয়। ব্রিটিশ বনাম মারাঠা যুদ্ধের আড়ালে এই যুদ্ধ নিম্নবর্গ-দলিত বনাম মারাঠা-উচ্চবর্ণ এই প্রতর্ককেও জড়িয়ে থাকে। উচ্চবর্ণ মারাঠাদের দীর্ঘদিনের শোষণের বিরুদ্ধে দলিতের প্রতিস্পর্ধার মঞ্চ হয়ে ওঠে মহারাষ্ট্রের ভীমা-কোরেগাঁও। ‘বিজয় স্তম্ভ’ স্থাপিত হয় শোষিতদের বিজয় উদ্‌যাপনে। ২০১৮ সালের পয়লা জানুয়ারি ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ওই বিজয়ের দ্বিশতবার্ষিকী উদ্‌যাপনে এক মিছিল ও সভার আয়োজন করেন ভীমা-কোরেগাঁওয়ের দলিত ও বহুজন সম্প্রদায়গুলি। কিন্তু, তাঁদের অভিযোগ– সভার ঠিক আগের দিনই শাম্ভাজি ভিডে ও মিলিন্দ একবোটের নেতৃত্বে আরএসএসের সন্ত্রাসবাদীরা ভীমা-কোরেগাঁও যুদ্ধের অবিংসংবাদী নেতা গোবিন্দ গোপাল মাহারের সমাধিস্থল তছনছ করে। পরের দিন মিছিল ও সভা চলাকালীন আরএসএসের আতঙ্কবাদীরা ফের আক্রমণ করে। কিন্তু, পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার না করে হিংসা ছড়ানোর অভিযোগে দলিত-বহুজন নেতৃত্বকে এবং সামাজিক আন্দোলনের কর্মীদের গ্রেপ্তার করে। আর, এর সঙ্গেই জুড়ে ছিল ‘মাওবাদীরা প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করতে চায়’– এই বয়ানে সাজানো ভুয়ো মামলা। ভীমা-কোরেগাঁও উদ্‌যাপনের পুরোধাদের সঙ্গে এই মামলা জুড়ে দিয়ে দেশজুড়ে ইউএপিএ ধারায় একের পর এক গ্রেপ্তারি চালাতে থাকে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা।

যেকোনও রাষ্ট্রবিরোধী গণবিক্ষোভে ও দেশ-বাঁচানোর আন্দোলনে মাওবাদী-নকশাল ভূত দেখে শাসকশ্রেণি। কৃষিবিলের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক উত্তাল জনবিক্ষোভেও মাওবাদীদের উপস্থিতির আতঙ্ক তাড়া করছে দিল্লি প্রাসাদকূটে সুখনিদ্রারত বাদশাজাদাকে। বিভিন্ন রাজ্য সরকার ও কেন্দ্র সরকার বিগত কয়েক দশক ধরে এই ভূত দেখছে। আর, রাষ্ট্রপ্রেমী সংবাদমাধ্যম তা প্রচার করছে ফুলিয়েফাঁপিয়ে। এতে রাষ্ট্রের সুবিধে এই হয় যে, নকশালরা সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাসী বলে তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ‘প্রমাণ’ সাজিয়ে ইউএপিএ চাপিয়ে দেওয়া যায়। নকশালদের ওপরে কারাগারে যথেচ্ছ নির্যাতন চালালেও বিচারবিভাগ ও রাষ্ট্রপ্রেমী সংবাদমাধ্যম সেই অত্যাচারকে ন্যায্যতা দিয়ে দেয়। কিন্তু, রাষ্ট্রচালকদের বারবার বুঝতে ভুল হয় যে, এই পদ্ধতিতে ভারতের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সমস্যার মূল সমাধান করা যায় না। বরং শাসনের ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদী প্রবণতায় নিপীড়িতের সংখ্যা বাড়ে, দেশের সঙ্কট গাঢ়তর হয়। আর, তাতে বিক্ষোভ-প্রতিবাদ উত্তরোত্তর বাড়ে। তখন রাষ্ট্রকেও হিংসার কাঠামোতে গুরুত্ব দিতে হয় বেশি। শ্রেণি-বর্ণ-লিঙ্গ বৈষম্যের ধ্বজাধারী রাষ্ট্রর ‘মানবিক মুখ’ যে হয় না, তা প্রমাণ হতে থাকে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায়। সরকারবিরোধী গণআন্দোলনের স্বরকে স্তব্ধ করতে রাষ্ট্রকে গ্রেপ্তারি ও জিজ্ঞাসাবাদের ‘নাটক’ অব্যাহত রাখতে হয়, প্রয়োজনে ভুয়ো এনকাউন্টারের বাজারজাত অভিনয়। স্ট্যান স্বামীর মুখ থেকে সিপার, গৌতম নাভালাখার চোখ থেকে চশমা, স্বপন দাশগুপ্তের বিছানা থেকে কম্বল সরিয়ে নিতে হয় কিংবা ভারভারা রাওয়ের অসুস্থতাকে সচেতন অবজ্ঞা করতে হয়। তবু, স্ট্যান স্বামী সামান্য এক গির্জেঘরের ‘ফাদার’ থেকে প্রতিরোধের মুখ হয়ে ওঠেন, নাভালাখা সাংবাদিক থেকে প্রতিস্পর্ধী সত্যসন্ধানী হয়ে ওঠেন। এই ফ্যাসিস্ত-হয়ে-ওঠা সংসদীয় গণতন্ত্র হয়তো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে জেলের ভেতরেই এঁদের খুন করবে কিংবা মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছিয়ে দেবে। কিন্তু, প্রতিস্পর্ধী জনতার দ্রোহের পতাকা কি অত সহজে কেড়ে নেওয়া যায়?

আমি বিস্ফোরক যোগান দিইনি
আদর্শও হাতে তুলে দিইনি কারও
তোমরাই জুতোর নালে গুঁড়িয়ে দিয়েছ
আমদের সামান্য বসতি, ঘরদোর
সেই শোক ধিকিধিকি জ্বলে ক্রোধ,
ধ্বংসস্তূপ থেকে জন্মেছে প্রতিশোধ

লাঠি দিয়ে হিংস্র উল্লাসে ভেঙ্গেছ মৌচাক-
উদ্বাস্তু মৌমাছিঝাঁক
তোমাদের নিরাপদ নিশ্চয়তার দিকে
ধেয়ে যাচ্ছে জবাব চাইতে

রণবাদ্য দারুণ শব্দে বাজে জনতার বুকে
তুমি বন্দুক সাজাও, শাসনক্ষমতা।
ভাবো দু-একজনকে মেরে সব যায় চুকে,
দেখো, দিগন্ত জুড়ে ওড়ে দ্রোহের পতাকা

–ভারভারা রাও (অনুবাদ: লেখক)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...