Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বস্তুবাদ চর্চার একশো বছর: বিদ্যাসাগর থেকে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়

কণিষ্ক চৌধুরী

 



শিক্ষক, গবেষক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে বহুল প্রচলিত মতটি হল— এটি অধ্যাত্মবাদী/ভাববাদী। বস্তুবাদের কোনও স্থান এখানে নেই। বস্তুবাদ ব্যাপারটাই পশ্চিমি সভ্যতা থেকে আমদানি করা। আর তাই তা পরিত্যাজ্য। আবার কেউ কেউ ঢোক গিলে স্বীকার করে নেন যে, জড়বাদ/বস্তুবাদ ভারতীয় দর্শন প্রস্থানে ছিল, কিন্তু, “এই সকল দর্শনশাস্ত্র জনসমাজে অপ্রকাশিত থাকাই কর্তব্য।”[1] বিদ্যাসাগর এরই বিপরীতে ভারতীয় বস্তুবাদী দর্শন চার্বাক/লোকায়ত-কে ‘প্রকাশিত’ করাই কর্তব্য মনে করেছেন। আর সে কারণেই তিনি এই দর্শনকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেছেন, পাঠ্যপুস্তকের সম্পাদনা করেছেন এবং সংস্কৃত থেকে তা বাংলায় অনুবাদের ব্যবস্থাও করেছেন। আর এইভাবেই উনিশ শতকের দ্বিতীয়ভাগে বস্তুবাদ চর্চায় বহুজনকে আগ্রহী করে তুলেছেন। তাঁর সম্পাদিত বইটি হল মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’। বইটির প্রথম অধ্যায়টিই চার্বাক দর্শন সম্পর্কিত। এই সম্পাদিত গ্রন্থটির মধ্যে দিয়েই দেশি ও বিদেশি ছাত্র ও পণ্ডিতবর্গ জানতে পারলেন যে ভারতেও বস্তুবাদী দর্শন প্রস্থান ছিল। শুধু ছিলই না, বেশ জোরালোভাবেই ছিল।

বিদ্যাসাগর সম্পাদিত ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ প্রকাশিত হওয়ার আগে ঔপনিবেশিক ভারতে চার্বাক দর্শন সম্পর্কে পণ্ডিতদের জ্ঞান ও আগ্রহ প্রায় ছিল না বললেই চলে। তবে টমাস কোলব্রুক বিষয়টি নিয়ে সামান্য কিছু নাড়াচাড়া করেছিলেন। তিনি যে সকল উৎস ব্যবহার করেছিলেন, সেগুলি হল সাংখ্য ও বেদান্তসূত্রের কয়েকটি ভাষ্য। উৎস যতই স্বল্প হোক কোলব্রুকের এটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, চার্বাক/লোকায়ত হল একটি খোলাখুলি বস্তুবাদী দর্শন। তাছাড়া হেমচন্দ্র-র ‘অভিধানচিন্তামণি’-তে ‘বার্হস্পত্য’ বা ‘নাস্তিক’ ও ‘চার্বাক’ বা ‘লোকায়ত’-র উল্লেখ থেকে কোলব্রুক সিদ্ধান্ত করেন যে এই দর্শন পরকাল, ঈশ্বর ইত্যাদিকে অস্বীকার করে।[2] কোলব্রুকের কাজের যথাযথ স্বীকৃতি দিয়েও বলতে হয় যে, বিদ্যাসাগরই ঔপনিবেশিক ভারতে বস্তুবাদ চর্চার প্রকৃত সূত্রপাত করেন এবং তাকে বেগবান করেন।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বিদ্যাসাগরের হাতে চার্বাক/লোকায়ত চর্চার যে শুভ সূচনা ঘটে তা পরিণতি পায় একশো বছর বাদে মার্কসবাদী চিন্তাবিদ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের গবেষণার মধ্যে দিয়ে। সময়টি দীর্ঘ এবং পথটি সহজ নয়। তবুও নানাজন বিষয়টি নিয়ে চর্চা করেছেন। কিন্তু এই চর্চাকারীদের অধিকাংশই বস্তুবাদ-বিরোধী। তবুও তাঁরা করেছেন। অবশেষে দেবীপ্রসাদের হাতে এসে তা পূর্ণতা পেয়েছে। আর অবসান ঘটেছে ভারতীয় ভাববাদের একাধিপত্যের অতিকথাটির। এটাই বর্তমান সন্দর্ভের মুখ্য আলোচ্য বিষয়।

 

প্রথম পর্ব: বিদ্যাসাগরের দর্শন চর্চা

রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের চিন্তাজগতের কেন্দ্রে বেদান্ত দর্শনের স্থান। চরম ভাববাদ সহ আধ্যাত্মিকতা সুরভিত মতাদর্শের ভিত্তিতেই তাঁদের যা কিছু বলা, যা কিছু করা। আর বিদ্যাসাগরের পথ চলা এরই বিপরীতে। যাবতীয় ভাববাদী, অধ্যাত্মবাদী, ধর্মগন্ধী দর্শন ও মতকে তিনি সযত্নে পরিহার করেই চলেছেন। ভগবান, ঈশ্বর, দেবদেবীর স্থান কোনও গুরুত্বই পায়নি তাঁর জীবনে। বিদ্যাসাগর তাই অনায়াসে বলতেন, “ঈশ্বর যদি থাকেন ত তিনি ত আর কামড়াবেন না।”[3] বিদ্যাসাগরের ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের কাছ থেকে জানা যায়: “অগ্রজ মহাশয় [বিদ্যাসাগর] শৈশবকাল হইতে কাল্পনিক দেবতার প্রতি কখনই ভক্তি বা শ্রদ্ধা করিতেন না।”[4] বয়ঃবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর এই চিন্তাদর্শটি আরও পরিপক্বতা লাভ করে ও আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তিনি দার্শনিক জ্ঞানের ভিত্তিতে এই মতকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর যুক্তিবাদ, সেকুলারবাদ ও মানবতাবাদের পিছনে একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি গভীরভাবে কার্যকরী ছিল। সেটা দেখে নেওয়া দরকার।

২.

১৮২৯-এ উচ্চশিক্ষার জন্য ইশ্বরচন্দ্র কলকাতার সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। তাঁর ছাত্রজীবন শেষ হয় ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে। সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য শিক্ষার পাশাপাশি ভারতীয় দর্শন সম্পর্কেও তিনি পাঠ গ্রহণ করেন। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদ লাভ করেন। শুরু হয় তাঁর শিক্ষা সংস্কারের কাজ।

১৮২৪ খ্রিস্টাব্দ থেকেই কলকাতার সংস্কৃত কলেজে নব্যন্যায় ও বেদান্ত দর্শন পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বিদ্যাসাগর ছিলেন এ-দুয়েরই বিরোধী। ডিসেম্বর ১৮৫০-এ লেখা একটি রিপোর্টে তিনি এ-বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানিয়েছিলেন।[5] ১২ এপ্রিল ১৮৫২-তে সংস্কৃত কলেজ সম্পর্কিত Notes-এ তিনি লেখেন:

একথা ঠিক যে হিন্দু দর্শনের অনেক মতামত আধুনিক যুগের প্রগতিশীল ভাবধারার সঙ্গে খাপ খায় না, কিন্তু তাহলেও প্রত্যেক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের এই দর্শন সম্বন্ধে জ্ঞান থাকা উচিত, ছাত্ররা যখন দর্শন শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবে, তার আগে ইংরেজি ভাষায় তারা যে জ্ঞান অর্জন করবে তাতে ইওরোপের আধুনিক দর্শনবিদ্যা পাঠ করারও সুবিধা হবে তাদের। ভারতীয় ও পাশ্চাত্য দুই দর্শনেই সম্যক জ্ঞান থাকলে, এদেশের পণ্ডিতদের পক্ষে আমাদের দর্শনের ভ্রান্তি ও অসারতা কোথায় তা বোঝা সহজ হবে। সমস্ত রকম মতামতের দর্শন ছাত্রদের পড়তে বলার উদ্দেশ্য হল, সেগুলি পড়লে তারা দেখতে পাবে কীভাবে এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের মত খণ্ডন করেছেন এবং এক দর্শনের পণ্ডিত ভিন্ন দর্শনের ভুলভ্রান্তি দেখিয়েছেন এবং প্রতিপাদ্যের যৌক্তিকতা খণ্ডন করেছেন। সুতরাং আমার ধারণা, সর্বমতের দর্শন পাঠ করবার সুযোগ দিলে ছাত্রদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত গড়ে উঠবে। তার সঙ্গে পাশ্চাত্য দর্শন সম্বন্ধে জ্ঞান থাকলে, দুই দর্শনের মধ্যে সাদৃশ্য ও পার্থক্য কোথায় তাও তারা বুঝতে পারবে।” (True it is that the most part of the Hindu system of philosophy do not tally with the advanced ideas of modern times, yet it is undeniable that to a good Sanskrit scholar their knowledge is absolutely required. By the time that the students come to the Darshana or Philosophy class their acquirements in English will enable them to study the Modern Philosophy of Europe. Thus they shall have ampler opportunity of comparing the system of Philosophy of their own, with the new Philosophy of Western World. Youngmen thus educated will the better able to expose the errors of ancient Hindu Philosophy than if they were to derive their knowledge of Philosophy simply from the Europeans sources. One of the principal reasons why I have ventured to suggest the study of all the prevalent systems of Philosophy in India is that the student will clearly see that the propounders of different systems have attacked each other and have pointed out each other’s errors and fallacies. Thus he will be able to judge for himself. His knowledge of European Philosophy shall be to him an invaluable guide to the understanding of the merits of the different systems.[6]

বিদ্যাসাগর তাঁর রিপোর্টে স্পষ্টভাবেই বলেছেন যে—

ক. হিন্দু দর্শনের অনেক মতামতই আধুনিক যুগের প্রগতিশীল ভাবধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অর্থাৎ সেগুলি অত্যন্ত ক্ষতিকর।

খ. ভারতীয় দর্শনের ভ্রান্তি ও অসারতা বোঝার জন্য এদেশের পণ্ডিতদের ভারতীয় ও পাশ্চাত্য উভয় ধরনের দর্শনই পাঠ করা প্রয়োজন। এই প্রস্তাবের মধ্যে দিয়ে তিনি তুলনামূলক দর্শনতত্ত্বের আলোচনার সূত্রপাত ঘটান।

গ. ভারতীয় দর্শনগুলি একমাত্রিক ও সমগোত্রীয় নয় তা বোঝার প্রয়োজনে সকল ধরনের দর্শনগুলির পাঠ প্রয়োজন। এর মধ্যে দিয়ে ছাত্ররা দেখতে পাবেন যে, দার্শনিকগণ কীভাবে অন্য দর্শন সম্প্রদায়ের মতকে খণ্ডন করেছেন বা ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করেছেন। যেমন, বেদান্তবাদীরা নিজেদের মধ্যে যেমন তর্কবিতর্ক চালিয়েছেন, তেমনি চার্বাক/লোকায়ত বৌদ্ধ সাংখ্য দর্শনগুলিকে ভ্রান্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন।

ঘ. তাঁর সিদ্ধান্ত হল ছাত্রদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও মতামত গড়ে তোলার জন্য এই সর্বমতের দর্শন পাঠ প্রয়োজনীয়।

বিদ্যাসাগর ছাত্রদের জন্য যে পাঠ্যতালিকা তৈরি করেছিলেন, তা হল: “ন্যায় দর্শন— গৌতম সূত্র ও কুসুমাঞ্জলি; বৈশেষিক দর্শন— কণাদের সূত্র; সাংখ্য দর্শন— কপিলের সূত্র এবং কৌমুদী; পতঞ্জল দর্শন— পতঞ্জলের সূত্র; বেদান্ত দর্শন— বেদান্তসার এবং ব্যাসের সূত্র, প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ; মীমাংসাদর্শন— জৈমিনির সূত্র। এগুলি ছাড়া ছাত্ররা ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ পড়বে, কারণ তার মধ্যে সব দর্শনের সারকথা পাওয়া যাবে।”[7] বিদ্যাসাগরের পাঠ্যতালিকা কিন্তু নজর করার মতো। কারণ এখানে তিনি ন্যায়, সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শনকে পাঠ্যতালিকা থেকে বাদ দেননি। যদিও এই তিনটি দর্শন সম্পর্কে তাঁর মতটি মোটেই সদর্থক ছিল না।

প্রথমেই দেখা দরকার বেদান্ত দর্শন সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের মতটি কেমন ছিল। ভারতীয় ষড়দর্শন সম্পর্কে তাঁর ধারণা মোটেই ভাল ছিল না তা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।[8] বেদান্ত ও অন্যান্য দর্শন সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায় ‘ব্যালেন্টাইন বিতর্কে’। ডঃ জেমস আর ব্যালেন্টাইন বেনারস সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপাল, শিক্ষা পরিষদ ব্যালেন্টাইনকে আহ্বান করল বিদ্যাসাগর পরিচালিত কলিকাতা সংস্কৃত কলেজ পরিদর্শন করে একটি রিপোর্ট তৈরি করতে। তিনি তাঁর রিপোর্টে (১৮৫৩) বিদ্যাসাগরের প্রশংসা করলেও কতগুলি ত্রুটির উল্লেখ করেন এবং সে ত্রুটি সংশোধনের জন্য কয়েকটি বইকে পাঠ্যতালিকার অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেন। তাঁর প্রস্তাবিত গ্রন্থগুলির মধ্যে একটি হল বার্কলের ‘ইনকোয়ারি’।[9] শিক্ষা পরিষদ বিদ্যাসাগরের কাছে এই রিপোর্ট পাঠিয়ে দেয়। এই রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগর শিক্ষা পরিষদের সম্পাদক এফ জে ময়েটকে একটি চিঠিতে জানান:

…the Vedanta and Sankhya are false systems of Philosophy is no more a matter of dispute. These systems are false as they are, command unbounded reverence from the Hindus. Whilst teaching these in the Sanskrit course, we should oppose them by sound Philosophy in the English course to counteract their influence. (বেদান্ত ও সাংখ্য দর্শন ভ্রান্ত দর্শনতন্ত্র, এটা নিয়ে আর কোনও বিতর্ক নেই। ভ্রান্ত হলেও, এই দুটি দর্শনতন্ত্র হিন্দুদের অপরিসীম শ্রদ্ধা পেয়ে থাকে। আমাদের উচিত সংস্কৃত পাঠক্রমে এগুলি পড়ানোর সময়ে, এদের প্রভাব দূর করার জন্যে ইংরাজি পাঠক্রমে খাঁটি দর্শন দিয়ে এগুলির বিরোধিতা করা।)[10]

ব্যালেন্টাইনের প্রস্তাবিত ‘ইনকোয়ারি’ (বার্কলের লেখা)-কে পাঠক্রমে যুক্ত করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বিদ্যাসাগর লিখেছেন:

Bishop Barkeley’s Inquiry, which has arrived at similar or identical conclusions with the Vedanta or Sankhya and which is no more considered in Europe as a sound system of philosophy, will not serve that purpose. On the contrary, when, by the perusal of that book, the Hindu students of Sanskrit will find that the theories advanced by the Sankhya and Vedanta system are corroborated by a Philosophy of Europe, their reverence for these two systems may increased instead of being diminished. Under this circumstance I regret I cannot agree with Dr Ballantyne in recommending the adoption of Bishop Berkeley’s work as a class-book.[11]

বিদ্যাসাগরের বক্তব্যের মোদ্দা কথাটি হল: বিশপ বার্কলের লেখা ‘ইনকোয়ারি’ গ্রন্থটিতে যে ধরনের সিদ্ধান্ত করা হয়েছে তা বেদান্তের সিদ্ধান্তেরই অনুরূপ এবং বার্কলের দর্শনকে ইউরোপে মোটেই যথাযথ দর্শন বা সঠিক দর্শন বলে মনে করা হয় না। ফলে বিদ্যাসাগর যে যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক মনোভাব ছাত্রদের মধ্যে গড়ে তুলতে চাইছেন, সেই উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। বরং ছাত্ররা যখন দেখতে পাবে বেদান্ত ও সাংখ্যের সিদ্ধান্তগুলি কোনও ইউরোপীয় দর্শন (বার্কলের ভাববাদ) দ্বারা সমর্থিত হচ্ছে, তখন বেদান্ত ও সাংখ্যের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা কমার বদলে বেড়ে যাবে। সুতরাং ব্যালেন্টাইনের সঙ্গে তিনি একমত হতে পারছেন না এবং ছাত্রদের এই বই পড়ানোর প্রস্তাবে তিনি একেবারেই সম্মত নন।

৩.

এখানে একটি সমস্যার উল্লেখ প্রয়োজন। ষড়দর্শনের অন্যতম প্রধান দর্শন সাংখ্যদর্শনের মধ্যে বহু প্রগতিশীল ও যুক্তিবাদী উপাদান থাকা সত্ত্বেও বিদ্যাসাগর একে ভ্রান্ত দর্শন হিসেবে গ্রহণ করলেন কেন? কেনই বা সাংখ্য ও বেদান্তকে প্রায় এক পর্যায়ে ফেললেন? তিনি কোন সাংখ্যের কথা ভেবেছিলেন?

বেদকে যারা প্রমাণ বা সঠিক জ্ঞান বলে মনে করে সেই ছয়টি দর্শন হল— সাংখ্যযোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, (পূর্ব) মীমাংসা ও উত্তর মীমাংসা বা বেদান্ত। সাংখ্যদর্শনের জনক কপিল মোটেই ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। সাংখ্যদর্শনও ছিল নিরীশ্বরবাদী। অন্যদিকে বেদান্ত হল ব্রহ্মবাদী। এরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়গুলিকে একেবারেই গুরুত্ব দেয় না বা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তথ্যকে গৌণ স্থান দেয়। কিন্তু সাংখ্যদর্শনের ভাবনাটি এর একদম বিপরীত। সাংখ্য মতে জড় প্রকৃতি থেকে সমস্ত বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে। একে বলা হয় ‘অচেতন কারণবাদ’। বেদান্তের তত্ত্ব হল ‘চেতন কারণবাদ’। অর্থাৎ চেতন ব্রহ্মই হল পরম সত্তা, তার থেকে সমস্ত কিছুর উদ্ভব ঘটেছে। এই দুই দর্শনের সম্পর্ক তাই শত্রুতামূলক। “বেদান্ত দর্শনের মূল বই, বাদরায়ণ-এর ;ব্রহ্মসূত্র’য় ৫৫৫টি সূত্রর মধ্যে অন্তত ৬০টি খরচ করা হয়েছে সাংখ্য-খণ্ডনে, অন্যান্য দর্শনের ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে মোট ৪৩টি (তার মধ্যে বৌদ্ধ ও জৈন দর্শনও আছে)। ব্রহ্মসূত্র-র ভাষ্যে শঙ্কর, রামানুজ প্রমুখ ভাষ্যকাররা সাংখ্যর বিরুদ্ধে পাতার পর পাতা লিখেছেন।”[12] তাই যদি হয় তাহলে বেদান্ত ও সাংখ্যকে বিদ্যাসাগর একাসনে বসালেন কেন?

দার্শনিক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ব্যাখ্যায় এ প্রশ্নের উত্তরটির সন্ধান মেলে। বিদ্যাসাগর আদি-বস্তুবাদী সাংখ্য নয়, বেদান্ত-প্রভাবিত সাংখ্যকেই ভ্রান্ত দর্শন হিসেবে ঘোষণা করেন। দার্শনিক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য লিখেছেন:

আদি সাংখ্যর রূপ কী ছিল তা আর জানা যায় না। তার কোনও সূত্রগ্রন্থ পাওয়া যায়নি। ‘সাংখ্য-প্রবচন-সূত্র’ নামে ৫২৫টি সূত্রর যে সঙ্কলনটি পাওয়া যায় সেটি নেহাতই আধুনিক— খ্রিস্টীয় চোদ্দো শতকের আগের নয়। যে বইটির ভিত্তিতে এখন সাংখ্যর মত স্থির করা হয়, সেই সাংখ্যকারিকা-ও আনুমানিক খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে লেখা।

‘সাংখ্যসূত্র’-র মধ্যেই বেদান্ত মতের কিছু কিছু ধারণা স্থান পেয়েছে। আত্মা বিষয়ক সূত্রটি নিত্য-শুদ্ধ-বদ্ধ-মুক্ত স্বভাব (১/১৯)— তো উপনিষদেরই প্রতিধ্বনি। ৪/৩ সূত্রটি আসলে ‘ব্রহ্মসূত্র’-র ৪/১/১-এর অবিকল উদ্ধৃতি। তেমনই ৫/১১৬-য় বেদান্তর পারিভাষিক শব্দ ‘ব্রহ্মরূপতা’ ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলি নিশ্চয় আদি-সাংখ্যে ছিল না। থাকলে, শংকর-রামানুজ ইত্যাদি নানান মতের বৈদান্তিকরা সাংখ্যকে শ্রুতিবিরোধী বলে নিন্দা করবেন কেন, আর সেই কারণেই বাতিলই বা করে দেবেন কেন? সাংখ্যকে বেদসম্মত (=আস্তিক) করার জন্যেই এই ধরনের পরিবর্তন করা হয়েছিল।

আরও গোলমাল করেছেন ‘সাংখ্যকারিকা’ ও ‘সাংখ্যসূত্র’-র ভাষ্যকাররা। গৌড়পাদ, অনিরুদ্ধ বাচস্পতি মিশ্র, বিজ্ঞানভিক্ষু— সকলেই ছিলেন বৈদান্তিক। তাঁরা চেষ্টা করেছিলেন সাংখ্যকে বেদান্তরই কাছাকাছি নিয়ে আসতে। ‘পুরুষ’ আর ‘ব্রহ্ম’ তাদের হাতে প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। তার জন্যেই গৌড়পাদ সাংখ্যর বহু ‘পুরুষ’কে এক করে ফেলেছেন। কারিকা-র বক্তব্যের সঙ্গে তা মেলে না।[13]

এইভাবেই দার্শনিক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন, বিদ্যাসাগর যে সাংখ্যকে বাতিল করতে চেয়েছিলেন, তা হল এই বেদান্ত-অনুবর্তী সাংখ্য। এই বেদান্ত ও সাংখ্যর সঙ্গে বিশপ বার্কলের দর্শনের প্রচুর সাদৃশ্য। এই দর্শনগুলি জীবন-জগৎকে গৌণ বা তাৎপর্যহীন মনে করত। দার্শনিক চিন্তায় এরা ছিল ভাববাদী। আর তাই বিদ্যাসাগরের কাছে এই দর্শনতন্ত্রগুলি একান্তভাবেই ভ্রান্ত দর্শনতন্ত্র। অর্থাৎ আদি-সাংখ্য নয়, বেদান্ত প্রভাবিত ভেজাল সাংখ্যই হল তাঁর আক্রমণের লক্ষ্য।

৪.

বিদ্যাসাগরের শিক্ষা সংস্কারের অন্যতম লক্ষ্য ছিল নব্যন্যায়-এর চর্চাকে খর্ব করা এবং অবশেষে কলেজ থেকে বাদ দেওয়া। তাঁর কাছে নব্যন্যায় ছিল ‘কর্দমাক্ত অধিবিদ্যা’ (muddy metaphysics)। ষড়দর্শনের অন্যতম ন্যায়দর্শন-এর সূত্রপাত খ্রিস্টপূর্ব ৩০০-খ্রিস্টপূর্ব ২০০-র মধ্যে।[14] এই আদি ন্যায়দর্শন-এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে গোতম বা গৌতম-এর নাম। চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে বাৎস্যায়ন গৌতমের ‘ন্যায়সূত্র’-র ভাষ্য রচনা করেন। পরবর্তীকালে বৈশেষিক দর্শনের সঙ্গে মিলে এই দর্শনটি ন্যায়-বৈশেষিক দর্শন হিসেবে পরিচিত হয়। বাৎস্যায়ন শুরুতেই তাঁর ভাষ্যে সংশয় ও critical examination-এর কথা বলেছেন। স্পষ্টতই তা বেদান্ত দর্শনের বিরোধী। এই সংশয় ও তার প্রয়োগের মধ্যে দিয়ে জ্ঞানের সঠিকতা বা ভ্রান্তি বিচার সম্ভব। বেদান্তে এ পদ্ধতি স্বীকৃতি পায় না। দ্বাদশ শতাব্দীতে বেদান্তবাদী দর্শনকার শ্রীহর্ষ নৈয়ায়িকদের বিরুদ্ধে নানা আপত্তি তোলেন। বৈদান্তিক মায়াবাদের বিরুদ্ধে নৈয়ায়িকরা বাস্তববাদ (realism) প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হলেন। এই প্রচেষ্টার প্রথম উদ্যোগ হল গঙ্গেশ উপাধ্যায়-এর ‘তত্ত্বচিন্তামণি’ (১২২৫ খ্রিস্টাব্দ)। এই ধারাতেই আবির্ভাব ঘটল ‘নব্যন্যায়’-এর। নব্য নৈয়ায়িকরা গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন পরিভাষা, সংজ্ঞার সংস্কার ও রূপের ওপর। আর সদর্থক দর্শন ভাবনা হল উপেক্ষিত ও অবহেলিত। লক্ষ্যের বদলে উপলক্ষই হয়ে উঠল প্রধান।

বাংলায় নব্যন্যায়ের চর্চা তিনশো বছর ধরে প্রচলিত থাকলেও ঔপনিবেশিক পর্বের প্রথমদিকে তা দুর্বল হতে শুরু করে। কিন্তু ১৮২৪-এ নব্যন্যায়ের চর্চা নতুন করে কলকাতার সরকারি সংস্কৃত কলেজে শুরু হল। বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ পদ গ্রহণ করে (১৮৫২) নব্যন্যায় চর্চার ওপর আঘাত হানলেন। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি নব্যন্যায়-এর মূল বই গঙ্গেশ উপাধ্যায়ের ‘তত্ত্বচিন্তামণি’ ও রঘুনাথ শিরোমণির টীকা ‘দীধিতি’ পাঠক্রম থেকে বাদ দেন। পাঠক্রমে যুক্ত করেন গোতমের ’ন্যায়সূত্র’ ও ‘ন্যায়কুসুমাঞ্জলি’ এবং কপিলের সূত্র [সাংখ্যবচনসূত্র] ও তত্ত্বকৌমুদী।[15]

নব্যন্যায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল তর্কের জন্য তর্ক— কেবল বাক্যবিস্তার। ফলে বিদ্যাসাগরের তা মোটেই পছন্দ হয়নি। এইরকম অকারণ এবং মাত্রাতিরিক্ত তর্কাতর্কি করে সত্য নির্ণয়ের পথ থেকে সরে আসার জন্য বিদ্যাসাগর এই দর্শনের ওপর বিরক্ত হয়ে পাঠক্রম থেকে বাদ দিয়ে আদিন্যায়-এর পাঠ প্রচলন করেন।[16]

৫.

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের দর্শন চর্চার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর ছিলেন প্রধান পুরুষ। তাঁর কৃতিত্ব অতুলনীয়। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সংস্কৃত কলেজের পাঠক্রমে ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’টি যুক্ত করেন। এই গ্রন্থে ১৫টি দর্শনশাস্ত্রের সারসংক্ষেপ রয়েছে বেদান্ত দর্শনবাদে। শুরুতেই রয়েছে চার্বাক দর্শনের কথা। এই প্রথম কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠক্রমের মধ্যে চার্বাক/লোকায়ত দর্শনকে সংযুক্ত করা হল। এতদিন পর্যন্ত দর্শন চর্চায় বেদান্ত ও নব্যন্যায়ের যে একাধিপত্য ছিল, ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’কে পাঠক্রমে সংযুক্ত করে বিদ্যাসাগর তার অবসান ঘটালেন। চার্বাক দর্শন একটি বস্তুবাদী দর্শন। ভাববাদী চিন্তাবিদ ও শিক্ষকরা সযত্নে তাকে এড়িয়ে চলতেন। এবং চার্বাক/লোকায়ত দর্শনকে পাঠক্রমের বাইরে রেখে তাঁরা ছাত্রদের এই দর্শনকে জানার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করেছিলেন। বিদ্যাসাগর সেই বাধা অপসারণ করলেন এবং চার্বাক চর্চার দ্বার উন্মুক্ত করলেন।

তিনি ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’কে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করলেও এ-সংক্রান্ত সম্পাদিত বইয়ের অভাব ছিল সে-সময়ে। তাই বিদ্যাসাগর নিজেই এই গ্রন্থটির সম্পাদনার কাজ শুরু করেন। কিন্তু কাজটি মোটেই সহজ ছিল না। বিদ্যাসাগর মশাই লিখেছেন:

যখন আমি সম্পাদনার কাজটি নিই, তখন ভেবেছিলাম যে কাজটি সহজ। সে সময় কলিকাতাতে [গ্রন্থটির] দুটি পাণ্ডুলিপি ছিল— একটি সংস্কৃত কলেজের লাইব্রেরিতে এবং অন্যটি এশিয়াটিক সোসাইটিতে। প্রাথমিক পাঠের পর মনে হয়েছিল প্রথম পাণ্ডুলিপিটি বেশ সঠিক। কিন্তু প্রকাশনার লক্ষ্যে সতর্কতার সঙ্গে খুঁটিয়ে দেখতে [এশিয়াটিক] সোসাইটির পাণ্ডুলিপির সঙ্গে মিলিয়ে দেখি যে আরও পাণ্ডুলিপির সহায়তা প্রয়োজন। [কারণ] এই পাণ্ডুলিপি দুটির বহু অনুচ্ছেদ একে অপরের থেকে অমীমাংসাসাধ্যভাবে পৃথক। বাংলায় আর কোনও পাণ্ডুলিপি নেই, কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ বেনারস থেকে আরও তিনটি পাণ্ডুলিপি আমি সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম।[17]

বিদ্যাসাগর এই শেষ তিনটি পাণ্ডুলিপি পেয়েছিলেন বেনারস কলেজের মি. এডওয়ার্ড হলের কাছ থেকে।

‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’-এর লেখক হলেন মাধবাচার্য। তিনি ছিলেন চতুর্দশ শতাব্দীর বিজয়নগর রাজ্যের রাজা বুক্কাবীর=এর রাজসভার প্রধানমন্ত্রী। দার্শনিক দিক থেকে তাঁর অবস্থান শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্ত। সে-সময়ে দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত ১৬টি দর্শনের সারসক্ষেপ হল এই ‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’। গ্রন্থটির প্রথম অধ্যায়টিতে রয়েছে চার্বাক দর্শনের কথা। মাধবাচার্য গোটা বইটি লিখেছিলেন বৈদান্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। বিদ্যাসাগর বইটির শুধু সম্পাদনা করেই থামলেন না। এটি বাংলা অনুবাদেরও ব্যবস্থা করলেন। দায়িত্ব দিলেন তাঁর শিক্ষক জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চাননকে। জয়নারায়ণকে এ-কাজে সাহায্য করেছিলেন তাঁরই ছাত্র শ্রী মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন। অনুবাদটি প্রকাশিত হয় ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে।

‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’-র সম্পাদনা, প্রকাশ (১৮৫৪-৫৮) ও অনুবাদের (১৮৬৪) কাজটি নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। সেকাল ও একালেও অনেকেই মনে করেন যে বস্তুবাদ, অজ্ঞেয়বাদ, সন্দেহবাদ ইত্যাদি বিদেশি বা ইওরোপ থেকে আমদানি করা ভাবনা ও দর্শন। চার্বাক, লোকায়ত, অনাধ্যাত্মিক বস্তুবাদী চিন্তাপ্রবাহও যে ভারতীয় দর্শনচিন্তায় যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিল সে কথা প্রায় প্রথম জানা গেল বিদ্যাসাগরের এই সম্পাদনাকর্ম ও পাঠক্রমে ‘সর্বদর্শনসংগ্রহে’র সংযুক্তির মধ্যে দিয়ে। বিদ্যাসাগরের এই কাজের মধ্যে দিয়ে প্রমাণিত হল— প্রথমত, ভাববাদ ও আধ্যাত্মিকতাবাদই ভারতীয় দর্শনের একমাত্র ধারা নয়, এখানে একটি শক্তিশালী বস্তুবাদী ধারাও অস্তিত্বশীল। দ্বিতীয়ত, বস্তুবাদ মোটেই বিদেশ থেকে আমদানি করা দর্শন নয় বরং একান্তভাবেই ভারতীয়। শুধু তাই নয়, দেশীয় ও বিদেশি পণ্ডিতদের মধ্যে চার্বাক/লোকায়ত সম্বন্ধে গভীর আগ্রহের সঞ্চার ঘটাল গ্রন্থটি। বিদ্যাসাগরের এই কাজের সূত্র ধরেই পরবর্তীকালে বহু লেখক চার্বাক/লোকায়ত দর্শন সম্পর্কে প্রবন্ধ রচনা করেছেন, গবেষণা করেছেন। এই প্রসঙ্গে বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর দুই বিরাট ব্যক্তিত্বের নাম এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন— দর্শনতত্ত্ববিদ দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় এবং দার্শনিক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য।

‘সর্বদর্শনসংগ্রহ’ সম্পর্কে দার্শনিক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের সিদ্ধান্তটির উল্লেখ এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তিনি লিখেছেন:

চার্বাক দর্শনের ব্যাপারে ১৮৫৩ থেকে সায়নমাধবই সবচেয়ে পরিচিত উৎস, কিন্তু, এটি আদৌ নির্ভরযোগ্য নয়। তাঁর বিবরণের প্রথম অংশ বাদে বাকি সবই অ-লোকায়ত উৎস থেকে পাওয়া ও/বা নিজের মনগড়া। তাঁর হাতে যে মূল ‘চার্বাকসূত্র’ বা তার কোনও বৃত্তি ছিল না— একথা ঠিক। আবুল ফজল তাঁর ‘আইন-ই-আকবরী’তে পণ্ডিতদের মুখে যা শুনেছিলেন সেইটুকুই লিখেছেন। সায়নমাধবও যদি প্রচলিত ধারণাগুলিই লিখতেন, তাতে কিছু বলার ছিল না (অন্যান্য দর্শনসংগ্রহ-য় তাই করা হয়েছে)। তাতেও কিছু ভুল থাকত; কিন্তু এমন গোলমেলে অবস্থা তৈরি হত না। নিজের মতো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে চার্বাক-মতকে তিনি একই সঙ্গে অত্যন্ত খেলো জীবনদর্শন ও (অনুমান ইত্যাদির আলোচনায়) অতিমাত্রায় সূক্ষ্ম তর্কশাস্ত্র হিসেবে হাজির করেছেন। দুটি শ্লোকের পাঠ ইচ্ছেমতো বিকৃত করে তিনি যে অন্যায় করেছেন তা ক্ষমার অযোগ্য। আর সেই সঙ্গে অবান্তর পুনরুক্তি করে শুধু পাতা বাড়ানো হয়েছে। স-দ-স [সর্বদর্শনসংগ্রহ]-র প্রথম অধ্যায়টি সবচেয়ে দুর্বল ও অগোছালো।[18]

গ্রন্থটির এইসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য বিদ্যাসাগরের সম্পাদনার কাজটির গুরুত্ব উল্লেখ করতে ভোলেননি।

…লোকে— এদেশে ও বিদেশে প্রাচীন ভারতের আপসহীন নিরীশ্বরবাদী বেদবিরোধী বস্তুবাদী এই [চার্বাক] দর্শনের কথা জানতে পারলেন। তার আগে এ বিষয়ে পণ্ডিতদেরও জ্ঞান ছিল নামমাত্র…। …স-দ-স [সর্বদর্শনসংগ্রহ]-র সূত্র ধরেই পুরোদমে চার্বাকচর্চা শুরু হল। এই দায়দায়িত্ব তাই বিদ্যাসাগরের ওপরেই পরোক্ষে এসে পড়ে।[19]

৬.

বিদ্যাসাগরের কাছে এই দর্শনচর্চাটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লক্ষ করেছিলেন তাঁর সমসাময়িক সমাজের পশ্চাৎপদতা, কুসংস্কার, অন্ধত্ব, গোঁড়ামি, ধর্মের নামে চূড়ান্ত লাম্পট্য, অসততা, দুর্নীতি, অমানবিকতা, স্বার্থপরতা, মেরুদণ্ঢীনতা ইত্যাদি। আর এর সঙ্গে যুক্ত ছিল ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক শাস্ত্রীয় সমর্থন। ঊনবিংশ শতাব্দীর ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় বঙ্গসমাজে দুটি পরস্পরবিরোধী ঝোঁকের আবির্ভাব ঘটেছিল। একদিকে ঔপনিবেশিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে পাশ্চাত্যের প্রতি চূড়ান্ত অনুরাগ গড়ে ওঠে। তাদের কাছে পাশ্চাত্য সমাজ, দর্শন, জীবনযাত্রা— সবই ভালো, সবই অনুকরণযোগ্য। আর দেশীয় সকল কিছুই অনগ্রসর, ক্ষতিকর ও সেই কারণে সর্বতোভাবেই পরিত্যাজ্য। এরই বিপরীত ঝোঁকটি ছিল রক্ষণশীলতাকে আঁকড়ে ধরা। এই ঝোঁকের অনুগামীরা স্বভাবতই অতীতমুখী। তাঁরা অতীত ভারতের সকল কিছুকেই নির্বিচারে গ্রহণ করলেন। শিবনাথ শাস্ত্রী এঁদের সম্পর্কে লিখেছেন:

এক শ্রেণীর লোকের প্রকৃতিতে শ্রদ্ধার মাত্রা কিঞ্চিৎ অধিক, তাঁহারা অতীতের প্রতি এমনি শ্রদ্ধাসমন্বিত, যে বর্তমানের প্রতি যখনই তাঁহাদের অতৃপ্তি জন্মে, তখনই তাঁহারা আবেগের সহিত অতীতের দিকে যাইতে চান। তাঁহাদের চিত্ত অতীতের মধ্যেই ঘুরিয়া বেড়ায়, অতীতের চিন্তার মধ্যেই তাঁহারা বাস করিতে ভালোবাসেন।[20]

বিদ্যাসাগর এই দুই ঝোঁকেরই বিরোধী ছিলেন। পোশাকে, খাদ্যে, আচার-আচরণে তিনি ছিলেন দেশীয় ধারাবাহিকতার অনুসারী। পৈতে ও টিকি পরিত্যাগ না করলেও চিন্তায় ও কর্মে পাশ্চাত্যের সকল সদর্থক দিকগুলিকে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। আবার তাদের নেতিবাচক দিকগুলিকে ত্যাগ করতেও দ্বিধা করেননি। তিনি সমাজ সংস্কারের কাজে শাস্ত্রীয় যুক্তির সমর্থন যেমন খুঁজে বের করেছেন, তেমনই ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক শাস্ত্র ও ভাববাদী অযৌক্তিক দর্শনের বিরুদ্ধে ভারতীয় ঐতিহ্যের যুক্তিবাদ ও বস্তুবাদকে প্রকাশ করে তাদের চর্চার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন। বেদান্ত ও বেদান্ত-প্রভাবিত সকল ভাববাদী দর্শনকে ভ্রান্ত বলে চিহ্নিত করে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের গোড়ায় কুঠারাঘাত করেছেন। সে যুগে বেদান্ত দর্শনকে ভ্রান্ত বলে ঘোষণা করাটা নিঃসন্দেহে একটা বিরাট সাহসের পরিচয় ছিল। প্রমথনাথ বিশী বলেছেন:

এখন বিদ্যাসাগরের এই উক্তিটির মূল্য, গুরুত্ব ও সম্ভাবনা অসীম। … এই উক্তির গুরুত্ব শতগুণ বাড়িয়া যায় যখন স্মরণ করি যে, বিদ্যাসাগর ছিলেন দেশের সংস্কৃত চর্চার শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের শ্রেষ্ঠ পুরুষ (অধ্যক্ষ), নিজে ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বংশের সন্তান, সংস্কৃত, সাহিত্য, দর্শন প্রভৃতিতে ‘বিদ্যাসাগর’। আজকের দিনে কয়জন দায়িত্বসম্পন্ন ব্যক্তি প্রকাশ্যভাবে লিখিত আকারে মন্তব্য করিতে পারেন যে, ‘বেদান্ত ও সাংখ্য দর্শন ভ্রান্ত’? বোধকরি কেহই পারেন না, যদিও সন্দেহ করিবার যথেষ্ট কারণ আছে, মনে মনে অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি ওই দুই দর্শনকে, অন্তত বেদান্তকে ‘ভ্রান্ত দর্শন’ মনে করিয়া থাকেন। এই উক্তিটির জন্যই পণ্ডিত সমাজের গোঁড়া অংশ এখনও বিদ্যাসাগরকে ক্ষমা করিতে পারেন না। … আমার তো মনে হয়, প্রকাশ্যে বেদান্তকে ভ্রান্ত দর্শন ঘোষণা করাই দুঃসাহসী বিদ্যাসাগরের দুঃসাহসিকতম কার্য, তুলনায় বিধবা বিবাহ সমর্থন বা বহুবিবাহ প্রতিকূলতা নিতান্ত ছেলেখেলা। ঐ এক উক্তির দ্বারা ভারতের বহুযুগ সঞ্চিত সংস্কার ও অহম্মন্যতার মূলে আঘাত করিয়াছেন।[21]

প্রসঙ্গত বলা দরকার যে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ কিন্তু এই বেদান্ত নিয়েই তাঁদের জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন।

[ক্রমশ]


[1] ভট্টাচার্য, রামকৃষ্ণ। ২০১০ : ১৩।
[2] পূর্বোক্ত, ৮।
[3] ভট্টাচার্য, কৃষ্ণকমল। ১৯৯৭ : ৩৯৯।
[4] বিদ্যারত্ন, শম্ভুচন্দ্র। ২০০২ : ১৯।
[5] বি.র.স.। ১৯৭২ : ১ : ৪৫১।
[6] ‘Notes’ on the Sanskrit College. 12 April, 1852. বি.র.স.। ১৯৭২ : ১ : ৪৪৮-৯।
[7] পূর্বোক্ত: ৪৫১।
[8] পূর্বোক্ত: ৪৫১।
[9] দ্রষ্টব্য: Ballantyne. 1853; ঘোষ, বিনয়। ২০১১ : ৫২০-২৫।
[10] বি.র.স.। ১৯৭২ : ১ : ৪৫৩।
[11] বি.র.স.। ১৯৭২ : ১ : ৪৫৩।
[12] ভট্টাচার্য, রামকৃষ্ণ। ২০১১ : ১২৩।
[13] পূর্বোক্ত: ১২৫।
[14] Chattopadhyay, D. 2007 : 100.
[15] Guha. 1971 : 49.
[16] দ্রষ্টব্য: ভট্টাচার্য, রামকৃষ্ণ। ২০১১ : ১১২-১১৫।
[17] Vidyasagara. 2019 : VII.
[18] ভট্টাচার্য, রামকৃষ্ণ। ২০১০ : ২৩৫।
[19] পূর্বোক্ত: ৮।
[20] শাস্ত্রী, শিবনাথ। ২০০৮ : ২২-২৩।
[21] উদ্ধৃত ভট্টাচার্য, রামকৃষ্ণ। ২০১১ : ১০৭-৮।