![kanishka@ramkrishna](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2022/10/kanishka@ramkrishna-1.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
কণিষ্ক চৌধুরী
শিক্ষক, প্রাবন্ধিক
১৮৯১-এর ৩০ জুলাই ‘দি ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকায় আইনজীবী বিনোদবিহারী মিত্র বিদ্যাসাগর ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে একটি চিঠিতে লেখেন:
সভ্য জগৎ প্রয়াত মানুষটির [বিদ্যাসাগর] জন্য শোক করবে, তাঁর মৃত্যুতে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে তা কখনওই পূরণ হবে না, নবীন প্রবীণের কাছে চিরকালের অনুকরণযোগ্য উদাহরণ রেখে দিয়েছেন, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।[1]
গত ২ অক্টোবর ২০২২ নীলরতন সরকার হাসপাতালের অ্যানাটমি বিভাগে অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের মরদেহটি দান করে ফেরবার পর বিনোদবিহারীর কথাগুলিই বারংবার মনে হচ্ছিল। এক সমুদ্র চোখের জল আর বুকের ওপর পাষাণভার নিয়ে ফেরার পথে ভাবছিলাম আমরা বিদ্যাসাগরকে দেখিনি, কিন্তু দেখেছি রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যকে— যাঁর পথ নবীন ও প্রবীণ উভয়ের কাছেই অনুসরণযোগ্য, অনুকরণযোগ্য। যাঁরা স্বপ্ন দেখেন নতুন সমাজের, যাঁরা পুরাতন সমাজকে আমূল পালটে ফেলে নতুন সমাজ-সভ্যতার জন্ম দিতে চান, তাঁদের কাছে বিপ্লবী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য প্রেরণার অন্যতম উৎসস্থল হিসেবে কাজ করবে।
দুই.
একালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক অনুতাপহীন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী অধ্যাপক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য চলে গেলেন না-ফেরার দেশে। সময় সকাল ৮টা ৫০, রবিবার, ২ অক্টোবর ২০২২। স্থান: চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট, রাজারহাট নিউটাউন, পশ্চিমবঙ্গ। চলে গেলেন ৭৪তম বসন্তকে ছোঁয়ার আগেই। আর রেখে গেলেন সমাজব্দলের মালমশলা ও একরাশ স্বপ্ন।
১০ ডিসেম্বর ১৯৪৭ উত্তর কলকাতার মোহনলাল স্ট্রিটে তাঁর যাত্রা শুরু। মেধাবী রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য বিদ্যালয়জীবনেই শিক্ষকদের সম্ভ্রম আদায় করে নিয়েছিলেন। পড়তেন স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলে। ১৯৬৩-তে তিনি হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেন। এই পরীক্ষায় তিনি তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। যাঁরা তাঁর ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তাঁরাও একথা জানতেন না। কারণ আত্মপ্রচারবিমুখ এই মানুষটি শুধু এই কথাই নয়, নিজের কোনও কৃতিত্বের কথাই অন্যদের বলতেন না। বিদ্যালয়জীবন অতিক্রম করে বিদ্যাসাগর কলেজে ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হন। সাফল্যের সঙ্গে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়া শুরু করেন। সে সময় পড়াশুনায় ভাল ছেলেদের একাংশ মোটা মাইনের চাকরি ও বিদেশভ্রমণের স্বপ্নে যেমন মশগুল ছিল, তেমনই অপর অংশটি স্বপ্ন দেখতেন সাম্যবাদী শোষণমুক্ত সমাজের। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ছিলেন এই দ্বিতীয় দলের মানুষ। সে সময় তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, আজীবন সে মতবাদকেই পুষ্ট করেছেন, আর বিপ্লবীদের হাতে তুলে দিয়েছেন তাত্ত্বিক আয়ুধ।
চিন্তা ও কর্মের সার্থক সমন্বয় হয় রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের যৌবনকালেই। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়কালে তিনি মার্কসবাদকে জীবনদর্শন হিসেবে গ্রহণ করেই থামেননি, পাশাপাশি তাকে প্রয়োগও করেছেন সমান তালে। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন। বাম ছাত্র সংগঠন বিপিএসএফ-এর সভাপতি হিসেবে তিনি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে মতাদর্শগত সংগ্রামেও ছিলেন অগ্রণী।
১৯৬৬-র খাদ্য আন্দোলন ও ভিয়েতনাম সংহতি আন্দোলনে তিনি ছিলেন এক বিশেষ নাম। চিন্তাগত সংঘাতের কারণেই ১৯৭০-এ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ ত্যাগ করেন। এই সময় থেকেই মার্কসবাদ-লেনিনবাদের চর্চায় পুরোপুরি মগ্ন হন। আর তার ফলেই জন্ম নেয় অনন্যসাধারণ সব গ্রন্থ।
তিন.
১৯৭৭-এ আনন্দমোহন কলেজে (সিটি কলেজের নৈশ বিভাগ) অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয়। এখানে একটানা তিরিশ বছর শিক্ষকতা করেন। ১৯৮৬-তে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি পান। ২০০৭-এর ডিসেম্বর মাসে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। অবসর গ্রহণের পরবর্তীকালেও দীর্ঘদিন শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘আর্টস অ্যান্ড কমার্স’ কলেজের স্নাতকোত্তর বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকেন কয়েক বছর। ২০০৯ থেকে ২০১০— এই পর্বে ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ ফিলজফিকাল রিসার্চ’-এর ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। এছাড়াও ইউজিসি-র ‘এমেরিটাস ফেলো’ হিসেবে সম্মানিত হয়েছিলেন। শিক্ষক হিসেবে তাঁর ভূমিকা কারও থেকে কিছু কম নয়। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছাত্রছাত্রীরা তাঁর শিক্ষকতার অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ধনী হয়েছেন। বিস্মিত হয়েছেন। এ যুগে তাঁর মতো শিক্ষক দুর্লভ।
চার.
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য এ যুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। তাঁকে ‘দার্শনিক’ বলে প্রথম যিনি চিহ্নিত করেন তিনি হলেন সুকুমারী ভট্টাচার্য (১৯২১-২০১৪)। জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য রীতিমতো বিস্ময়ের। সাহিত্যতত্ত্ব, মার্কসবাদ, নন্দনতত্ত্ব, ভারতীয় দর্শন, জ্যামিতি, বিজ্ঞান চেতনা ও যুক্তিবাদী বিদ্যাচর্চায় তাঁর রচনাগুলি এক বিরাট সম্পদ। এত পাণ্ডিত্য থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির পিছনে কোনও দিন হাঁটেননি। বরং সেদিক থেকে তিনি মুখ ফিরিয়েই রেখেছিলেন। সরকারি স্বীকৃতি ও প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সমর্থক প্রাতিষ্ঠানিক পত্র-পত্রিকাগুলির থেকে বরাবরই নিজেকে সরিয়ে রাখতেন। তাঁর রচনা মূলত প্রকাশিত হত লিটল ম্যাগাজিনগুলিতে। গভীর ও উচ্চমানের প্রবন্ধ ও গবেষণা যে এই পত্রিকাগুলিতে প্রকাশ সম্ভব— তা তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন লিটল ম্যাগাজিনের অহঙ্কার।
এ-পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর বইয়ের সংখ্যা ৩৯। প্রায় দ্বিশতাধিক গবেষণাপত্র প্রকাশ পেয়েছে নানা দেশি-বিদেশি পত্রিকায়। পাণ্ডিত্য অনেক সময় অহঙ্কার ও অনমনীয়তার জন্ম দেয়। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ছিলেন এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি সহজেই অন্য মানুষের সঙ্গে মিশতে পারতেন, এমনকি ভিন্নমতের হলেও। কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গেও ছিল সহজ সম্পর্ক। আশ্চর্য সুন্দর এক ধরনের নমনীয়তা ছিল তাঁর মধ্যে। তাঁদের জন্য দুঃখ হয় যাঁরা তাঁর এই পাণ্ডিত্য ও নমনীয়তার স্বাদ পেলেন না। দুঃখ হয় তাঁদের জন্যেও যাঁরা দার্শনিক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে অন্য আর এক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যকে গুলিয়ে ফেলেন বা গুলিয়ে দিতে চান— ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে।
তাঁর গবেষণা নানা দিগন্তে বিস্তৃত। সাহিত্যতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞানের ইতিহাস, ইতিহাসের দর্শন, বস্তুবাদ, মার্কসবাদ, বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদানের কথা ভোলা সম্ভব নয়। পলিমিকসেও তিনি ছিলেন সমান দক্ষ। ফলে বেশ কিছু শত্রুও জুটেছিল জীবদ্দশাতেই। সেইসব বামন, অর্ধশিক্ষিতের দল নানা সময়ে দার্শনিক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যকে কামড় দিতে চেষ্টা করেছেন। যদিও তাতে তাঁর কিছুই যায়-আসেনি। সারাজীবন মেরুদণ্ড টানটান করে হেঁটেছেন। শাসকের কাছে মাথা নত করেননি। আমরা বিদ্যাসাগর মশাইকে দেখিনি ঠিকই, কিন্তু রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যকে দেখেছি। এটাই আমাদের লাভের লাভ।
[1] মিত্র, উদয়ন। ২০১৬ : ৫২।