Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘মেফিস্টো’– নেভার এগেইন! কখনও নয়!– এক প্রতিক্রিয়া, এক উপলব্ধির সফর

‘মেফিস্টো’– নেভার এগেইন! কখনও নয়!– এক প্রতিক্রিয়া, এক উপলব্ধির সফর -- অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 

নেভার এগেইন! কখনও নয়!

 

নাটক শুরুর আগে, মঞ্চের উপরে বিশাল এক সাদা পর্দাতে তীক্ষ্ণ বল্লমে বেঁধানো একটি মোরগের মৃতদেহের তলায় জার্মান যে শব্দদুটি লেখা ছিল – তাদের বাংলা তর্জমা করলে এইটিই দাঁড়ায়, “কখনও নয়” – নেভার এগেইন! এই নাটকের এর চেয়ে বড় সারমর্ম হয় না।

 

নাটক দেখি কেন ? এর উত্তর হচ্ছে সমকালকে অনুভব করব বলে। সমকালকে অনুভব করতে গেলে হয় তাতে আদ্যোপান্ত সওয়ার হতে হয়, নতুবা যাঁরা শিল্পী (সার্থক শিল্পী) – তাঁদের কাজের ভিতরে সেই সমকালকে খুঁজে নিতে হয়। একজন সার্থক শিল্পী সমকালের নিবন্ধক হিসেবে কাজ করেন। সেই সমকালের বার্তাকে চিরন্তন করে তুলতে সচেষ্ট হন। চিরন্তন হল কি হল না, সেটাও তাঁদের দেখবার বিষয় নয় – কেবল সত্যের প্রতি নিষ্ঠ থাকাটাই, এবং সেই সত্যকে ভয়শূন্য চিত্তে সমাজের আর পাঁচজন গড়পড়তা মানুষ এবং শাসকের সামনে নগ্নভাবে উন্মোচিত করাটাই একজন শিল্পীর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যে কারণেই বোধহয় ‘মেফিস্টো’র হেনরিক কোনওদিন শিল্পী হয়ে উঠতে পারল না। অভিনেতা হতে চাওয়ার জন্য যে প্রাণপণ আকুতি ছিল তার, সেই আকুতি আসলে হেরে গিয়েছিল তার শঠতার কাছে – সত্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তার মিথ্যাচারের কাছে, তার চূড়ান্ত আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার কাছে। নোবেলজয়ী সাহিত্যিক থমাস মানের পুত্র, ক্লাউস মানের সুবিখ্যাত উপন্যাস – ‘মেফিস্টো’ – নিম্নচাপের বৃষ্টিতে যেদিন শহরে তুমুল জল, সেদিনও কোনওভাবে রবীন্দ্র সদনে পৌঁছিয়েছিলাম – এই ‘মেফিস্টো’কেই উপভোগ করব বলে। এই নাটক যে এক ইতিহাসকে ফিরে দেখার সফর, যে ইতিহাস বর্তমানকে মনে পড়ায়।

 

নাটক শুরুর আগে নির্দেশক/পরিচালক সুমন মুখোপাধ্যায় মঞ্চে দাঁড়িয়ে সরাসরিই বলে দিলেন, “এই নাটক স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে। যে স্বৈরতন্ত্র আজ আমাদের দেশে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে, সেই স্বৈরতন্ত্রকে মানুষের লড়াইয়ের মাধ্যমে খানিকটা থামানো গিয়েছে ঠিকই, কিন্তু কেবল এই থামানোতেই তো চলবে না – তাকে সরাতে হবে। সেই সরানোর প্রচেষ্টাতেই এই নাটক।” আসলে সার্থক শিল্পের প্রকাশ যে রাষ্ট্রের ভ্রুকুটি-কুটিল চক্ষুকে উপেক্ষা করেই। এরপর নাটকের বাকি ২ ঘণ্টা ৫০ মিনিট সময় যে কোথা দিয়ে কেটে গিয়েছিল দর্শক তা বুঝেও উঠতে পারেনি।

চেতনা, তৃতীয় সূত্র ও মুখোমুখি – এই তিনটি দলের যৌথ প্রযোজনার ফসল ‘মেফিস্টো’। অভিনয়, মঞ্চ-নির্মাণ, পোশাক, আবহ – সমস্ত বিষয়েই সর্বতোভাবে সফল এই নাটক। এখন প্রথমেই যে বিষয়টাকে দিয়ে শুরু করব, অপেশাদার নাটকের মঞ্চে যান্ত্রিক কলাকৌশল কতদূর অবধি ব্যবহার করা হবে সেই নিয়ে কিঞ্চিৎ দ্বিধাদ্বন্দ্ব থেকেই যায়। বিশেষ করে নাট্যমঞ্চে প্রোজেক্টরের ব্যবহার অনেক সময়ই কাঁচা হাতের কাজ হওয়ার দরুণ, আরোপিত নয়তো বড্ড চড়া দাগের বলে মনে হয়। কিন্তু এই নাটকে সেই প্রোজেকশনের ব্যবহারকে আক্ষরিক অর্থেই এক শৈল্পিক উচ্চতায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। শুরু হওয়ার সময় সাদা পর্দাতে প্রোজেকশনের মাধ্যমে সেই বল্লমে বিঁধে থাকা মোরগটির দেহ মিলিয়ে যায়। সাদা দৃশ্যপট বেয়ে চুঁইয়ে আসে গাঢ় লাল রক্তস্রোত। যুগে যুগে স্বৈরতন্ত্রের হাতে প্রাণ হারানো মানুষের সেই রক্তস্রোত। তারই পিছনে আলো জ্বলে ওঠে, ছায়ার কেরামতিতে অনেক মানুষকে পর্দার পিছন থেকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। যেন বা যুগ যুগান্তের সাধারণ মানুষের মিছিল। ক্রমশ তাদের ছায়ার চেহারাগুলিই বিপুল থেকে বিপুলতর হয়ে উঠতে থাকে। আলো কমে আসে, পর্দা উঠে যায়। ছায়া থেকেই যেন বা মানুষ হয়ে উঠে কলাকুশলীরা মঞ্চের উপরে চলে আসেন। নাটক শুরু হয়।

 

এই নাটক ইতিহাসকে ফিরে দেখার নাটক। এই নাটকের সূত্রপাত ১৯২৩-এ, যেদিন ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট পার্টির কর্মী হিটলারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তখনও হিটলার, হিটলার হয়ে উঠতে পারেনি। হামবুর্গ শহরের সরকারি নাট্যশালাতে তখন বামমনস্ক একেকটি নাটক মঞ্চস্থ করা হচ্ছে। জার্মানিতে তখনও অবধি সেভাবে দানা বেঁধে উঠতে না পারা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আগে থেকেই নিজেদেরকে শক্তিশালী করে তোলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে কম্যুনিস্ট মনোভাবাপন্ন মানুষদের। কিন্তু সেই মানুষদেরও কারও কারও মধ্যে যেন একটা সুপ্ত উন্নাসিকতা কাজ করে। যেমন কিনা হেনরিক। সেই উন্নাসিকতাই ক্রমশ পরিণত হবে আত্মকেন্দ্রিকতায়। আদর্শ হয়ে উঠবে তাদের কাছে কেবলই খেলনাবস্তুমাত্র। একদিকে অসংগঠিত, বেকার ও নিরাশায় পরিপূর্ণ দেশের এক বৃহত্তর যুবশক্তিকে ক্রমশ এক শক্তিশালী রাষ্ট্র ও ভবিষ্যতের মেকি স্বপ্ন দেখিয়ে নাৎসি পার্টির ক্ষমতায় উঠে আসার ইতিহাস, অন্যদিকে বিরোধী ও বিশেষত বামমনস্ক, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বিরুদ্ধে তীব্র মিথ্যে প্রচার – অস্ত্রব্যবসায়ীদের টাকায় হিটলারের উত্থান ঘটেছিল এভাবেই। এই নাটক ইতিহাসকে ফিরে দেখার নাটক। এই নাটক তাই বর্তমানকে মনে পড়ায়।

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যে কতখানি সুস্পষ্ট, কতখানি সহজ – তাকে বুঝে নিতে হলে আরও একবার পূর্বের অনুচ্ছেদটিকে পড়ে দেখুন। হেনরিক সেই সময়ে দাঁড়িয়ে, ক্রমশ আজকের কিছু চাটুকারেদের মতোই ধীরে ধীরে হামবুর্গ শহর থেকে বার্লিনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমিয়েছে। ফেলে গিয়েছে তার স্ত্রী এরিকা (উপন্যাসে যার নাম ছিল বারবারা; কিন্তু এখানে মনে রাখতে হবে – বাস্তবে সাহিত্যিক থমাস মানেরও কন্যার নাম ছিল এরিকা – এবং অনেকেই মনে করেন, এই এরিকারই অনুপ্রেরণায় ক্লাউস মান বারবারা চরিত্রটিকে সৃষ্টি করেছিলেন), নাচের শিক্ষিকা জুলিয়েট, অথবা বন্ধু অটো হানস(মূল উপন্যাসে যার পদবী ছিল উলরিখ)কেও। আত্মসর্বস্ব, ভোগী হয়ে উঠতে উঠতে সিঁড়ির একেবারে শেষ ধাপটিতে পৌঁছিয়ে হেনরিক যখন দেখবে তার চারপাশের অন্ধকারটুকু কেমন রাতের চেয়েও বেশি, অনেক বেশি গভীর হয়ে এসেছে, তখন তার আর কোনওকিছুই করার থাকবে না। যে অন্ধকারকে আসলে ঔপন্যাসিক তার উপন্যাসে দেখাতে চেয়েছেন, যে গল্পকে আসলে নাট্যকার এই নাটকে তুলে ধরতে চেয়েছেন – তা হল, মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় আসলে এক বহুল বিস্তৃত সম্প্রদায়। আদর্শে উজ্জীবিত মানুষের সংখ্যা এই পৃথিবীতে সব সময়েই কম। হয়তো বা মধ্যবিত্তে আরওই তা কমে আসে, তার কারণ মধ্যবিত্ত সমাজে প্রাথমিকভাবে নূন্যতম সামাজিক ও আর্থিক নিরাপত্তাটুকুকেই বড্ড বেশি করে গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। সেই থেকেই একেকজন মধ্যবিত্তের আত্মকেন্দ্রিকতা কখন যে স্বার্থপরতা হয়ে ওঠে, আমরা ঠাহর করতে পারি না। অপরপক্ষে দাঁড়িয়ে অসংগঠিত যুবসমাজকে সর্বদাই একেকটা হুজুগে মাতিয়ে তোলার, নাচিয়ে তোলার চেষ্টা করে চলে ক্ষমতাসীন মানুষেরা। যৌবনের উচ্ছাসকে চিন্তাশক্তির বদলে পেশীশক্তি ও পশুশক্তির দিকে তাদের অজান্তেই তারা চালিত করে দেয়। তৈরী হয় সহস্র সহস্র সেনানীর ভক্তকুল। স্বৈরতন্ত্রের মিনারের উপরে দাঁড়িয়ে, পরে যখন সেই নেতারাই এই যুবশক্তিকে পায়ের ভৃত্য হিসেবে ব্যবহার করে, অথবা মুখ মুছে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে দেয় পুরনো রুমালের মতোই – ততদিনে এই ভক্তকুলের মানসিক শক্তি বিনষ্ট হয়েছে। তারা কেবল ধুঁকতে পারে আর গজরাতে পারে কেবল। সত্যিকারের এই গল্পই উঠে এসেছে ক্লাউস মানের উপন্যাসে। এই গল্পই আজ সত্যি হয়ে দাঁড়িয়েছে ২০২১-এর ভারতবর্ষে। এই নাটক তাই সময়ের দলিল হয়ে থাকবে।

 

এই নাটকে আরেকটি জায়গা গুরুত্বপূর্ণ। জার্মানির আদর্শবান, বুদ্ধিমান মধ্যবিত্তদের একটা ধারণাই ছিল যে তাদের দেশে কোনওদিনই ফ্যাসিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। একই ভুল আমরা করেছি আমাদের দেশের ক্ষেত্রে। আমরা কোনওদিনও ভাবিনি, গুজরাতের গণহত্যার নায়ককে আমরা একদিন দেশের মসনদে বসাব। ভোটবাক্সে ভরে উঠবে তার প্রতিপত্তি। ফ্যাসিবাদকে কখনও লঘু ভাবতে নেই। ইতিহাস আমাদেরকে শিখিয়েছে। বর্তমান আমাদেরকে শেখাচ্ছে; আর এত বেশি করে যে প্রাসঙ্গিক সময়ের কথা চলে আসছে, এটাই বুঝিয়ে দিচ্ছে এই নাটকের সমকালীন গুরুত্বকে। অনেকদিন ধরেই আমরা বোধহয় এমনই একটি নাটকের প্রতীক্ষায় ছিলাম।

নেভার এগেইন! কখনও নয়!

 

অভিনেতাদের অভিনয় নিয়ে আলাদা করে কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। অনির্বাণ ভট্টাচার্য, অনির্বাণ চক্রবর্তী, সুজন মুখোপাধ্যায়, পৌলমী চট্টোপাধ্যায়, অর্ণ মুখোপাধ্যায়, অঙ্কিতা মাঝি, দেবলীনা দত্ত – এঁরা প্রত্যেকে যেন নিজেরা নিজেদেরকে ছাপিয়ে গিয়ে অভিনয় করেছেন; আর ইতিপূর্বে যাঁরা ‘নটধা’র ‘অথৈ’ নাটকটি দেখেছেন, তাঁরা জানবেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য এবং অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের বোঝাপড়ার গল্প। এই নাটকেও সেই দুজনেরই যুগলবন্দির পাশাপাশি তিন নম্বরে যোগ দিয়েছেন অনির্বাণ চক্রবর্তী। এই ট্রায়ো’র যে মেলবন্ধন তাকে আলাদা করে উল্লেখ করতেই হত। ‘মেফিস্টো’র চরিত্রে অনির্বাণ (ভট্টাচার্য), তাঁর সমস্ত শরীরটুকুকে নিংড়ে দিয়ে অভিনয় করেছেন। হেনরিকের ‘মেফিস্টো’ হয়ে ওঠার এই দীর্ঘ, তীক্ষ্ণ যাত্রাপথকে বোধহয় একমাত্র তাঁর পক্ষেই ফোটানো সম্ভব ছিল। এদিকে আমরা তখন, কেমন করে জানি এক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সুমুখেতে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। আলোকসম্পাত ও আলোকপ্রক্ষেপণ …

 

আলোর এক অদ্ভুত কারসাজিতে রবীন্দ্র সদনের মঞ্চে তখন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের ইতিহাস। সারি বেঁধে চলে যাওয়া মালগাড়ির কামরাগুলি থেকে ভেসে আসছে অসহ্য চিৎকার। নাম বলতে চাইছে সেই মানুষগুলো, ঠিকানাটুকুকে জানিয়ে দিয়ে যেতে চাইছে। যে ঠিকানায় আর কোনওদিনও ফেরা হবে না তাদের। ফ্যাসিবাদের নগ্নতা বড় নির্জন, বড় ভয়াবহ, বড় নৃশংস। সেই নৃশংসতাকে কেবল বইতে পড়ে উপলব্ধি করা চলে না। চোখের সামনে সেই নগ্নতাকে জোরের সঙ্গে উন্মোচিত করে দিতে হয়। তাই ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’, তাই ‘জোজো র‍্যাবিট’ – অথবা, তাই ‘মেফিস্টো’র নাট্যায়ন। আমাদের দায়িত্ব বর্তিয়েছে দেশের মানুষকে এই নগ্নতার সামনে এনে দাঁড় করানোর। তাই দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের নাটক, ‘একদিন মন্দিরে যাওয়ার পথে’, তাই ঋতব্রত ভট্টাচার্যের নাটক ‘দেশের নামে’, তাই জয়রাজ ভট্টাচার্যের ‘তিতুমীর’। তাই ‘মেফিস্টো’। কলকাতাবাসী হিসেবে আমাদের গর্ব হওয়া উচিত যে এই সমস্ত নাটক ক্ষমতাসীন ফ্যাসিস্ত শক্তিকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। যে কারণে ‘দেশের নামে’র প্রযোজনা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য চাপ আসছে। যে কারণে বাঙালি ফ্যাসিস্ত শক্তিকে পরাস্ত করতে পেরেছে। আমাদের এই প্রত্যেকটি নাটক দেখা উচিত। এই প্রত্যেকটি নাটক কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, যেন প্রতিবাদের মাধ্যম হয়ে ওঠে সেই কাজে আমাদের সচেষ্ট হওয়া উচিত। তাই আমরা লিখব, পোর্টালে পোর্টালে লিখব, সামাজিক মাধ্যমে বার্তা ছড়াব – ফ্যাসিস্ত শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। নাগরিক হিসেবে এই দায়িত্ব আমাদের। …

তাই ‘মেফিস্টো’র শেষ দৃশ্যে আবারও প্রোজেকশন। সারা পৃথিবীর ইতিহাসে ফ্যাসিস্তদের বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের ইতিহাস – একে একে মূর্ত হয়ে ফুটে উঠেছে সাদা পর্দার উপর। কখনও বা এবড়োখেবড়ো পথ ভেঙে দীর্ঘ লাঠিটি কাঁধে নিয়ে দৃপ্ত পদক্ষেপে হেঁটে চলেছেন গান্ধীমহারাজ, কখনও বা টেবলে শোয়ানো গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া চে গ্যেভারার মরদেহের ছবি – চারপাশে সিআইএ-এর চরেরা দাঁড়িয়ে (হায়নার মতোই), কখনও বা কলকাতার কাগজে চারু মজুমদারের গ্রেপ্তারের খবর, কখনও বা দিল্লির কৃষক বিক্ষোভ – চার্লি চ্যাপলিনের সেই মহান উদ্ধৃতিটিকে মনে পড়ে যাচ্ছিল, “সো লং এ্যাজ মেন ডাই, লিবার্টি ক্যান নেভার পেরিশ” – “যতদিন অবধি মানুষ (আদর্শের জন্য) মৃত্যুবরণ করবে, ততদিন অবধি মুক্তির কোনও মৃত্যু নেই!” একে একে পর্দায় সমস্ত নাম ভেসে উঠছিল। সফদর হাসমি, অভিজিৎ রায়, গৌরী লঙ্কেশ, রোহিত ভেমুলা, নরেন্দ্র দাভোলকর … ও আরও অনেকে। প্রেক্ষাগৃহের প্রতিটি হৃদয়কে স্পর্শ করে তখন গমগম করে বেজে উঠেছিল ‘বেলা সিয়াও’ – গলা মিলিয়ে, সহর্ষ করতালিতে তখন আমরাও, কখন যেন একসুরে সকলে মিলে গেয়ে উঠেছিলাম,

 

“জব তক হ্যায় বাকি – সিনে মে দম,

গায়েঙ্গে এ্যায় জালিম, ওয়াপস যাও যাও যাও!

ফির লেহরায়েগি, লাল গগন মে,

তেরে ইরাদোঁ কি রাখ, ওয়াপস যাও!”

 

বৃষ্টিতে চারিদিক ভেসে যাচ্ছিল। নাটক শেষে একাডেমির সামনে দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে কখন যেন মনে হচ্ছিল যে, দর্শক হিসেবে আমাদেরও গর্বের অধিকার আছে, কলমচি হিসেবে আমাদেরও গর্বের অধিকার আছে – এবং গর্বের অধিকার আছে এই শহরের বাসিন্দা হিসেবে, যারা কিনা সামান্য দর্শক হিসেবে নাটক দেখতে এসেও ফ্যাসিস্তদের বিরুদ্ধে শ্লোগান তোলার ক্ষমতা রাখে। এই শহরে মঞ্চস্থ হয় ‘মানুষ’ (নান্দীকার), ‘দেশের নামে’ (অশোকনগর নাট্যআনন), অথবা ‘মেফিস্টো’! এই শহর তাই ফ্যাসিস্তদের চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে জানে। এই শহর তাই আর সব শহরের চেয়ে আলাদা।

 

অনেক দূর থেকে তখনও যেন গান ভেসে আসছিল,

 

“হম টকরাতে তুমে, ওয়াপস যাও যাও যাও – বুলন্দ আওয়াজেঁ, শুনকর ও কাঁপে – মিলকর চিল্লাও, ওয়াপস যাও যাও যাও!” … ‘মেফিস্টো’র রেশ থেকে গিয়েছে।