Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সেই চাঁদের পাহাড়

সেই চাঁদের পাহাড় [৩] -- অয়নেশ দাস

অয়নেশ দাস

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

লুআলাবা থেকে দিওগো সাও-এর লাইমস্টোন স্তম্ভ

উৎস থেকে মোহনা— কঙ্গোর প্রতিটি স্রোতধারায় যেন অপার রহস্য মিশে ছিল। যদিও বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’-এ কঙ্গোর উল্লেখ ছিল সংক্ষিপ্ত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। কিসুমু থেকে স্টিমারে লেক ভিক্টোরিয়া পার করে মোয়ানজা-তে নেমে সেখান থেকে তিনশো মাইল দূরে ট্যাবোরায় পৌঁছে সেখানে কিছুদিন বিশ্রাম নিয়েছিল আলভারেজ ও শঙ্কর। তারপর তারা পৌঁছবে লেক টাঙ্গানিকার উজিজি বন্দরে। সেই উজিজি বন্দর। যেখানে স্ট্যানলি নিউ ইয়র্ক হেরাল্ডের হয়ে আবিষ্কার করেছিল ডঃ লিভিংস্টোনের সর্বশেষ অবস্থান। এখান থেকেই স্ট্যানলি-লিভিংস্টোনের যৌথ লুআলাবা অভিযান। তারপর লিভিংস্টোনের মৃত্যু ও সবশেষে স্ট্যানলির একক কঙ্গো অভিযান। এই সবকটি ঘটনার সঙ্গেই জুড়ে থেকেছে লেক টাঙ্গানিকা ও তার তীরের উজিজি নামের বন্দরটি।

দিন পনেরো পরে শঙ্কর ও আলভারেজ উজিজি বন্দর থেকে স্টীমারে টাঙ্গানিয়াকা হ্রদে ভাসল। হ্রদ পার হয়ে আলবার্টভিল বলে একটা ছোট শহরে কিছু আবশ্যকীয় জিনিস কিনে নিল। এই শহর থেকে কাবালো পর্যন্ত বেলজিয়ম গভর্ণমেন্টের রেলপথ আছে। সেখান থেকে কঙ্গোনদীতে স্টীমার চড়ে তিনদিনের পথ সানকিনি যেতে হবে, সানকিনিতে নেমে কঙ্গোনদীর পথ ছেড়ে, দক্ষিণ মুখে অজ্ঞাত বনজঙ্গল ও মরুভূমির দেশে প্রবেশ করতে হবে।

–চাঁদের পাহাড়, পৃঃ ৮০-৮১

শঙ্করদের অভিযান যখন চলছিল, কঙ্গো ফ্রি স্টেট ততদিনে বেলজিয়ান কঙ্গো। লিওপোল্ডকে বিক্রি করে দিতে হয়েছে নিজের উপনিবেশ। সে কথায় পরে আসছি। কিন্তু যে স্টিমারে ভেসে তারা তিনদিনের কঙ্গো-পথ পাড়ি দিতে পেরেছিল তার যাবতীয় কৃতিত্বের স্বত্ত্বাধিকারী কিন্তু হেনরি মর্টন স্ট্যানলি-ই। স্ট্যানলির কঙ্গো বিজয়ের হাত ধরে হয়েছিল আরও কিছু রহস্যভেদ। হয়েছিল যুগ যুগ ধরে জমতে থাকা তিন তিনটি মহারহস্যের উদ্ঘাটন।

কঙ্গো নদীতে স্টিমার যাত্রা। ১৮৯১ সালে প্রকাশিত উড এনগ্রেভিং

সে অনেকদিনের কথা। পঞ্চদশ শতাব্দী। ইউরোপীয় দেশগুলির সমুদ্রশাসনের উষালগ্ন তখন। লিসবনের জাহাজ-কারিগরেরা ১৪৪০ সালে বানাল ‘কারাভেল’— ছোটখাটো অথচ ভীষণ শক্তপোক্ত এক সমুদ্রজাহাজ, যা সামুদ্রিক ঝঞ্ঝায় ভেসে চলার পক্ষে বিশেষভাবে উপযোগী। মাত্র একশো ফুট দৈর্ঘ্যে হলে কী হবে, এই কারাভেলগুলিতেই সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের ঢল। সাম্রাজ্য ও উপনিবেশের ইতিহাসে কারাভেলের উদ্ভাবন একটি বিশেষ মাইলফলক। এই কারাভেল নিয়েই পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলি, বিশেষ করে পর্তুগাল, সেই সময়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল ইউরোপের দক্ষিণে— আফ্রিকার পাড় ধরে— আরও গভীরে। সে উন্মাদনার নেপথ্যে ক্রিয়াশীল ছিল ইউরোপের অনন্ত ঐশ্বর্য-আকাঙ্খাই শুধু নয়, নীলনদের উৎস সন্ধান-ও, যা সেই পুরাকাল থেকে ইউরোপের মস্তিষ্ক অক্ষয় কীটের মতো কুরে খেয়েছে।

১৪৮২-তে পশ্চিম আফ্রিকার তীর বরাবর এইরকমই দক্ষিণমুখী এক উচ্চাকাঙ্খী নৌ-যাত্রায় বেরিয়ে কাপ্তান দিওগো সাও একদিন হঠাৎই আকাশ থেকে ধ্রুবতারা অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখলেন; তিনি বুঝলেন তাঁর কারাভেল এই প্রথম কোনও ইউরোপীয় জাহাজ হিসেবে বিষুবরেখা পার করল। প্রবল উৎসাহে আরও দক্ষিণে এগিয়ে তিনি এক অদ্ভুত ব্যাপার দেখলেন। হঠাৎই তাঁর আশেপাশের নীল সমুদ্র ক্রমশ কালচে, খয়েরি-হলুদ ঢেউয়ে ভরে উঠছিল। তীরবরাবর বহু মাইল বিস্তৃত যে খাঁড়িমুখ থেকে এই বিপুল জলরাশি বেরিয়ে আসছিল, সেদিকে জাহাজ চালিয়ে সাও দেখলেন যে তাঁকে প্রায় আট-নয় নট স্রোতের সঙ্গে যুঝতে হচ্ছে।[1] আরও আশ্চর্য হয়ে তাঁরা লক্ষ করলেন, এই পলিমিশ্রিত জলের স্বাদ মিষ্টি, লবণাক্ত নয়। এক প্রকাণ্ডকায় দৈত্যাকার নদীর মোহনায় শুকনো পাতার টুকরোর মতো নোঙ্গর ফেলল দিওগো সাওয়ের পর্তুগীজ কারাভেল। এত বিশালকায় নদী তাঁর আগে কোনও ইউরোপীয়র ভাগ্যে দেখার সুযোগ ঘটেনি। এই জলধারাই পরের সাড়ে পাঁচশো বছরের ইতিহাসে পরিচিত হবে কঙ্গো নামে। মোহনার মুখে সাও একটি লাইমস্টোনের স্তম্ভ খাড়া করলেন। তাতে লেখা হল—

ইন দ্য ইয়ার ৬৬৮১ অব দ্য ওয়র্ল্ড অ্যান্ড ইন দ্যাট অব ১৪৮২ সিন্স দ্য বার্থ অব আওয়ার লর্ড জেসাস ক্রাইস্ট, দ্য মোস্ট সিরিন, দ্য মোস্ট এক্সেলেন্ট অ্যান্ড পোটেন্ট প্রিন্স, কিং যোয়াও টু অব পোর্তুগাল ডিড অর্ডার দিস ল্যান্ড টু বি ডিসকভার্ড অ্যান্ড দিস পিলার অব স্টোন টু বি ইরেক্টেড বাই দিওগো সাও, অ্যান এস্কোয়ার ইন হিজ় হাউসহোল্ড।

মধ্য আফ্রিকার মাটিতে সেই প্রথম ইউরোপিয়ান সাম্রাজ্যের পতাকা উত্তোলন। ইউরোপীয় সভ্যতার প্রথম দংশনও বলা যেতে পারে তাকে। মধ্য আফ্রিকা থেকে ট্রান্স আটলান্টিক দাসব্যবসারও শুরুয়াতের ল্যান্ডমার্ক এই কঙ্গোর মোহনায় সাও-এর লাইমস্টোন পিলার। একই সঙ্গে সেই মহারহস্য তিনটিও জমতে শুরু করল কঙ্গো নামের নদীটিকে ঘিরে, যার দুটির জন্য সভ্যতাকে অপেক্ষা করতে হবে ১৮৭৭ সালের স্ট্যানলির অভিযান পর্যন্ত। অন্যটির জন্য তারও পরে আরো দুই দশক। সাও-এর কারাভেল নোঙর ফেলার মুহূর্তটি থেকে আফ্রিকার মাটিতে আধুনিক ইউরোপীয় পুঁজির সরাসরি ঔপনিবেশিক দখলদারিকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল প্রায় চারশো বছর। ততদিন পর্যন্ত আফ্রিকা ছিল শুধুমাত্র অফুরন্ত কৃষ্ণকায় মানবশরীর ও হাতির দাঁত সরবরাহের এক অজানা অচেনা অন্ধকার কাদামাটির উৎস-মহাদেশ। অতএব, থ্রু দ্য ডার্ক কন্টিনেন্ট…

কঙ্গো ধরে ‘লেডি অ্যালিস’[2]-এ চড়ে স্ট্যানলির দুর্ধর্ষ অভিযান— সে অভিযানে স্ট্যানলি শুধু কি একজন সাধারণ অভিযাত্রী ছিল? তার দুই সন্ধানী চোখ যেন এক চৌখস জরিপওয়ালার চোখ দিয়ে তন্ন তন্ন করে মেপে নিয়েছিল কঙ্গো ঘিরে যাবতীয় মানচিত্র। ছিন্ন করে ফেলছিল সব অজানা রহস্যের মায়াজাল। প্রথমটির ক্ষেত্রে— লিভিংস্টোন ভুল ছিলেন। লুআলাবা নীলনদের নয়, উৎস ছিল কঙ্গোর। লিভিংস্টোন যতটা দেখেছিলেন, লুআলাবা ছিল উত্তরবাহিনী। ফলে তিনি ভেবেছিলেন এই হয়ত নীলের উৎস। কিন্তু স্ট্যানলির সন্দেহ ছিল এই বিশাল জলধারা নীলের উৎস হতে পারে না। একবার তার মনে হয়েছিল এটা বুঝি নাইজার। কিন্তু কিছুদূর এগিয়ে স্ট্যানলির আবিষ্কারে এল সেই রহস্যঘেরা একশো আশি ডিগ্রি লুআলাবার বাঁক। তারপর আর সন্দেহ ছিল না, যে লুআলাবাই কঙ্গো।

একই সঙ্গে হয়েছিল দ্বিতীয় রহস্যভেদ। দিওগো সাও-এর কারাভেল যে মুহূর্তটিতে ভেসে এসে ভিড়েছিল কঙ্গোর মোহনায়, সেই মুহূর্তটি থেকেই ইউরোপীয়দের স্তম্ভিত করে রেখেছিল কঙ্গোর বিপুল জলরাশি। প্রকাণ্ডকায় এই নদী থেকে প্রতি সেকেন্ডে আটলান্টিকে মিশে যায় প্রায় ১.৪ মিলিয়ন কিউবিক ফিট জল। এবং… এক অসামান্য রহস্য জমে উঠল যখন দেখা গেল সে জলের পরিমাণে সারা বছরে বিশেষ কিছুই তারতম্য হয় না। সে এক আশ্চর্য। এইখানেই কঙ্গো বাকি তাবৎ মহান ক্রান্তীয় নদীদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। গঙ্গা এমনকি আমাজ়নেও বর্ষা ঋতুতে যে পরিমাণ জল বাহিত হয়, শুষ্ক ঋতুগুলিতে তার পরিমাণ অনেকটাই কমে আসে। কঙ্গোর ক্ষেত্রে কীভাবে বজায় থাকে সারা বছর ধরে তারতম্যহীন এক বিপুল জলরাশি বহনের ক্ষমতা? চারশো বছর অপেক্ষা করার পর জানা গেল সে প্রশ্নের উত্তর। কঙ্গোর উৎস এবং মোহনা দুই-ই বিষুবরেখার দক্ষিণে; কিন্তু কঙ্গোর সেই দৈত্যাকার উপবৃত্তাকার বাঁকটির উপরের অংশটি থেকে যায় বিষুবরেখার উত্তরে। ফলে সারা বছরই দুই দিক থেকেই বর্ষার জলে সুপুষ্ট থেকে যায় কঙ্গো।

একই সঙ্গে তীব্র হয়ে ওঠে আরেকটি জমে ওঠা রহস্যভেদের স্পৃহা। যে নদীর এই বিপুল শক্তি, যার অ্যাল্যুভিয়াল কন্টেন্ট মাপার জো নেই, সেখানে যেন থাকতেই হবে তার অস্তিত্বের ভাণ্ডার। হীরকসন্ধানী ইউরোপীয় চোখ ঘুরে বেড়াতে থাকে কঙ্গো বেসিন জুড়ে। কাদামাটির মানুষে ঘেরা পৃথিবীর প্রাচীনতম ভূত্বকগুলির একটি— কাতাঙ্গা মালভূমি। তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে লুআলাবার গতিপথ। ১৯০৩ সালের ডিসেম্বরের এক বিকেল। লুআলাবায় এসে মিশে যাওয়া মুতেন্দেলে নামের এক ছোট্ট পাহাড়ি নদীর বুকে আবিষ্কৃত হয় কঙ্গোর প্রথম হীরকখণ্ডটি। টাঙ্গানিকা কন্সেশন নামে এক ইংলিশ টিন কোম্পানির দুই প্রসপেক্টর কুকসন আর জ্যাক্‌স্‌ ছিল সে আবিষ্কারের নায়ক। এরপর থেকে কঙ্গোর বুকে তৈরি হল আরেক নতুন ইতিহাস— যে ইতিহাসে আসা যাবে সময়মতো। তার আগে সেই দীর্ঘ পথটিকে আমাদের চিনতেই হবে।

লুআলাবা থেকে সাও-এর লাইমস্টোনের স্তম্ভ। বড় দীর্ঘ সে পথ। তার খানিকটায় পা পড়েছিল বাঙালি শঙ্করেরও। সে এক আশ্চর্য পথ। স্ট্যানলির নিজের জার্নালে লেখা—

দ্য পাওয়ার পজে়সিং দ্য কঙ্গো উড অ্যাবসর্ব টু ইটসেলফ দ্য ট্রেড অব দ্য হোল অব দ্য এনোর্মাস বেসিন বিহাইন্ড। দ্য রিভার ইজ় অ্যান্ড উইল বি দ্য গ্র্যান্ড হাইওয়ে অব কমার্স টু ওয়েস্ট সেন্ট্রাল আফ্রিকা।

যদিও এই গ্র্যান্ড হাইওয়ে পুরোপুরি আবিষ্কৃত হওয়ার অনেক আগে থেকেই তা আন্তুর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল। কঙ্গোর মাটিতে দিওগো সাও-এর পদার্পণের নয় বছরের মাথায় পর্তুগীজ কারাভেল স্পর্শ করেছিল ব্রাজিলের তটভূমি। তার কয়েক দশকের মধ্যে এক অন্য ব্যবসায় জমে উঠেছিল পশ্চিম গোলার্ধ। জ্যান্ত মানুষের ব্যবসা। ব্রাজিলের হাজার হাজার খনি আর কফিবাগিচা, ওয়েস্ট ইন্ডিজের চিনির খামার, আরও কিছু দশক পর থেকে উত্তর আমেরিকার তুলো ও তামাকের আবাদ ভরে উঠল লক্ষ লক্ষ কালো মানুষ দাসে। সে এক দুরন্ত লাভজনক ব্যাবসা। লিসবন শহরে ডাক্তার বা শিক্ষক হওয়ার চেয়ে ঢের ঢের বেশি লাভজনক ছিল লোহার শিকলে বাঁধা কালোমানুষের পাল তাড়িয়ে এনে কঙ্গোর মোহনায় অপেক্ষমান কারাভেলগুলির কাপ্তানদের কাছে বিক্রি করা। সাও-এর স্তম্ভটি যেখানে খাড়া ছিল, তার পাশের গ্রামটি হয়ে উঠল পাকাপাকি দাস-বন্দর। এক সারিবদ্ধ ধাতব শব্দের ক্রমাগত ধ্বনিতে ভরে যেত সন্ধেবেলার বন্দর-পথ। অপেক্ষমান কারাভেলগুলির স্টারবোর্ড, ডেক, নোঙর ফেলা ঝিমুনি কাটিয়ে জেগে উঠত সেই শব্দে। সবাই চিনত সেই শব্দ। স্লেভ কারাভ্যান। গলাবন্ধ লোহার আংটা থেকে আটকে থাকা লোহার শিকলের পরম্পর ঝুম ঝুম শব্দ এগিয়ে আসত বন্দরের পথ ধরে। বড় দীর্ঘ সেই পথ।

বন্দরে অপেক্ষমান স্লেভ কারাভেলগুলির খোল ভর্তি হচ্ছে ধরে আনা হতভাগ্য কৃষ্ণাঙ্গ দাসে

সেই দীর্ঘ পথের দীর্ঘতম বিস্তৃতি ধরে ১৮৭৭ সালটি ধরে কঙ্গোর তীরবর্তী সমস্ত লোকালয়গুলি পর্যায়ক্রমে সচকিত হয়ে উঠছিল যেন এরকমই এক বিশাল স্লেভ কারাভ্যানের অনন্ত ঝুম ঝুম শব্দে। এক একটি গ্রাম পার হচ্ছিল সে কারাভ্যান আর সে অবিশ্রান্ত ধাতব শব্দের প্রথম আওয়াজটি কানে আসার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তে ম্যাজিকের মতো জনশূন্য হয়ে পড়ছিল গ্রামগুলি। খুব একটা ভুল ছিল না তারা, যদিও কোনও স্লেভ কারাভ্যান নয়, এক্ষেত্রে সেটা ছিল স্ট্যানলির অভিযান। মালবহনকারী কুলি, পতাকাবাহক ও গানম্যানদের মাঝামাঝি হেঁটে চলছিল শিকলে বাঁধা পলাতক কুলিদের সারি। মাত্র হাফ ডজন বছর আগেই স্ট্যানলি নিজেই ইউএস নেভির পলাতক সৈন্য হিসেবে চিহ্নিত ছিল। অথচ নিজের অভিযানে ক্লান্ত ও পলাতক কুলিদের জন্য এই ছিল স্ট্যানলির নিদান। তার নিজের কথায়— “দি ইনকরিজিবল ডেজা়র্টার্স… ওয়্যার ওয়েল ফ্লগড অ্যান্ড চেইনড।” আর সে পথের বাকি লোকালয়গুলি? যারা সে শব্দের মর্মধ্বনি শুনেও শুনতে পায়নি? স্ট্যানলির জার্নাল বলছে— “উই হ্যাভ অ্যাটাক্‌ড অ্যান্ড ডেসট্রয়েড ২৮ লার্জ টাউনস অ্যান্ড থ্রি অর ফোর স্কোর ভিলেজেস।”

দীর্ঘদিন উগান্ডার সাভানায় কাটানোর পরে স্টিমারযাত্রায় কঙ্গোর দুই তীরের অরণ্যের শোভায় অভিভূত হয়ে পড়েছিল বাঙালি শঙ্কর। লুআলাবার তীরে কাবালো থেকে শুরু হয়েছিল সে যাত্রা। বিভূতিভূষণের কলমে বন্যপ্রকৃতি সেখানে আত্মহারা, লীলাময়ী আপনার সৌন্দর্য ও নিবিড় প্রাচুর্যে আপনি মুগ্ধ। সেই দীর্ঘ পথ জুড়ে শঙ্করের সৌন্দর্যপ্রিয় ভাবুক মনটি যে স্বপ্নজাল রচনা করে চলছিল তার থেকে বুঝি সম্পূর্ণ আলাদা ছিল সেক্সট্যান্টে মাপা ইউরোপীয় অভিযাত্রীর মনস্তত্ত্ব। বিভূতিভূষণ ব্র্যাকেটের মধ্যে লিখছেন—

(হাজার হোক সে বাঙলার মাটির ছেলে, ডিয়েগো আলভারেজের মতো শুধু কঠিন প্রাণ স্বর্ণান্বেষী প্রসপেক্টর নয়।)

–চাঁদের পাহাড়, পৃঃ ৮৪

আলভারেজের প্রাণ ঠিক কতটা কঠিন ছিল জানি না, কিন্তু বিভূতিভূষণের লেখাতেই সে ইউরোপীয় কাঠিন্যের কিছু নমুনা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। লুআলাবার তীরে যেন ওয়াইল্ড ওয়াইল্ড ওয়েস্টের মতো এক শহর কাবালো-তে বেলজিয়ান গভর্নমেন্টের ট্রেন থেকে নেমে শঙ্করকে মুখোমুখি হতে হবে আলবুকার্ক নামে এক ভীষণ জোয়ান পর্তুগিজের। যে ‘বদমাইশ’ পর্তুগিজ পোকার খেলায় ফাঁসাতে চাইবে শঙ্করকে। শঙ্কর তাতে রাজি না হওয়ায় আলবুকার্কের কাঠিন্যের সম্যক নমুনাও সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া যাবে।

শঙ্করের উত্তর শুনে পর্টুগীজ বদমাইসটা রেগে লাল হয়ে উঠল। তার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরুতে চাইল। সে আরও কাছে ঘেঁষে এসে, দাঁতে দাঁত চেপে, অতি বিকৃত সুরে বললে— কী? নিগার, কী বললি? ইস্ট ইন্ডিজের তুলনায় তুই অত্যন্ত ফাজিল দেখছি। তোর ভবিষ্যতের মঙ্গলের জন্য তোকে জানিয়ে দিই যে, তোর মতো কালা আদমিকে আলবুকার্ক এই রিভলবারের গুলিতে কাদাখোঁচা পাখির মতো ডজনে-ডজনে মেরেচে।

–চাঁদের পাহাড়, পৃঃ ৮২

দিওগো সাও-এর পদার্পণের পর থেকেই সেই দীর্ঘ পথটির আনাচকানাচ হাজার হাজার আলবুকার্কে ভরে গিয়েছিল, আর কাদামাটির কালা আদমিরা কাদাখোঁচা পাখির মতো ডজনে-ডজনে মরতে মরতে তার সংখ্যাটা যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল তা আমাদের কল্পনারও বাইরে। আর আমাদের কৈশোরের স্বপ্নপুরুষ, ঔপনিবেশিক  ইতিহাস যাকে অভিযাত্রিক মহানায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ছেড়েছে, সেই হেনরি মর্টন স্ট্যানলি? নীল নদের উৎস আবিষ্কারের কৃতিত্ব যার নামের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে, সেই রিচার্ড বার্টন স্ট্যানলি সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন— “…শুট্‌স্‌ নিগ্রোজ়় অ্যাজ় ইফ দে ওয়্যার মাঙ্কিজ়।” ক্র্যাকশট আলভারেজের কেরামতিতে আলবুকার্ককে তাও হার মানতে হয়েছিল। স্ট্যানলির সে সব বালাই ছিল না। আগাগোড়াই উচ্চকিত ঠোঁটকাটা ছিল তার যাবতীয় উচ্চারণ। সেই দীর্ঘ পথেরই একেবারে শুরুর দিকে স্ট্যানলির লেডি অ্যালিস যখন টাঙ্গানিকা থেকে লুআলাবার দিকে যাত্রা শুরু করেছে, তখনকার এক চিত্র— স্ট্যানলির নিজেরই জার্নাল—

দ্য বিচ ওয়জ় ক্রাউডেড উইথ ইনফিউরিয়েটস অ্যান্ড মকারস্‌… উই পারসিভড উই ওয়্যার ফলোড বাই সেভেরাল ক্যানোজ়় ইন সাম অব হুইচ উই স স্পিয়ারস শেক্‌ন্‌ অ্যাট আস… আই ওপেনড অন দেম উইথ দ্য উইনচেস্টার রিপিটিং রাইফেল। সিক্স শট্‌স অ্যান্ড ফোর ডেথস ওয়্যার সাফিশিয়েন্ট টু কোয়ায়েট দ্য মকারস্‌।

মধ্য আফ্রিকার সূর্য বড় নিষ্ঠুর। তার জ্বালায় অস্থির অভিযাত্রীর সাদা চামড়ার হৃদয় কিছুক্ষণের জন্য ঠান্ডা হত কালোচামড়ার রক্তস্নানে।

অ্যান্ড হোয়েন দ্য হিট অব আফ্রিক’স সান
গ্রিউ কোয়ায়েট টূ এনার্ভেটিং
সাম ব্লাডশেড উইথ দ্য ম্যাক্সিম গান
ওয়জ় মোস্ট এক্সিলারেটিং

তবুও সে ছিল কিছুই না, ঝলক মাত্র। কয়েক বছরের মধ্যেই কঙ্গোর কাদামাটির উপত্যকায় নেমে আসবে আরো ভয়ঙ্কর দুর্দশার কুয়াশা। সে কুয়াশায় মিশে থাকবে রাজা লিওপোল্ডের ভূত। শুকিয়ে আসা কাটা হাতের দুর্গন্ধে ভরে উঠবে স্ট্যানলির স্বপ্নবাণিজ্যের গ্র্যান্ড হাইওয়ে। লুআলাবা থেকে দিওগো সাও-এর লাইমস্টোন স্তম্ভ পর্যন্ত দীর্ঘ সেই পথ। বড় যন্ত্রণার, বড় দুখী সে পথ। দিওগো সাও-এর নোঙর ফেলার মুহূর্তটি থেকে সময়ের সরণী বেয়ে লিওপোল্ডের কঙ্গো ফ্রি স্টেট, বেলজিয়ান কঙ্গো, মোবুতুর[3] জা়ইরে… এমনকি আজকের ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর সময় অবধি সে পথ আজও যন্ত্রণাময়। বাঙালি কৈশোরের যাবতীয় স্বপ্ন বুকে নিয়ে সে পথে খানিকটা হলেও একদিন হেঁটেছিল শঙ্কর। তার প্রকৃতিপ্রেমী ভাবুক কবিমনের দৃষ্টির আড়ালে থেকে গিয়েছিল সে পথের দুখী রূপটি। তাই হয়তো খোলামনে এক বিচিত্র নেশার সঙ্গী হতে পেরেছিল সে। যে নেশায় ভর করে তার কয়েক দশকের মধ্যেই হীরক সরবরাহে আফ্রিকীয় দেশগুলির মধ্যে সবার আগে উঠে আসবে কঙ্গো উপত্যকার নাম।

 

শোআহ্‌…

এ লেখার কেন্দ্রে রয়েছে আলোর বর্ণমালায় দীপ্যমান এক আশ্চর্য স্ফটিকখণ্ড, ওপরে ইতস্তত উড়ছে কিছু বুকের ভিতরে থেকে যাওয়া একটি বইয়ের নানা পাতা আর নীচে খানিকটা ভারতবর্ষ, খানিক লাতিন আমেরিকা ঘুরে ক্রমশ জেগে উঠছে আফ্রিকা মহাদেশ। এ লেখার— কোনও চৌখস সাহিত্যিকের তরতরে, পরম্পরায় নির্ভুল, অভিজ্ঞ পরিকল্পনায় নিখুঁত লেখা হয়ে ওঠার কোনও সম্ভাবনাই নেই। বরং বলা ভালো এক কিশোর আখ্যানের রোমাঞ্চ বুকে খামচে ধরে এক অশিক্ষিতের নাছোড় প্রত্নসন্ধান। অনেকটা প্রসপেক্টিং-এর মতোই। মানচিত্র থেকে মানচিত্রে খুঁড়ে চলা, কিন্তু এ ক্ষেত্রে কাদামাটির তলে হাত ভিজে যায় কান্না ও রক্তে… যত গভীরে পৌঁছয় হাত, বুক অবধি আঁচড়ের দাগ উঠে আসে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জমতে থাকা উঁচু নীচু স্ট্যালাকটাইটের মতো তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার বয়ানে। কখনও কখনও সে গহ্বর জুড়ে পড়ে থাকে এক অপার্থিব নৈঃশব্দ— কান্না নয়, শব্দ নয়— এক শীতল স্তব্ধতা স্নায়ুময়।

শোআহ্‌…

বার্লিন, ১৯৮৬। কনকনে শীতল ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ। গমগম করে চলছে বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। কয়েকশো মানুষ ভিড় জমিয়েছিলেন ডেলফি প্যালাস্ট সিনেমায়। সেই সপ্তাহে ওই হলটিতে একটি ছবির প্রিমিয়ার চলছিল। ক্লদ লাঞ্জ়মান পরিচালিত হলোকস্টের ওপর নির্মিত সাড়ে নয় ঘন্টার ছবি ‘শোআহ্‌’। ছবিটির প্রিমিয়ারের জন্য উৎসবের পক্ষ থেকে এক কর্মকর্তা দায়িত্বে ছিলেন, তিনি আমন্ত্রণপত্র ছাপানোর সময় লাঞ্জ়মানকে ছবির টাইটেলের মানে জিজ্ঞাসা করলে লাঞ্জ়মানের উত্তর ছিল— “শোআহ্‌।”

কর্মকর্তা বললেন— “কিন্তু আপনার এটা অনুবাদ করে দেওয়া দরকার, নয়তো কেউই বুঝবে না।”

পরিচালক উত্তর দিয়েছিলেন— “ঠিক এটাই আমি চাই। কেউ না বুঝুক।”

‘শোআহ্‌’-এর কোনও অনুবাদ ছিল না আমন্ত্রণপত্রে। কিন্তু যখন সাড়ে ন ঘন্টা পর ডেলফি প্যালাস্টের পোর্টিকোর সিঁড়ি বেয়ে রক্তশূন্য নির্বাক প্রেতচ্ছায়াদের মতো নেমে আসছিল একজন একজন করে দর্শক, তখন তাদের অনুবাদ করে বলে দেওয়ার দরকার ছিল না ‘শোআহ্‌’ মানে কী। তাদের মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার ছিল না যে বাইবেলে এই হিব্রু শব্দটি অন্তত একডজনবার ব্যবহৃত হয়েছে, প্রত্যেকবারই শব্দটি দিয়ে চিহ্নিত হয়েছে এক চরম এবং চূড়ান্ত ধ্বংস। নাৎসি জার্মানির হাতে ছয় মিলিয়ন ইহুদির হিমশীতল হত্যালীলার সঙ্গে চিরতরে জুড়ে গিয়েছে শব্দটি। অনেকেই হয়তো দেখেছেন লাঞ্জ়মানের এই অসামান্য ডকুমেন্টারি ছবিটি। হলোকস্টের প্রায় চল্লিশ বছর পর নাৎসি জমানার এক স্টিম ইঞ্জিনে সাড়ে ন ঘন্টা ধরে লাঞ্জ়মান এক ডেথ ক্যাম্প থেকে আরেক ডেথ ক্যাম্পে ঘুরে বেড়ান। না, একটিও মৃত্যুর দৃশ্য দেখাননি লাঞ্জ়মান। শুধু সেই পথ ধরে আমরাও চলতে শুরু করি, চল্লিশ বছর পরেও… সেইসব সাড়হীন লৌহপাঁজড়ের রেলট্র্যাক ধরে– বন্ধ ওয়াগনে ঠাসাঠাসি মানুষ যে ট্র্যাক ধরে পৌঁছত ট্রেবলিঙ্কায়… আউৎসভিৎশে…। কখন জানি না আমরাও ঢুকে পড়ি সে বন্ধ ঠাসাঠাসি ওয়াগনে… অন্ধকার হিম-হিম সুড়ঙ্গ ধরে লাইন করে একেক গ্যাসচেম্বারে। মৃত্যুর যাবতীয় বিভীষিকা ছাপিয়ে ডেলফি প্যালাস্টের হাজার দর্শকের অসাড় স্নায়ুতন্ত্রের রেলট্র্যাকে এক আর্ত শূন্যতা ফেলে রেখে একসময় কুয়াশায় মিলিয়ে যায় লাঞ্জ়মানের স্টিম ইঞ্জিন। সে শূন্যতা ভরে ওঠে উত্তর আধুনিক ইউরোপের কালেক্টিভ গিল্টে। ১৯৪৪ সালে এভাবেই উদ্ভাবিত হয়েছিল আরেকটি শব্দবন্ধ— ‘জেনোসাইড’। উদ্ভাবক জন্মসূত্রে পোলিশ ইহুদি, আইনজীবী রাফায়েল লেমকিন। ১৯৪৮ সালে ইউনাইটেড নেশনস জেনোসাইড কনভেনশন ‘জেনোসাইড’ শব্দটির যে সংজ্ঞা তৈরি করে তা এইরকম—

… অ্যাক্টস কমিটেড উইথ ইন্টেন্ট টু ডেসট্রয়, ইন হোল অর ইন পার্ট, আ ন্যাশনাল, এথনিক, রেসিয়াল অর রিলিজিয়াস গ্রুপ, অ্যাজ় সাচ ‘ইনক্লিউডিং দ্য কিলিং অব ইটস মেম্বারস, কজ়িং সিরিয়াস বডিলি অর মেন্টাল হার্ম টু মেম্বারস অব দ্য গ্রুপ, ডেলিবারেটলি ইমপোজ়িং লিভিং কন্ডিশনস দ্যাট সিক টু ব্রিং আবাউট ইটস ফিজ়িকাল ডেস্ট্রাকশন ইন হোল অর ইন পার্ট…

যে নাৎসি হলোকস্টের অভিঘাতে ইউরোপের মনস্তত্ত্ব নুয়ে পড়ছিল বিভীষিকায়… অপরাধবোধে— লাঞ্জ়মানের ভাষায় যাকে বলে ‘কালেকটিভ গিল্ট’— ডেলফি প্যালাস্টের ঠিক কতজন দর্শকের আদৌ জানা ছিল যে এই হলোকস্টেরই এক পূর্বরঙ্গ ঘটে গিয়েছিল এক কাদামাটির দেশে— নাৎসি জমানার প্রায় অর্ধশতক আগে— এই জার্মানদেরই হাতে!

এবার খানিক পিছিয়ে যাই। আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণাংশের পশ্চিম তট। মালভূমি আর মরু বালিয়াড়ি জড়াজড়ি করে পড়েছে আটলান্টিকের নীল জলে। উপত্যকা জুড়ে হেরেরো ও নামা উপজাতির বাস। দুই উপজাতির জীবনযাপন ছিল প্যাস্টোরাল, অর্থাৎ প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় যাপন ও পশুপালন। বিশাল গবাদি পশুর পাল নিয়ে সেই অন্তহীন ধূ-ধূ ভূখণ্ডে সিল্যুয়েট ভাস্কর্যের মতো ঘুরে বেড়াত দীর্ঘদেহী হেরেরো পশুপালক। একদম প্রথম পর্যায়ে যে ইউরোপীয়রা পা ফেলেছিল সেই ভূখণ্ডে, হেরেরোরা তাদের চোখে ছিল ‘ন্যাচারাল অ্যারিস্টোক্রাট’। যে ভূখণ্ডের কথা বলছি, ১৮৮৪ থেকে তা পরিচিত হয়েছিল জার্মান সাউথ ওয়েস্ট আফ্রিকা নামে— আজকের দিনে যাকে আমরা নামিবিয়া নামে চিনি।       

তখনও নামিবিয়ার হীরক ঐশ্বর্য জার্মানদের কাছে ছিল অজানা। যদিও পাশেই সাম্রাজ্যবাদী প্রতিদ্বন্দ্বী সিসিল রোডসের ব্রিটিশ কলোনিতে রমরম করে চলছিল কিম্বার্লির জাদুব্যবসা। জার্মানির কাছে এই উপনিবেশ ছিল ‘নতুন আফ্রিকান জার্মানি’— তাই সম্পূর্ণ ভূখণ্ডের ওপর সর্বাত্মক শ্বেতাঙ্গ অধিকার ছিল জরুরি। দামারাল্যান্ড ও নামাকোয়াল্যান্ড নামের যে দুটি ভূমিখণ্ড ছিল হেরেরো ও নামাদের মুক্তভূমি, সেখান থেকে হটতে হটতে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ল তারা। দলে দলে মরতে লাগল তাদের অতিপ্রিয় গবাদি পশুর পাল। এক সময়ের ‘ন্যাচারাল অ্যারিস্টোক্রাট’রা দ্রুত পরিণত হতে থাকছিল জার্মান অভিবাসীদের জন্য প্রয়োজনীয় বাধ্যতামূলক শ্রমশক্তিতে— দাস শ্রমিকে। ১৯০৪ সালে বিদ্রোহ করল হেরেরো ও নামা। সে বিদ্রোহ দমনে জার্মানি থেকে দশ হাজার সুশিক্ষিত, আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত সৈন্য নিয়ে জার্মান সাউথ ওয়েস্ট আফ্রিকার কম্যান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে নিযুক্ত হল লেফটেন্যান্ট জেনারেল লোথার ফন ট্রোথা। তার মত ছিল—

আই বিলিভ দ্যাট দ্য নেশন অ্যাজ় সাচ শুড বি অ্যানাইহিলেটেড, ইফ দিস ওয়জ় নট পসিবল বাই ট্যাকটিকাল মেজ়ারস, হ্যাভ টু বি এক্সপেলড ফ্রম দ্য কান্ট্রি… দ্য কন্সট্যান্ট মুভমেন্ট অব আওয়ার ট্রুপস উইল এনাব্‌ল্‌ আস টু ফাইন্ড দ্য স্মল গ্রুপস অব দিস নেশন হু হ্যাভ মুভ ব্যাকওয়ার্ডস অ্যান্ড ডেসট্রয় দেম গ্র্যাজুয়ালি।

আফ্রিকার মাটিতে পা রেখেই হেরেরোদের উদ্দেশ্যে ট্রোথার সরাসরি চেতাবনি ছিল—

এনি হেরেরো ফাউন্ড ইন দ্য জার্মান ফ্রন্টিয়ার, উইথ অর উইদাউট আ গান অর ক্যাট্‌ল্‌, উইল বি এক্সেকিউটেড। আই শ্যাল স্পেয়ার নাইদার ওমেন নর চিল্ড্রেন। আই শ্যাল গিভ দ্য অর্ডার টু ড্রাইভ দেম অ্যাওয়ে অ্যান্ড ফায়ার অন দেম। সাচ আর মাই ওয়র্ডস টু দ্য হেরেরো পিপল।

অ্যানাইহিলেশন… শোআহ্‌…

১৯০৪-এর উইন্ডহোকের জার্মান হেডকোয়ার্টারে অবিকল নাৎসি জার্মানির মতোই বেজে উঠত সান্ধ্য অর্কেস্ট্রা— বিঠোফেন-এর প্যাস্টোরাল সিম্ফনি[4]। আরেকটু উত্তরে ছবির মতো ওয়াটারবার্গের মালভূমি জুড়ে অপার শান্তির ‘প্যাস্টোরাল’ যাপনে অভ্যস্ত হেরেরোদের জীবনে বেজে উঠছিল হলোকস্টের প্রিলিউড। সেই প্রিলিউডে ধ্বংস হয়েছিল এক লক্ষের বেশি কাদামাটির মানুষ। অবশ্য অভিবাসী জার্মানরা যাদের মানুষের থেকে বেবুন বলে সম্বোধন করা বেশি শ্রেয় মনে করত। পুরো পরিসংখ্যান কোনওদিনই পাওয়া যায়নি। মোটামুটি বলা যায় আশি শতাংশ হেরেরো এবং পঞ্চাশ শতাংশ নামা উপজাতির মানুষকে এক সামান্য সময়ের ব্যবধানে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছিল— আ টোটাল অ্যানাইহিলেশন— শোআহ্‌।

 

যে জেনোসাইডের স্মারক— একটি তেতাল্লিশ ফিট বালির গর্ত

ওয়াটারবার্গের অসম মুখোমুখি যুদ্ধে দুই দিনের মধ্যে পাঁচ হাজারের বেশি হেরেরো নিকেশ হয়েছিল। পালাতে থাকা হেরেরো জনতাকে তাড়িয়ে কালাহারি মরুভূমির গভীরতর অংশে ঢুকিয়ে দিচ্ছিল জার্মান বাহিনি। যারাই অবসন্ন হয়ে পিছিয়ে পড়ছিল তারা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিকেশ হচ্ছিল। জ্যান ক্লোয়েট নামে এক জার্মান গাইডের জবানবন্দি—

ওয়াটারবার্গের কাছে যে যুদ্ধে হেরেরোরা পরাজিত হয়েছিল, সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম। যুদ্ধের শেষে সমস্ত পুরুষ, মহিলা ও শিশু, যারাই জার্মানদের হাতে পড়েছিল, তাদের নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। তারপর জার্মানরা বাকিদের পিছু তাড়া করে গেল। পথের কাছাকাছি বা বালির পাহাড়ে যাদেরকেই জার্মানরা পেয়েছিল, প্রত্যেককেই গুলি করে অথবা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছিল। হেরেরো পুরুষেরা পুরোপুরি নিরস্ত্র ছিল, সামান্যতম প্রতিরোধও তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তারা শুধু তাদের গরুর পাল নিয়ে পালাতে চেয়েছিল।

তারপরেও দলে দলে কাদামাটির হেরেরো মানুষ বাঁচার জন্য ছুটছিল। কালাহারির ভয়ঙ্করতম ওমাহেকে অংশটি ছাড়া তাদের আর কোনও দিকে যাওয়ার উপায় ছিল না। এক ব্রিটিশ বেচুআনাল্যান্ডের দিকের সীমান্ত ছাড়া সবদিক ঘিরে রেখেছিল মেশিনগানে সজ্জিত সুসভ্য জার্মান বাহিনি। আর সে সীমান্ত পার করতে হলে তাদের পুরো কালাহারি পার করতে হত। হ্যাঁ, সেই কালাহারি।

সেই সময়কার কালাহারির মানচিত্র

তারপর পড়ল আসল মরু কালাহারি মরুভূমির এক অংশ। দূর থেকে তার চেহারা দেখে শঙ্কর ভয়ে শিউরে উঠল। মানুষ কী করে পার হতে পারে এই অগ্নিদগ্ধ প্রান্তর!

–চাঁদের পাহাড়, পৃ. ১৬৪

মরুভূমি ধরে প্রাণপণ দৌড়চ্ছিল কাদামাটির ‘প্যাস্টোরাল’ নারী-পুরুষ-শিশু। অবসন্ন পা টানতে টানতে। একটু জলের খোঁজে— একটু বাঁচার আশায়— যদি খোঁজে আসে অন্তত একটা উনুই। না শঙ্করের মতো কোনও ম্যাপ তাদের কাছে ছিল না। শেষ শক্তি দিয়ে সর্বত্র সে বালির মানচিত্র তলাশ করছিল কাদামাটির কালো কালো হাত— অন্তত একটা উনুই…

ম্যাপে বার বার লিখে দিয়েচে, উত্তর পূর্ব কোণ ঘেঁষে ছাড়া কেউ এই মরুভূমি মাঝামাঝি পার হতে যাবে না। গেলেই মৃত্যু, কারণ সেখানে জল একদম নেই। জল যে উত্তর-পূর্ব ধারে আছে তাও নয়, তবে ত্রিশ মাইল, সত্তর মাইল ব্যবধানে তিনটি স্বাভাবিক উনুই আছে— যাতে জল পাওয়া যায়। ঐ উনুইগুলি প্রায়ই পাহাড়ের ফাটলে, খুঁজে বার করা বড়ই কঠিন। এই জন্যেই মিলিটারি ম্যাপে ওদের জায়গায় অক্ষ ও দ্রাঘিমা দেওয়া আছে।

–চাঁদের পাহাড়, পৃ. ১৬৪

শঙ্করের কাছে যে ম্যাপটি ছিল সেটি খুব সম্ভবত জার্মান মিলিটারি ম্যাপ। জার্মান প্যাট্রোল ঘুরে ঘুরে যত উনুই রয়েছে কালাহারির জার্মান অংশে, তার সব কটিতে বিষ মিশিয়ে দিয়েছিল। পাঁচ বছরে সে বিষক্রিয়া নিশ্চয়ই কেটে গিয়েছিল, কারণ শঙ্কর এমনই এক উনুই-এর ঘোলা জল পান করে তার আকণ্ঠ তৃষ্ণা মিটিয়েছিল। কিন্তু কাদামাটির হেরেরোদের সে সৌভাগ্য ঘটেনি। জার্মান প্যাট্রোল ক্রমাগত তাদের মরুভূমির আরও… আরও… গভীরে ঠেলে দিচ্ছিল। পুরুষদের দর্শনমাত্র নির্দয়ভাবে খুন করা হচ্ছিল। আর তৃষ্ণায় ছটফট করতে থাকা নারীদের ধর্ষণ করে ফেলে দেওয়া হচ্ছিল অগ্নিদগ্ধ বালিয়াড়ির ওপরে। তাও তারা হেঁটে চলছিল… বিভূতিভূষণের ভাষায় যেখানে ১৩৫ ডিগ্রি ওঠে তাপমান যন্ত্রে, রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে যেখানে পথ হাঁটা চলে না… সেই পথ বেয়ে।

হেরেরোদের গন ফাঁসি: জার্মান সাউথ ইস্ট আফ্রিকা

বাঁচার চেষ্টায় মানুষ কী কী করতে পারে? দিনের পর দিন অভুক্ত, তৃষ্ণার্ত— বেশিরভাগই নারী ও শিশু— পুরুষদের অধিকাংশই যখন নিষ্ঠুরভাবে নিহত— কী করতে পারে তারা বেঁচে থাকার জন্যে? খুঁড়ে ফেলতে পারে কালাহারির বালির আস্তরণ? পশু-পাখি-মানুষ-গাছ— কাদামাটির এই পৃথিবীর সকল সজীব অস্তিত্ব জানে সেই সত্য— মাটির নীচে থাকে জল। মরুভূমি জুড়ে ইতিউতি ছড়িয়ে আছে মানুষের কঙ্কাল— জার্মান প্যাট্রোল পরে আবিষ্কার করেছিল ছোট-বড় কঙ্কালে ভরা এক গর্ত— যার গভীরতা ৪৩ ফিট! কিন্তু নিষ্ঠুর কালাহারির বালির আস্তরণ যে তার চেয়েও অনেক, অনেক পুরু! মাত্র কয়েক বছর পরেই শঙ্কর এ পথ দিয়ে হেঁটে যাবে। বালির আড়ালে এক লুকনো গুহায় খুঁজে পাবে আত্তিলিও গাত্তির কঙ্কাল। কিন্তু তার ক্লান্ত, অবসন্ন চোখে পড়বে না একটিও হেরেরো কঙ্কাল। কাদামাটির মানুষ ছিল তারা। হয়তো তাই অতি দ্রুত মিশে গিয়েছিল বালির কণা হয়ে, আর সে বালি হাওয়ায় উড়ে ঢেকে দিয়েছিল শেষ প্রচেষ্টার গভীর সে গর্ত। তখনও কিন্তু উইন্ডহোকের সান্ধ্য অর্কেষ্ট্রায় বেজে চলছিল— প্যাস্টোরাল সিম্ফনি!

শঙ্কর কালাহারি ধরে পূর্বদিকে হেঁটে সলস্‌বেরি পৌঁছেছিল। পশ্চিমদিকে হাঁটলে আরও আগেই সে পেরোতে পারত কালাহারি। পৌঁছে যেত আটলান্টিকের তীর। মরু বালিয়াড়ির শুকনো হাওয়া যেখানে আটলান্টিকের ভেজা হাওয়ায় মেশে, সেখানে দাঁড়িয়ে কান পাতলে শঙ্কর শুনতে পেত প্যাস্টোরাল সিম্ফনির প্রফুল্ল মুভমেন্টগুলি ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে তীব্র আর্তনাদে। চেলো আর ভায়োলিনের ছড় থেকে ফুঁপিয়ে বেরিয়ে আসছে কান্না। সেই সুর অনুসরণ করলেই সে পৌঁছে যেত এক ছোট্ট পেনিনসুলায়। শার্ক আইল্যান্ড তার নাম। জার্মান সাউথ ওয়েস্ট আফ্রিকার সবচেয়ে বড় ডেথ ক্যাম্প। ভাগ্যিস শঙ্কর সে পথে যায়নি। তার ভাবুক, সৌন্দর্যপ্রিয়, বাঙালি কবিমনের পক্ষে তা হত ভয়ঙ্কর। কেননা শার্ক আইলান্ডের ডেথ ক্যাম্পে চল্লিশ বছর আগেই তৈরি হচ্ছিল আউৎসভিৎস, ট্রেবলিঙ্কার নীল-নকশা।

হাজারে হাজারে নামা ও হেরেরোর শেষ জায়গা হয়েছিল ডেথ ক্যাম্পে। ক্যাম্পে বীভৎস অত্যাচার ও অপুষ্টির কারণে দলে দলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত তারা। হ্যাঁ, দলে দলে। মিশনারিদের একটি পরিসংখ্যান বলছে— দিনে প্রায় আঠেরো থেকে কুড়ি জনের মৃত্যু ছিল অবধারিত। ফ্রেড করনেল নামে এক ব্রিটিশ হীরক-সন্ধানী তখন কাছেই লুডেরিৎশে প্রসপেক্টিং করছিল। শার্ক আইল্যান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী ছিল সে।

ঠান্ডা— রাতে সেখানে ভয়াবহ ঠান্ডা ছিল— ক্ষিদেয়, তেষ্টায়, অনাবৃত শরীরে, ব্যাধিতে, উন্মাদ দশায় তারা রোজ রোজ প্রচুর সংখ্যায় মরত। ভাটার সময় হাতে ঠেলা গাড়িতে করে তাদের শবদেহ বয়ে আনা হত পিছনের সমুদ্রতটে আর বালির মাত্র কয়েক ইঞ্চি নীচেই তাদের পুঁতে দেওয়া হত। যখন জোয়ার আসত, বালির আস্তরণ ধুয়ে গিয়ে তারা আটলান্টিকের জলে ভেসে পড়ত হাঙরের খাদ্য হওয়ার জন্য।

১৯০৬ নাগাদই জার্মান সাউথ ওয়েস্ট আফ্রিকা জনশূন্য হয়ে পড়ল। মাত্র পঁচিশ হাজারের মতো হেরেরো তখনও বেঁচে ছিল, যাদের লাগিয়ে দেওয়া হল জার্মান অভিবাসীদের সেবায়। বালিয়াড়ি, সমুদ্রতট আর বিস্তীর্ণ ভেল্ড জুড়ে মাইলের পর মাইল অন্তরে শুধু চোখে পড়ত ছোট ছোট হীরক-সন্ধানী দলের ইতস্তত খোঁড়াখুঁড়ি। স্বাধীন উপজাতিদের অনুপস্থিতিতে আরও মুক্তভাবে কাজ করতে পারছিল তারা। অবশেষে ১৯০৮ সালে কোলম্যানস্কপের জনশূন্য বালিয়াড়ি ধরে রেললাইন পাতার কাজে নিযুক্ত রেলশ্রমিক জ়াকারিয়াস লেওয়ালার হাতে উঠে এল নামিবিয়ার প্রথম হীরকখণ্ডটি। কিছুদিন পরেই এত হীরা সেখানে পাওয়া যেতে থাকল যে আত্তিলিও গাত্তির গুহাও হয়তো তার কাছে কম পড়ে যেত। সমুদ্রতটের বালিয়াড়ি থেকে হামাগুড়ি দিয়ে তুলে নিতে হত ছড়ানো ছেটানো অ্যাল্যুভিয়াল হীরকখণ্ড। সেই সব হীরা যখন বাজারে পৌঁছত, তাতে লেগে থাকা শার্ক আইল্যান্ডের ঠান্ডা, ভারী হাওয়ার গন্ধ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যেত— যেমন করে প্রায় সাফ হয়ে গিয়েছিল সে জেনোসাইডের ইতিহাস।

না, ১৯৪৪-এর আগে জেনোসাইড শব্দটি কেউ শোনেনি। শোআহ্‌-র প্রিমিয়ারে যে ‘কালেক্টিভ গিল্ট’ জমে উঠছিল যত শ্বেতাঙ্গ সভ্য বুকের ওপর ভারী পাথরের মতো— সেও হওয়ার ছিল না কাদামাটির মানুষদের ঘিরে। যখন শ্বেতাঙ্গরাই এক সার্বিক নিশ্চিহ্নকরণের শিকার হল শ্বেতাঙ্গদেরই হাতে, শুধুমাত্র তখনই উদ্ভাবিত হতে পারল ‘জেনোসাইড’ শব্দটি। না, লক্ষ লক্ষ আমেরিকান-ইন্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়া ও আফ্রিকার কাদামাটির মানুষ যখন নিশ্চিহ্ন হয়েছিল, ধ্বংস হয়েছিল তাদের সংস্কৃতি, তাদের ইতিহাস, তাদের যাপনচিত্র— তখন ‘জেনোসাইড’ বলে পৃথিবীর কোনও ভাষায় কোনও শব্দ ছিল না। যখন হেরেরো আর নামারা ধ্বংস হচ্ছিল, তাদের ধ্বংসে নিষ্কাশিত লাভে ফুলে-ফলে উঠছিল জার্মানির ইহুদিরাও[5]। হলোকস্টের ক্ষতিপূরণ হিসেবে জার্মানির থেকে ইজরায়েল সরকার ও ইহুদিরা পেয়েছিল একশো বিলিয়ন ডলার। নামা ও হেরেরো উত্তরপুরুষদের মাত্র চার বিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণের দাবিকে জার্মানি কোনওদিনই পাত্তা দেয়নি। এই সেদিন মাত্র, ২৮ মে, ২০২১-এ, জার্মানি, আবিশ্ব জনমতের চাপে সেই ধ্বংসের ইতিহাসকে ‘জেনোসাইড’ বলে সরকারিভাবে মানতে বাধ্য হয়েছে।

না, ১৯৪৪-এর আগে জেনোসাইড শব্দটি কেউ শোনেনি। শুধু এক বিস্মৃত জেনোসাইডের অস্তিত্বহীন স্মারক হিসেবে কালাহারির নীচে হারিয়ে গিয়েছিল এক তেতাল্লিশ ফিট গর্ত…

 

[ক্রমশ]

 


[1] আধুনিক সমুদ্রবিজ্ঞানীরা লক্ষ করে দেখেছেন যে কঙ্গোর বিপুল জলরাশির শক্তির তীব্রতা এতটাই বেশি যে তার অভিঘাত মোহনাবরাবর সমুদ্রের বুকে অন্তত একশো মাইল দীর্ঘ এক গিরিখাত সৃষ্টি করেছে, যার গভীরতা কোনও কোনও জায়গায় এমনকি চার হাজার ফুটেরও বেশি।
[2] লেডি অ্যালিস: কঙ্গো অভিযানের সময় স্ট্যানলি একটি বিশেষভাবে তৈরি নৌকা বানিয়েছিল। নৌকাটি ভাগ ভাগ করে খুলে আলাদা করে বয়ে নিয়ে যাওয়া যেত। কঙ্গোর যে সমস্ত অংশে নৌকা চালানো অসম্ভব, সেই সব জায়গায় পাড় ধরে নৌকাটিকে খুলে বয়ে নিয়ে যেত কুলিরা। সেই সময়ের প্রেমিকা অ্যালিস পাইকের নামে স্ট্যানলি নৌকাটির নামকরণ করেছিল লেডি অ্যালিস।
[3] মোবুতু: ১৯৬০ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্যাট্রিস লুমুম্বাকে পশ্চিমি শক্তির সাহায্যে হত্যা করে ক্ষমতায় এসেছিল মোবুতু সেসে সেকো। ডেমোক্রাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর নাম পরিবর্তন করে নাম রেখেছিল জ়াইরে। এর প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে।
[4] প্যাস্টোরাল সিম্ফনি: বিখ্যাত জার্মান কম্পোজ়ার লুডভিগ ফ্যান বিঠোফেনের অমর সৃষ্টি সিম্ফনি নং ৬ ইন এফ মেজর যা প্যাস্টোরাল সিম্ফনি নামে বেশি পরিচিত। বিঠোফেনের নিবিড় প্রকৃতিপ্রেমের স্বাক্ষর এই সিম্ফনি।
[5] লেফটেন্যান্ট জেনারেল লোথার ফন ট্রোথার স্ত্রী লুসি গোল্ডস্টাইন ফন ট্রোথা নিজেই একজন জার্মান ইহুদি ছিল।