সেই চাঁদের পাহাড়

সেই চাঁদের পাহাড় [৫] | অয়নেশ দাস

অয়নেশ দাস

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

সামথিং হিড বিহাইন্ড দ্য রেঞ্জেস…

রুডিয়ার্ড কিপলিং বলতেন— ‘সামথিং হিড বিহাইন্ড দ্য রেঞ্জেস। গো অ্যান্ড লুক বিহাইন্ড দ্য রেঞ্জেস।’ খুঁজে গিয়েছে কিছু মানুষ। এক অনন্ত খোঁজ। সে এক বিচিত্র নেশা। সে এক মারাত্মক অশরীরী টান। খুব বেশিদিনের কথা নয়। আবার স্মৃতিতে ফিরে ফিরে আসে আশির দশক। ভাড়াবাড়ি ছেড়ে শহরের প্রান্তে নতুন বাড়িতে উঠে এলাম আমরা। তখনও সে রাস্তায় ইলেকট্রিক ঢোকেনি। হাতপাখা নিয়ে গ্রীষ্মের রাতে বাবার সঙ্গে শুতে যেতাম খোলা ছাদে। বাবার সঙ্গে চিনতাম সপ্তর্ষিমন্ডল, কালপুরুষ। আমাদের বাড়ির চারদিক ছিল নানারকম ছোটবড় গাছে ঘেরা। বাড়ি থেকে খানিক দূরে ছিল কলেজ। কলেজের সামনে ছিল এক প্রকাণ্ডকায় শিরিষ গাছ। দিনের বেলায় আশপাশের গাছপালা ছাড়িয়ে তার উপস্থিতি খুব একটা বোঝা যেত না। কিন্তু রাতে পূবদিক থেকে যখন একটু একটু করে চাঁদ উঠত সেই মহাবৃক্ষের পেছন থেকে, সেই চাঁদকে পিছনে রেখে, আশপাশের অন্ধকার চাপ-চাপ গাঢ় ফোলিয়েজের আকাশসীমা হেলায় নীচে ফেলে রেখে, অতিঘন, তার নিরবচ্ছিন্ন ডালপালার দূরবিস্তৃত সিল্যুয়েট কনট্যুর ক্রমশ বদলে যেত এক অচেনা, রহস্যময় পাহাড়ের অবয়বে। সত্যিকারের পাহাড় দেখার সৌভাগ্য তখনও হয়নি এমন এক বালকের জন্য পশ্চিমবাংলার এক মফস্বলের উপান্তে, তার একতলার ছাদের অনতিদূরে ধীরে ধীরে মাথা উঁচিয়ে উঠত রিখটারসভেল্ড পর্বতশ্রেণি… আমার চাঁদের পাহাড়। ঝিরঝিরে হাওয়ায় দু চোখে ঘুম জড়িয়ে আসার আগের মুহূর্তটি পর্যন্ত আমার দু চোখ ঘিরে মেঘের মতো এসে জমত সে অনন্ত খোঁজের টুকরো হাতছানিরা। সেই মুহূর্তটিতে আমি ঠিক জানতাম সে পাহাড়ের পেছনে আর কলেজের চেনা মাঠটি নেই, ইতিউতি ইউফার্বিয়ায় ভরা রুক্ষ, উঁচুনিচু ভেল্ড সেখানে মিশে গিয়েছে কালাহারির দুরন্ত বালিয়াড়িতে। তখন আশপাশের – বাঙালি ভূগোলের যাবতীয় চেনা ল্যান্ডস্কেপের ওপর থ্রি-ডি সারফেস মেশ-এর মতো রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে বিছিয়ে গিয়েছে বাবার দেওয়া ঢাউস র‍্যান্ড-ম্যাকনেলির পাতাজোড়া আফ্রিকার ম্যাপ। সব বাঙালি মধ্যবিত্ত ছেলেবেলাই বোধহয় এরকমই হয়। কিন্তু সব বড়বেলা আর শঙ্করের মতো হয়ে ওঠে না। যাক…

সে এক অমোঘ টানেই এক তৃতীয় বিশ্বের উপনিবেশ থেকে আরেক উপনিবেশের পাহাড়চূড়ায় পৌঁছেছিল শঙ্করের স্বপ্নযাত্রা। কী জানি, সে যাত্রায় ‘সামথিং হিড বিহাইন্ড দ্য রেঞ্জ’ খোঁজার চেয়েও হয়তো বেশি করে ক্রিয়াশীল ছিল ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতা কাটিয়ে ওঠার উচ্চাকাঙ্খা। অবশ্যই যে কোনও ইউরোপীয়র ক্ষেত্রে সে প্রশ্ন ছিল অবান্তর। সেই অমোঘ টানেই কিন্তু তুখোড় পর্তুগিজ আলভেরেজের উচ্চারণ তাই সোজাসুজি, স্পষ্ট।

যেখানেই নদী বা খাল দেখি— কিংবা পাহাড় দেখি— সকলের আগে সোনার স্তরের সন্ধান করি। লোকে কত কী পেয়ে বড়মানুষ হয়ে গিয়েচে দক্ষিণ-আফ্রিকায়, এ সম্বন্ধে বাল্যকাল থেকে কত কাহিনীই শুনে এসেছিলুম— সেইসব গল্পের মোহই আমায় আফ্রিকায় নিয়ে এসে ফেলেছিল।

–চাঁদের পাহাড়, পৃ. ৫৫

বরং ফ্রেড করনেলের সাফাইয়ের মধ্যে শঙ্করকে পাওয়া যায় অনেকখানি। এ সেই ফ্রেড করনেল, যে ছিল জার্মান সাউথ-ওয়েস্ট আফ্রিকার শার্ক আইল্যান্ডের প্রত্যক্ষদর্শী। ব্রাজিলের ডায়ম্যান্টিনা ও মিনাস গেরাইস হয়ে আফ্রিকার দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত এক দীর্ঘ প্রসপেক্টিং-এর অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ছিল করনেলের জীবন। আফ্রিকার দক্ষিণাংশে তার প্রসপেক্টিং জীবন নিয়ে নিয়ে একটি আস্ত বই লিখেছিল করনেল— ‘গ্ল্যামার অব প্রসপেক্টিং’। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৯ সালে। আর বিভূতিভূষণের ‘চাঁদের পাহাড়’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৩৭ সালে। বিভূতিভূষণ ‘গ্ল্যামার অব প্রসপেক্টিং’ পড়ে উঠতে পেরেছিলেন কিনা জানি না। কিন্তু অদ্ভুত সমাপতনে দুই বইয়েরই পাতায় পাতায় অ্যাডভেঞ্চারের যাবতীয় আকাশ ছুঁয়ে রেখেছে রিখটারসভেল্ড, আর মাটিতে ছড়িয়ে থেকেছে কালাহারি। শঙ্কর আর আলভারেজ যেমন পূর্বে রোডেশিয়ার দিক থেকে পৌঁছেছিল রিখটারসভেল্ডে, তেমনি পশ্চিমে জার্মান সাউথ-ওয়েস্ট আফ্রিকার দিক থেকে পৌঁছেছিল করনেলের অভিযান। অদ্ভুতভাবে দুয়ের ক্ষেত্রেই সময়টাও একই। ১৯১০-এর এদিক-ওদিক। হীরার খোঁজই দুই অভিযানের কার্যত মূল অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল। একই পর্বতশ্রেণি, একই শৈলশিরা, ভেল্ডের পর ভেল্ড প্রায় একই অগম্য রাস্তা, একই কালাহারি ধরে ছড়িয়ে ছিল দুই অভিযানেরই পায়ের ছাপ। এমনকি বিভুতিভূষণ রিখটারসভেল্ডের গভীরে যে ভয়ঙ্কর ‘বুনিপ’-এর বর্ণনা দিয়েছিলেন, প্রায় একইরকম এক অতিপ্রাকৃত জীবের জনশ্রুতির উল্লেখ পাই ফ্রেড করনেলের লেখায়— ‘গ্রুট স্ল্যাং’।

কালাহারির বুকে পর্যটকের দল

আবার শঙ্করের ম্যাপে যা ছিল ‘তৃষ্ণার দেশ’, করনেলের ম্যাপে তাই ছিল ‘গ্রেট থার্স্ট ল্যান্ড’। এই তৃষ্ণার দেশের গভীরতম কোনও এক অংশে, ফ্রেড করনেল শুনেছিল এক রহস্যময় মরূদ্যানের কথা। ‘হটেনটট’স[1] প্যারাডাইস’। হেরেরো যুদ্ধে জার্মান সৈন্য যখন অস্ত্রহীন হেরেরোদের ঠেলে দিচ্ছিল মরুভূমির আরও গভীরে, কিছু হেরেরো দৈবাৎ পৌঁছে গিয়েছিল সেই মরূদ্যানে। নিষ্ঠুর তৃষ্ণার দেশ উজিয়ে জার্মান সৈন্যদের পক্ষে সম্ভব হয়নি সে রহস্যময় মরূদ্যান খুঁজে বের করা। পরে, রিখস্টারভেল্ডের শৈলশিরায়, কালাহারির যুদ্ধকালীন সেনা ছাউনিগুলোতে, প্রস্পেকটরদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল এক রহস্যময় গুঞ্জন। সেই অজানা মরূদ্যানের আনাচেকানাচে ইতস্তত পড়ে থাকে অবিশ্বাস্য রকমের বৃহদাকার গোনাগুনতিহীন স্বচ্ছ হীরকখণ্ড। অনেক প্রাণপাত চেষ্টাতেও করনেল খুঁজে পায়নি সেই ‘হটেনটট’স প্যারাডাইস’।

দৈবক্রমেই আত্তিলিও গাত্তির রত্নগুহা খুঁজে পেয়েছিল শঙ্কর। অনুচ্চ টিলার আড়ালে সেই গুহা কালাহারির ঠিক কোন অংশে ছিল তা বিভূতিভূষণ অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ মেপে স্পষ্ট করেননি। তবে তা যে সেই কুখ্যাত ‘তৃষ্ণার দেশ’-এরই কোনও এক জায়গায় তা ছিল, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। এবং অদ্ভুত সমাপতনের খেয়ালে সেখানে প্রাকৃতিক জলের স্রোতধারা ছিল, যেমন করনেল একই কথা শুনেছিল ‘হটেনটট’স প্যারাডাইস’ সম্পর্কে— হীরকখণ্ড যেখানে অপর্যাপ্ত ছড়িয়ে থাকে। শঙ্করের আবিষ্কৃত গুহাও তাই—

এ পাথরের নুড়ি তো সে রাশি রাশি দেখেচে গুহার মধ্যে সেই অন্ধকারময়ী নদীর জলস্রোতের নিচে, তার দুই তীরে। কে জানত যে হীরের খনি খুঁজতে সে ও আলভারেজ সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এসে ছ’মাস ধরে রিখসটারভেল্ড পার্বত্য অঞ্চলে ঘুরে-ঘুরে হয়রান হয়ে গিয়েচে— এমন সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে সে সেখানে গিয়ে পড়বে! হীরে যে এমন রাশি রাশি পড়ে থাকে পাথরের নুড়ির মতো— তাই বা কে ভেবেছিল!

–চাঁদের পাহাড়, পৃ. ১৭৫-১৭৬  

কালাহারির গভীরতর অংশে যেখানে কাঁটাঝোপের সারি চোখে পড়ছিল, ফ্রেড করনেল সেখানেই সন্ধান করেছিল একটুকরো হটেনটট’স প্যারাডাইস। না, তার হাতে উঠে আসেনি এমনকি কোনও ক্ষুদ্রকায় হীরের টুকরোটিও। বরং কাঁটাঝোপের ভিতর থেকে বারংবার তার হাতে উঠে এসেছে নরকঙ্কালের অবশেষ। তুমুল মরু আবহাওয়ায় পাঁচ বছর কেটে গেলেও সেই অবশেষ দেখে ঠিক চিনে নেওয়া যেত সেসব মানুষের অবশেষ। ‘ন্যাচারাল অ্যারিস্টোক্র্যাট’ হেরেরোদের বালির গভীরে গিঁথে থাকা হাড়ের অবশেষেও বোধহয় সেই কালো আফ্রিকার হতভাগ্য অ্যারিস্টোক্রেসির চিহ্ন লেগে থাকত।

কিন্তু ‘চাঁদের পাহাড়’-এ কালাহারির বুকে আমরা সেই সব অসংখ্য জার্মান সেনা ছাউনির কথা পাই না, যা করনেলের লেখায় পাই। হেরেরো যুদ্ধের পর যখন হেরেরো-নামারা কার্যত নিশ্চিহ্ন, তখনও মরুভূমি জুড়ে কী কাজ ছিল সে সব ছাউনির? করনেলেরও প্রশ্ন ছিল তাই। এই রকম এক ছাউনি থেকে হেরেরো যুদ্ধে ট্রান্সপোর্ট ডেলিভারির কাযে যুক্ত ছিল এমন একজন ডাচ বোঅর স্টুরমান-এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল করনেলের। স্টুরমানের কাছ থেকে কালাহারির বুকে দুর্ভাগা হেরেরো ও নামাদের চরম দুর্ভাগ্যের গায়ে কাঁটা দেওয়া প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ পেয়েছিল সে। করনেল সেনা ছাউনিগুলি থেকে নিজেও বিভিন্ন জার্মান সেনাদের কাছ থেকে নানা বিবরণ সংগ্রহ করেছিল। নাৎসিজমানার মতোই জার্মান সৈন্যরা এই পাইকারি গণহত্যার বিভিন্ন রেকর্ড বানিয়ে রাখত নিজেদের মতো করে। যেমন সেই সময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল— ইলাস্ট্রেটেড পোস্টকার্ড। এমনই একটি পোস্টকার্ডের ছবির বর্ণনা নিজের বইতে দিয়ে গিয়েছিল করনেল।

One of these, that enjoyed great vogue at that time, showed a line of 10 hottentots dangling from a single gallows, some still standing on the packing cases with a noose round their necks, waiting for the soldiers to kick their last standing place away; some kicking and wreathing in the death struggle, for the short drop did not break their necks, but only strangled them slowly, and one having a German soldier hanging on to his legs to finish the work more quickly.

জার্মান সাউথ-ওয়েস্ট আফ্রিকার ঔপনিবেশিক পোস্টকার্ডের একটি নমুনা

কেন এমন একটিও পোস্টকার্ড অন্তত চোখে পড়ল না শঙ্করের? সে কি কিশোর মনের নায়ক বলেই? না, বাঙালি শঙ্করের সঙ্গে দেখা হয়নি ইংলিশম্যান ফ্রেড করনেলের। অথচ এক রহস্যময় পর্বতমালার, এক ভয়ঙ্কর মরুভূমির আনাচ-কানাচে সর্বস্ব বাজি রেখে হেঁটে বেড়িয়েছে দুজনেই— একই সময়খণ্ড জুড়ে— সেই একই অশরীরী টানে…।

What gave me ‘Diamond fever’ I don’t pretend to say. Certainly I have no love for the cut and finished article, and nothing would induce me to wear it; but for the rough stone, and for the rough life entailed in searching for it, I have always had a passion.

সেই অমোঘ টানের সূত্রেই অন্তত একটি জায়গায় ইংলিশম্যান ফ্রেড করনেলের স্বরে কোথাও মিলে যায় বাঙালি শঙ্করের স্বর।

The ideal prospector is born, not made. He may be versed in geology and mineralogy an axle with the blowpipe, but unless he has the love of the wild places in his bones he will never fulfil his purpose. He must be an ‘adventurer’ in the older and honourable sense of the word…

কালাহারির বুকে ফ্রেড করনেল

নিশ্চিতভাবে এই হল বিশুদ্ধ ‘অ্যাডভেঞ্চারার’-এর অকৃত্রিম নিষ্পাপ স্বর। যুগ যুগ ধরে মানুষ সে স্বরে রোমাঞ্চিত হয়েছে মানুষ, ছুটে গিয়েছে দেশ-দেশান্তরে… পাগলের মতো। ঝরনার মতো ক্ষরিত হয়েছে অ্যাড্রিনালিন— ভরে উঠেছে সাহিত্যের পাতার পর পাতা— রঙিন হয়ে উঠেছে রুপোলি পর্দা আর টেলিভিশন স্ক্রিন— উছলে উঠেছে ইতিহাস আর জমে উঠেছে অনন্ত রূপকথার স্তুপ। অজানা দেশ, অজানা সংস্কৃতি, অজানা ভূপ্রকৃতি, অজানা জীববৈচিত্র্য, অজানা জলবায়ুর যাবতীয় রহস্যের অন্ধকার ছিঁড়ে ফেলার, অজানা মাটির বুকে আবিষ্কারের গর্বিত বিজয়পতাকা গেঁথে দেওয়ার রূপকথা তারা— ‘লাভ অব দ্য ওয়াইল্ড’। করনেলের ভাষায়—

And the wild must call him. ‘Something hid behind the ranges! Go and look behind the ranges!’ As Kipling has it. That is the true spirit of the prospector.

এই স্পিরিটের কাছে বড্ড বেমানান রাজু পাঁড়ে, দোবরু পান্না। তাই ‘চাঁদের পাহাড়’-এ কোথাও নেই তারা। ‘চাঁদের পাহাড়’ সেই স্পিরিটের আখ্যান, আবিষ্কারের আখ্যান, পুরুষকারের আখ্যান, বিজয়ীর আখ্যান। ‘চাঁদের পাহাড়’ আলভারেজের আখ্যান, লিভিংস্টোনের আখ্যান, স্ট্যানলির আখ্যান। ‘চাঁদের পাহাড়’ একান্তই শঙ্করের আখ্যান, সত্যচরণের নয়। এ এক বিজয় আকাঙ্খার আখ্যান। বিদ্রোহী বাঙালি কবির কলমও সে আকাঙ্খায় চনমন করে ওঠে। শক্ত হয়ে ওঠে নবযৌবন-কৈশোরের হাতের মুঠো।

পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, উঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে;
বিশ্ব-জগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।

সে এক অমোঘ টান। এক অশরীরী টান। গ্লোরি আর মাসক্যুলিনিটি যেখানে প্রপেলারের মতো কাজ করে। আমার দূর-সম্পর্কীয় এক দিদিমা ছিলেন। সারা জীবন মোট তিনটি জায়গায় থেকেছেন। তিনটি লোকালয়। প্রথমটি তাঁর ওপার বাংলার বাপের বাড়ি। দ্বিতীয়টি তাঁর ওপার বাংলার শ্বশুর বাড়ি, তারপর শেষে দেশভাগের পর উচ্ছেদ হয়ে এপার বাংলার বাড়ি। এর বাইরে তিনি কোথাও যাননি। কিছুই দেখেননি। কোথাও যেতে চানওনি। শেষ দুপুরের রোদে নারকেলের পাতা ছাড়িয়ে জড়ো করার পর তিনি আরাম করে খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসতেন আর দু চোখ ভরে তাঁর বাগানখানি দেখতেন। তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হত— দিদিমা, তুমি কোথাও যাও না কেন? তোমার নতুন কিছু দেখতে ইচ্ছে করে না? তখন অমায়িক হেসে অশীতিপর দিদিমা উত্তর দিতেন— এইহানেই যা আছে দেইখ্যা শ্যাষ করতে পারি না, তয় আর কই যামু? দিদিমার পৃথিবী ছিল স্থবির, কার্টোগ্রাফারের দূরবীনে নিতান্তই ছোট; তবু অফুরন্ত। যা তাঁর স্বাভাবিক, তাতেই মগ্ন ছিলেন আজীবন। না, ‘চাঁদের পাহাড়’ একান্তই শঙ্করের নিজস্ব আখ্যান, আমার সেই দূর-সম্পর্কীয় দিদিমার নয়।

সে বেশ অনেকদিনের কথা। ১৯০৯ সাল। এই সময়টাকে বিভূতিভূষণ বেছে নিয়েছিলেন শঙ্করের যাত্রাকাল হিসেবে। করনেলের প্রস্পেকটিং-ও ওই একই সময়ের আশেপাশে। একই বছরে নিউ ইয়র্ক থেকে মার্কিন কিশোরদের জন্য টুডর জেঙ্কস-এর কলমে একটি বই প্রকাশিত হয় এবং বহুল প্রচারিতও হয়। বইটির পুরো নাম— ‘দ্য বয়েজ় বুক অব এক্সপ্লোরেশানস— ট্রু স্টোরিজ় অব দ্য হিরোজ় অব ট্রাভেল অ্যান্ড ডিসকভারি ইন আফ্রিকা, এশিয়া অ্যান্ড অস্ট্রেলিয়া ফ্রম দ্য ‘ডার্ক এজেজ়’ টু দ্য ‘ওয়ান্ডারফুল সেঞ্চুরি’। লক্ষণীয়, শিরোনামেই বইটি আফ্রিকা, এশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে ইউরোপীয়দের দখলে আসার আগের শতাব্দীগুলোকে ‘ডার্ক এজ’ ও ইউরোপীয়দের দখলদারির শতাব্দীটিকে ‘ওয়ান্ডারফুল সেঞ্চুরি’ ঘোষণা করে রেখেছে।

অন্ধকার থেকে ‘ওয়ান্ডারফুল সেঞ্চুরি’-তে পৌঁছনো পৌরুষের মূলমন্ত্রই ছিল— ‘লাভ অব দ্য ওয়াইল্ড’। পাখির চোখ ছিল— ‘সামথিং হিড বিহাইন্ড দ্য রেঞ্জেস’। এ যেন লন্ডনের ছাপাখানা থেকে ছেপে বেরোনো লিভিংস্টোনের ঝকঝকে এনগ্রেভিং প্লেট। আলোকবর্তিকা হাতে ধূ-ধূ অন্ধকার চিরে এগিয়ে চলেছেন মহান দেশ-আবিষ্কারক। সামান্য নুব্জ কাঁধে তাঁর ‘হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন’। ‘দ্য বয়েজ় বুক অব এক্সপ্লোরেশানস’ শুরু হচ্ছে এভাবে—

Open your Atlas to the earliest maps— the rough sketches of an unknown world made by the wisest of the ancients. The geographer of those days was like a lost traveller who stands at night in an unknown land holding a flickering lantern that can light only the little circle close around his feet. Outside is a vast darkness which seems to him to hold unknown terrors.

Go into a great library, revolve a modern globe, and note the thousands of lines, letters and figures upon its crowded surface. Compare the antique chart with the latest globe, and you will have some hint of the work of the explorers— the brave, devoted, chivalrous heroes who have ventured their lives to bring the earth into the possession of man.

–The Boys Book of Explorations, p.27-28.

রিডার্স ডাইজেস্টের প্রকাশনা থেকে বাবার আনিয়ে দেওয়া র‍্যান্ড-ম্যাকনেলির অ্যাটলাসটা হয়তো আজও আছে। মাঝে মাঝে খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু খুঁজে কী হবে? আশি সালে প্রকাশিত সে ঢাউস মানচিত্র-বই আজকের জিপিএসের যুগে যে নিতান্তই অকেজো, তা বোধহয় সে নিজেই বুঝতে পেরে কোন ধুলোর অন্ধকারে লুকিয়ে পড়েছে! তখনও তার পাতা আজকের গুগল ম্যাপের মতো গিজগিজে ছিল না। অক্ষরহীন অনেকখানি ফাঁকা জায়গার সাইবেরিয়া নিয়ে একটা আস্ত সোভিয়েত ইউনিয়নও ছিল। ছেলেবেলার প্রায় সবকিছুর সঙ্গে সে মানচিত্রও আজ বদলে গিয়েছে। যাক সে কথা…

কিন্তু মানচিত্রের ফাঁকা জায়গাগুলো তো আর সত্যি সত্যি ফাঁকা ছিল না। সেখানে হাজার হাজার বছর ধরে একইভাবে খেলা করে চলে জলবায়ু-প্রকৃতি-জীববৈচিত্র্য-মানুষ নিরন্তর। ছোট ছোট স্রোতধারার মতো কুল কুল করে স্থানীয় আদানপ্রদান ও সংস্কৃতির চলাচল। কিন্তু র‍্যান্ড-ম্যাকনেলির পাতার ফাঁকা জায়গাগুলির নাম দাগিয়ে ভরে দেওয়ার ক্ষমতা তার নেই। সে পাতা খালিই থাকে যতক্ষণ না কোনও এক দেশ আবিষ্কারকের লণ্ঠনের আলো সেখানে গিয়ে পড়ে। হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেন কাঁধে নিয়ে লিভিংস্টোনের মতো কেউ একজন গিয়ে সেই অন্ধকারে আলো জ্বালে। সভ্য মানুষের বৈজ্ঞানিক কৌতূহল নিবৃত্তির স্পিরিটে ক্রমে গিজগিজে দাগে আর নামে ভরে যায় র‍্যান্ড-ম্যাকনেলির ফাঁকা পাতা।

Just as a boy’s curiosity becomes developed into a man’s thirst for knowledge, so has the desire of early explorers to see strange and remarkable places been expanded into a devotion to science that looks upon every unknown portion of the earth as a challenge to mankind’s exploring spirit.

–The Boys Book of Explorations, p.35.

সভ্যতা পৌঁছে যায় র‍্যান্ড-ম্যাকনেলির পাতা ভরা মানচিত্রের অক্ষরহীন বন্য এলাকায়। হোয়াইট ম্যান’স বার্ডেনের সৌজন্যে আলোকিত হয়ে ওঠে অন্ধকার ভূমিভাগ। লিভিংস্টোনের একক লণ্ঠনের আলো সে অন্ধকার প্রথম স্পর্শ করলেও অতি দ্রুত তাকে অনুসরণ করে পৌঁছে যায় তিন ‘সি’— সিভিলাইজেশন, কমার্স আর ক্রিস্টিয়ানিটি। আর অবশ্যই সেই অদৃশ্য চতুর্থ ‘সি’-টি, যার নাম কলোনাইজেশন।

The explorer is the pioneer of civilization; but no matter how far he may go, the trader is quick to follow at his heels, and nowadays the civil engineer and surveyor soon arrive to prepare the way for the locomotive and telegraph. The conquest of the wilds follows so fast that the children of the first discoverer may find a home at the end of their fathers root, and a home surrounded by all the advantages of civilized life…

–The Boys Book of Explorations, p.39.

অদম্য স্পিরিটে উধাও হয়ে যেতে থাকে কূল-গোত্রহীন মানুষের জৈবনিক চলাচল। উধাও হয়ে যায় অনামা মানুষের এতাবৎ অজ্ঞাত প্রকৃতিবাস। কারণ বন্যতার অন্ধকারে সভ্যতার আলো ঢুকে পড়ে। সভ্যতা অন্ধকার বিচার করে। দাগ দিয়ে দেয়। খোপে পুরে ফেলে যাবতীয় আঞ্চলিক ইতিহাসের অনবদ্য বিভিন্নতা। অন্ধকার সংরক্ষণের মতোই খোপগুলির জায়গা হয় সভ্যতার মিউজিয়মে। শোকেসের নিচে গ্রাভিউর প্লেটে লেখা থাকে নির্বিকল্প স্ট্যাচুটরি ডিক্লারেশন।

No civilization is perfect, but no civilization is worse than barbarism, with superstition, slavery, cannibalism, and tyranny; and from these terrors the explorers have freed millions of the oppressed of mankind.

–The Boys Book of Explorations, p.41.

 

সেই সব জোনাকিরা

দেশ-আবিষ্কারক খুঁজতে চায়; প্রস্পেকটর খুঁড়তে চায়; সভ্যতা জুড়তে চায়। জুড়তে চায় তার নিজের লণ্ঠনের আলোয়। নিভে যায় সব প্রাকৃতিক জোনাকিরা। নামের ভারে, দাগের হিজিবিজিতে ভারি হয়ে আসে র‍্যান্ড-ম্যাকনেলির পাতা। জুড়ে যায় সমস্ত অক্ষরহীন ফাঁকা অক্ষাংশ-দ্রাঘিমাংশ। যেমন করে সিসিল রোডস হুঙ্কার ছেড়ে বলে— আই উড অ্যানেক্স দ্য প্ল্যানেটস ইফ আই কুড। যেমন করে সভ্যতার অগ্রগামী কিশোর মন উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে অজানাকে জানার নেশায়। কাদামাটির অন্ধকারে আলো বয়ে নিয়ে যাওয়ার নেশায়।

The explorers and the captains of our race. They have now marched forward to begin the conquest of the new lands that we are to hold.

–The Boys Book of Explorations, p.40.

শুরু হয় প্রতিযোগিতা। অজানাকে জানার… দেশ আবিষ্কারের… দেশ দখলের প্রতিযোগিতা। শঙ্কর জার্মান পর্যটক অ্যান্টন হাউপ্টমানের মাউন্টেন অব দি মুন[2] পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। আবার ফ্রেড করনেল কালাহারির মাটিতে দেখা পেয়েছিল সমনামী আরেক জার্মান— হাউপ্টমান মুলারের। জার্মানরা তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে দেশ দখলের প্রতিযোগিতায় মত্ত। যদিও জার্মানিকে এ ব্যাপারে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছিল ইউনিয়ন জ্যাক। করনেলের কাছে হাউপ্টমান রেখেছিল তার অনাবিল স্বীকারোক্তি—

‘উই কেম লেট, ইউ ইংলিশ হ্যাড অল দ্য গুড ল্যান্ড। বাট নাউ উই হ্যাভ ডায়মন্ডস অ্যান্ড কপার হিয়ার, অ্যান্ড হোয়েন দ্য প্রটেক্টরেট পেজ় উই উইল ডেভেলপ দিস কান্ট্রি— দ্যাট ইজ়, ইফ উই হ্যাভ নট ফট ইউ বিফোর দেন।’ হাউপ্টমান মনে করত ব্রিটেন আর জার্মানির যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। ‘ইউ ইংলিশ হ্যাভ দ্য পিক অব দ্য ওয়র্ল্ড, বাট ইউ ক্যাননট কিপ ইট। ইউ হ্যাভ নো আর্মি অ্যান্ড উই আর বিল্ডিং আ নেভি দ্যাট উইল ইকোয়াল ইয়োর ওন। অ্যান্ড হোয়েন ‘দ্য ডে’ কামস উই শ্যাল স্ম্যাশ ইউ আপ অ্যান্ড টেক হোয়াট উই ওয়ান্ট, অ্যান্ড ইউ উইল ডিক্লাইন ইনটু আ লিট্‌ল সেকেন্ড-রেট পাওয়ার। উই মাস্ট ডু সো; ইউ ক্যাননট কনফাইন আস টু ইউরোপ অ্যান্ড দ্য ওয়েস্ট প্লেসেস অব দ্য আর্থ।’

বোঝা গিয়েছিল হেরেরো ও নামাদের নিকেশ করার পরেও কালাহারির বুকে অত জার্মান সেনাছাউনি কিসের উদ্দেশ্যে মোতায়েন ছিল। কিছুদিন পরেই পৃথিবী দেখেছিল প্রথম মহাযুদ্ধের তাণ্ডব। এবং সে যুদ্ধে যে হাউপ্টমানের আশা দুরাশায় পরিণত হয়েছিল, তা বলাই বাহুল্য। সাম্রাজ্যের খেলায় জার্মানি নয়, বরং উত্থান ঘটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। সভ্যতার ব্যাটন এক হাত থেকে আরেক হাতে ফেরে। দখলের বিজয়পতাকা এক রং থেকে আরেক রঙে গিয়ে মেশে। সভ্যতার জোড়ার খেলায় কাদামাটির অনামা পৃথিবীর লক্ষ বছরের যাবতীয় প্রাকৃতিক-মানবিক সম্পর্কের আদিম স্রোতধারা স্তব্ধ হয়ে আসে। প্রকৃতি রূপান্তরিত হয় সম্পদের এককে। মানুষ রূপান্তরিত হয় দাসশ্রমের এককে। কাদামাটির পৃথিবীর সমস্ত গল্প ধ্বংস হয়ে শেষে শুরু হয় ইলাঙ্গা-র[3] গল্প। ইলাঙ্গা এক রমণী। কাদামাটির কঙ্গো তার দেশ।

গ্রামের নেতা নিয়েন্দোর নামে নাম মিলিয়ে আমাদের গ্রামের নামটি ছিল ওয়ানিয়েন্দো। কাসাভা আর ভুট্টার ক্ষেত দিয়ে ঘেরা বড় গ্রামটির পাশেই বইত এক ছোট্ট নদী। আমরা প্রাণপণ মেহনত করে ফসল ফলাতাম। তাই আমাদের খাদ্যের চিন্তা ছিল না। আমাদের দেশে কখনও যুদ্ধ হয়নি। যুদ্ধ কী জিনিস আমরা জানতাম না। গ্রামের পুরুষদের কাছে তাই সাধারণ ছুরি ছাড়া আর কোনও অস্ত্রও ছিল না।

কিন্তু শঙ্কর যে সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করছিল, তার আয়ত্তে ছিল সভ্যতার আধুনিকতম ধাতুবিজ্ঞান। তাই তার কাছে উইনচেস্টার ছিল। ছিল ম্যাক্সিম গান। সভ্যতা ক্রমেই এগিয়ে চলে। সামনের দিকে। পিছনে হাঁটতে সে জানে না। অথচ এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিল চ্যাথাম আইল্যান্ডে। যে সময় পলিনেশিয়ান কৃষক-জাতি মাওরি-রা পৌঁছেছিল নিউজ়িল্যান্ডের মূল ভূখণ্ডে, মাওরিদের একটি শাখা মোরিওরি-রা সময়ের এক অদ্ভুত সন্ধিক্ষণে কোনওভাবে এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপটিতে পৌঁছেছিল। কৃষিজ্ঞান তাদের আয়ত্তে থাকা সত্ত্বেও সেই সম্পদশালী দ্বীপে তাদের সে প্রয়োজন ফুরিয়েছিল। তারা আবার তাদের শিকারি-কুড়ুনি জীবনে ফিরে গেল। সম্পদের তারতম্য না থাকায় তাদের যুদ্ধাস্ত্রের প্রয়োজনও ফুরিয়েছিল। এক সরলতর সামাজিক ব্যবস্থা আর সামান্য কিছু বুনিয়াদি অস্ত্রের সাহায্যেই তাদের জীবন সুখে কেটে যাচ্ছিল। অফুরান সম্পদের দ্বীপ ছেড়ে যাওয়ার প্রয়োজনও আর না থাকায় তাদের নৌশক্তিরও কোনও দরকার আর ছিল না। কিন্তু সভ্যতা মোরিওরিদের এই পিছিয়ে যাওয়াকে মান্যতা দেয় না। সে শুধু এগিয়ে চলে। তার নিজের হিসেবে। তার দরকার আধুনিকতম সমরাস্ত্র। আধুনিকতম বাঁচার মানে। আধুনিকতম অর্থনীতি। আধুনিকতম সমাজনীতি। এগিয়ে চলার যাবতীয় রসদ সে পিছিয়ে পড়ার দুর্ভাগ্য থেকে শুষে নিয়েই এগিয়ে চলে। হাতের মুঠোয় নিতে চায় তার যাবতীয় উপকরণ। বাকি সব তার কাছে মূল্যহীন। ইলাঙ্গা বলে চলে—

তখন আমরা জমিতে রুইছিলাম, কারণ সেই সময়টা ছিল ভরা বর্ষা; ভুট্টাচারা এই সময়ই দ্রুত বেড়ে চলে। এমন সময় দৌড়ে আমাদেরই একজন এসে খবর দিল— লাল টুপি ও নীল জামা পরে, হাতে লম্বা ছুরি ও বন্দুক নিয়ে সাদা মানুষের দল আমাদের গ্রামের দিকেই আসছে।

এইভাবেই গ্রামের পথে দেখা দিত এক্সপ্লোরারদের তল্লাসি দল। এভাবেই কাদামাটির পথে পথে দেখা দিত লিভিংস্টোন, মাঙ্গো পার্ক, স্ট্যানলির দল। এভাবেই হয়ত দেখা দিতে পারত শঙ্কর বা ফ্রেড করনেলেরও দল। ইলাঙ্গা আবার বলে—

সেই দলের নেতা ছিল কিবালাঙ্গা[4]। নিয়েন্দোর পরামর্শে আমরা সবাই ঝুড়ি ভর্তি করে চীনাবাদাম, কলার কাঁদি আর কাসাভা তাদের জন্য পথের ধারে রেখে এলাম। নিয়েন্দোর যুক্তি ছিল আমরা যত বেশি এসব রাখব, তাতে খুশি হয়ে ওরা আমাদের কোনও ক্ষতি না করেই চলে যাবে। আর হলও তাই।

কিন্তু সভ্যতার ক্ষিদে অত সহজে কি মেটে! এগিয়ে চলার দাম তাকে শুষে নিতেই হয়। কাদামাটির নিয়েন্দো তা যদি জানত। ইলাঙ্গা বাকিটা বলে চলে—

কিন্তু একটু পরেই ওরা ফিরে এল। আমাদের গ্রামের যত মুরগি আর ছাগল ছিল, সব ছিনিয়ে নিল আর গ্রামের পাশেই তাঁবু গেড়ে বসল। আমরা তখনও কিছু মনে করিনি, কারণ ওরা তখনও আমাদের গায়ে হাত দেয়নি। কিন্তু পরের দিন সকালে ওরা বাড়ি বাড়ি ঢুকে সবাইকে বের করে নিয়ে এল। আমাদের বাড়ি থেকে আমাকে, আমার স্বামী ওলেকা আর আমার বোন কাতিঙ্গাকেও তাই করল। তারপর আমাদের প্রত্যেককে প্রত্যেকের সঙ্গে গলায় শক্ত করে দড়ি বেঁধে নিয়ে চলল। আমরা সবাই কাঁদছিলাম, আমরা আন্দাজ করছিলাম ওরা আমাদের দাস বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা আমাদের চুপ করাতে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে মারছিল। পথে আমাদের ভারি খাবারের ঝুড়ি বইতে হচ্ছিল, যার থেকে মানুষের পোড়া মাংসের দুর্গন্ধ বেরিয়ে আসছিল। আমার বোন কাতিঙ্গা তার শিশুটিকে নিয়ে ছিল। তাই ও কিছু বইতে পারছিল না। ওলেকাকে বইতে হচ্ছিল একটি ভারি ওজনের ছাগল। আমাদের পেট খালি ছিল। সারাদিন চলে একটি ঝর্নার জলে আমাদের তৃষ্ণা মেটাতে হল। পথে যত জনশূণ্য গ্রাম পড়ছিল, সেগুলো থেকে সাদারা কিছু না কিছু সংগ্রহ করেই যাচ্ছিল। ফলে মোটের পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছিল। এইভাবে পাঁচদিন চলার পর কাতিঙ্গার শিশুটিকে ওরা তার কোল থেকে টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে মেরে ফেলল। আর তার খালি হাতে ধরিয়ে দিল পরিত্যক্ত গ্রাম থেকে সংগৃহীত বাসন-কোসনের ঝুড়ি। না খেতে পেয়ে আমরা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছিলাম। একসময় আমার স্বামী ওলেকা আর হাঁটতে না পেরে বসে পড়ল। তখন ওরা ওকে নৃশংসভাবে চাবুক দিয়ে মারল। তাতেও ওলেকা উঠে না দাঁড়ানোয় ওরা বন্দুকের ফলা দিয়ে ওকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারল। আমি দেখলাম ওলেকার শরীর থেকে রক্ত গলগল করে বেরিয়ে এল। সেই আমাদের শেষ দেখা। পথে আরও নারী-পুরুষ মারা পড়ল। আরও অনেক শিশুকেই ঘাসের বনে ছুঁড়ে ফেলা হল। শেষ পর্যন্ত গলায় বাঁধা অবস্থায় আমরা সাদাদের শহর নিয়াঙ্গোয়ে-তে এসে পৌঁছলাম।

এইভাবেই চলত ইলাঙ্গাদের শেষযাত্রা

চ্যাথাম আইল্যান্ডের শান্তিপ্রিয়, সভ্যতার স্তরে পিছনের দিকে চলে যাওয়া মাওরিওরি শাখাটির শান্তি বেশিদিন ছিল না। কয়েক শতাব্দী পরেই মাওরিদের মূল শাখাটি, যারা আধুনিক ধাতব অস্ত্র, জটিলতর রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠন ও উন্নত নৌবহরে বলীয়ান ছিল, তাদের আক্রমনে চ্যাথাম আইল্যান্ডের শান্তিপ্রিয় মাওরিওরিরা পৃথিবী থেকেই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ডোডোপাখিদের মতো। যেভাবে গোটা আফ্রিকা জুড়ে লক্ষ লক্ষ ইলাঙ্গার গল্পে কাদামাটি ধুয়ে গিয়েছে। কান পাতলেই শোনা যায় ইলাঙ্গার গল্পরা এখনও কানে কানে ফিসফিস করে চলেছে। পিছিয়ে থাকা সভ্যতার মাসুল এভাবেই দিয়ে চলেছে ইলাঙ্গারা। কলোনাইজেশন থেকে কলোনাইজেশনের ইতিহাসে ক্রমাগত সে গল্প এখনও ঘটে চলেছে। আফ্রিকার কোনায় কোনায়। সারা পৃথিবীর কোনায় কোনায়।

পৃথিবীর এক কোনায় খাস জমির এক ছোট্ট অপূর্ব বাগান নিয়ে বেঁচে ছিলেন আমার সেই দূর-সম্পর্কীয় দিদিমা। তারাহীন রাত্তিরেও তিনি নির্ভয়ে বাগানে হেঁটে বেড়াতেন নিকষ অন্ধকারে। কোনও দেশ আবিষ্কারের লণ্ঠন তাঁর প্রয়োজন ছিল না। কাগজেকলমে জমির মালিকানা তাঁর ছিল না। ভালোবাসার বাগানটুকু চিনতেন হাতের তালুর মতো। সাপখোপেরও ভয় ছিল না তাঁর। তাঁর ছিল ওদের সঙ্গে মিথোস্ক্রিয়ার সম্পর্ক। ব্ল্যাক মাম্বাকে বশ করতে শঙ্করের যেমন উন্নত সভ্যতায় উজ্জ্বল টর্চের আলোর প্রয়োজন হয়েছিল, পিছিয়ে থাকা এক সভ্যতার অধিবাসী দিদিমার দরকার ছিল না তাও। রাতের অন্ধকারে বাগানের মধ্য দিয়ে হেঁটে একবার পুকুরঘাটে যাওয়া ছিল তাঁর রোজকার অভ্যেস। অত্যন্ত সামান্য সেসব চলাচল, সভ্যতার গতির নিরিখে তা স্থবিরতারই নামান্তর।

একদিন দিদিমার স্থবির সেই অচেনা, অজানা জীবনের বন্য উঠোনে পৌঁছে যায় সভ্যতার আলো। লোভী চোখের রহস্যময় প্রাণীদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। মোড়কের প্যাঁচ খুলে অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ে আলোর মতো। দিদিমার বাগানটা দখল হয়ে গেল একদিন। ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরির মাল মশলায় চাপা পড়ে গেল রক্তজবা, শিউলিগাছের ঝাড়। পুকুরটারও আর দরকার ছিল না। বড় সাইজের চৌবাচ্চার মতো সেটার অস্তিত্ব তখনও বজায় ছিল শুধুমাত্র কাঁচা কংক্রিট ভিজিয়ে পাকা করার একমাত্র উদ্দেশ্যে। মাল চুরি আটকাতে লাগানো হয়েছিল হ্যালোজেন আলো। একদিন সেই আলোয় চৌবাচ্চার মতো বেঁচে থাকা অবশিষ্ট পুকুরের জলে সাদা মতো কী একটা ভাসতে দেখা গেল। ধবধবে শাদা থানে জড়িয়ে সে জলে উপুড় হয়ে ভেসে উঠেছিল দিদিমার অশীতিপর শীর্ণ দেহ। সাদা চুলগুলো জলে কেঁপে কেঁপে ভাসছিল আর পিঠে হাড়গুলো উজিয়ে ছিল হারিয়ে যাওয়া সভ্যতার ফসিলের মতো। সেই মারাত্মক টান যা ঘর ছাড়িয়েছিল বাঙালি শঙ্করকে, কেউ যদি শঙ্করকে এটুকু বলে দিত যে সে টানেরই পিছু পিছু শাদা ভাম্বির মতো আবির্ভূত হয় লোভী চোখের রহস্যময় প্রাণীরা… মোড়ক খুলে আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে অন্ধকার আর সেই অন্ধকারে ক্রমে মুছে যায় পৃথিবীর যত ইলাঙ্গারা, আমার সেই দিদিমা, সেই সব প্রাকৃতিক জোনাকিরা!

[ক্রমশ]

____

[1] হটেনটট: দক্ষিণ আফ্রিকার বান্টু জাতিভুক্ত নয় এমন কৃষ্ণাঙ্গ জনজাতিদের ঔপনিবেশিক ভাষায় হটেনটট বলা হত। এখন এদের খোইখোই বলা হয়।
[2] এই বইটি আমি অনেক চেষ্টা করেও জোগাড় করতে পারিনি।
[3] কঙ্গোতে ইংরেজি ও সোয়াহিলি ভাষায় পারদর্শী মার্কিন স্টেট এজেন্ট এডগার ক্যানিসিয়াস ইলাংগার সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন ও তার কাছ থেকে এই স্মৃতিকথা সংগ্রহ করেছিলেন।
[4] কিবালাঙ্গা: রাজা লিওপোল্ডের কুখ্যাত বাহিনি ফোর্স পাবলিক (Force Publique)-এর কুখ্যাত অফিসার অস্কার মিশোঁ-কে কঙ্গোর মানুষেরা এই নামে ডাকত।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4663 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...