Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অক্সিজেন ম্যান – নোনা দ্বীপের বাতিওয়ালা

চার নম্বর নিউজডেস্ক

 

সৌমিত্র মণ্ডল। গোসাবার এক সাধারণ যুবক। তবে গল্পটা এক ট্রানজিশনের। অসাধারণত্বে ওঠার গল্প। কিভাবে? কোন অসাধারণত্ব? সে গল্পে যাওয়ার আগে মানুষটার উঠে আসা, বড় হওয়াটা একটু জেনে নিই।

সুন্দরবনের এক অত্যন্ত নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। সৌমিত্রের ছোটবেলা। নস্টালজিয়া। আর সেখানেই কষ্ট দানা বাঁধে বুকের ভেতরে। পড়াশুনোর জন্য নিজের ঘর, নিজের গ্রাম ছেড়ে কলকাতার কাছে এসে আত্মীয়দের বাড়িতে বড় হতে বাধ্য হওয়া সৌমিত্র এক এক করে স্কুলের গণ্ডি, কলেজের সিলেবাস পেরোলেন। কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে জিওগ্রাফি অনার্স এবং পরে বি.এড ডিগ্রি। এলিট ভারতবর্ষ তাতে নাক কোঁচকালেও সৌমিত্র জানেন, স্বপ্ন দেখতে হলে এটুকুতেই হাঁটা যাবে। হাঁটা যায়। সৌমিত্র হাঁটলেন।

শিক্ষা শেষ করে গোসাবার বালি, অর্থাৎ নিজের গ্রামে ফিরে এলেন। স্থানীয় একটি সরকারি স্কুলে ভূগোলের পার্ট টাইম টিচারের কাজ পেয়ে সৌমিত্র সিঁড়িতে পা রাখলেন। সামান্য ৩০০০ টাকা মাইনের চাকরি। কিন্তু এহ বাহ্য। নিজের গ্রামের, নিজের বেড়ে ওঠার রাস্তায় এক প্রজন্ম ব্যবধানের কিছু স্বপ্নকণ্ঠকে পড়ানো – এ তো স্বপ্ন হাতে পাওয়া। সৌমিত্র সেই স্বপ্নকেই বড় করতে শুরু করলেন। এলাকার অসম্ভব গরিব, কিছুই প্রায় দিতে না পারা পরিবারের ছেলেমেয়েদের ফ্রি কোচিং করাতে শুরু করলেন। স্থানীয় এনজিও বা সরকারি সংস্থার থেকে সাহায্যে স্কলারশিপের জোগান দেওয়া – নিজের হাতে তৈরি সেইসব ছোটছোট মুখকে স্কুল, কলেজের গণ্ডি টপকে উচ্চতর শিক্ষার উঠোনে পাঠানো – সৌমিত্র স্বপ্নকে এভারেস্টে নিয়ে গেলেন। মাধ্যমিকে নিজের ২০জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ১৮জন ভূগোলে শতকরা আশি পেল। এতটা পারবেন, ভাবেননি। আর সেখানেই টুইস্ট।

স্বপ্নে সব রাস্তা সমান না। কিছু উঁচুনিচু, বন্ধুর। ২০১৯। সৌমিত্র চাকরি হারালেন। পার্ট টাইম টিচার পোস্টকে পার্মানেন্ট পোস্ট দিয়ে ভরাট করে দেওয়ার কথা ভাবল সরকার। সৌমিত্রর জায়গায় এলেন অন্য কেউ। প্রথাগত শিক্ষা জায়গা পেল। ছোট ছোট মুখগুলো তাদের পরিচিত আশ্রয়, ভরসা হারাল। যদিও ফ্রি টিউশন সমানে দিয়ে যেতে থাকলেন সৌমিত্র। এখনও দিচ্ছেন। কিন্তু কাজ, চাকরি। ভাঁড়ার যে শেষ হয়ে আসছে …

গল্পটা তাই শুধু এই ফ্রি কোচিং-এর না। গল্পটা অতিমারিমুখর ভয়ঙ্কর, অসহায় ভারতবর্ষের। সে গল্পেও সৌমিত্র এক কাণ্ডারি। চাকরি হারানো সৌমিত্র মণ্ডল স্বপ্নের আরেকটি প্ল্যাটফর্ম পেলেন। অস্কিজেন। শ্বাসবায়ু। অতিমারি আক্রান্ত সুন্দরবনের গ্রামে গ্রামে একটি পুরোনো সাইকেলে চেপে অক্সিজেন সিলিন্ডার, ক্যান বা কনসেন্ট্রেটর পৌঁছে দিতে থাকলেন। অথবা কোথাও কেউ আক্রান্ত হলেই ডাক্তারকে ফোন করে দরকারি ওষুধপত্রও। কে বা কারা সাহায্যে এসেছেন? সৌমিত্র জানেন এ লড়াই-এ তিনি একা নন। তাঁর একার সাইকেল জার্নির শ্রম, ঝুঁকিপূর্ণ কোভিড পরিবেশে তাঁকে আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় তাঁর যাতায়াতে সমস্তরকম আর্থিক খরচ জোগাচ্ছে প্রশাসন। পাশে এসছে এনজিও। মুক্তি বা কিশলয় ফাউন্ডেশন থেকে দুটি অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর দেওয়া হয়েছে সৌমিত্রকে। বেশ কিছু সমাজকর্মীর থেকে বিনামূল্যে অক্সিজেন সিলিন্ডারও পেয়েছেন।

কিন্তু অন্যান্য ঝুঁকি? সংক্রমণ? পরিশ্রম? গোসাবা ব্লকের ৯টি দ্বীপে মাত্র একটি হাসপাতাল থাকা এক সমাজের বাসিন্দা সৌমিত্রের মতো মানুষরা জানেন, তাঁদের আর কোনও অপশন নেই। ভারী অক্সিজেন সিলিন্ডার সাইকেলে বেঁধে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার প্রত্যন্ত গ্রামে আসা যাওয়া – সৌমিত্রের হাঁফ ধরলেও প্যাডেল থামে না। কিন্তু সংক্রমণের ঝুঁকি? সৌমিত্র নিজে সিভিয়ার ডায়াবেটিক। ঝুঁকি এমনিতেই বাকিদের থেকে বেশি। লড়াই করতে করতে গত ২০২১-এর জুনে সৌমিত্র নিজেই অসুখে পড়লেন। পজিটিভ। সেরে উঠলেন। একটু বিরতি। আবার শ্রম। অক্সিজেন। সৌমিত্র কাজে ফিরলেন, নিজের স্বপ্নে ফিরলেন।

তৃতীয় ঢেউ হয়তো ততটা ভয়ঙ্কর হয়নি। তবু, যেখানেই ডাক পাচ্ছেন, সাইকেল নিয়ে চলে আসছেন ‘রাজা’, এই ডাকনামে গোটা সুন্দরবন যাকে এই নামে চেনে। তবু, মাঝে মাঝেই চিন্তায় পড়ে যান বছর ২৯-এর এই অক্সিজেন ম্যান। নিজের একটা চাকরি দরকার। একটু আর্থিক সংস্থান। পিতার সামান্য আয় বা অল্প একটু চাষবাসে টান লেগেই থাকে, যা ক্রমশ বাড়ছে দিনের পর দিন। অথবা কাজের ক্ষেত্রে, কনসেন্ট্রেটর ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েও শেষরক্ষা কি হয়? লোডশেডিং? পাওয়ার কাট বড়ই নিয়মিত দ্বীপের আনাচে কানাচে। কনসেন্ট্রেটর চালাতে গেলে তো কারেন্ট প্রয়োজন। ফলে শ্রম অনেকাংশেই দাম পাচ্ছে না। সৌমিত্র তাঁর সাধ্যের সীমা বাড়িয়ে দিয়ে অসুস্থ রোগীকে এমনকী হাসপাতালেও পৌঁছে দিচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে লক্ষণ বুঝে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিচ্ছেন, দিচ্ছেন দরকারি ওষুধ। নিজের ফ্রি কোচিং-এর ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, স্কলারশিপের পাশাপাশি নজর রাখছেন বাল্য বিবাহের কড়া নিষেধাজ্ঞায়। কারণ, পরিবার থেকে এমন কোনও ঘটনা ঘটলেই স্কলারশিপ বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মাস্টার। অক্সিজেন ম্যান। ড্রিম ম্যান।

সৌমিত্র যেন একটা চাকরি পান। সুস্থ থাকুন। নোনা গরিব অন্ধকার ভারতবর্ষকে আলো দিন। ওষুধ দিন। অক্সিজেন দিন। আশা দিন।