Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রিতা মেস্তোকশু: ইনু উপজাতির কবিতা — পরম্পরা ও প্রাকৃতবিশ্বের উত্তরাধিকার

পার্থপ্রতিম মণ্ডল

 

“স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সত্তাকে জানান দেওয়ার মোক্ষম অস্ত্র হল সাহিত্য।” কথাগুলি বলেছিলেন ফরাসি সাহিত্যিক জাঁ মারি গুস্তাভ ল্য ক্লেজিও, তাঁর ২০০৮ সালে প্রদত্ত নোবেল ভাষণে। যাদের লেখালেখি প্রসঙ্গে ক্লেজিওর এ-কথা মনে হয়েছিল তাঁদের মধ্যে সর্বপ্রথম তিনি উল্লেখ করেছিলেন ইনু উপজাতির কবি রিতা মেস্তোকশু (Rita Mestokosho)-র নাম। কিন্তু কে এই রিতা মেস্তোকশু? আমরা পড়ে নেব, নিজেই নিজের সম্পর্কে যে কথা বলেছেন রিতা:

আমি একজন ইনু। আর ‘ইনু’ কথার অর্থ হল ‘মানব’। আমরা ১৫০০-র মতো ইনু পৃথিবীতে এখনও বেঁচে আছি। তাও এগারোটির মতো সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে। আমাদের দুটি সম্প্রদায় বাস করে লাব্রাডর-এ, ইংরেজি তাদের দ্বিতীয় ভাষা। নটি সম্প্রদায় থাকে কেবেক-এ, তাদের দ্বিতীয় ভাষা ফরাসি। আমরা বেঁচে আছি দুই বিশ্বের মাঝখানে— আজকের এই আধুনিক বিশ্ব, আর আমাদের পরম্পরাগত প্রাকৃত বিশ্ব। এই দুই বিশ্বের মধ্যে বোঝাপড়া করে চলা সোজা কথা নয়, কেননা আমাদের পূর্বপুরুষদের মাটি চিরটাকাল আক্রান্ত হয়ে এসেছে বৃহৎ অরণ্য-শিল্প, জলবিদুৎ প্রকল্প আর মাটির নীচে লুকিয়ে থাকা খনিজ উত্তোলনকারীদের হাতে। আমাদের জীবন আর টিঁকে থাকা, বেঁচে থাকা এখনও নদী, বন আর জলাশয়গুলোর টিঁকে থাকার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। ফরাসি ভাষায় লেখালেখির ব্যাপারটাও বেশ বড় ব্যাপার। আমাদের যাবতীয় আশঙ্কাকে কবিতার শব্দে বহির্বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেওয়া তা সম্ভব করেছে।

রিতা মেস্তোকশুর জন্ম কানাডার কেবেক প্রদেশের ছোট্ট গ্রাম একুয়ানিতশিত-এ, ১৯৬৬ সালে। সেন্ট লরেন্স নদীর উত্তর উপকূলে মিঙ্গান-এর ইন্ডিয়ান রিজার্ভ-এ। শৈশবের একটা বড় সময় কেটেছে তাঁর অরণ্যজীবী বাবা-মায়ের সঙ্গে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে। প্রথমে কেবেক সিটি ও পরে মঁত্রেয়াল-এ স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্যে আসেন কেবেক বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি পড়াশোনা করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয় নিয়ে। কিন্তু পড়াশোনার পর আর পাঁচজনের মতো নাগরিক জীবনে নিজেকে হারিয়ে ফেলেননি রিতা। ফিরে এসেছেন তাঁর উপজাতির সমাজে, গড়ে তুলেছেন তাঁর উপজাতির মানুষদের সাংস্কৃতিক সংগঠন “Innu mitshuap uteitun”, ইংরেজিতে যার অর্থ দাঁড়ায় ‘A House of Innu Culture’। উপজাতি অধিকার-রক্ষার এক সক্রিয় কর্মী হিসেবে রিতা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ইনুদের নিজস্ব ভাষা ‘ইনু-এমুঁ’ (Innu-aimun)-র স্বীকৃতি আর প্রকৃতি ও পরিবেশরক্ষার দাবিতে। রোমান নদীতে তাপবিদুৎপ্রকল্পের বিরোধিতায় তাঁর লড়াই ইতিমধ্যেই নজর কেড়েছে।

রিতার কবিতা ও তাঁর সক্রিয় রাজনীতিকে একে অপরের থেকে আলাদা করা সম্ভব নয়। কেননা রিতা বিশ্বাস করেন, রাজনৈতিক ভাষণের চেয়ে কবিতা ইনুদের দাবিকে অনেক বেশি বাঙ্ময় করে তুলতে সক্ষম। মেস্তোকশু তাঁর কবিতাকে ব্যবহার করেন সাংস্কৃতিক অধিকাররক্ষার নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে তুলে নেওয়ার জন্যে। Oxford Handbook of Indigenous American Literature-এ রিতা মেস্তোকশু সম্পর্কে অন্তত এমনটাই বলা হয়েছে।

১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় রিতার প্রথম কবিতার বই Eshi Uapataman Nukum। প্রথম সংস্করণটি ছিল কেবলমাত্র ইনু ভাষায়। ২০১০-এ সুইডেনের প্রকাশন সংস্থা Beijbom Books বইটির ত্রিভাষিক সংস্করণ করে ইনু, ফরাসি ও সুইডিশ ভাষায়। ইনু-এমুঁ ও ফরাসি— একইসঙ্গে এই দুই ভাষার কবি সম্ভবত মেস্তোকশুই প্র্রথম। ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: নে দ্য লা প্লুই এ দ্য লা ত্যের (Née de la pluie et de la terre/‘বৃষ্টি আর মাটিতে প্রসূত’)।

রিতা মেস্তোকশু, আর জঁ দেসি। দুই যাযাবর কবি। দুজনেই ভাগ করে নিতে চান একই আকাশ, একই মাটি, একই জল। এমনই দুই কবির কবিতায় লেখা পত্রবিনিময়, বা বলা যেতে পারে পত্রবিনিময়ের অছিলায় লেখা কবিতার সঙ্কলন Uashtessiu/ Lumiѐre d’Automne (‘লুমিয়ের দোতোম’/ ‘হেমন্তের আলো)। বইটি থেকে রিতার লেখা পাঁচটি কবিতা এখানে মূল ফরাসি থেকে অনুবাদ করে দেওয়া হল।

কথা

নিজেকে আমি তুলে দিয়েছি
সেই ‘মহান আত্মা’র হাতে
আমার অনন্ত কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্যে
যাবতীয় উপাদান আর চর্তুবিধ বাতাসের হাতে
নিয়তি আমার ভাই, আমার বন্ধুও
সে-ই রচনা করে কথার
এই শীর্ণ পথ:

তুমি, যে জানো না ঋতুদের গান
জেনো আসলে তা এক অনন্য শব্দ
এক সঙ্গীত
অন্যতর অনুভূতি এক…

তুমি, যে জানো না বাতাসের নাম
তার নাম নিশ্চয়ই উত্তরদেশীয় সমীর
যা যন্ত্রণাকে ফিনকি দিয়ে বের করে আনে
সব আক্ষেপকে দূর করে দেয়।

তুমি, যে জানো না পাহাড়কে
অথচ তার কোলে বাস করো
জেনো, আমাদের ইনুদের কাছে এই পাহাড় বড় পবিত্র
আমার অস্ট্রেলিয়ার ভাই ‘আনানগুস’দের কাছেও।

তুমি, যে জানো না এই নদীকে
অথচ তার বুকে ভেসে চলো
সেখানে তুমি ডুবিয়ে দাও কল্পনায় দেখা তোমার যত স্বপ্ন
বিসর্জন দাও আসল সত্তাকে।

তুমি, যে কোনওদিন জানোনি এই পৃথিবীর বয়স
দ্যাখো সমুদ্রনুনে তার ত্বক বলিচিহ্নিত
তার অবয়ব রঞ্জিত মানুষের পদচিহ্নে
নৈশকালীন নৃত্যে আর রোদ-ঝলমলে গানে।

এই হল শব্দের অন্তরাত্মা
যা পথ দেখায় লাল পালককে
আমাদের মিলনের রং
নিঃসঙ্গতার রং

Tshima Tshishe-Manitu nakutuenitak innu-aimunne[1]

 

আবার পথে ২

এমনটাই আমি মনে করি
রাস্তার উপর, সমুদ্রের উপর
আমার পায়ের উপর
আমি খুঁটিয়ে দেখতে থাকি আমার প্রতিটি পদক্ষেপ
এগিয়ে দেওয়া, পিছিয়ে নেওয়া প্রতিটি পদক্ষেপ
নোনা জলের পাশে
বিবসন নদীর পাশে
কিনারের নুড়িপাথরের পাশে
আমার হৃদয়ের হাঁটাপথের পাশে
কিন্তু সর্বোপরি
তা হল আমার আত্মা
যে হেসে চলেছে আজ সকাল থেকে।

এমনটাই আমি মনে করি
যে কবিতা মানে হল আমাদের এই যাযাবর জীবনের
টিঁকে থাকা।
আজ রাতে আমি নিজেকে ভাসিয়ে দেব
মানুষের ঘামে,
আর আমার শরীরের ঘাগুলো ধুয়ে নেব
এমনকী পাথরের উত্তাপেও।
নিশ্চুপ আমি গান গাইব
শুধু আমার ভাবনার জোরে।

আমি বিশ্বাস করি
প্রার্থনাই শান্তির একমাত্র উৎস
প্রার্থনা হাঁটে বন্ধুর মতো
কেননা সে কথা বলে নিস্তব্ধতায়
হৃদয়ের ভাষায়।
সে কোনও প্রশ্ন করে না
শুধু মুহূর্তের গভীরতা
ভাগ করে নেয়।

 

মিঠে

শীঘ্রই হেমন্ত
শীঘ্রই রঙের আজাদি

জীবনের হাসি
আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপের কোমলতা
মাটির ঘ্রাণ
নদীর বিস্তার
সমুদ্রের রূপ
আমাদের গভীর বোঝাপড়া
আমাদের শব্দের দূরত্ব
আমাদের ভাষার নিস্বন

এখনও আমাকে পথ দেখায়
এখনও আমাকে খুঁজে বেড়ায়…

আর দূরে ওই সমুদ্র হয়ে উঠবে শব্দহীন
তীরে এসে কড়া নাড়বে তার
ঢেউ আমাদের মনে করিয়ে দেওয়ার জন্যে
আমাদের অস্তিত্বের কথা।

 

সুপ্রভাত, তোমার জন্যে

আর এই সবকিছুর জন্যেই আমি এত সুখী
শুধু থাকাটাই সেখানে এত সুখের
চারপাশে এত জীবনের মাঝখানে
আমি জানি কবিতা উপস্থিত
আমাদের সবার জন্যে
বড় পথের করিগর
আর ছোট রাস্তার
সংকীর্ণ গলিপথের
আর চওড়া বহনপথের।
জীবনের এই প্রশস্থ নদীতে
এসো আমরা শান্তিতে পাল তুলে দিই
আর কথায় উঠে আসুক এইসব শব্দ…

 

আমি এখনও স্বপ্ন দেখি

আমি এখনও স্বপ্ন দেখি
একটা ভাষার যা সমাহিত, হৈ-হল্লাহীন
যে ভাষায় মানুষ এত শব্দ ব্যবহার করে না
মাথা পাগল করে দেওয়া এত শব্দ
একই কথার পুনরাবৃত্তি করে চলা শব্দ।

আমি এখনও স্বপ্ন দেখি

একটা দ্বীপের যেখানে ভালোবাসার
আরেক নাম হৃদয়, বন্ধু
যেখানে আমি জিরোতে পারি
ভয়কে ফেলে রেখে ঘুমিয়ে পড়তে পারি।

আমি এখনও স্বপ্ন দেখি

এমন একটা বন্ধুত্ব সম্ভব হোক
আমাদের এই দুই পৃথিবীর মধ্যে
ওসব নৈতিকতার গালগল্প যেখানে নেই, নেই কোনও সংস্কার
ভীতিহীন, নিরহঙ্কার একটা বন্ধুত্ব।

আমি এখনও স্বপ্ন দেখি

মূক, অবাধ এক হেঁটে চলার
সমুদ্রের পাশাপাশি
আর হালকা পা ফেলে নেচে বেড়ানোর
নদীর গা বেয়ে।

আমি এখনও স্বপ্ন দেখি

প্রকৃত নৈঃশব্দ খুঁজে পাওয়ার
আর মনকে নিমগ্ন রাখার তার ভেতর

আমার বন্ধু আমার হৃদয় অনুচ্চ স্বরে গাইবে
যাতে কেউ ভয় না পেয়ে যায়।

আমি এখনও স্বপ্ন দেখি

ডানাওয়ালা একটা ব্যাপ্তির
যার হিমপ্রান্তর হবে এত সুন্দর
যে তা উড়ে আসবে আমাদের কাছে
যার জলাভূমির পাইনবন পরে নেবে শেওলার পোশাক
আর আমাদের শরীরকে আবৃত করবে।

আর ওই ছোট্ট ভাল্লুকটার ব্যাপারে
আমি এখনও ওর স্বপ্ন দেখি
শুধু প্রার্থনা করি
আমাদের বাসভূমি এই অন্তর্দেশেই যেন থাকতে পায় সে……


[1] ‘মহান আত্মা’ ইনুদের ভাষাকে রক্ষা করুন।