ভাষার বাঁধন, ভাষার মুক্তিও

পার্থপ্রতিম মণ্ডল

 


বিদেশি অনুবাদ-সাহিত্যে এটা প্রায়ই দেখা যায়, অনুবাদের কাজটা অনুবাদক ও লেখকের যৌথ অংশগ্রহণে হয়ে থাকে। বলাই বাহুল্য, আমরা যখন সমসাময়িক বিদেশি লেখকদের কাজ বাংলায় তরজমা করি তখন এভাবে ভাবার কোনও চেষ্টাই করি না। তবে একটা কথা মনে রাখা ভীষণ জরুরি। তা হল, অনুবাদের ক্ষেত্রে যে দুটি ভাষা নিয়ে কাজ, সেই দুটি ভাষাই জানা কিন্তু অপরিহার্য। বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রায়ই এমনটা হয় না

 

তিব্বতিতে শব্দটি ‘লো-ৎচা-ওয়া’ (ལོ་ཙཱ་བ)। অর্থ করলে দাঁড়ায়, ‘পৃথিবীর চোখ’। ভেঙে বললে, এমন একজন যিনি জগতের চোখ খুলে দেন। কথাটি এসেছে সংস্কৃত ‘লোকচাক্ষুষ’ থেকে। তিব্বতি ভাষায় এই ‘লো-ৎচা-ওয়া’ শব্দটির অর্থ অনুবাদক। তিব্বতি ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে যাদের সামান্যতম উৎসাহ আছে তারা জানেন, তিব্বতিতে এই ‘অনুবাদক’ শব্দটির গুরুত্বটি ঠিক কতখানি! যুগ যুগ ধরে তিব্বতি সমাজ-সংস্কৃতিতে অনুবাদকের আসনটি শুধু সম্মানের নয়, তা রীতিমতো ঐশ্বরিক।

পাঠকের মনে হতে পারে, আমাদের আলোচ্য বিষয় যখন আজকের অনুবাদসাহিত্য ও অনুবাদকের সমস্যা, তখন হঠাৎ তিব্বত নিয়ে এসব কথা বলার মানেটা কী? মানে আর কিছু না, ‘অনুবাদক’ এই শব্দটির গুরুত্বটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করা। অনুবাদক হতে হলে, তিব্বতিদের কাছে শর্তটা ছিল, তাঁকে শুধু পণ্ডিত ব্যক্তি হলেই চলবে না, হয়ে উঠতে হবে একজন সাধক। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, একজন অনুবাদককে সেই স্তরে উন্নীত হতে হলে খুব কম করে হলেও কুড়ি বছরের গভীর অধ্যয়ন তো প্রয়োজনই, সেই সঙ্গে প্রয়োজন নিভৃতে গভীর তপস্যার। সপ্তম শতাব্দীতে স্রোং-চেন-গাম্পো-র রাজত্বকালে কিংবা তারপরে থোন-মি-সম্ভোটা-র মতো প্রতিভাবান যে তিব্বতিরা ভারতবর্ষে এসেছিলেন তিব্বতের জন্যে এক সুনির্দিষ্ট লিপি তৈরি করতে এবং বৌদ্ধ দর্শনকে সেই ভাষায় অনুবাদ করে দেশে নিয়ে যেতে, তাঁদের কাছে ব্যাপারটা এরকমই ছিল। এমনও বলা হয়, পরবর্তীকালে নানা পরিস্থতিতে মূল গ্রন্থগুলি ধ্বংস হয়ে গেলে সেগুলিকে মূল ভাষায় ফের অনুবাদ করা হয় তাদের তিব্বতি তরজমা থেকে। এবং সেইভাবেই মূল গ্রন্থগুলির পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়। এতখানিই বিশ্বাসযোগ্য নাকি সেইসব অনুবাদ যে, তাতে মূল গ্রন্থগুলিকে প্রায় অবিকৃত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল! শুধু তিব্বতি অনুবাদের ক্ষেত্রেই নয়, প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থগুলির যে চিনা অনুবাদ হয়েছিল তাদের বেলায়ও একই কথা শোনা যায়। বৌদ্ধদর্শনের অনেক অমূল্য গ্রন্থের কথা আমরা জানতেই পারতাম না, যদি না অনূদিত গ্রন্থগুলির হাত ধরে তারা আবার মূল ভাষায় ফিরে আসত।

 

অনুবাদ নিয়ে আমরা যখন আমাদের সমস্যার কথা আলোচনা করি তখন এইসব ইতিহাস আমাদের মাথায় রাখা জরুরি। কেননা, তাতে করে ‘অনুবাদ’ শব্দটির সুপ্রাচীনতা সম্পর্কে একটা ধারণা আমরা করতে পারি। ‘ট্রান্সলেশন স্টাডিজ’ শব্দবন্ধটির জন্ম তো এই সেদিন। সম্ভবত ১৯৭২ সালে আমেরিকান স্কলার জেমস এস হোমস কথাটি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর ‘The Name and Nature of Translation Studies’ শীর্ষক এক নিবন্ধে। অথচ ইংরেজিতে এই ‘ট্রান্সলেশন’ শব্দটির উৎস ল্যাটিন ‘translatio’, যার অর্থ ‘বয়ে নিয়ে যাওয়া’। আর আমরা সবাই জানি, সুমেরীয় মহাকাব্য ‘এপিক অফ গিলগামেশ’-এর কথা, আনুমানিক দু-হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে যা এশিয়ার বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে অনেক তথ্যই আমরা জানতে পারি অনুবাদের কল্যাণে। ১৭৯৯ সালে নাপোলেয়ঁর ফরাসি সৈন্যরা খ্রিস্টপূর্ব ১৯৬ সালের একটি পাথরের ফলক আবিষ্কার করে। ইতিহাসে যা রোসেটা স্টোন নামে পরিচিত। খুব সম্ভবত কোনও মন্দিরের ভেতর ফলকটি রাখা ছিল। রাজা পঞ্চম টলেমি এপিফেনস্-র কোনও ফরমান ফলকটিতে লেখা ছিল। ফলকের গায়ে এই ফরমানটি লেখা ছিল তিনটি ভাষায়— একেবারে উপরে ইজিপ্‌শীয় চিত্রলিপিতে, মাঝে ডেমোটিক স্ক্রিপ্ট-এ, আর তলায় প্রাচীন গ্রিক ভাষায়। এই রোসেটা স্টোনের কথা ইতিহাস বইয়ে আমরা সবাই পড়েছি। প্রাচীন যুগে অনুবাদের চল কেমন ছিল তা বোঝাতে এই ফলকটির কথা প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। শুধু অতীতের রাজারাজড়াদের অনুশাসন বা দলিল দস্তাবেজ নয়, অনুবাদ বিষয়টি কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা প্রাচীন ধর্মপুস্তক অনুবাদের ক্ষেত্রেও বোঝা যায়। আমরা গ্রিক সেপটুয়াজেন্টের কথা পড়েছি। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় থেকে প্রথম শতাব্দীতে গ্রিক ভাষার এই হিব্রু বাইবেলটি অনুবাদ করতে কাজে লাগানো হয়েছিল সত্তরজন অনুবাদককে। সেপটুয়াজেন্ট শব্দটি সে কারণেই ব্যবহার করা।

 

কাজেই যে কথাটা বলার, ‘ট্রান্সলেশন স্টাডিজ’ সাম্প্রতিককালে সাহিত্য ও ভাষাতত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠলেও, অনুবাদের ইতিহাস কিন্তু মানুষের সভ্যতার ইতিহাসের মতোই সুপ্রাচীন। সেই সুদুর অতীত থেকে মানুষ অনুবাদের গুরুত্ব উপলব্ধি করে এসেছে, অনুবাদের পেছনে শ্রম ও সময় ব্যয় করেছে, অনেক পরীক্ষানিরীক্ষার পথও অতিক্রম করেছে।

 

এইসব ইতিহাস মনে পড়লে লেখালেখির বাজারের কিছু কিছু কথাবার্তায় বেশ কৌতুক হয়। হাতে কোনও বড় লেখার কাজ নেই, তাই বাড়িতে বসে কিছু অনুবাদ করছি। কিংবা, আজ অমুক কবির তমুক কবিতাটি পড়ে চমকে গেলাম। বাড়িতে ফিরেই বাংলায় তার একটা তরজমা করে ফেললাম। এরকম কথা প্রায়ই কানে আসে। আমরা তিব্বতের অনুবাদের কথা বলছিলাম। সংস্কৃত থেকে তিব্বতিতে দর্শন ও কাব্যতত্ত্বের যেসব অনুবাদ হত তাতে কম করে হলেও দুজন মানুষের অংশগ্রহণ থাকত। একজন তিব্বতি অনুবাদক, অন্যজন কোনও সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতের কাজ ছিল মূল টেক্সটটি জায়গায় জায়গায় বিশ্লেষণ করে দেওয়া ও অনুবাদকের যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। কখনও কখনও তৃতীয় আরেকজনও পুরো প্রক্রিয়াটিতে জড়িত থাকতেন। তাঁর কাজ ছিল অনুবাদের পুরো খসড়াটি পরিমার্জন করা। তা হলেই বুঝুন।

অনেকেই বলবেন, গল্প-কবিতা-উপন্যাসের অনুবাদ এভাবে হয় নাকি! প্রাচীন কাব্যতত্ত্ব বা দর্শনের সঙ্গে গল্প-কবিতা-উপন্যাসের তুলনা করার কোনও মানে হয় না। তাছাড়া আজকের দিনে এভাবে অনুবাদের কথা কল্পনা করাটাও অবাস্তব একটা ব্যাপার। অনুবাদকর্মকে যাঁরা কেবলমাত্র অবসর সময়ের সদ্ব্যবহার বলে মনে করেন তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের বই যখন ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয় তখন কিন্তু পুরো বিষয়টাকে ঠিক এতখানিই গুরুত্ব দেওয়া হয়।

মার্কেজকে বেশিরভাগ মানুষই চিনেছেন তাঁর উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ পড়ে। মার্কেজের প্রধান দুই অনুবাদক এডিথ গ্রসম্যান এবং গ্রেগরি রাবাসা শুধু যে মার্কেজের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাই নয়, এই দুই অনুবাদকের উপর মার্কেজের আস্থা ছিল অগাধ। তাঁদের প্রশংসায় তিনি উচ্ছ্বসিত ছিলেন। এই দুই অনুবাদক যে কেবলমাত্র তাঁদের বুদ্ধির উপর নির্ভর না করে তাঁদের বোধকে কাজে লাগিয়েছেন, এ-কথা মার্কেজ নিজে উল্লেখ করেছেন। অনুবাদককে অনুবাদের কাজে যে কতটা সজাগ থাকতে হয় তার প্রমাণ আমরা গ্রসম্যানের কথায় পাই। গ্রসম্যান এক জায়গায় বলেছেন, মার্কেজ স্প্যানিশে -mente প্রত্যয়যুক্ত ক্রিয়াবিশেষণ ব্যবহার করেন না, তিনি নিজেও তাই ইংরেজিতে অনুবাদের সময় -ly প্রত্যয়যুক্ত ক্রিয়াবিশেষণ যতটা সম্ভব এড়িয়ে গেছেন। কোথাও ‘slowly’ লেখার প্রয়োজন হলে তিনি ‘without haste’ লিখেছেন। ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় মনে হলেও অনুবাদের কাজটি কতখানি জটিল তা বুঝতে আমাদের সাহায্য করে। অনুবাদের কাজকে যাঁরা সিরিয়াসলি নেন তাঁদের একটি সঙ্কটের ভেতর দিয়ে সবসময় যেতে হয়। তা হল, মূলের শরীরকে যতটা সম্ভব অক্ষুণ্ণ রাখা, আবার তার আত্মাকে অন্য ভাষার পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়া। ভাব ও ভাষার এই সততা অনুবাদকের কাছে এক মস্ত চ্যালেঞ্জ।

গাঈসিয়া মার্কেজ, এডিথ গ্রসম্যান

ব্যাপারটি কেমন তা বোঝাতে অরুণ মিত্র একটি দারুণ উদাহরণ দিয়েছিলেন। বিখ্যাত ফরাসি কবি পল ক্লোদেলের অনুবাদ করা কভেন্ট্রি প্যাটমোর-এর একটি কবিতার কথা তিনি বলেছিলেন। মূল কবিতাটিতে একটি শব্দবন্ধ ছিল, ‘প্যাথেটিক ল্যাশ’ (‘pathetic lash’)। ক্লোদেল ফরাসিতে করেছিলেন, ‘পাতেতিক পোপিয়ের’ (‘pathétique paupiѐre’)। কিন্তু ‘পোপিয়ের’ তো eyelid, eyelash নয়। ‘ল্যাশ’ তো ফরাসিতে ‘সিল’ (‘cil’)। ক্লোদেলের অনুবাদে আপত্তি উঠেছিল। ক্লোদেল চিঠিতে যা জবাব দিয়েছিলেন তা অরুণ মিত্রের অনুবাদেই তুলে দিচ্ছি। “দুর্ভাগ্যের বিষয় ‘ল্যাস’কে ‘সিল’ দিয়ে অনুবাদ করা অসম্ভব। একটা হল সেই ‘সিল’ যা বিদুৎস্ফূরণ ক’রে উপরে ওঠে, আর একটি হল সেই ঝালর যা নীচে নামে, সে এক ছায়ার শব্দ, প্রায় নির্বাক। গম্ভীর ‘পোপিয়ের’ শব্দটি বেশি উপযোগী, বিশেষত ‘পাতেতিক’-এর সঙ্গে অনুপ্রাসে।” অনুবাদ অনুবাদই, তা সৃজন-সাহিত্য নয়। তবু কাজটি কতখানি রসবোধের তা, আশা করি, পাঠক এর থেকে বুঝতে পারবেন।

সামান্যতম ভ্রান্তিও অনুবাদের ক্ষেত্রে কতটা বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে তা একবার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আমাদের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক জ্যোতি ভট্টাচার্য। এক ঘরোয়া আড্ডায় হাতে বিষ্ণু দে-কৃত এলিয়টের কবিতার বঙ্গানুবাদ দেখে জানতে চেয়েছিলেন, কেমন লাগছে বইটি। অপরিণত ছাত্রের মুখে পণ্ডিতসুলভ প্রশংসা শুনে স্মিত হেসে বলেছিলেন, ‘দ্য হলো ম্যান’ কবিতার এপিগ্রাফটা দ্যাখো। ‘A penny for the Old Guy’-এর বিষ্ণু দে অনুবাদ করেছেন, ‘বুড়ো মোড়লকে কানাকড়ি’। উনি তো Guy Fawkes-কে আমেরিকান ‘গাই’ করে দিয়েছেন!

 

যাই হোক, যে কথা বলছিলাম, বিদেশি অনুবাদ-সাহিত্যে এটা প্রায়ই দেখা যায়, অনুবাদের কাজটা অনুবাদক ও লেখকের যৌথ অংশগ্রহণে হয়ে থাকে। বলাই বাহুল্য, আমরা যখন সমসাময়িক বিদেশি লেখকদের কাজ বাংলায় তরজমা করি তখন এভাবে ভাবার কোনও চেষ্টাই করি না। তবে একটা কথা মনে রাখা ভীষণ জরুরি। তা হল, অনুবাদের ক্ষেত্রে যে দুটি ভাষা নিয়ে কাজ, সেই দুটি ভাষাই জানা কিন্তু অপরিহার্য। বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে প্রায়ই এমনটা হয় না। অনুবাদক অনুবাদের অনুবাদ, তস্য অনুবাদ থেকে বাংলা তরজমা করে দিব্যি তা পাঠকের কাছে পরিবেশন করছেন। শুধু শখের অনুবাদক নন, নাম করব না, অনেক খ্যতনামা কবি-সাহিত্যিকদের করা এমন অনুবাদ বহু পড়েছি যার মূল ভাষাটি তাঁদের জানা নেই। সেসব অনুবাদ স্বতন্ত্র রচনা হিসেবে হয়তো খুবই চিত্তাকর্ষক হয়েছে, কিন্তু মূল রচয়িতাকে সেখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই সমস্ত লেখাকে অনুবাদ না বলে অনুসরণ বলাই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে করি। এ ব্যাপারেও আমি অরুণ মিত্রের মন্তব্যকে স্মরণ করব:

অনুবাদ-কর্মের প্রথম শর্তই হল দুটি ভাষা সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান। সমান জ্ঞান বলব না। কারণ একদিকে পাল্লা ভারী হবেই… কিন্তু যে ভাষা অনুবাদ করার দায়িত্ব নেওয়া, সেই ভাষা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অপরিহার্য।

একান্তই তা সম্ভব না হলে, দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তির অংশগ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়ে। হাফিজের অনুবাদের ক্ষেত্রে সুভাষ মুখোপাধ্যায় যেটা অকপটে স্বীকার করেছেন। ফারসি তিনি জানতেন না, কিন্তু মূলের প্রতিটি শব্দ ধরে ধরে হাফিজের পদানুসরণে তাঁকে সাহায্য করে দিয়েছেন রেওতীলাল শাহ, উর্দু ও ফারসি দুটি ভাষাই যাঁর জানা। এর মানে আবার এই নয় যে, কোনও একটি ভাষা শিক্ষা করলেই কোনও ব্যক্তির সাহিত্য অনুবাদের স্বাভাবিক অধিকার জন্মে যায়। অনুবাদককে সর্বোপরি একজন সুলেখক হতে হবে। যতই বলি, অনুবাদও একপ্রকার সৃজন বইকি! যিনি নিজে সুলেখক নন কেবলমাত্র ভাষাজ্ঞান তাঁর অন্য প্রয়োজন মেটাতে পারে, তাঁকে সাহিত্য-অনুবাদক করে তুলতে পারে না।

বাংলা অনুবাদ-সাহিত্য নিয়ে এত কথা বলার মানে এই নয় যে, বাংলা অনুবাদের ধারাটিকে অগুরুত্বপূর্ণ প্রতিপন্ন করা। বাংলায়, বিশেষত কলকাতায়, বিদেশি ভাষাচর্চার একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস ও গৌরবোজ্জ্বল পরম্পরা আছে। অনেক প্রথিতযশা ও বিদ্বান মানুষ এ ধারাটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। এই মুহূর্তেও অনেক মূল্যবান অনুবাদ-কর্ম বাংলায় হয়ে চলেছে। যেটা জরুরি তা হল, এ ব্যাপারে একটু প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা। ভাল অনুবাদ-সাহিত্য ছাড়া কোনও দেশের সাহিত্যই সমৃদ্ধ হতে পারে না। বাংলাতে পৃষ্ঠপোষকতা না পেয়ে, বিক্রি ও বণ্টনের নিশ্চয়তা না পেয়ে, অনেকেই এখন মাতৃভাষা ছেড়ে ইংরেজিতে অনুবাদের দিকে ঝুঁকছেন। ইংরেজি অনেক বাঙালিরই মাতৃভাষাতুল্য। তবু বাংলার জল-মাটি-বাতাসে যিনি বড় হয়েছেন, বাংলা ভাষার সঙ্গে যাঁর নাড়ির সম্পর্ক তাঁর পক্ষে বাংলাতে অনুবাদ করাটাই যুক্তিযুক্ত। জার্মান যাজক, থিওলজিশিয়ান ও সুলেখক মার্টিন লুথার কিংবা ওহান গডফ্রিয়েড ফন হের্ডার-এর মতো মানুষেরা যা অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলেন। মাতৃভাষাতে অনুবাদ যতটা বিশ্বাসযোগ্য ও সফল হয়, দ্বিতীয় কোনও ভাষাতে তা কখনও সম্ভব নয়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4664 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...