অনুবাদের অর্থনীতি, অনুবাদকের সঙ্কট

শুভদীপ বড়ুয়া

 


অর্থনীতির সবরকম চলনে যেমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে রাজনীতি, অনুবাদ-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাই। বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ-সাহিত্যের অপ্রতুলতার কারণ আলোচনায়, বিশেষজ্ঞরা লগ্নির অভাবকেই একমাত্র কারণ ঘোষণা করে দিয়ে দায়সারাভাবে আলোচনার ইতি টানেন। কিন্তু লগ্নির এহেন শোচনীয় অবস্থার কারণ কী হতে পারে?

 

অনুবাদ প্রসঙ্গে একবার ইতালো কালভিনো বলেছিলেন ‘অনুবাদ না হলে আমি থেকে যেতাম আমার দেশের সীমাটুকুর মধ্যে। একজন অনুবাদক আমার জন্য বিরাট বড় সহায়। যিনি বিশ্বের কাছে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।’ কালভিনো একা নন, কৃতি সাহিত্যিকেরা সকলেই স্বীকার করে গিয়েছেন মুক্তচিত্তে, তাঁরা কীভাবে অনুবাদকের ওপর ভরসা করেন, কতটাই বা করেন। ১৯৬৮ সালের নোবেল পুরস্কার-গ্রহণ বক্তৃতায় কাওয়াবাতা ইয়াসুনারি সরাসরি তাঁর একমাত্র অনুবাদক এডোয়ার্ড সাইডেনস্টেকারের অসামান্য কৃতিত্বকে বারংবার উল্লেখ করেছিলেন। সাইডেনস্টেকারের অনুবাদ ব্যতীত কাওয়াবাতা-র সাহিত্যসম্ভার বিশ্বের দরবারে যথাযোগ্য সমাদৃত হয়তো না-ও হতে পারত। কেবল কাওয়াবাতা বা কালভিনো নন, বিশ্বের সর্বকালের সকল কৃতি সাহিত্যিক তাঁদের অনুবাদকের কাছে কমবেশি ঋণী। যে ঋণটির দায়ভার শুধু একদিককার নয়, অর্থাৎ পাঠকসমাজও প্রায় লেখকের মতোই একইরকম ঋণী বিশ্বের সকল কৃতবিদ্য অনুবাদকের কাছে।

অনুবাদের প্রতি সাহিত্যের নির্ভরশীলতা তাই ভীষণ বাস্তব এবং সুসঙ্গত। শুধুমাত্র ভিন্ন দেশ-জাতি, ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া নয়, অনুবাদের মধ্যে দিয়ে উৎসারিত হয় সাহিত্যের নিত্যনতুন ধারণা, সাহিত্যের ঐতিহ্যবাহী চলনশীলতায় যুক্ত হয় নতুন চেতনার স্রোত। যে-কোনও ভাষার সংশ্লিষ্ট জ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে তার সাহিত্যের যে নিত্য সংলাপ চলে সেটি হয়ে ওঠে আরও সুদৃঢ়। অনুবাদের মাধ্যমে যেটুকু সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ঘটার সম্ভাবনা থেকে যায়, সেটি বাস্তবায়িত হয় তখনই, যখন অনূদিত রচনাটি তার মূল বা আসল-টিকে যথাসম্ভব অনুসরণ করার পরেও ভিন্ন এক স্বতন্ত্র সাহিত্যকর্ম হয়ে ওঠে। কিন্তু সাংস্কৃতিক অসঙ্গতি, চেতনার অমিল, প্রাদেশিক এবং আঞ্চলিক সংস্কৃতি, বিদেশি সংস্কৃতি, সাহিত্যতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্বের জটিল খুঁটিনাটি, সব কিছু পরিহার করে অহেতুক সরলীকৃত অনুবাদের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, যে ভাষায় অনূদিত হচ্ছে কোনও একটি সাহিত্য, সেই অনূদিত ভাষার প্রধান বা চলতি-সংস্কৃতিই শেষ পর্যন্ত প্রাধান্য পায়। ফলে ভিনদেশের চেতনা ও মনন, কল্পনাশক্তি ও সৌন্দর্যবোধ, সেগুলো সবই মাঝপথে পথ হারায় অনুবাদকের নিজের ভাষা এবং সংস্কৃতির প্রতি ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার কারণে। অতি-সরলীকরণ এবং নিজস্ব বাজার-চলতি সংস্কৃতির প্রতি অধিকতর ঝোঁকের ব্যাপারটি পশ্চিমি, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষার সুবিশাল অনুবাদ-সাহিত্যে যথেষ্ট দেখা গিয়েছে। বিশেষত, আধুনিক এশীয় সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদের ক্ষেত্রে খুব বেশি প্রকট এই ব্যাপারটি। নাগিব মাহফুজ, হারুকি মুরাকামি, ইসমাইল কাদারে (ইওরোপীয় সাহিত্যিক), এবং আরও অনেকের বাজার-চলতি ইংরেজি অনুবাদগুলো অনেকটাই পশ্চিমের চেতনার সঙ্গে সাম্যতা বজায় রেখে করা। সেগুলো ইংরেজি বইয়ের বাজারে যথেষ্ট জনপ্রিয়তাও পেয়েছে।

একই সঙ্কট ভারতীয় অনুবাদ-সাহিত্যেও প্রকট। সকলেই জানেন, ভারতের বিশাল সাহিত্য পরিসরে অনুবাদের প্রকৃত জোয়ার আসে স্বাধীনতার পরেই। সরকারি প্রচেষ্টা, সেইসঙ্গে বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষার বিশিষ্ট অনুবাদক এবং বেসরকারি প্রকাশকদের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রাদেশিক-ভাষার তো অবশ্যই, পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার ক্লাসিক-সাহিত্যের অনুবাদের কাজ শুরু হয়েছিল পুরোদমে। ভারত-সরকারের সাহিত্য-অকাদেমির ভূমিকা এই ব্যাপারে অনিবার্য ছিল। স্বাধীন ভারতের কোনও এক প্রদেশের ভাষার সাহিত্যকে অন্য প্রদেশের ভাষায় অনুবাদ করার মতো একটি সুবিশাল উদ্যোগ সম্ভবত বিশ্বের আর কোনও দেশের প্রশাসনকে বাস্তবায়িত করার জন্য ভাবতে হয়নি। অধিকাংশ দেশে অজস্র ‘কথ্যভাষা’র উপস্থিতি থাকলেও লিখিত-পঠিত প্রধান ভাষার সংখ্যা খুব বেশি নেই। ধরা যাক, ইরান। ভারতের চাইতে আয়তনে অনেকটাই বড় এবং সাংস্কৃতিকভাবে প্রাচীনকাল থেকে বিশিষ্ট এই দেশে অঞ্চলভেদে কথ্যভাষার সংখ্যা আজকের পরিসংখ্যানে দুশো-বাহান্ন। সেসব ভাষায় মুখে মুখে অনেক ছড়া, গীতি-কবিতা, প্রেমকাব্য, হাজার-হাজার বছর ধরে প্রচলিত থাকলেও সাহিত্য রচনা হয় কিন্তু আজও সেই ফারসি-তে। সাহিত্যের ফারসি, যা আজ শুধুমাত্র তেহরান এবং তার আশেপাশের কিছু প্রদেশের জনমানুষের মুখেই শোনা যায়। বস্তুতপক্ষে, সাহিত্যের ভাষার জন্ম এবং লালন-পালন হয় সাহিত্যিকের অবদানে। কোনও ভাষায় ধারাবাহিক সাহিত্যসৃষ্টিতে। যে ভাষায় এতকাল শুধুই কথা বলা হয়ে এসেছে, সাহিত্য-কাব্য সেরকম সৃষ্টি হয়নি, বা সাহিত্য-কাব্যের প্রয়োজনীয়তাও অনুভূত হয়নি, সেই ভাষায় নতুন করে কেউ সাহিত্য সৃষ্টি করতেই পারেন, কিন্তু সেই ভাষাকে সাহিত্যের ভাষার মর্যাদা পেতে লেগে যাবে সহস্র বছর আরও। ভারতের মাটিতে প্রায় প্রতিটি ভাষার নিজস্ব সাহিত্যের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য রয়েছে, রয়েছে সাহিত্যসৃষ্টির ধারাবাহিকতা, তাই ভারতে সাহিত্যের ভাষার পরিকাঠামো অন্যান্য দেশের সঙ্গে কখনওই মেলানো যাবে না। ভারতে আজকের দিনে সাহিত্যের ভাষা রয়েছে প্রতিটি প্রদেশের নামেই একটি করে, সমসংখ্যক রয়েছে অনুবাদের ভাষাও। এই কারণে, ভারতের সরকারি ও বেসরকারি স্তরে যথেষ্ট উদ্যোগ দেখা না গেলে, দেশব্যাপী অনুবাদশিল্প কখনওই যথার্থ বাস্তবায়িত হওয়া সম্ভব নয়।

 

বাংলাভাষা ছিল ভারতীয় অনুবাদ-সাহিত্যের ক্ষেত্রে অন্যতম অগ্রণী। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার ক্লাসিক সাহিত্যের অনুবাদ শুরু হয় বাংলাভাষাতে প্রায় একশো বছর আগে থাকতেই। কিন্তু সেই সময়কার অনুবাদের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল নানান সাংস্কৃতিক আপস এবং অতি-সরলীকরণ। অনুবাদশিল্পের সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ হল ভিন্ন ভাষা এবং আপন সাহিত্যের ভাষা, উভয়ের ওপর সমপরিমাণ দখলদারি। একইসঙ্গে দুটি চ্যালেঞ্জে সাড়া দেওয়ার মতো অনুবাদক আগেও কম ছিল, এখন চোখে লাগার মতো কম। বরেণ্য সাহিত্যিকদের গল্প-উপন্যাসের বাংলা অনুবাদের ক্ষেত্রে বাহক-ভাষাটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল ইংরেজি। ইংরেজি-বাহক ব্যতীত অ-ইংরেজি ইউরোপীয় সাহিত্য এবং এশীয়-সাহিত্যের অনুবাদ ছিল প্রায় অসম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই সঙ্কট আজও একইরকম বিরাজ করছে। শিশু ও কিশোর উপযোগী যে অনুবাদসম্ভার রয়েছে বাংলাভাষায়, সেখানেও মূল সাহিত্যকর্মটির ছোটদের জন্য করা একটি ইংরেজি সংক্ষেপিত-সংস্করণ বা অ্যাব্রিজড-ভার্সনের অনুবাদ করেই কাহিনির রসাস্বাদন করানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়, অনুবাদকের দক্ষতা এবং কাহিনির আকর্ষণে যা ছোটদের সঙ্গে বড়রাও হামলে পড়ে পড়েন। কিন্তু সাহিত্যটির শিল্পশৈলী এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্ব বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় না। ছোটদের জন্য সংক্ষেপিত কাহিনির সাহিত্যগুণ যদিও মূল সাহিত্যের সঙ্গে একেবারেই মিলতে পারে না, তবু এই আলোচনার প্রসঙ্গে সে-অর্থে ছোটদের জন্য করা সফল অনুবাদ-সাহিত্য আজও কম, যাতে একটি অনুবাদ-সাহিত্য পড়ার পর কিশোর-কিশোরীরা মূল-সাহিত্যটি পড়ে ফেলার ইচ্ছে পোষণ করবে।

তবু সংক্ষেপিত অনুবাদ কি ছোটদের অনুবাদের গুরুত্ব কিন্তু এতটুকু লঘু নয়। গল্প বলার ধরন, মহাকাব্যিক কাহিনি, নাটকীয়তা, ইত্যাদিতে সুনির্মিত ক্লাসিক সাহিত্যের যে অনিঃশেষ জগৎ, তার খণ্ডাংশের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আজও একমাত্র প্রাঙ্গন হচ্ছে ছোটদের অনুবাদ-সাহিত্য। বাংলা নয়, বিশ্বের সব প্রধান ভাষাতেই ছোটদের অনুবাদ-সাহিত্যের বিস্তৃত প্রচলন রয়েছে। ছোটদের মতো বড়রাও সেই অনুবাদ-সাহিত্য গোগ্রাসে পড়লেও, ছোটদের মতো তারা পরবর্তীকালে মূল সাহিত্যটিকে পড়ার স্বপ্ন হয়তো দেখেন না। অর্থাৎ সাহিত্যের ‘শিল্পশৈলী’ ব্যাপারটা মাত্র ত্রিশ শতাংশ কি তার চাইতেও কম পাঠকের জন্য চিরতরে তোলা রইল, বাকি সত্তর শতাংশ সংক্ষেপে শুধুমাত্র কাহিনিটুকু জানতে পেরেই অনাবিল আনন্দ লাভ করেন। কোনও এক বিশ্ববন্দিত সাহিত্যের ছোটদের অনুবাদ পড়ে ফেলার পর যখন কেউ জানতে পারেন বইটির একটি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তখন সম্ভবত তিনি ওই বইটির দিকে হাত না-ও বাড়াতে পারেন। কারণ কাহিনি-টি যে আগেই ছোটদের অনুবাদে পড়ে জানা হয়ে গিয়েছে। সেইসঙ্গে এসেছে ‘নো ইন ব্রিফ’ বা সংক্ষেপে জেনে নেওয়ার অভিনব সব পন্থা। বিভিন্ন অডিও-ভিশুয়াল কি খুব ছোট ছোট বইয়ের মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে, ‘ইলিয়াড’ আসলে কী, ‘ইউলেসিস’ বইটির সারমর্মই বা কী, ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের নাম ‘চোখের বালি’ কেন, ‘ইফ টুমরো কামস’-এর খলনায়ক কে। শুধু তাই নয়, অতি সংক্ষেপে জানাজানির জগৎটি শুধুমাত্র কাহিনির সংক্ষিপ্তসার দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, চলছে বিভিন্ন বইয়ের অন্তর্নিহিত দর্শন এবং ফুটে ওঠা বার্তা নিয়েও গভীর আলোচনা। অর্থাৎ, মূল বই-টই আর নয়, ছোটদের জন্য সংক্ষিপ্ত-সংস্করণও নিষ্প্রয়োজন। কয়েকটি অডিও-ভিশুয়াল থেকেই দিব্যি জানা হয়ে যাচ্ছে পাঁচ লক্ষ শব্দের উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’-এর গল্প, তার মূলভাব, বার্তা, দর্শন, আধ্যাত্মিকতা, ইত্যাদি। এরপর হয়ত ছোটদের অনুবাদ-সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তাও কমে আসতে পারে, কারণ বড়দের পাশাপাশি ইউটিউবের বিভিন্ন চ্যানেল থেকে ছোটরাও জেনে নিতে পারবে, বেন হার উপন্যাসের কাহিনির সার, বা টম সয়ারের অ্যাডভেঞ্চার-পর্ব।

 

কিছুকাল আগে পর্যন্ত পুস্তক-ব্যবসার জগৎ অদ্ভুত বিপন্নতায় ভুগত। ধরে নেওয়া গিয়েছিল, ইলেকট্রনিক বই এবং অডিও-ভিশুয়ালের দাপটে কাগজের-বই ব্যাপারটা উঠে যেতে বসেছে। কিন্তু শেষ দশ বছরে ইলেকট্রনিক বইয়ের জগৎ অনেকটা এগিয়ে এলেও, কাগজের বইয়ের বিক্রি বিশ্বব্যাপী সেরকম পিছিয়ে পড়েনি, যতটা আশঙ্কা করা গিয়েছিল। এমন কি, কিছু কিছু ভাষায় বইয়ের বিক্রি বেশ খানিকটা বেড়েছে। অর্থাৎ, বই জিনিসটা থেকে যাচ্ছে শেষ পর্যন্ত, থেকে যাবে সাহিত্য এবং অনুবাদ-সাহিত্য। কিন্তু বিক্রি যদি বিশ্বব্যাপী না বাড়ে, লগ্নি কমে আসবে নিশ্চিত করেই। বিশেষ করে অনুবাদ-সাহিত্যে। কারণ, অনুবাদ-সাহিত্যে প্রারম্ভিক লগ্নি বেশি। শুধুমাত্র ভাষাগত বা সংস্কৃতির বাধ্যবাধকতার দোষে নয়, অনুবাদ-সাহিত্যের থেকে একজন ভিন্নভাষী পাঠক ও তার সমাজের যা যা পাওয়ার কথা থাকে, সেটি যে পুরোপুরি পাওয়া হয়ে ওঠে না, তার অন্যতম প্রধান কারণ অর্থনীতি। সংস্কৃতি এবং অর্থনীতির মেঘ জমে থাকে দুদিকে। একদিকের দায়, মূল-সাহিত্যটিকে যথার্থভাবে ফুটিয়ে তোলা, অর্থাৎ মূল-সাহিত্যের শিল্পশৈলীকে যতটা সম্ভব বজায় রাখার গুরুদায়িত্ব। অপরটি হল, যে ভাষায় অনূদিত হতে চলেছে একটি বই, সেই ভাষা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে অনূদিত সাহিত্যটিকে পর্যাপ্তভাবে একাত্মবোধ করানো। অর্থাৎ, ভিন্ন এক ভাষা এবং সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর প্রচেষ্টা। মুখ্য উদ্দেশ্য হয় একটিই, যাতে অনুবাদ-কর্মটি সেই ভাষার সাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে। হৃদয়ের কাছের হতে পারে। জনপ্রিয় হতে পারে। হতে পারে বেস্ট-সেলারও। কোনও নামকরা সাহিত্যের অনুবাদে যে পরিমাণ মোটা অঙ্কের লগ্নির প্রয়োজন, সেটির নিরিখে কিছুটা আপস না হয় মেনে নেওয়া যেতেই পারে।

কিন্তু এতসব সঙ্কট একলা অনুবাদকেরই, এর দায়ভার দ্বিতীয় কেউ নেবেন না। কতটা তিনি মূল সাহিত্যের মতো লিখতে চাইবেন, আর কতটাই বা থাকবে তাঁর সাংস্কৃতিক আপস? কোনও নিয়ম-নির্দেশিকা আজও লেখা হয়নি। এক অলিখিত সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার সবরকম প্রচলিত মাপকাঠি মাথায় রেখেই একজন অনুবাদককে অনুবাদের কাজ খুব সাবধানে চালিয়ে নিয়ে যেতে হয়। বিদেশি প্রকাশনাগুলো তাঁদের অনুবাদকদের যথেষ্ট সাম্মানিক প্রদান করলেও, একটি কি দুটি ভাষা ব্যতীত, অধিকাংশ ভারতীয়-ভাষাতেই দেখা গিয়েছে অনুবাদকের সাম্মানিক খুবই কম। অনুবাদের ক্ষেত্রে অর্থ-লগ্নিও সেরকম চোখে পড়ার মতো নয়। বাংলাভাষাতে অনুবাদের জন্য লগ্নি বলতে গেলে নেই। তার ওপর পশ্চিমবাংলার অধিকাংশ স্বনামধন্য প্রকাশক অনুবাদ-সাহিত্য ছাপতে সেরকম আগ্রহী নন। খুবই সাধারণ পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা এবং বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ-কর্মে এগিয়ে আসেন মূলত নিম্ন-মাঝারি এবং উঠতি প্রকাশকেরাই। কিন্তু তাঁদের অর্থলগ্নির সামর্থ্য অত্যন্ত কম। সঙ্গে রয়েছে কপিরাইটের সমস্যা। বিশ্বের যে পুরনো সাহিত্যসম্ভার কপিরাইটের আওতার থেকে এখন মুক্ত, সেসব বইয়ের অনুবাদের খরচ তুলনামূলকভাবে অনেকটাই কম। কিন্তু সাম্প্রতিককালের কপিরাইটযুক্ত সাহিত্যের অনুবাদের ক্ষেত্রে আলাদা করে নগদ অর্থ দিয়ে ‘ট্রান্সলেশন কপিরাইট’ কিনতে হয়। তার জন্য ভিনদেশি লেখক বা তাঁর জন-প্রতিনিধির সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া, বা সেই দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করা, সব দায় থেকে যায় শুধু অনুবাদকের ওপর। একজন অনুবাদকের প্রশাসনিক স্তরে কতটা চেনা-পরিচিতি রয়েছে, প্রতিষ্ঠা রয়েছে, শুধুমাত্র তার ভিত্তিতেই কোনও প্রকাশক মূল ভাষার থেকে অনুবাদে অর্থ লগ্নি করতে সম্মত হন। অর্থাৎ অনুবাদে লগ্নি হয় লেখকের নামে নয়, একজন অনুবাদকের সাহিত্যগত সাফল্য এবং বহুমুখী চেনা-পরিচিতির মাপকাঠিতে।

অর্থনীতির সবরকম চলনে যেমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে রাজনীতি, অনুবাদ-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও তাই। বাংলা তথা ভারতের বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ-সাহিত্যের অপ্রতুলতার কারণ আলোচনায়, বিশেষজ্ঞরা লগ্নির অভাবকেই একমাত্র কারণ ঘোষণা করে দিয়ে দায়সারাভাবে আলোচনার ইতি টানেন। কিন্তু লগ্নির এহেন শোচনীয় অবস্থার কারণ কী হতে পারে? মনে করে দেখুন, রাশিয়ান-সাহিত্যের বাংলা-অনুবাদ শুরু হয়েছিল সকলের আগে, এবং সেই প্রয়াস ছিল সর্বাধিক প্রচলিত বাহক-ভাষা ইংরেজিকে সম্পূর্ণ বর্জন করেই। ভারত এবং রাশিয়া, দু-পক্ষেরই ছিল এই ব্যাপারে উৎসাহ। সেই উৎসাহ বাস্তবায়িত হতে পেরেছিল একমাত্র সরকারি বদান্যতায়। নেপথ্যে বিশেষ কোনও রাজনৈতিক মতবাদ ক্রিয়াশীল থাকলেও, রাশিয়ান ছোটদের সাহিত্য থেকে রাশিয়ান ক্লাসিক-সাহিত্যের অনুবাদ হয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মধারায়। রাশিয়ান ভাষা এবং সাহিত্যে পারদর্শী অনুবাদকের নির্মাণ থেকে শুরু করে অনুবাদের উপযোগী সাহিত্য-চয়ন, প্রতিটি ধাপেই ছিল সুদক্ষ পেশাদারিত্ব। কিন্তু আজকের সাহিত্যের যে সাধারণ রাজনীতি বা অনুবাদের রাজনীতি, সেটির দুটি সুস্পষ্ট অভিমুখ। একটি হল, কোনও ভিন্নভাষী বা বিদেশি সাহিত্যের রাজনৈতিক মতামত এবং দর্শনের বাংলার মাটিতে গ্রহণযোগ্যতা এবং তার বিবিধ পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে সচেতন এবং সন্দেহবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা। দ্বিতীয় দিকটি খুব প্রাচীন এবং ইন্দ্রিয়ের কাছাকাছি। যদি একটি অনুবাদ-সাহিত্য কোনওভাবে শ্লথ দেহে চলতে থাকা স্থানীয় সাহিত্যের চাইতে অনেকটাই বেশি বাজার গ্রাস করে বসে, যদি অনুবাদটি বেস্ট-সেলার তালিকায় জায়গা করে নেয়, তবে একটি বড় কর্পোরেট আচম্বিত ‘লস’ বা ‘ক্ষয়-স্বীকার’ করার আগে পর্যন্ত যতরকম আগাম সুরক্ষা নিতে চান, শুধুমাত্র সেই সুরক্ষাতত্ত্বের নিরিখেই অনেক কালোত্তীর্ণ সাহিত্যের অনুবাদ আজও বাংলা ভাষায় হয়নি। এমন কী, অনুবাদ হয়ে গেলেও যথার্থ প্রকাশক পাওয়া যায়নি। অনুবাদ-সাহিত্যকে অতি সম্প্রতি যে অকারণেই ‘উচ্চমান এবং ইন্টেলেকচুয়াল’ সাহিত্যের তকমা দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে আপ্রাণ, সেটিরও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য একটাই, যাতে অত্যন্ত জনপ্রিয় কোনও একটি ভিনদেশি সাহিত্য বাংলায় অনুবাদ হলে সেটির কারণে যাতে ইঁদুর-দৌড় শুরু না হয়। জেমস বন্ড রচনাবলীর পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ বেশ কিছুকাল বেস্ট-সেলারের তালিকায় থেকে গিয়েছিল। দীর্ঘকালের বেস্ট-সেলার ছিল সহস্র আরব্যরজনী, জিম করবেট অমনিবাস। যথেষ্ট ‘উচ্চমান এবং ইন্টেলেকচুয়াল’ দোষে দুষ্ট না হয়েও। কিন্তু ফ্রেডরিক ফোরসাইথের একটি উপন্যাসেরও বাংলা-অনুবাদ না হওয়ার কারণ যদি ওপরে লেখা দ্বিতীয় কারণটি হয়, তবে অ্যান্টনি বোরজেসের উপন্যস ‘এ ক্লকওয়ার্ক অরেঞ্জ’, ওরহান পামুকের ‘মাই নেম ইজ রেড’, বা সালমান রুশদির উপন্যাসেরও আজ অবধি বাংলা এবং কোনও ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ না হওয়ার কারণ হয়তো-বা আরও একটু আগে লিখে আসা প্রথম কারণটি। তামিল ভাষাতে আজ নয়, কুড়ি বছর আগেই কাওয়াবাতা-র সব কটি উপন্যাসের মূল জাপানি থেকে অনুবাদ হয়ে গিয়েছে। বাংলায় এখনও শুরু হয়নি। সাম্প্রতিকদের মধ্যে হারুকি মুরাকামি-র জাপানি থেকে অনুবাদ হয়েছে কিছু। স্প্যানিশ সাহিত্যের কিছু মূল থেকে অনুবাদ প্রকাশিত হলেও, সাহিত্য চয়নে নজরদারি করে বেড়ায় বিশ্ব-চেতনা ও স্থানীয় রাজনীতি। অথচ রাজনীতির বাইরে গিয়ে অকাতরে অনুবাদ চলছে বোর্হেসের। অর্থাৎ তিনি ‘ক্লাসিক’ দোষে দুষ্ট। বোবার শত্রু হয় না যেমন, ক্লাসিক সাহিত্যেরও রাজনীতি থাকে না। শুধু স্থানীয় রাজনীতির জেরেই বেকেটের নাটক একাধিকবার বাংলায় অনূদিত হলেও, অনুবাদ হয়নি মার্সেল প্রুস্ত, বালজাক, স্তাঞদাল, এমন অনেক ফরাসি দিকপালের লেখা। ফরাসি ভাষা এবং সাহিত্যে পারদর্শী অনুবাদক থাকা সত্ত্বেও। ভৌতিক এক রাজনীতিতে অভিযুক্ত হয়ে বাংলা-অনুবাদের বদান্যতা থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়েছেন ক্লাসিক থেকে সাম্প্রতিক, সব কালের বিশিষ্ট আমেরিকান লেখকেরা।

প্রাচীন এবং ঐতিহাসিক গ্রন্থাবলির অনুবাদের ক্ষেত্রেও চলছে একই রাজনীতি। ঐতিহাসিক মিনহাজ-উদ্দিনের অমূল্য দলিলগ্রন্থ ‘তবাকাৎ-ই-নাসিরি’-র একটি অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে বাংলায়। অনূদিত হয়েছে মেগাস্থিনিসের ‘ইন্দিকা’। বাংলাদেশ থেকে। ‘তবাকাৎ-ই-নাসিরি’-র অনুবাদটি মূল-ফারসি থেকে না র‍্যাভার্টি-সাহেবের ইংরেজির থেকে, সেই প্রসঙ্গে না-গিয়েও বলা চলে, একটু সচেষ্ট হতে পারলে পশ্চিমবাংলার থেকেই অনেক বছর আগে বইটি অনূদিত হতে পারত। মিনহাজ-উদ্দিন রচিত ত্রয়োদশ শতকের ফারসি-কে অনুবাদ করার মতো বিদ্বানও ছিল এই বাংলায়। অনুবাদ নিয়ে অতিরিক্ত সংশয়বাদী রাজনীতির জন্যেই সেটি সম্ভবপর হয়নি। বাংলাদেশকে সাধুবাদ। ঐতিহাসিক গ্রন্থের অনুবাদে অগ্রসরতার জন্য।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4667 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...