Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সাতকাহন

শুভাশিস মুখোপাধ্যায়

 



প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, পরিবেশবিদ

 

 

 

In the epic, Draupadi’s legitimized pluralization (as a wife among husbands) in singularity (as a possible mother or harlot) is used to demonstrate male glory. She provides the occasion for a violent transaction between men, the efficient cause of the crucial battle.

–গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, মহাশ্বেতা দেবীর লেখা “দ্রৌপদী” গল্পের আলোচনার প্রেক্ষিতে

ভারতবর্ষ এক আজব দেশ যেখানে সারা বছর কোনও না কোনও নির্বাচন লেগেই আছে। মৃত্যু, পদত্যাগ, শপথ না নেওয়া ইত্যাদি কারণে নির্বাচন ক্ষেত্রে নানান আসন “ফাঁকা” হয়, অন্যকে স্থান করে দেওয়ার জন্য নির্বাচন জিতে পদত্যাগ করে আবার অন্য একজন সেই “ফাঁকা” আসনে “প্রতিদ্বন্দ্বিতা” করে। এই হরির লুঠের বাজারে এরকম প্রহসন দেখতে দেখতে আমরা পুরো বিষয়টির মধ্যে যে মজার উপাদান আছে, সেইদিকটা উপভোগের চেষ্টা করি।

তবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অন্যান্য নির্বাচনের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। রাজ্যে রাজ্যে সাজো সাজো রব নেই, যদিও এবারের মহিলা প্রার্থীর ফ্লেক্স এবং কাট-আউট-এ শহর ছয়লাপ, দিল্লির নিভৃত কুঞ্জে ভোটপর্বের সমাধান হবে। এর আগের ১৪ জন মাননীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সঙ্গে এবারের নির্বাচনের গুণগত বা পরিমাণগত কোনও পার্থক্যই আমজনতার চোখে পড়ছে না। আমাদের সংবিধান বলে যে চিত্র-বিচিত্র করা “বস্তাপচা” (জনৈক বিজেপি-র টিকিটে নির্বাচিত সাংসদের মুখ নিঃসৃত বাণী) দলিলটি এখনও বিদ্যমান, সেই সংবিধানের ৬২(১) উপধারা মতে রাষ্ট্রপতির নির্বাচন হবে যখন তাঁর বর্তমান মেয়াদ শেষ হবে। এই নির্বাচনপ্রক্রিয়া শেষ করতে হবে বর্তমান রাষ্ট্রপতির মেয়াদের মধ্যে। বর্তমান রাষ্ট্রপতির শেষদিন হচ্ছে জুলাই ২৫। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে যে আগামী ১৮ জুলাই, ২০২২ নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কাজ সমাপ্ত করতে হবে।

ভারতীয় সংবিধান অনুসারে দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন যে পদ্ধতিতে, তার সাংবিধানিক নাম হল ‘ইলেক্টোরাল কলেজ’ পদ্ধতি, যেখানে আগে থেকেই সরাসরি নির্বাচনে জয়ী হয়ে যাঁরা রাজ্যে এবং লোকসভা-বিধানসভায় এবং অপ্রত্যক্ষভাবে রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন, তাঁরা ভোট দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করেন। প্রত্যেক রাজ্যের ১৯৭১ সালের জনসংখ্যার ভিত্তিতে বিধানসভার সদস্যদের ভোটের মূল্য নির্ধারিত হয়; জনবহুল রাজ্য, যেমন অবিভক্ত উত্তরপ্রদেশে প্রত্যেক বিধায়কের ভোটের মূল্য ২০৮ আর সিকিমে সেখানে মাত্র ৭! ভারতবর্ষের মোট বিধায়কের সংখ্যা ৪০৩৩, ভোটের মূল্য ৫,৪৩,২৩১। রাজ্যসভা ও লোকসভা মিলিয়ে মোট আসনসংখ্যা ৭৭৬, সব মিলিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সর্বাধিক ভোটের সংখ্যা ১০.৮৬ লক্ষ। রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার শর্ত হল বিজয়ী প্রার্থীকে ৫০ শতাংশের চেয়ে বেশি ভোট পেতে হবে।

এবারের নির্বাচনে যে দুজন মুখ্য প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে চলেছে, তার মধ্যে কে বিরোধী পার্টির প্রার্থী তা বোঝা মুশকিল। শ্রীমতী দ্রৌপদী মুর্মুকে বিজেপি এবং এনডিএ তাদের প্রার্থী হিসেবে সরাসরি ঘোষণা করে দিয়েছে। সংসদীয় রাজনীতিতে ক্রমশ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়া অন্যান্য সমস্ত দলগুলি সম্মিলিতভাবে যাঁকে প্রার্থী হিসেবে খাড়া করেছেন, তাঁর অনতি-অতীত দেখলেও তাঁকে ‘বিরোধী পক্ষ’ বলা যায় না।

কে এই ‘বিরোধী-পক্ষীয় সর্বদলগ্রাহ্য’ যশোবন্ত সিংহ মহাশয়?

যশোবন্ত সিংহ ১৯৩৭ সালে জন্মেছেন, এই বছর তাঁর বয়স দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৫ বছর। তিনি তাঁর জীবন শুরু করেছেন একজন আইএএস আধিকারিক হিসেবে, ১৯৮৪ সালে তিনি স্বেচ্ছাবসর নিয়ে (৪৭ বছর বয়সে) ভারতের পিচ্ছিল সংসদীয় রাজনীতিতে যোগ দেন। বিহারের একসময়ের মুখ্যমন্ত্রী কর্পূরী ঠাকুরের সরকারি সহায়ক হিসেবে সত্তরের দশকের শেষে তাঁকে কাজ করতে দেখা গেছে। সংসদীয় রাজনীতির পরম্পরা মেনে তিনি রাজনৈতিক উত্থানের উদগ্র তাগিদে কোনও একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে থাকেননি, সংসদে তাঁর পছন্দমতো স্থান না পেলেই তিনি দ্রুত আর একটি দলের ছত্রছায়ায় গিয়ে তাঁর রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য পাড়ি জমিয়েছেন।

সিংহ মহাশয়ের উত্থান অবিভক্ত বিহারের সংসদীয় রাজনীতির মধ্য দিয়ে। ১৯৮৯ সালে তিনি বিহার থেকে জনতা দলের হয়ে রাজ্যসভার সদস্য হন। ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাসে যখন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-এর নেতৃত্বে অকংগ্রেসি সরকার দিল্লিতে অধিষ্ঠিত হয়, সেই মন্ত্রিসভায় রাজনীতিতে প্রায় নবাগত, মাত্র সামান্য কয়েকমাসের সাংসদের অভিজ্ঞতাপ্রাপ্ত সিংহ মশাই-এর জন্য ভি পি সিং একটি রাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ দেন। কিন্তু উত্থান-উন্মুখ সিংহ মহাশয়ের সেই পদ অপছন্দ হওয়ায় তিনি রাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিতে অস্বীকার করেন। রাজনৈতিক অন্তর্দ্বন্দ্বে দীর্ণ হয়ে ভি পি সিং সরকারের পতন আসন্ন হয়ে উঠলে সুযোগ বুঝে সিংহ মশাই চন্দ্রশেখরের নেতৃত্বে একটি উপদলে যোগ দিয়ে, জনতা পার্টি ভেঙে সমাজবাদী জনতা পার্টি গঠনের সময় সেই পার্টিতে যোগ দেন মন্ত্রিত্বের দুরাশায়। চন্দ্রশেখর দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে বৃত হলে সিংহ মহাশয় দেশের অর্থমন্ত্রীর পদ পেয়ে যান। চন্দ্রশেখরের নেতৃত্বে সরকার মাত্র সাত মাস স্থায়ী হয় এবং মন্ত্রিসভার পতন ঘটে।

১৯৯১ সালে নতুন করে লোকসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষিত হলে সিংহ মশাই পাটনা নির্বাচনীক্ষেত্র থেকে সমাজবাদী জনতা পার্টির পক্ষ থেকে সেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। পাটনাতে সেইসময় এক অভূতপূর্ব লাগাতার প্রাক্‌-নির্বাচনী হিংসাত্মক ঘটনা ঘটায় সেই নির্বাচন স্থগিত হয়ে যায়। ইতোমধ্যে দেশে ঘটে যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনা, ঘটে বোম্বাই-এর ভয়াবহ দাঙ্গা। বিজেপির রাজনৈতিক যাত্রার পালে হাওয়ার ঠেলা লাগছে অনুমান করে তিনি অতঃপর ১৯৯৫ সালে রাঁচির হাতিয়া থেকে বিহার বিধানসভায় বিজেপির প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়ে অবিভক্ত বিহার বিধানসভার বিরোধী দলনেতার পদ পান। ভারতীয় সংসদীয় রাজনীতির ‘ঐতিহ্য’ অনুসরণ করে তাঁর নাম অতঃপর কুখ্যাত জৈন-হাওয়ালা মামলায় জড়িয়ে গেলে তিনি তাঁর পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।

১৯৯৯ সালে তিনি অবিভক্ত বিহারের হাজারিবাগ থেকে বিজেপি-র হয়ে লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে অটলবিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বে এনডিএ সরকারের মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন। যথারীতি তাঁর নাম পুনরায় ‘ইউটিআই’ আর্থিক দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে যায় (২০০১-২০০২)। এই মামলায় এক সময়ে অর্থমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ ইউটিআই-এর তত্কালীন চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার হয়ে গেলে তাঁকে মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত করে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ দেওয়া হয়।

২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তিনি বিজয়ী হন।  ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি বিজেপি-র কাণ্ডারি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিজেপি-র ‘ওল্ড গার্ড’-দের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সরিয়ে দেওয়ার ‘রণকৌশল’ রূপায়ণের তাগিদে হাজারিবাগ লোকসভা কেন্দ্রে যশোবন্তকে প্রার্থীপদ দিতে অস্বীকার করেন। ২০১৮ সালে পাটনায় একটি অনুষ্ঠানে যশোবন্ত প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিলেন, তিনি সরকার বা কোনও রাজনৈতিক দলের কোনও পদ গ্রহণ করবেন না।

২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করেই দলটির উপসভাপতির পদে বৃত হন। বাম দলগুলি এবং কংগ্রেসের চাপাচাপিতে তিনি তৃণমূল কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে অতঃপর রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হয়েছেন অনেকগুলি বিজেপি-বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে!

 

এনডিএ-র প্রার্থী শ্রীমতী দ্রৌপদী মুর্মু

অন্যদিকে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বে এনডিএ গোষ্ঠী সরাসরি বিজেপি সদস্য ও তাদের রাজনীতির একনিষ্ঠ কর্মী, ঝাড়খণ্ড রাজ্যের প্রাক্তন রাজ্যপাল তফসিলি উপজাতি বর্গের শ্রীমতী দ্রৌপদী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করেছেন। দ্রৌপদী মুর্মু জাতীয় রাজনীতিতে প্রথম পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন, যখন তাঁকে এনডিএ সরকার ২০১৫ সালে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাজ্যপাল নিযুক্ত করে। বস্তুত, ২০১৭ সালে যখন নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কথা আসে, তখনও শ্রীমতী দ্রৌপদী মুর্মু-র নাম প্রস্তাব করা নিয়ে বিজেপি-র উচ্চ মহলে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছিল।

শ্রীমতী মুর্মু, ওডিশা-র ময়ূরভঞ্জ জেলার মানুষ, তাঁর জীবনের শুরু শিক্ষিকা হিসেবে। ১৯৯৭ সালে তাঁকে প্রথম রাজনীতিতে দেখা যায়, যখন তিনি ওডিশা-র রায়রংপুর জেলা থেকে কাউন্সিলার হিসেবে নির্বাচিত হন। পরে, বিজেপি প্রার্থী হিসেবে তিনি সেই রায়রংপুর থেকেই ২০০০ এবং ২০০৯ সালে বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন। সেই সময় ওডিশায় বিজেপি ও বিজু জনতা দল-এর সরকার ছিল; তিনি সেই সরকারের প্রথমে পরিবহন ও বাণিজ্য বিষয়ের রাষ্ট্রমন্ত্রী (২০০-২০০২) এবং পরে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ বিকাশ দপ্তরের পূর্ণমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।  বিজেপি দলটির অভ্যন্তরে শ্রীমতী মুর্মু-র স্থানও বেশ সুদৃঢ়। তিনি বিজেপি-র ওডিশা রাজ্যের তপসিলি উপজাতি মোর্চার উপ-সভাপতি (২০০৬-২০০৯) পদের নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি বেশ কয়েকবার ময়ূরভঞ্জ জেলার দলের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।

 

কেন এল শ্রীমতী মুর্মু-র নাম?

শ্রীমতী দ্রৌপদী মুর্মু-র নাম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে বিজেপি-র পক্ষ থেকে ঘোষিত হওয়ার পর আরএসএস এবং বিজেপির-র পক্ষ থেকে যেসব বক্তব্য প্রকাশ্যে এসেছিল, সেগুলি বিশ্লেষণ করলে আমাদের বেশ কয়েকটি প্রবণতা চোখে না পড়েই পারে না। আমরা প্রথমে শুরু করি আরএসএস-এর মুখপত্র, ‘অর্গানাইজার’-এর ১০ জুলাই, ২০২২-র বক্তব্য দিয়ে:

After the declaration of Draupadi Murmu’s name, the missionary mafia on twitter triggered a series of tweets. No doubt, she is the best weapon against such missionary conversion mafia who have been targeting Hindu tribes in different ways since decades.

Draupadi Murmu’s photos of sweeping the floor of a temple, whispering something into the years of Nandi, the ‘vahana’ of Lord Shiva went viral in media and social media recently. It is believed that when a devotee whispers prayers into the ears of Nandi the prayers will be communicated to Lord Shiva. This was the morning of the next day of announcement as presidential candidature…

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও তাঁর বক্তব্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলেছেন। তাঁর টুইট থেকে জানা যাচ্ছে,

Millions of people, especially those who have experienced poverty and faced hardships, derive great strength from the life of Smt. Droupadi Murmu Ji.

এর পাশাপাশি বিজেপি-র তফসিলি উপজাতি মোর্চা সারা দেশ জুড়ে অভিনন্দন যাত্রা সংগঠিত করা শুরু করে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, এই যাত্রার উদ্দেশ্য শ্রীমতী মুর্মুকে তফসিলি উপজাতির প্রতিনিধি হিসেবে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা।

সংঘ পরিবারের যে বৃহত্তর কর্মসূচি, তার কিছু আভাস শ্রীমতী মুর্মু-র পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে চোখে পড়ছে। শ্রীমতী মুর্মুকে সামনে রেখে আগামী দিনে ‘ঘর-বাপসি’ ইস্যুকে সামনে রেখে দেশ জুড়ে দাঙ্গা বাধানোর পরিকল্পনা ‘অর্গানাইজার’ পত্রিকার থেকে যে উদ্ধৃতি আমরা দিয়েছি, সেখানে এই ইঙ্গিত স্পষ্ট। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে এটাও পরিষ্কার যে নিকট ভবিষ্যতে আরএসএস তার পারিবারিক জাল ব্যবহার করে তফসিলি উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ-বিষ ছড়ানোর কাজে গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করবে। জাতীয় পরিস্থিতির দিকে নজর করলে বিজেপি-র ‘নতুন অ্যাজেন্ডা’-র একটা বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা মেলে।

 

সংঘ পরিবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের রাজনীতি

বিজেপিশাসিত রাজ্য, খণ্ডিত মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তিশগড়, যেখানে বিজেপি বিরোধী পক্ষে, সেই দুই রাজ্যে ২০২৩-এ বিধানসভা নির্বাচন বিজেপি-র পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই দুটি রাজ্যেই তফসিলি উপজাতি শ্রেণির জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা প্রচুর। ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই দুই রাজ্যে তফসিলি উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসনে বিজেপি প্রায় সব কটি আসনেই পরাজিত হয়েছিল। ২০১৯ সালে কর্নাটক, গুজারাট, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে বিজেপি এই এই সংরক্ষিত আসনের সবকটিতেই বিজয়ী হয়। এর কারণ হিসেবে বিজেপি সাংসদ এবং বিজেপি-র তফসিলি উপজাতি মোর্চার কার্যকর্তা সমীর ওরাঁও সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “During the Pathalgadi movement when the attempted tweaking of the tenancy acts had created distrust among tribals, Droupadi Murmu as the governor of Jharkhand spoke to both sides, and without falling prey to pressure politics but also behaving practically brought the situation under control. The situation could have worsened if she hadn’t taken that route.”

সংঘ পরিবারের নজর তফসিলি উপজাতিদের হিন্দুত্বের অংশ করে তোলার দিকে যাওয়ার মূল কারণ হল ভারতের তফসিলি উপজাতি শ্রেণির ওপর বিজেপির প্রত্যক্ষ মদতে যে ভয়াবহ অত্যাচার চলছে, তার বিরুদ্ধে ‘বনাধিকার’ আন্দোলন গড়ে তুলে তফসিলি উপজাতির মানুষরা তীব্র প্রতিরোধ শুরু করেছেন। এই আন্দোলনের অগ্ন্যুৎপাতে গুজারাট, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড এবং মধ্যপ্রদেশের এক বড় অংশ কম্পমান। ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল এবং বিজেপি-র তফসিলি উপজাতি মোর্চার একজন বরিষ্ঠ নেতা হিসেবে শ্রীমতী মুর্মু এই আন্দোলনের ধার কমানোর কাজে ব্যবহৃত হওয়ার প্রতিশ্রুতি রাখছেন বলে বিজেপি-র চিন্তকরা মনে করছেন।

গুজরাটের তফসিলি উপজাতি শ্রেণির বিজেপি সংগঠনের প্রধান শ্রী হর্ষদ ভাসাভাদা মন্তব্য করেছেন, “In Gujarat too, we had protests a while back by some groups. This is only because they get misled. I tell them to show any state that has better living conditions for STs and they can’t. Here, with Modi’s Van Bandhu programme, the ST community is much better than what it was years ago. With a tribal as the ST community President, they would expect a better deal.”

অন্যদিকে, ভারতের নির্বাচনব্যবস্থায় ‘নির্বাচিত প্রতিনিধি প্রত্যাহার’-এর অধিকার না থাকায় যেকোনও নির্বাচনে যাঁরা সুবিধা পাওয়ার আশায় নিশ্চিন্তে দলবদল করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও এই বিষয় ঘটবে, কেননা বিজেপির ঝুলিতে রয়েছে ৪৮ শতাংশ ভোট, তাকে আরও ২ শতাংশের বেশি ভোট জোগাড় করতে হবে। ওয়াইএসআর এবং বিজু জনতা দল সম্ভবত বিজেপির দিকে ঝুঁকবে, কেননা নবীন পট্টনায়েক এখনি বলে দিয়েছেন যে শ্রীমতী মুর্মু ওডিশার মানুষ, অতএব…। অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস কী করবে তা তৃণমূল কংগ্রেসেরও কেউ জানে কিনা সন্দেহ, দলটা প্রাক্তন ও বিজেপি-র দিকে পা-বাড়িয়ে-থাকা সাংসদে গিজগিজ করছে।

পার্লামেন্টারি এই পাঁকের মধ্যে অন্যান্য যেসব ঘটনা নিয়ে কথা বলা দরকার সেগুলি নিয়ে আশ্চর্যভাবে বামপন্থীরা নিশ্চুপ। বিজেপি-র বক্তব্য শ্রীমতী মুর্মু তফসিলি উপজাতির মধ্যে থেকে উঠে আসা বলে এই শ্রেণির মানুষরা তাঁর সময়কালে খানিকটা সুবিধা পাবেন। বর্তমানের দলিত রাষ্ট্রপতির আমলে ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় আমরা দেখেছি দলিত কর্মীদের হেনস্থা, স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু। এই বিষয় নিয়ে দলিত রাষ্ট্রপতি হিরণ্ময় নীরবতা পালন করেছেন। রাষ্ট্রপতি জৈল সিং-এর আমলে ঘটেছে দিল্লিতে শিখ-নিধন, ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ জরুরি অবস্থা ঘোষণার কাণ্ডারি ছিলেন। রাষ্ট্রের নীতি ব্যক্তি নির্ধারণ করেন না, ব্যক্তি রাষ্ট্র দ্বারা পরিচালিত হন। শ্রীমতী মুর্মু যদি নির্বাচিত হন, তবে তাঁকে কী নীতিকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করতে হবে তার উদাহরণ এখনই তৈরি হয়ে গেছে। দলিত-বন্ধু হিমাংশু কুমারকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয়েছে তাঁর দলিতদের স্বার্থে কাজের জন্য, বর্তমান দলিত রাষ্ট্রপতি এই সময়ে ব্যস্ত ছিলেন সেনাবাহিনির পেনশন কেটে নেওয়ার সুপারিশে সই দেওয়ায়, প্রার্থীপদে থাকা শ্রীমতী মুর্মু-র কাছে বার্তা যে এইসব করতে হবে এবং দলিত ও তফসিলি উপজাতিদের আন্দোলন স্তিমিত করার কাজে রাষ্ট্র ও নিপীড়িতদের মধ্যে ঢাল হিসেবে তাঁকে অবস্থান করতে হবে। অন্যদিকে, বিজয় মালিয়ার অপরাধের জন্য জরিমানা ২ হাজার টাকা, স্যাঙাৎ পুঁজিকেও তোয়াজ করার বার্তা স্পষ্ট। আশাকরি ভারতের নিপীড়িত জনগণ শ্রীমতী মুর্মু-র প্রসারিত হাস্যমুখের রহস্য বুঝে একদিন শেষ হাসি হাসবেন।