Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এসএসসি কেলেঙ্কারি— দু-চারটি প্রাসঙ্গিক কথা

পার্থ সারথি মৌলিক

 


নাট্যকর্মী, সমাজকর্মী

 

 

 

 

এসএসসি কেলেঙ্কারি নিয়ে খুব হইচই চলছে। সততার প্রতীক মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল সরকারের দুই নম্বর লোক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জেলযাত্রা ও এক অভিনেত্রীর বাড়ি থেকে কোটি কোটি টাকা, সোনার গয়না উদ্ধার হওয়ায়। বঙ্গবাসীর চোখ কপালে। রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্তসিক্ত আটপৌরে মধ্যবিত্ত বাঙালি বেশ একটা ধাক্কা খেয়েছে। নারদা সারদা হয়ে যাওয়ার পর সাদা শাড়ির মধ্যে আর কোনও সততার রহস্য লুকিয়ে নেই তা বাঙালি জেনে গেছে। তবুও তদন্তকারী সংস্থা যেভাবে প্রচুর টাকা উদ্ধারের নির্বাচিত কিছু ভিডিও ক্লিপ সংবাদমাধ্যমের হাতে তুলে দিয়েছে বা ওই অভিনেত্রীর সঙ্গে পার্থর ঘনিষ্ঠতা নিয়ে যেসব তথ্য দিয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের চোখ কপালে ওঠা স্বাভাবিক। তবে সংবাদমাধ্যমে যতই আলোচনা হোক না কেন শাসক দল হিসেবে তৃণমূল প্রথমদিকে চরম উদ্ধত মনোভাব নিয়েই এগিয়েছিল। এমনকি শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতিকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূল কর্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী বঙ্গ(বি)ভূষণ পুরস্কারমঞ্চে ঘোষণা করেন সব সংগঠনই সব জায়গাতে কিছু নিজের লোক ঢোকায়। সুতরাং এটা পরিষ্কার উনি এটাকে দুর্নীতি বলে মনেই করেন না। পরে চাপে পার্থকে মন্ত্রিসভা থেকে সরাতে বাধ্য হন। ওঁর কাছ থেকে এটা খুব অপ্রত্যাশিত নয়। উনি সমস্ত সরকারি কাজকেই জনগণের প্রতি তাঁর দয়া বলে মনে করেন। সুতরাং তিনি ও তাঁর দলীয় সাঙ্গপাঙ্গরা জনগণকে দয়া দেখিয়ে কিছু টাকা পকেটস্থ করবে এটা আর এমন কী। মনে রাখতে হবে নব্বইয়ের দশক থেকেই মমতা ব্যনার্জির নেতৃত্বে কংগ্রেসের চরম বামবিরোধী, লুম্পেন ও আত্মপ্রতিষ্ঠালোভী অংশটি একজোট হয়। তারই ফলশ্রুতি আজকের তৃণমূল। সুতরাং দুর্নীতির যে প্রকাশ্য প্রাতিষ্ঠানিক রূপ তৃণমূল জমানায় সর্বব্যাপ্ত হয়েছে এসএসসি-দুর্নীতি তারই অংশমাত্র।

এই দুর্নীতিকে ঘিরে বেশ কিছু প্রশ্ন ঊঠে আসছে। কিন্তু সেগুলো কার্পেটের তলায় চাপা থাকছে। যেমন এই দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলাতে সিবিআই বা ইডি র ভূমিকাও কিন্তু আতসকাচের তলায় রাখা উচিত। আদালতের ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণগুলি কোনও রাজনীতির অবস্থানকে শক্তিশালী করতে চাইছে কি না সেগুলিও বিশ্লেষিত হওয়া উচিত। যেমন আমরা ধরে নিচ্ছি যা টাকা তদন্তকারী সংস্থা উদ্ধার করেছে সেই কটা টাকাই উদ্ধার হয়েছে, তদন্তকারীদের মধ্যে থেকে কেউ টাকা সরায়নি। আদালত যা রায় দিচ্ছে বা দেবে তা সব নিরপেক্ষভাবে। এবার প্রশ্ন উঠতেই পারে এতদিন আদালত কী করছিল। এটা তো কোনও ব্যক্তি বিচারকের দায় হতে পারে না। এবং  ইডির আচরণ ও তার তদন্তের গতিপ্রকৃতি দেখে মনে হচ্ছে যেন পুরো দুর্নীতিটা দুজনকে কেন্দ্র করে হয়েছে। যাতে করে খালি তৃণমূল নয়, এই ব্যবস্থার গায়ে কোনও আঁচ না লাগে। কারণ এই দুর্নীতি শুধু আমাদের রাজ্যে হচ্ছে এমনটা নয়। মধ্যপ্রদেশে মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় রাজ্য সরকারের ব্যবস্থাপক সংস্থা (ব্যাপম)-র বারোশো কোটি টাকার শিক্ষা-কেলেঙ্কারি সামনে আসে। যেখানে তদন্তকারী সংস্থা তদন্ত শুরু করলে ঐ কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত অভিযুক্ত, অভিযোগকারী, সাক্ষী সহ আটান্নজনের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে। শেষপর্যন্ত তদন্তের অপমৃত্যু ঘটে। সুতরাং সিবিআই বা ইডি এই ব্যবস্থারই অঙ্গ। তাদেরও নির্দেশদাতা আছে। ভারতের এই আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত বিশাল পরিকাঠামো দাঁড়িয়েই আছে বৈষম্য আর দুর্নীতির উপর। কোটি কোটি বেকারকে ছোটানো হচ্ছে কয়েক হাজার চাকরির পিছনে। সেখানে স্বচ্ছতা বা নৈতিকতার কথকতা মধ্যবিত্ত দ্বিপ্রাহরিক বিশ্রম্ভালাপ মাত্র। সুতরাং এই তদন্ত থেকে দারুণ কিছু প্রত্যাশার কোনও কারণ আছে বলে মনে হয় না।

বিভিন্ন আলোচনাতে ঘটনার রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা যাবে পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতার হওয়ার পর তৃণমূলের একাংশ বিশেষ করে অভিষেক–কুণাল গোষ্ঠীর সক্রিয়তা বেড়ে গেছে। গুরুত্ব বেড়েছে। এতদিন গোয়া, ত্রিপুরা, অসম যেখানে কংগ্রেস শক্তিশালী সেখানে এই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল নির্বাচনে লড়ে বিজেপিকে সুবিধে পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ ঊঠেছে। আজকে পার্থর গ্রেফতার থেকে টাকার সন্ধান পাওয়া সেই চক্রান্তের অংশ কি না ভবিষ্যতে সেটি পরিষ্কার হবে। তবে এগুলি সব হচ্ছে শাসক গোষ্ঠীগুলীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার লড়াইয়ের পরিণতি। সাধারণ জনগণ খালি বুঝতে পারে তারা কীভাবে প্রতারিত হচ্ছে বা বঞ্চিত হচ্ছে।

এসএসসি কেলেঙ্কারি থেকে আরও কয়েকটি বিষয় আলোচনার টেবিলে উঠে আসতেই পারে। যেমন ভারতের রাজনীতিতে সামন্ত সংস্কৃতি কীভাবে কাজ করে। আমরা সকলেই জানি এসএসসি পরীক্ষায় কৃতকার্য অথচ দুর্নীতির কারণে শিক্ষকপদে চাকরি হয়নি যাদের তারা গত প্রায় দেড় বছর ধরে আন্দোলন করছে। মামলা করেছে। তারই ফল হিসেবে তৃণমূল সরকারের মাত্র একটি দফতর শিক্ষাক্ষেত্রের অতিক্ষুদ্র অংশের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি সামনে এসেছে। তবে এটাও পরিষ্কার হচ্ছে যে এই দুর্নীতি খালি একটি দফতরে হয়েছে এমনটি নয়। এটি হিমশৈলের চূড়া মাত্র। মমতা ব্যানার্জিরা এখন দায় ঝাড়তে ব্যস্ত। সেখানে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই আন্দোলনকারীরা। জনসাধারণের সহানুভূতিও আন্দোলনকারীদের দাবীর প্রতি। এই পরিস্থিতিতে দেড় বছর পর তৃণমূলের সাধারন সম্পাদক, মমতা ব্যানার্জির ভাইপো ব্রাহ্মণতনয় অভিষেক ব্যানার্জির আন্দোলনকারীদের প্রতি সহানুভূতি কেন উথলে উঠল তা বুঝতে গণৎকার লাগে না। কিন্তু কে এই অভিষেক ব্যানার্জি? আন্দোলনকারীদের আশ্বাস দেওয়ার কী অধিকার তার আছে? উনি তো তৃণমূল সরকারের কেউ নন। তাছাড়া ওঁর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির বহু অভিযোগ উঠেছে। সবাই জানে ওঁর অবিবাহিত পিসি তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির পরিবার খুবই দরিদ্র ছিল। সেখানে অভিষেকবাবুর এই বিপুল সম্পত্তির উৎস কী? এখানেই আসে সেই ক্ষমতার ঔদ্ধত্য। সামন্ত-জমিদারি মনোভাব। যাকে দেখাতে, বুঝিয়ে দিতে হয়। সেখানে অভিষেকবাবু আন্দোলনকারীদের মঞ্চে যেতে পারেন না। অথচ দেখুন এটা হচ্ছে কখন। যে সময়ে সবাই বুঝে গেছে যে অভিষেকবাবুর দল সরাসরি এই আন্দোলনকারীদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করে অন্যদের অর্থের বিনিময়ে চাকরি দিয়েছে। তখনও শুধু আন্দোলনকারীদের নয় শিক্ষামন্ত্রীকেও তার অফিসে যেতে হয়। সেখানে বন্ধ ঘরে আলোচনা হয়। এটাই হচ্ছে ভারতের ক্ষমতাবানদের সংস্কৃতি।

আন্দোলনকারীরাও এত সামাজিক সমর্থন সত্ত্বেও শিরদাঁড়া টানটান করে বলতে পারে না যে না অভিষেকবাবুকে তাদের মঞ্চে আসতে হবে। তারা অধিকারের জন্য লড়ছে দয়া পেতে নয়। বলতে পারছে না আলোচনা বদ্ধ ঘরে নয়, খোলা মঞ্চে হবে। তারা দেড় বছর যে বহু কষ্ট সহ্য করে আন্দোলন করেছে, তাকে সমস্ত শ্রদ্ধা জানিয়েও বলতে হয়, অধিকার আন্দোলনে আত্মসম্মান গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি তারা এসএলএসটি শিক্ষকদের আন্দোলনের পাশেও দাঁড়াচ্ছে না। নিজের অধিকার পেতে গেলে অন্যের অধিকারকেও স্বীকৃতি দিতে হয়।

এসএসসি কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত আরেকটি বিষয় আলোচনা না করলেই নয়। তৃণমূলের দুর্নীতি সামনে আসায় সিপিআইএম হঠাৎ করে নিজেদের ধোয়া তুলসিপাতা বলে বুক চাপড়াচ্ছে। দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ বাম আমলেও ছিল, কংগ্রেস আমলেও ছিল। মাত্রার এবং চক্ষুলজ্জার হেরফের আছে। সিপিএমের পদস্থ সদস্যদের পরিবারের বেশিরভাগ সরকারি চাকরি করত। আর শহর-গঞ্জের সর্বক্ষণের কর্মীদের স্ত্রী/স্বামী/কন্যা/পুত্রদের কেউ না কেউ সরকারি চাকরি করতই। কীভাবে পেত! এত বুদ্ধিমান ছিল তারা! বামফ্রন্টীয় বামেদের ভারি অদ্ভুত যুক্তি। তদন্ত হয়নি। কেউ শাস্তি পায়নি। হাস্যকর। সত্তরের দশকের সন্ত্রাসের কথা বলে সিপিএম ভোট চাইত। সিপিএম ক্ষমতায় আসবার পরেও কোনও কংগ্রেসি নেতা-গুণ্ডারা শাস্তি পায়নি। তাহলে কি সন্ত্রাস হয়নি? নিশ্চয় হয়েছে। কিন্তু তদন্ত হয়নি। শাস্তি হয়নি। একই কথা বাম সরকারের আমলের দুর্নীতি নিয়েও বলা যায়।

তাই এই এসএসসি কেলেঙ্কারি আসলে এই রাষ্ট্রব্যবস্থার দুর্নীতি। এই দুর্নীতির পরতে পরতে রয়েছে নির্মম রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়। এর তদন্ত নিশ্চয় চাই। কিন্তু এটাও জানি যদি তদন্ত কিছুটা হয়ও তার মূল কাজ হবে ব্যবস্থার বদলে ব্যক্তিকে দায়ী করা। দুর্নীতি উচ্ছেদের একটাই উপায়— জনগণের হাতে ক্ষমতা। আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার বদল।