Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

যশোধরা রায়চৌধুরী

কবিতা-পদ্ধতি

 

এ একটা পদ্ধতি বটে। নিজেই নিজেকে করে। এ একটা সাক্ষাৎকার বটে।
এ এক জঙ্গল বটে। ঢুকলে হারিয়ে যাবে, কিন্তু সে জঙ্গল
তোমাকে গিলেও ফের ফেরত পাঠাবে উপকূলে…
উপকূল নয় বাবা, এ হল গাছের বৃত্তে ঘেরা সেই উপদ্রুত স্থল…
জঙ্গলের মাঝামাঝি ফাঁকা জায়গাই। এনে, ছেড়ে দেবে ঠিক।

এ এক খতরনাক ঢেউ বটে! নিজেই নিজেকে নিয়ে খেলে।
এবং তুমিও সেই উপকূল থেকে ভেসে, ফিরে আস ফের তীরদেশে…
পাগল ও শিশু ঢেউ, সমুদ্রের ঢেউ কোন দেহ ধরে রাখে না কখনো
ফেরত পাঠায় ঠিক চেটেপুটে খেয়ে নিয়ে প্রাণ।

এ এক আশ্চর্য বটে! কীরকম শাবক, প্রাচীন
মুণ্ডহীন ধড় যেন নিজের মতন নড়ে, চড়ে–
হস্তপদহীন ধড়, গড়ায় গড়ায়
গায়ের চামড়া নেই, গোলাপি পিণ্ডটি
কুৎসিত, জঘন্য, কিন্তু অসম্ভব মায়াভরে তুমি তাকে দেখ
হামাগুড়ি দিতে দিতে সে তোমার ঘরে ঢুকে পড়ে।

অথবা নিজেই মুণ্ড, দেহহীন, তাকে
নিজেরই, নিজেরই তুমি দেহটি, বাড়িয়ে দিতে এলে
কাগজ কলম এনে, হাত এনে, আঙুলসমূহ
নিবেদন করে দিলে, সে শুধু লেখাটি
নিজের, লিখিয়ে নেবে, অদ্ভুত, প্রকাণ্ড এক মাথা…

তোমাকে সে নিয়ন্ত্রণ করে নিল, আজ এই মুহূর্তেই, বেঁধে নিল গাথা
বহু বহু যুগান্তের। এক দিন, আরো এক দিন
সে তোমার কাছে চাইবে, নিজ মুণ্ড বাঁধা রাখবার মুচলেকা।

নিজের মস্তিষ্ক তুমি ছেড়ে দাও কবিতার কাছে। ও যে রাজসিক, একা!

এ বড় চঞ্চল বিন্দু, স্বতঃসঞ্চরমান, এ বড় জোনাকি, আহা গাছ থেকে গাছে
চলে যায়। মুক্তি দেয়, বাঁধে।
এ বড় অস্থির কিন্তু দুঃখদায়ী সুখ, কিন্তু একইসঙ্গে বড় অচঞ্চল
যেমন চাঁদের বৃত্তে আলো থাকে বিপুল, প্রাঞ্জল।
পূর্ণচাঁদ সুতরাং কবিতা জাগায় ভাল, একা একা অনন্ত কুয়োয়
যখন প্রচ্ছায়া পড়ে, ওটাই কাগজ আর ওটাই তো কবিতার খাতা!

এখন ফিরায়ে লও। হে বিস্ময়! হে বিস্ময়, আর তো পারছি না আমি,
ক্ষমা কর, দাতা…
তোমার কবিতাঘরে স্বপ্নের ভেতরে আমি ঢুকি আর বেরোতে পারি না
তোমার ঘরের কত দরজা আছে, ভুলে ভটকে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে
চলে যাওয়া যায় কিন্তু ফেরা যায় না, যারা ফিরতে পারে
তারা ভিতু, তারা নিজেদের ভাল হারাতে পারে না…
হারিয়ে যাবার খেলা যারা খেলল তারা সব উঁচু উঁচু বালক, গরিমা
তাদেরই কবির মত। অবক্ষয়ী, স্থিতিহীন, অবলুপ্ত কথার সাধক।
আগুনের কুণ্ডে গিয়ে তারা সব বিলীন হয়েছে, নিজ অন্তিম স্তাবক
খুঁজে পেতে তাদের কি একদিন খুলে গেছে তৃতীয় নয়ন…?

আমরা যখন যাই, আমরা যাই… আমাদেরও দেন তিনি,
প্রবেশের অধিকার… ক্ষণ।
তারপর ধরে রাখা, তারপর আত্মবিস্মৃতি
সে খেলায় অন্ধকার, সে খেলায় পরম নিভৃতি।
এটুকুই যদি পাও, মনে রাখো, তাবিজ-কবচ করে ধরে রাখা যাবে…
ফিরে এসে আবার তো মাছিমারা কেরানিরা আপিসের ড্রয়ারে ঢোকাবে
পাতলা রসিদবই, গোলাপি, তুচ্ছতা।
কবিতা এভাবে হবে আমাদের চির নীরবতা।


গমন তখনি হবে যখন সে পা দুটি হারাবে
মুক্তি তখনি পাই যখন প্রকৃত বন্দিদশা
আলো আসে সেইমাত্র যেইদিন সূর্য হারালো
সুর আসে কোথা থেকে এত বিষ, এত ঝালাপালা
সব নিয়ে যে মুহূর্তে আমি আছি আমার বিবশে
যখন বিষাদ এল, গড়িয়ে পড়ল শুধু কশে…
নিরামিষ কান্না থেকে, মুখ গুঁজড়ে পড়ে থাকা থেকে
যেইমাত্র আলম্বন পেয়ে যাব, সেইমাত্র রোষে
আমিষ হয়েছে সব… বিরাট করেই দেখি রূপ…
এ আমার প্রাণবস্তু। এ আমার অতি অন্ধ কূপ।