‘ট্র্যাপিজ’ : ফিরে দেখা

সর্বজিৎ সরকার

 

যুক্তি হল এমন একটা দরজা যেটা মানুষ তার নিজের প্রয়োজনে খোলে অথবা বন্ধ রাখে। প্রয়োজনটা সামাজিক হতে পারে, জৈবিক হতে পারে, অথবা ব্যক্তিগত হতে পারে। সমস্যাটা তখন হয় যখন যুক্তির এই দরজাটাই আর কাজ করে না। আর তখন আবেগের একটা প্রবল ঢেউ অন্য আর একটা প্রবল ঢেউকে টেনে নিয়ে আসে। প্রথম ঢেউটার মতোই এই দ্বিতীয় ঢেউও একইভাবে যুক্তিহীন, অনিকেত, আর বিধ্বংসী।

ঠিক এই ঘটনাটাই ঘটতে দেখি শমীক ঘোষ পরিচালিত শর্ট ফিল্ম, ‘ট্রাপিজ’-এ। ছবির মূল চরিত্র এক যুবক, নিম্নমধ্যবিত্ত, একটা পুরনো বাড়িতে মা’র সাথে থাকে। ছবির শুরুতেই তাকে দেখি ঘর বন্ধ করে সে কমপিউটার গেম খেলছে। গেম-এর মধ্যে শত্রু নিধনে তার মেশিনগান এই মুহূর্তে ভয়ঙ্কর ব্যস্ত। তার মা তাকে ডাকলে সে অত্যন্ত বিরক্ত হয়। আর এই সময়েই তার এক বন্ধু ফোন করে তাকে জানায়, টিভির সংবাদে দেখাচ্ছে যে পুলিশ তাকে একটি মার্ডার কেসে খুঁজছে। খুনী সে নিজে। সে তার প্রেমিকাকে খুন করেছে। যুবকটি অস্বীকার করে। পালায়। সে নিজে জানে সে খুন করেনি। আমরা জানি না। মিডিয়া জানে না। রাষ্ট্র জানে না। সে শুধু পালায়। আর ঠিক এই সময়ে তার দেখা হয়ে যায় ক্লাউনের সাথে। ক্লাউন তাকে অভিযুক্ত করে। ক্লাউন সব জানে। সেই খুনী। যুবককে তাড়া করে ফেরে তার নিহত প্রেমিকার শরীর। তার মনে পড়ে যেদিন সে প্রেমিকাকে আঘাত করেছিল। তাকে বলেছিল এই সম্পর্ক সে আর রাখতে চায় না, সেই মুহূর্তটার কথা। কোনও কারণ ছিল না এই বিচ্ছেদের। থাকলেও সেটা স্পষ্ট নয় কারও কাছে। মেয়েটি চেয়েছিল আঁকড়ে থাকতে। সে যেন ছেড়ে না যায়। ছেলেটি শোনেনি। আর আজ সে পলাতক। পালাচ্ছে। কোথায়, সে জানে না।

থ্রিলারের শর্ত মেনে তৈরি হলেও শমীকের এই ছবি আসলে এক দার্শনিক প্রশ্ন তুলতে চায়। এবং যে দর্শন আজকের সামাজিক রাজনৈতিক প্রেক্ষিতকেই চ্যালেঞ্জ জানায়। ছবির শুরুতে আর মাঝে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের কথা নিয়ে আসাতে ছবির প্রচ্ছন্ন এই ভাবনাটা আরও অন্য মাত্রা পায়। প্রশ্নটা এই, যে আমাদের বাইরের বাস্তবের এই হিংস্রতা যার কোনও কার্যকারণ, অর্থ, উদ্দেশ্য, কোনওটাই আমরা খুঁজে পাই না, সেটা কি একসময়ে ব্যক্তির ভেতরের হিংস্রতাকেও প্ররোচিত করে? আমাদের অন্তর্গত যে বাস্তবতা যা ক্রমশই নিঃসঙ্গতার দিকে আমাদের ঠেলে দিচ্ছে, সেও কি একটা সময়ে সমানভাবেই কারণহীন, অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন হয়ে ওঠে? আর এতটাই প্রবল, তীব্র, ও বিধ্বংসী হয়ে ওঠে যে, ভালোবেসে যে অন্য মানুষটি আমার কাছে আশ্রয় চাইছে, তাকেও হত্যা করতে আমার হাত কাঁপে না?

ট্রাপিজ-এ শমীক কোথাও স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন না ছেলেটি আসলে খুন করেছিল কি না। বরং সচেতনভাবেই আমাদের সংশয়ে রাখেন। ছবিতে প্রচুর ক্লোজ আপ এবং পরিকল্পিতভাবে ধারাবাহিক সময়কে ভেঙে দিয়ে ফ্ল্যাশ ব্যাক এবং জাম্প কাট করে ছবিকে গতিময় করে তুলেছেন। শমীকের প্রথম ছবি হিসেবে আমার কাছে সেটা প্রশংসনীয় বলেই মনে হয়েছে।

ভার্চুয়াল বাস্তব আর যেটা প্রাত্যহিকের বাস্তবতা সে দুটোর মাঝের ব্যাবধানটা ক্রমশই কেমন অস্পষ্ট হয়ে আসছে। কম্পিউটার গেমস আর বাইরের পৃথিবীর সন্ত্রাস কোথায় গিয়ে যেন একাকার হয়ে যায়। বেসিনে দাড়ি কামাতে কামাতে ছেলেটি দেখে বেসিনের নালী থেকে রক্তের ঢেউ উঠে আসছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে হেলিকপটারের পাখার আওয়াজ শোনা যায়। যেন অন্তহীন ভায়োলেন্স, অর্থহীন এক আক্রমণ চুপিসাড়ে এগিয়ে আসছে আমাদের দৈনন্দিনের দিকে। আমরা ভয় পাচ্ছি। আর্তনাদ করছি। নিজেদের শ্বাস রুদ্ধ করে সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে চাইছি। তারপর এক সময়ে পালটা আঘাত করছি। কিন্তু সে আঘাত আর্ত। দিশেহারা। অন্ধের মতো। সেই প্রত্যাঘাতে আমাদেরই, ভাই বোন বন্ধু পরিজন, নিহত, পড়ে আছে।

শমীক নিজে একজন লেখক। তার গদ্যের অন্তর্লীন যে চলন, যেভাবে তিনি সময়ের ভিন্ন ছবিগুলোকে এক স্পেসের মধ্যে নিয়ে এসে জীবনের ধারাবাহিকতার একটা অন্য মাত্রা খুঁজতে চান, সেই সবই ছবিতে তিনি আনার চেষ্টা করেছেন। কিছু ক্ষেত্রে তা অবশ্যই সার্থক।

শেষ করার আগে এ ছবির সুরকার আর সম্পাদককে অভিনন্দন জানাতে হয় যে এই কঠিন ন্যারেটিভের ছবিটিকে তারা এক অন্য স্তরে নিয়ে গেছেন।

 

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4418 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...