ডোপামিন-বিষয়ক

ডোপামিন

সব্যসাচী দাস

 

‘আমার মনে হয় আমরা এমন এক যন্ত্র বানিয়েছি যা সমাজের ধারক বনিয়াদটাকেই ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। তাৎক্ষণিক, ডোপামিন-চালিত ফিডব্যাক লুপই হল সেই বিধ্বংসী যন্ত্র।’

গত নভেম্বরে বলেছিলেন চামাথ পালিহাপিটিয়া। ফেসবুকের ইউজার গ্রোথের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট।

এও বলেছিলেন:

‘আপনি বুঝতেও পারছেন না যে, আপনি প্রোগ্রামড হচ্ছেন।’ [ভিডিও নিচে]

এ আর নতুন কথা কী! দেখতেই তো পাচ্ছি কত! তরতাজা নতুন লেখক। সরেস গদ্যের হাত। গড়ে দিনে দুটো করে স্ট্যাটাস। আট থেকে আশি লাইন। রম্যস্ট্যাটাস। লাইক, লাভ, ওয়াও। অগণিত ভক্তকুল। সে এখন বড় বড় প্রবন্ধ লিখবে ভাবে। কোয়ান্টাম থিওরি থেকে মধ্যপ্রাচ্য অব্ধি। ভেবে আবার স্ট্যাটাস। এবং শেষমেশ প্রবন্ধটা আর লেখা হয় না, কেবলই স্ট্যাটাস!

যা হোক। মরিবে আপন দোষে, কি, পরের ছেলে পরমানন্দ। এ লেখার প্রতিপাদ্য তিনি বা তাঁরা নন।

এই তো খুব তুলকালাম হল। ফেসবুক থেকে ডেটা বে-আইনিভাবে হাতিয়েছে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা বলে লন্ডনের একটা পলিটিক্যাল কনসালটেন্সি ফার্ম। যে ডেটা ব্যবহার করা হয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ট্রাম্পের ইলেকশন ক্যাম্পেনে। শুধু সেখানেই নয়, ব্রেক্সিট ক্যাম্পেনেও। বিজেপি সাথে সাথে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তোপ দাগল, কংগ্রেস এদের মক্কেল বলে।

হায়… বিজেপি! আইটি সেল শব্দবন্ধটাকে ভারতীয় রাজনীতিতে যারা পাকা আসন বানিয়ে দিয়েছে!

এখানেও তো! কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার ভারতীয় অ্যাফিলিয়েটের সাইট ওভলেনো বিজনেস ইন্টেলিজেন্স তাদের মক্কেল হিসেবে বলছে বিজেপি, কংগ্রেস এবং সংযুক্ত জনতা দলকে।

একে বলে, বিজেপির বড় গলা।

চামাথ বলেছেন, ‘ইউ ডোন্ট রিয়েলাইজ ইট, বাট ইউ আর বিইং প্রোগ্রামড।’

মার্কিন বা ভারতীয়, যে ভোটারই হও!

শুরুতে শিবের গীত গাইনি তাহলে পুরোপুরি। জোর নারদের গীত বলা যেতে পারে।

তা এও আশ্চর্যের কী! আমাদের দেশে সরকারের হাত থেকে আধার তথ্য লিক হয়ে যাচ্ছে, সরকার বাহাদুর বাধ্য করছেন ব্যাঙ্ক, মোবাইল অপারেটরদের মতো সমস্ত বহুজাতিক দানবদের হাতে নাগরিকদের সমস্ত ডেটাবেস তুলে দিতে! সেখানে ফেসবুক তো নিতান্তই এক দূরের গ্রহ, অতএব দায়হীন!

সেদিন এক বন্ধু বলছিল, মুখ সবারই হরেদরে এক। তফাত ভয়ঙ্করতার মাত্রায় — রূপে। সিপিএমেরও মরিচঝাঁপি, নন্দীগ্রাম, নেতাই আছে; সেজ নিয়ে হাঁকপাঁক আছে; জিএসটি খসড়ায় সমর্থন সাক্ষর আছে। কংগ্রেস তো ছেড়েই দিলাম। আমরাও মোটামুটি ধরেই বা মেনেই নিয়েছি শাসকের মুখ কমবেশি রাক্ষুসে হবেই, ও নিয়েই চলতে হবে ডেঙ্গু ফেঙ্গুর মতো। তাই আমরা মাথা ঘামাই মুখোশ নিয়ে। খেয়াল করার চেষ্টা করি কোন মুখোশটা একটু বেশি মানুষ মানুষ। সমস্যা হল, বিজেপির মুখোশটাও দানবের — সাম্প্রদায়িকতার! এ আর রূপে নয়, একদম গুণে তফাত হয়ে গেছে।

যথার্থ। এই কারণেই বিজেপি দেশের সামনে প্রধান বিপদ।

সাথে আরেকটু জুড়তে হবে। সেই মার্কসবাদীরা যেমন বলে থাকেন, অর্থনীতি ভিত আর রাজনীতি সংস্কৃতি উপরিকাঠামো হলেও রাজনীতি সংস্কৃতির ক্ষমতা আছে অর্থনৈতিক ভিতের ওপর প্রভাব বিস্তার করার, তেমনই এই মুখোশের ক্ষমতা আছে মুখের ওপর কিঞ্চিৎ প্রভাব বিস্তার করার।

মানে কারও যদি মার্কসবাদের মুখোশ থাকে, সে শ্রমিক কৃষকের ওপর হামলা একটু রেখেঢেকে করতে চাইবে, অগোচরে করতে চাইবে। কেউ আম আদমি বা রোটি কাপড়া মকানের বুকনি ঝাড়লে সেই বুকনির গরজেই তাকে সেইমুখী কিছু বালাইমার্কা পদক্ষেপ নিতে হবে। এই আর কী!

সাম্প্রদায়িকতাকে বিজেপির মুখোশ বলায় কেউ কি ভুরু কুঁচকোলেন? কুঁচকোবেন না। কারণ এটাই সত্যি!

অযোধ্যায় রামমন্দির হল কিনা সে নিয়ে সত্যি মনে করেন মোদী-অমিত শাহদের কিছু যায় আসে? আদৌ কিছু যায় আসে দাঙ্গা বাধলে যেসব হিন্দুর সর্বনাশ হয় তাদের নিয়ে? বাংলাদেশ পাকিস্তান কি আরব দুনিয়ায় মুসলিম মৌলবাদীরা যদি হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালায় তাতে বিজেপি নেতারা ব্যথিত হয়, না আহ্লাদিত?

সাম্প্রদায়িকতার বিষ জনগণকে দেয় বিজেপির ডোপামিন। ওদের প্রতিটা নির্বাচনী প্রচার, রণকৌশল খেয়াল করুন… বুঝে যাবেন। আর আজ এই উত্তর-সত্য যুগে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার লুপে তালগোল পাকিয়ে মণ্ড বনে ঘুরতে থাকা আমরা সেই ডোপামিনের তাড়নায় একটা বাদুড়িয়া, একটা মজফফরনগর ঘটিয়ে ফেলি!

আপনি জানতেও পারছেন না, আপনি প্রোগ্রামড হচ্ছেন!

সেদিন হোয়াটস অ্যাপে একটা লেখা পেলাম, বিজেপির এই অনলাইন প্রোপাগান্ডার যে সব মাধ্যমগুলি রয়েছে তাদের তথ্য সমেত। এখানে জানিয়ে দেওয়া যাক সেগুলি:

TheBharat365; Kechha, the Knowledge Centre; Bengal Times (এই নামে দুটো পোর্টাল আছে, বিজেপির ফেক নিউজের অ্যাড্রেস Bengal.site); suprovaat; priyobandhu — এইগুলি পুরোপুরি ফেক নিউজের পোর্টাল বা সাইট।

biswabanglasangbad; supravat; amaderbharat; channel Hindustan; najarbandi; eenaduindiabanglla; kolkata24*7 — এগুলি আধা ফেক। অর্থাৎ সত্যি খবরের সঙ্গে মিশিয়ে হালকা করে মিথ্যে খবর দিয়ে দেওয়া হয়। সত্যের ছদ্মবেশে থাকে বলে এরা বেশি বিপজ্জনক।

ফেসবুক এবং টুইটারে ফেক প্রোফাইল। এগুলি দুই কিসিমের। হিন্দু নামের এবং মুসলিম নামের। ব্যাখ্যা অপ্রয়োজনীয়।

ফেসবুকের বিভিন্ন ধার্মিক এবং মিম পেজ।

কাজের ধরনও মোটামুটি চেনা। বিভিন্ন মিথ্যে খবর — যেমন দুবছর আগের পাকিস্তানের কোনও ঘটনাকে আজ বারাসাতে হয়েছে বলে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া, বাংলাদেশের মৌলবাদীদের বিভিন্ন ভিডিও বা জলসার ভিডিও ছড়িয়ে হিন্দুদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ানো — এই সব। ছড়াবে ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস অ্যাপে। ডোপামিন।

শেষ কথা, মানে ওই মুখশুদ্ধির মতো, ইউবিআই নতুন লোন আর দেবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা নাকি পুরনো লোন আদায়ে এখন সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। বাকি সরকারি ব্যাঙ্কগুলিও নিশ্চয়ই বলবে কিছুদিনের মধ্যে। বা বলছেও হয়তো। এগুলো নীরবে ঘটে। আর, কদিন আগেই সংসদে মাত্র ৩০ মিনিটে ২১৮টি সংশোধনী সহ ৯৯টি সরকারি দপ্তরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফাইনান্স বিল পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে সাংসদদের মাসোহারা ১০০ শতাংশ বৃদ্ধির সাথে সাথে বৈধ করে দেওয়া হয়েছে ১৯৭৬-এর আগস্ট থেকে ভারতবর্ষের যেকোনও রাজনৈতিক দলের পার্টি তহবিলে বিদেশি কর্পোরেটদের দেওয়া ডোনেশনকে।

এবার জল, পেট ভরে —

পাশ হয়ে গেছে এবারের বাজেটে উল্লিখিত বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে ব্যাপক বরাদ্দ ছাঁটাইয়ের প্রস্তাবও।

ইউ ডোন্ট রিয়েলাইজ ইট, বাট ইউ আর বিইং প্রোগ্রামড…

প্রাসঙ্গিক লিংক:

  1. https://www.ndtv.com/india-news/cambridge-analytica-data-scandal-latest-reachtions-from-bjp-congress-1827208
  2. https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=507253656335337&id=100011521204439
  3. http://www.business-standard.com/article/economy-policy/in-30-minutes-lok-sabha-clears-finance-bill-218-amendments-without-debate-118031500115_1.html
Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4411 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

আপনার মতামত...