Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আলেহান্দ্রা পিসারনিক (Alejandra Pizarnik)-এর কয়েকটি কবিতা

অনুপ সেনগুপ্ত

 

আর্জেন্টিনার কবি আলেহান্দ্রা পিসারনিকের কবিতা এমন এক কাব্যিক পরিসর যেখানে আতঙ্ক ও স্বস্তির আলো-আঁধারি, আত্ম-অবস্থানের উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি লীলারত, যেখানে সৃষ্টি ও ধ্বংস যুগপৎ ঘটে কিংবা আপোক্যালিপ্সই হয়ে ওঠে জেনেসিস। বিষণ্নতার গোলকধাঁধায় বাঙ্ময় যাত্রাতেই পিসারনিক অন্তর্গত ক্ষতের নিরাময় খোঁজেন। তাঁর বাকস্ফটিক এক অনতিক্রম্য স্বচ্ছতা। নিঃসঙ্গতা, শৈশব, উন্মাদনা, মৃত্যু আর লাইলাক ফুলের ভাবপ্রতিমা ফিরে ফিরে আসে তাঁর কবিতায়। এইসব কবিতার ত্বক জুড়ে অনুপস্থিতির উল্কি। নীরবতা সেখানে আগুনের শিখার মতোই জ্বলতে থাকে। তাঁর কাছে ‘শব্দ/ ভালবাসা সৃষ্টি করে না/ সৃষ্টি করে অনুপস্থিতি/ যদি বলি জল, আমি কি পান করতে পারি?/ যদি বলি রুটি, আমি কি খেতে পারি?’ তাঁর কবিতা পড়ে হুলিও কোর্তাসার একটি চিঠিতে পিসারনিককে লিখেছিলেন— ‘It’s utterly your own; you’re so you in every line, so reticently clear. You are underneath it and inside of it.’ প্রকৃতপ্রস্তাবে আধ্যাত্মিকতার নিরাকরণে পিসারনিকের কবিতা একপ্রকার প্রতি-আধ্যাত্মিকতা। মাত্র ছত্রিশ বছরের জীবন। ১৯৩৬-এ আর্জেন্টিনার বুয়েনোস আইরেসে এক অভিবাসী রাশিয়ান-ইহুদি পরিবারে আলেহান্দ্রা পিসারনিকের জন্ম। মাতৃভাষা ইদ্দিশে নয়, স্প্যানিশেই লিখতেন কবিতা ও গদ্য। একটি কবিতার বই লিখেছিলেন আবার ফরাসিতে। ১৯৭২-এ ঘুমের ওষুধের ওভারডোজ়ে তাঁর মৃত্যু সম্ভবত আত্মহত্যা। পিসারনিকের লেখালেখির ঘরে একটা ব্ল্যাকবোর্ডে চক-খড়িতে তাঁর শেষ লেখা দেখতে পাওয়া গেছিল:

প্রার্থনায় শিশু
কুয়াশার প্রতি ক্রোধ

ঊষায়
লিখিত

আঁধারের
বিরুদ্ধে

আমি কোথাও যেতে চাই না
যদি-না গভীরে নামতে পারি

হে জীবন
হে ভাষা
হে ইসিদোর

 

কবিতাক্রম-৬

নিজের স্মৃতির স্বর্গোদ্যানে
নগ্ন হয় মেয়েটি
অন্তর্দৃষ্টির নিষ্ঠুর নিয়তি
সে জানে না
তার ভয়— কীভাবে দিতে হয় নাম
যার কোনও অস্তিত্বই নেই

(‘ডায়নার বৃক্ষ’/‘ÀRBOL DE DIANA’ কাব্যগ্রন্থ থেকে)

 

অন্য প্রান্ত থেকে

বালিঘড়ির বালির মতোই সঙ্গীত ঝরে পড়ে সঙ্গীতে, নেকড়ের তীক্ষ্ণ দাঁতের রাত্রির মতোই আমার দুঃখ

সঙ্গীত ঝরে পড়ে সঙ্গীতে যেভাবে আমার কথা ঝরে পড়ে কথায়

(‘এক সাঙ্গীতিক নরক’/‘EL INFIERNO MUSICAL’ কাব্যগ্রন্থ থেকে)

 

কোল্ড ইন হ্যান্ড ব্লুজ়

আর তুমি কী বলবে
আমি ঠিক কিছু একটা বলব
আর তুমি কী করবে
আমি ভাষার মধ্যে লুকোতে যাচ্ছি
কারণ
আমি আতঙ্কিত

(‘এক সাঙ্গীতিক নরক’/‘EL INFIERNO MUSICAL’ কাব্যগ্রন্থ থেকে)

 

কবিতাক্রম-৩

কোনও কবিতার
কেন্দ্র মাত্রই

অন্য কবিতা

কেন্দ্রর কেন্দ্র

এক অনুপস্থিতি

অনুপস্থিতির কেন্দ্রে
আমার ছায়া হল
কবিতার কেন্দ্রর কেন্দ্র

(‘ছোট ক্যান্টোস’/‘LOS PEQUEÑOS CANTOS’ কাব্যগ্রন্থ থেকে)

 

বিস্মৃতি

রাত্রির অন্য কিনারে
সম্ভব হয় প্রেম

আমাকে নিয়ে যাও সেখানে—

আমাকে নিয়ে যাও সেই মিষ্টি নির্যাসে
প্রতিদিন যা শুকিয়ে যায় তোমার স্মৃতিতে

(‘কর্ম ও রাত্রি’/‘LOS TRABAZOS Y LAS NOCHES’ কাব্যগ্রন্থ থেকে)

 

এক প্রাচীন শরতে

উৎসর্গ: মারি-জেন নোয়াহু

ওই নামকে কী নামে ডাকতে হয়?

কফিনের মতো এক রং, এক স্বচ্ছতা যা তুমি কখনও পেরোতে পারবে না

কীভাবে সম্ভব এতটা না-জানা?

(‘উন্মত্ততার পাথর উৎপাটন’/‘EXTRACCIÓN DE LA PIEDRA DE LOCURA’ কাব্যগ্রন্থ থেকে)

 

নিগূঢ় যা কিছু

যেহেতু শব্দ যথেষ্ট নয়, অন্তর্বর্তী কিছু মৃত্যু অনিবার্য

সঙ্গীতের মতো ভাষার আলো আমায় আবৃত করে, যেভাবে শোক-সারমেয় কামড়ে ধরে ভাবচ্ছবি। আর কোনও দেওয়ালের প্রেমিকের মতো শীতকাল আমাকে ধরে লতিয়ে ওপরে ওঠে

আশা করার আশাও যখন ছেড়ে দিই, আমার অন্তরে তোমার পতন শুরু হয়। আমি এখন এই অন্তর বই কিছু নই

(‘এক সাঙ্গীতিক নরক’/‘EL INFIERNO MUSICAL’ কাব্যগ্রন্থ থেকে)

 

টীকা: ১৯২৫-এ জ্যাক গি এবং ফ্রেড লংশর লেখা Cold in Hand Blues গানটি গেয়েছিলেন বেসি স্মিথ, সঙ্গে লংশর পিয়ানো এবং লুই আর্মস্ট্রং-এর কর্নেট। এই গানের টাইটেলটাই পিসারনিক কবিতার শিরোনাম করেছেন।